এন কোভ ১৯ , কোভিড-১৯ , এবং চেনা অচেনা
আমাদের চারদিকে এখন এন কোভ -১৯ নামে এমন একটি ভাইরাস ঘুরে বেড়াচ্ছে, এবং এমন একটি অসুখ কোভিড -১৯, যার গতি প্রকৃতি ও চরিত্র সম্বন্ধে আমরা একেক সময় মনে হয় অনেক কিছুই জানি আবার কখনো মনে হয় যেন কিছুই প্রায় জানি না। যেমন আমরা জানি যে এটি একটি ইনফ্লুয়েঞ্জা ধরণের অসুখ যেখানে সাংঘাতিক রকমের স্বাসকষ্ট হয়, জ্বর হয়, শুকনো কাশি হয়। আমরা মোটামুটি জানি যে বছরের এই সময়টায় নানা রকমের ছোঁয়াচে রোগ হয়, তবে আজকাল বেশির ভাগ কেন, প্রায় সমস্ত সংক্রামক ব্যাধি টিকা দিয়ে প্রতিহত করা যায় , নেহাত তাতেও যদি না উপকার হয়, তো উপযুক্ত ওষুধ পড়লে, কি সার্জেনের ছুরির দাপটে রোগ সারে । আমরা নানা রকম সংক্রামক অসুখের কথাও জানি, তার প্রত্যেকটি কোন না কোন প্রাণী বাহিত, বিচিত্র সব কীটপতঙ্গ, পোকামাকড়, মশা, মাছি, ইঁদুর, হরিণ, কুকুরের/বাদুড়ের/পশুর কামড়, ইনজেকশনের সিরিঞ্জ, মায় জং ধরা পেরেকএ পা ফুটে গেলে কেটে গেলে টিটেনাস, কাজেই আমরা সেসব এড়িয়ে চলতেই অভ্যস্ত, বা নেহাতই না সম্ভব হলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়ে, নাহলে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে বা বাড়িতে চিকিৎসা করলেও চলে । দিনের পর দিন বিজ্ঞানের অগ্রগতির কথা শুনতে শুনতে ও দেখতে দেখতে আমরা ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে যে অসুখই করুক না কেন, একদিন না একদিন ঠিক একটা জবরদস্ত ওষুধ ও ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হবে , সে দিন বেশি দূরে নেই। এবারে যেন সব কিরকম গোলমেলে, এমনকি ভ্যাকসিন কি কার্যকরী ওষুধের আশার বাণী ও যে প্রবলভাবে শোনা যাচ্ছে এমন ও নয়। নানা লোকে নানা কথা বলছে।
নানা দিক বিচার করে দেখলে এই অসুখটি এমন যে আমাদের চেনা জানা চিন্তা ভাবনার প্রায় কিছুই মিলছে না, আবার অনেক কিছুই অবাক লাগে ।
এই অসুখটির আপাতত কোনো সহজ সমাধান ওষুধ পত্তর দিয়ে বা টোটকা প্রভৃতি দিয়েকরা যাচ্ছে না , এমন কি অন্যান্য ভাইরাল অসুখের ও সংক্রামক অসুখের যেমন টিকার বন্দোবস্ত আছে, এই অসুখটির ক্ষেত্রে সেটাও করা যাচ্ছে না বা আবিষ্কৃত হয়নি এখনো অবধি। এই ভাইরাস টি মশা, কি পোকা, বা মাছি বাহিত নয়, ইনজেকশনের সিরিঞ্জ থেকে, বা ড্রাগ সেবনের ফলহেতু হয়েছে এমন মনে করার কোনো কারণ নেই, কোন পশুর কামড়ে বা অন্য কোনো জন্তু বাহিত ও "ঠিক" নয়, চীন বাদে অন্যত্র বাহক বলতে মানুষ। এমনকি কোনো খাবার থেকেও যে হয়েছে বা হতে পারে, তাও বলা যাবে না। তাহলে কি এই অসুখটিকে প্রতিহত করার কি কোনো উপায় নেই? না, তাও নয়, বরং যা দেখা যাচ্ছে অসুখটি প্রতিহত করা কিন্তু একরকম সহজই বলতে গেলে । তাছাড়া একেক বয়েসের মানুষের একেক রকম ভাবে ভোগার সম্ভাবনা।
সেইটাই আশ্চৰ্য্য !
