করোনা আর আমফানকে দুই কাঁধে নিয়ে ঈদ হাজির দোরগোড়ায়।
কাঁধ বলতেই মনে হয় মুনকির আর নকিরের কথা। আমি এত জানতুম না মেয়েবেলায়, 'সোজা পথে চলো রে ভাই ইমান থাকো ধরে' গান শেখানোর সময় স্যার বলেছিলেন দুই কাঁধে নাকি দুই ফেরেস্তা থাকে মানুষের; একজন ভাল কাজের লিস্টি বানায় আর আরেকজন খারাপ। রোজকেয়ামতের দিন এই গন্ডায় গন্ডায় লোকের আমৃত্যু এত কাজের ফিরিস্তি মেন্টেন করে হিসেব করা তো ভারি মুশকিল তাই এই ফরিশতাদের লিস্টি জনে জনে মিলিয়ে নিলেই কাম খতম!
আমফান আর করোনায় যদিও ভালর ব্যাপার নেই, ফরিশতার টরিশতা মেটাফোরও হ্যালিলুইয়া, তবু 'দোসর' হয়ে জুটেছে যখন, খানিক ট্রিবিউট করলাম আর কি জাজমেন্ট ডের নামে নচেৎ যা দিনকাল এই লিখতে লিখতেই কিছু না কিছুর ঠ্যালায় সটান টপকে গেলাম হলিউডি কায়দায়, অতএব.....।
এক বছর আগে এই ঈদ বাহানায়, ঘরে খাবার দাবারের মিনি হোটেল খুলে ফেলেছিলাম প্রায়; পেটের ভেতর সদা ফুটবল খেলে চলা ম্যাডাম আর আমি, হসপিটালে যাবার আগে (বেঁচে বর্তে ফিরব কিনা গ্যারান্টি নেই ভেবে আগাম দায়িত্ব নিয়ে ফেলেছিলাম, যাগ্গে) গুছিয়ে আঙুল চেটে খাব বলে, কুনাফা-সেমাই-ডিমের হালুয়া-লাচ্ছা। জানতাম যে বেটার ফিউচার-বাসযোগ্য পৃথিবী ইত্যাদি প্রভৃতি গালভরা আঁতেল কাব্যিক বিশেষণের নখ না পোঁছার দুনিয়া, ওদের জন্য অপেক্ষায় তবে বছর নিজে জামা দুলিয়ে ঘুরতে না ঘুরতেই যে বেচারিদের জীবন যাপন নিয়েই টানাটানি হবে সেসব আঁচ করার মতন প্রফেটিক হয়ে উঠতে পারিনি। পুরাই ফাউল কেস।
ডারউইন দাদুর মুখে মাস্ক পরিয়ে বিবর্তন, ধরাধামের নাটুকে স্টেজে হাজির; বোধ করি 'ভাইরাসটা যেহেতু যাচ্ছে না' সহজে, তাই এ প্রজন্মের ছোটবেলা ঘেঁটে ঘ। ম্যাডাম পেট টেট ফুঁড়ে দুনিয়ায় উঁকি মারলে, একসাথে বসে লাচ্ছা খেতে খেতে প্রথমবার আর কী কী করবো যাবতীয় প্ল্যানিং এর তাই অর্ধেকের বেশিই মুলতুবি এখন।
বলাই বাহুল্য, এসবই, প্রিভিলেজড শ্রেণীর জনগণ হওয়ার সুবাদে শখের মনখারাপ। ঝড়ে সর্বস্ব হারানো-চাল খোয়ানো হাজার হাজার মানুষ, আগামীতে দিন গুজরানের চিন্তায় নাজেহাল, বেসামাল। সেসব হাহাকার ছাপিয়ে ন্যাকা কুম্ভীরাশ্রু বিলাপসর্বস্ব ঠান্ডা ঘরে বসে স্ট্যাটাস হাঁকানো 'তোমাদের পাশে আছি' বিপ্লবের 'সময় খারাপ তবু ঈদ মুবারক' এর মুখে পেচ্ছাপ করা উচিৎ। দিনের শেষে যেহেতু স্বার্থপর কীট, অতএব এতকিছু সত্বেও আমাদের অতি বিলাসিতাযাপনে খানিক কাটা পড়া অসমীচিন কিন্তু মনুষ্যত্বের গোড়ায় ধুনো জ্বালা?! নৈব নৈব চ।
রোজা ব্যাপারটা এককালে বেশ উৎসাহ-উৎসব ছিল। এই যে বড়রা এতক্ষণ না খেয়ে থাকছে, আমি কেন পারব না কিংবা যতই সেহেরি-ইফতার জুটুক, সে তো সব খাবার পরে উপরি, বড়দের মতন তো শুধুই ওটা খাচ্ছি ; তেমন তো না'র সাথে মাথা উঁচিয়ে বড় সাজার আপ্রাণ চেষ্টা থেকে রোজা রাখা শুরু পুঁচকেবেলায়। তাপ্পর এযাবৎকালবাবদ একবারও তিরিশ তো দূর অস্ত, বিশের ঘরেই পৌঁছায়নি উপোসের দিন।
সত্যি বলতে, তিরিশদিন এমন না খেয়ে থাকলে নাকি গরীবের পেটের জ্বালার খানিক বোঝা যায়- এই যুক্তিখানার বাড়বাড়ন্ত, হালে, বেশ মনোরঞ্জনকারী। গুছিয়ে পরের ভোরের সেহেরির উপকরণের তোড়জোড় আর বিকেল থেকেই হরেক কিসিমের ফল-বাহারি নাস্তা সাজানো উপোসী বাড়ির মহিলাদের, ফুরসৎ নেই আপিস থেকে খানিক আগে ফিরে নামাজ-কোরান পাঠের পর আরামসে মিনিট তিরিশেক, আপনার মতন, গা এলিয়ে নেওয়ার। মশাই, বলুন তো, কোন গরীব মানুষ এমন বিলাসিতায় না খেয়ে থাকে?! দিনের শেষে খাবার জুটবে কিনা ভয়ে আতঙ্কে একশা হয় যারা, এই যে লাখ লাখ লোক লকডাউনের গোড়া থেকে হাঁটছে শুধু বাড়ি ফিরে সামান্য হলেও রেশনের চাল-ডাল জোটার আশায় কিংবা ঝড়ে এক বুক জল ঠেলে ঘরের শেষ কুটোটির দিকে অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকা কোন মানুষটা সন্ধেয় খেজুর-আপেল-আম-কলা-হালিম-টিকিয়া দিয়ে পেটের জোগান দেয়?! সুতরাং বাহাত্তর হুরের স্বপ্নে মশগুল আল্লাহর সুযোগ্য মুমিনগণ, বেহেস্তে যাওয়ার জন্য এসব যুক্তি হাজির করলে তার সাথে সাযুজ্য বজায় রেখে জীবন যাপন করুন। হজরত মোহাম্মদ সামান্য খেজুর-পানি দিয়েই রোজা ভাঙতেন, আপনাদের মতন মাংসের পিঠে বা ডালের পেঁয়াজু দিয়ে নয়।
ঠিক একই ভাবে, হজরত মোহাম্মদ ঈদের দিন 'পরিষ্কার জামা' পরতে বলেছিলেন, নতুন জামা নয়। যেভাবে নতুন জামা পরার হিড়িকে শপিংয়ে পেছন ভাসিয়েছেন তাতে আর কিছু না হোক, নিজেদের কাফনও আগাম কিনে নিতে পারতেন, তাতে চাট্টি নতুন শেখা আরবি ভাষা গুঁজে খিচুড়ি বাংলায় লেকচার মেরে- 'নবী'র নাম ব্যবহার করে, গরুর লেজ ধরে স্বর্গে যাবার অছিলায় অন্যের মাথা খাওয়ার অত্যাচার খানিক কমতো আর কি।
এতকিছুর পরও কিছু নমুনা, জমায়েতে ঈদের নামাজ পড়তে যাবে জানি, কারণ সেই মহামারী শুরু থেকেই অসভ্য আপনারা 'আল্লাহর গজব কাফেরদের ওপরই বর্ষিত হয়' বলে কনাঘুষোয় বলে বেড়ান, তার দায় একটা গোটা সম্প্রদায়কে বয়ে বেড়াতে হয় দিনের পর দিন। আর হ্যাঁ, ন্যাকামি করে এগুলো 'শিক্ষার আলো ঢোকেনি যাদের মধ্যে'র ট্যাবু লাগিয়ে গা বাঁচাবেন না। আপনাদের মতন 'শিক্ষিত' লোক শিক্ষাকে শুধু রোজগারের মই হিসেবেই দেখে এসেছেন বলেই নিজেদের ব্যবহৃত হবার দায় স্বেচ্ছায় আমরা রাজনৈতিক দলের হাতে তুলে দিই বারবার। নচেৎ আপনিও জানেন, আমিও জানি, আমার এইটুকু কথা বলার দায়েই গুচ্ছের জ্ঞানগর্ভ বাণী বিতরণে এখুনি উদয় হবেন ; আদতে একখান বেহিসেবি কথা বলা পাব্লিককেও 'সোজা' করেছেন দেখাতে পারলে আখেরতে মিষ্টি আঙুর-খেজুরের বাগান যে আপনার হাতের মুঠোয়।
এর চেয়ে বরং মেরুদন্ড সোজা করুন, নিজের বোধ-বুদ্ধির ওপর ব্রেন ওয়াশডের লেয়ার সরিয়ে এট্টু আলো ঢালুন, দেখবেন একসাথে সবাই একটা সুস্থ দুনিয়ায় বাঁচতে পারবেন। নিজেদের বাঁচার স্বার্থে, পরবর্তী প্রজন্মকে এতকিছুর সাথে লেজুড় সাম্প্রদায়িকতার বিষের হাত থেকে বাঁচাতে অন্তত স্বার্থপর হন।
উৎসবলগ্নে যতটুকু সম্ভব, আনন্দে-খুশিতে কাটান তবে ক্ষনিকের স্বার্থপরতার কাছে দয়া করে মনুষ্যত্ব বিসর্জন দেবেন না। ভাল হোক সবার। ঈদ মুবারক।
অদ্ভুত ভালো লেখা। মন ভরে গেল রে জারিফা।
ঈদ মোবারক বলবোনা কারণ এখন জান হ্যায় তো জাহাঁ হ্যায় বলার মতো গলা জলে দাঁড়িয়ে আছে মানুষ।
ভিড়ের হৃদয় পরিবর্তন হোক এই যদি দাবি হয় তাহলে খাবি খাওয়া ছাড়া উপায় নাই। এবছর বরং বলি এই অখাদ্য কুখাদ্য ভিড় যেন বেঁচে থাকে।
চালিয়ে যা। বেশ ভালো।
এ সব লেখা পড়ে কিছু ত আর বলার থাকে না।