উল্টে দেখুন, এ অসুখ প্রতিহত করার জন্যে যা যা করতে বলা হচ্ছে বা আমাদের করতে হচ্ছে, সে কিন্তু সহজ ব্যাপার দেখতে গেলে। আমরা অন্য সময় হলে অনেকেই শুচিবাই, বাড়াবাড়ি, বলে ঠাট্টা তামাশা করতাম। যেমন, এ অসুখ প্রতিহত করার সবচেয়ে ভালো উপায় বাইরে বেরোবার সময় বা জনসমাগম এড়িয়ে চলা, ভিড়ভাট্টা না করা, জমায়েত না করা, আদৌ সম্ভব না হলে বাড়ি থেকে বেরোবার সময় নাকে একটা কাপড় রাখা, নাকে মুখে হাত না দেয়া, বারংবার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, অসুখ হলে বাড়িতে বসে দরজা জানলা এঁটে বসে থাকা, কথা বলার সময় যার সঙ্গে কথা বলছেন তাঁর থেকে থেকে বেশ অনেকটা দূরত্ব বজায় রেখে কথা বলা, কথা বলার সময় খেয়াল রাখা কিছুতেই যেন থুতু না ছিটিয়ে যেন না যায়, থালা বাসন টেবিল চেয়ার পরিপাটি করে সাবান জল দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করে রাখা। ভাইরাস সংক্রান্ত না হয়ে অন্য সময় কেউ যদি এইসব কাজ বিশেষ করে যদি করতে বলতো, তাহলে বলা যেত যে এ আর কি এমন ব্যাপার। অথচ ইদানিং এই রকম সময়েই সেইগুলোই যে "চিকিৎসার" অঙ্গ হয়ে উঠবে এ কি রকম আজব ব্যাপার ? আমরা আজকালপ্রযুক্তিগত জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, তথাপি,প্রযুক্তির চেয়েও আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় যা মনে হয় সহজেই করা যায় এতেই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আসবে ভাবলেই অবাক লাগে। আমরা এমন একটা জীবনযাত্রায় অব্যস্ত হয়ে পড়েছি আজকাল যে এই ব্যাপারগুলো চট করে আমাদের কাছে ইদানিং আর অনায়াস বলে মনে নয় না। যেমন ধরুন, যেখানে বাজারচলতি সাবান দিয়ে হাত ধুলে চলে, আমরা দামি স্যানিটাইজার খুঁজি, সকলের থেকে আলাদা হয়ে থাকার কথা ভাবতেই গায়ে জ্বর আসে, তখন নানারকমের প্রযুক্তি আর কাজের অছিলা চাই আমাদের, কয়েকটা দিন ঘরে থাকতে হবে জেনে অস্বস্তিতে পড়ি। এই পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটা ব্যাপার আলোচনা করতেই হয়।
চারটি কথা
এক , ভাইরাসটি, আর এই অসুখটি নিয়ে আমরা কি কি জানি আর কি কি জানিনা?
যেমন ধরুন, এই অসুখটা ইনফ্লুয়েঞ্জা ধরণের অসুখ, আমরা তাই বলে ইনফ্লুয়েঞ্জা কি তা জানি না? যাদের গায়ে জ্বর থাকে তাদের কাছ থেকে অসুখ ছড়াতে পারে, তাই তাদের এড়িয়ে চলা চাই, আমাদের জানা কথা। কিন্তু এটির গতি প্রকৃতি অন্য রকম। এখানে যাদের আপাত ভাবে দেখে মনে হচ্ছে শরীরে জ্বর নেই, অসুখ নেই, তাদের কাছ থেকেও অসুখ ছড়াতে পারে, এখানেই হয়েছে গোলমাল, কে যে কোথা থেকে অসুখ ছড়াবে কেউ জানে না, অতএব কতটা সাবধান হতে হবে? কে কতদিন কোন লক্ষণ ছাড়াই অসুখ ছড়িয়ে যেতে পারে? এই ভাইরাস এর আক্রমণ আরো কতদিন চলবে? কবে নাগাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে? স্বাভাবিক প্রাকৃতিক কারণে বা গরম পড়লে কি ভাইরাসের ইনফেকশন চলে যাবে? এতে, অন্যান্য ফ্লু তে তো হতো, এবারেও কি তাই হবে? এই রকম নানা প্রশ্ন মনে আসে। এবারে আরো একটা ব্যাপার চিন্তা করুন, আমরা যদি কিছুই না করি বা কিছুই না করতাম, তাহলে পরিস্থিতি কতটা খারাপ হতে পারে বা কতটা খারাপ হতে পারতো? " খারাপ" হতে পারে কথাটার ই বা কি অর্থ এক্ষেত্রে? মানুষ মারা যাবার কথা বলা হচ্ছে? কারা মারা যাচ্ছেন? মানুষের অসুস্থতার কথা বলা হচ্ছে? সে কিরকম অসুখ? এর দীর্ঘমেয়াদি ফল কি হতে পারে?
দু নম্বর, নিয়ম।
আমরা জানি যে এই ভাইরাস আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য ব্যক্তিগত ভাবে আমাদের অনেক কিছু করার আছে। এখন এই এত নিয়ম দিনের পর দিন সবাই যে পালন করবেন বা করতে পারবেন তার নিশ্চয়তা নেই। যদি না করতে পারি, বা যারা ধরুন নানা কারণে করে উঠতে পারলো না, তাদের কি হবে? তাছাড়া, এতো নিয়ম করে পালন করলে কতটা সত্যি সত্যি আমরা ভাইরাসের আক্রমণ প্রতিহত করতে পারবো?
তিন নম্বর , দূরত্ব।
এই যে ডাক্তাররা বা স্বাস্থ্যবিদ রা বলছেন পরস্পরের থেকে সামাজিক (সামাজিক নাকি শারীরিক ) দূরত্ব বজায় রাখতে , এতে করে সত্যি ভাইরাস সংক্রমণ আটকানো যাবে? নিজে নিজে ঘরবন্দি হয়ে আলাদা থাকাটা আমাদের অনেকের কাছেই শাস্তির মতো, এরকম করে কতটা ভাইরাস আক্রমণের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া যেতে পারে? সব দেশে কি তাই করছে? এ ব্যাপারটা কতটা কাজের?
চার , করোনায় জনতার করণীয় ।
জনগণের কল্যানে সরকারের তরফে কিছু কাজ করার আছে, তাতে সরকারি কর্মচারী ছাড়াও আমাদের সক্রিয় অংশ নেবার একটা পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে । ভারত সরকার (ও অন্যান্য আরো কিছু দেশের সরকার) লকডাউন নাম দিয়ে দেশ প্রায় বন্ধ করে কোমর বেঁধে লেগেছেন করোনাভাইরাস নির্মূল করতে। তাছাড়া যেমন ধরুন সরকারের তরফে বার বার করে পরীক্ষার বন্দোবস্ত করা, বাজার চালু রাখা অথচ খুব বেশি লোকে যাতে ভিড় না করে সে দিকটা দেখা, মানুষের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করা, এবং ভারতে যেহেতু লকডাউন চালু হয়েছে কোন পয়েন্টে লকডাউন তুলে নেওয়া হবে সেই নিয়ে জনগণকে সচেতন করে জানানো, ইত্যাদি নানান রকমের জটিল কাজকর্মের দায়িত্ব রয়েছে, এ কাজে সাধারণ মানুষকেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে । সে যাই হোক, আমাদের মধ্যে কেউ কেউ ভাবতে পারি যে এই সমস্ত জটিল বিষয় জনজীবনে বা জনস্বাস্থ্যের বিশেষ করে এই ভাইরাস আক্রমন প্রতিহত করার ব্যাপারে সত্যি সত্যি কতটা কাজে লাগছে বা কাজে লাগতে পারে ? বিশেষ করে ধরুন আমরা কখন নিজেরা বুঝতে পারবো যে লক ডাউন কাজে দিচ্ছে, কখন বুঝতে পারবো যে লকডাউন এ কিছু হচ্ছে না? এর কিছু শর্ত শিথিল করা যেতে পারে? কখন ও কি উপায়ে লক ডাউনের তালা খোলা উচিত?
এক, ভাইরাসটি, আর এই অসুখটি নিয়ে আমরা কি কি জানি আর কি কি জানিনা?
জানিনা অনেক কিছুই, তবে যতটুকু জানি তার কিছুটা :
১) যেমন আমরা জানি যে এই ভাইরাসটি কোরোনাভাইরাস গোষ্ঠীর অন্তর্গত, এর এক জ্ঞাতি আমাদের সাধারণ সর্দি কাশির জন্যে দায়ী,আর দুই জ্ঞাতি তৈরী ভাইরাস, MERS ও SARS , এঁরা দুজনেই একবার করে আমাদের মধ্যে ঘুরে গেছেন, ও এদের বিদায় বা প্রায় বিদায় করা হয়েছে। এঁদের মধ্যে একজন আজ থেকে সাত আট বছর আগে ২০১২ ২০১৩ সাল নাগাদ মধ্যপ্রাচ্যে লোকজনকে ভুগিয়েছিলেন, মার্স নাম দিয়ে এক ভয়ানক অসুখে। মার্স কথাটি মিডল ইস্ট রেস্পিরেটরি সিনড্রোম (MERS ) কথাটির সংক্ষিপ্তরূপ, ওই অসুখে আরব, ইরান প্রভৃতি অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে কাশি, শ্বাসকষ্টে ভুগে শতকরা ৩৪-৩৬% মানুষের প্রাণবিয়োগ ঘটেছিলো, এঁদের অধিকাংশই অপেক্ষাকৃত বয়স্ক মানুষ (৬০ বছর ও তার বেশি বয়েস); শিশু ও অপেক্ষাকৃত অল্প বয়স্ক রা কম মারা গিয়েছিলো (১) , আরেক
---
উৎস সমূহ