কলকাতা উচ্চ আদালতের বেশ কিছু শুনানি এখন ইন্টারনেটে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়। আমি বেশ কটা দেখেছি এবং শুনে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেছে। বাদী-বিবাদী সবাই বাঙালি। দুই-তিন-চার-পাঁচজন উকিল, যাঁরা তর্কবিতর্ক করছেন, সবাই বাঙালি। বিষয়বস্তু বাংলার। কিন্তু পুরোটাই হচ্ছে ইংরিজিতে। কালো কোট পরে উকিলরা বিচারকের সামনে এসে নানারকম বিচিত্র উচ্চারণে ইংরিজিতে সওয়াল করছেন। বাংলায় কোনো অপরাধ হয়েছে, কোনো বাঙালি মেয়ের উপর অত্যাচার হয়েছে, বাংলার কোনো হাসপাতালে ময়নাতদন্ত নিয়ে প্রশ্ন, বিচারপ্রার্থীরা আদৌ কিছু বুঝছেন কিনা তার তোয়াক্কা না করে সবটাই ইংরিজিতে। শুনলে মনে হয়, এখনও ইংরেজ জমানা চলছে, আর ছন্দ করে 'কিউকাম্বার শসা, প্লৌম্যান চাষা' মুখস্থ করছেন।
ভারতীয় সংসদের কিছু কিছু অধিবেশন এখন ইন্টারনেটে সম্প্রচারিত হয়। তারও কিছু দেখে বুঝেছি সংসদের ভাষা মূলত হিন্দি এবং ইংরিজি। কেন হবে বোঝা মুশকিল। কারণ, ভারতে সবকটা ভাষারই মর্যাদা সমান। এবং চাইলে সংসদে নিজের ভাষায় কথা বলা যায়। কিন্তু স্মরণাতীতকালের মধ্যে কেবল দুজনকে বাংলায় বলতে দেখেছি। একজন দেব অধিকারি, অন্যজন বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। দুজনেই প্রতীকীভাবে একবার করেই বলেছেন। তা বাদে, বাংলার সাংসদরা তাঁদের নির্বাচকমণ্ডলীর ভাষা আদৌ বলেননা লোকসভা এবং রাজ্যসভায়। ঠিক যেমন আদালতে বলা হয়না বিচারপ্রার্থীর ভাষা।
এইখানে একটা প্রশ্ন আসতেই পারে, যে, সবাই নিজের ভাষা বললে বাকিরা বুঝবে কীকরে। যাঁরা এই প্রশ্নটা তুলবেন, তাঁদের একবার ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের কোনো একটা অধিবেশন দেখতে বলি। সেখানে সবাই নিজের নিজের ভাষায় কথা বলেন, প্রতিটা নথি সমস্ত ভাষায় তৈরি হয়। আজকের যুগে যেকোনো বক্তৃতার সরাসরি অনুবাদ কোনো ব্যাপারই নয়, সেটাই করা হয়, সবাই কানে হেডফোন লাগিয়ে শোনেন। হ্যাঁ, এতে করে ঝগড়া করার খুব একটা সুবিধে হয়না, কিন্তু ঝগড়া করতে তো কাউকে সংসদে পাঠানো হয়না।
কলকাতা শহরে নানা কারণে ঘোরাফেরা করতে হয়। সেখানে ব্যাংক আধিকারিক কোনো ভূমিকা ছাড়াই হিন্দি বলতে শুরু করেন। এফএম রেডিওতে কথা-নেই-বার্তা-নেই শুরু হয়ে যায় হিন্দিতে বাতচিত। ট্যাক্সিড্রাইভার মাঝেমধ্যেই হিন্দি ছাড়া কিছু বোঝেন না। অহরহ সাপোর্ট কল আসে হিন্দিতে। কেন জানা নেই। খদ্দের বাঙালি। এফ-এমএর বিজ্ঞাপনের ভাষা বাংলা। কিছু বেচতে হলে বাংলায় বেচা হয়। কিন্তু বেচা হয়ে গেলে, এবার ঘাড়ে-ধরে পরিষেবা হিন্দিতে। যেন ভাষাশিক্ষার ইশকুল। বইমেলাতেও দেখেছি, কাজের জিনিস, যেমন ওমুকটা করবেননা, তমুক হারিয়ে গেছে, গেটের সামনে গাড়ি রাখবেন না, অর্থাৎ কিনা যেগুলো দিয়ে সংযোগস্থাপন করতে হয়, সেই সব ঘোষণাই বাংলায়। অর্থাৎ সবাই জানেন, কাজের ভাষাটা বাংলাই। তার পরেও রেকর্ডের বাণীসমূহ বাংলা, হিন্দি এবং ইংরিজিতে। কেন তিনটেই ভাষা, ওড়িয়া-অসমিয়া কী দোষ করল, সে কেউ জানেনা।
সরকারি দপ্তরে বিশেষ যাতায়াত নেই। কিন্তু পুলিশ তো অহরহ দেখি রাস্তায়। পুলিশ এবং সিভিক ভলান্টিয়ার। কলকাতা শহরে তার বিরাট অংশ স্রেফ হিন্দিতে কথা বলেন। শুনেছি, সত্যিমিথ্যে বলতে পারবনা, কলকাতার অনেক থানাতেই অন্য রাজ্যের মানুষ অফিসার হয়ে এসেছেন। এটা নিজের চোখে দেখিনি, ভুলও হতে পারে, কিন্তু যেটা ভুল নয়, সেটা হল, পশ্চিমবঙ্গে কাজের ভাষা হিসেবে বাংলা চালু করা হয়নি। আমলারা নোট লেখেন ইংরিজিতে। সরকারি অ্যাপ ইংরিজিতে। সরকারি চাকরিতে বাংলা বাধ্যতামূলক নয়। ভূমিসন্তান সংরক্ষণের তো প্রশ্নই নেই।
রাজ্য সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে নানা কথা শুনি এবং পড়ি। তার আর বিশেষ মূল্য নেই কারো কাছে। শহরে মধ্যবিত্তরা তো বটেই, নিম্নবিত্তরাও পারলেই ছেলেমেয়েদের ভর্তি করান কেন্দ্রীয় বোর্ডে। শিক্ষা কী হচ্ছে বড় কথা না, ইংরিজি শিখছে কিনা সেটাও বড় কথা না, একটা ধারণা তৈরি হয়েছে, যে, কেন্দ্রীয় শিক্ষাই আসল শিক্ষা। রাজ্য সরকারের বহু স্কুল ধুঁকছে। বলা হচ্ছে, ছাত্রের অভাবেই। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের জনসমুদ্রে ছাত্রের অভাব হচ্ছেই বা কেন, সেটা বলা হচ্ছেনা। যে কটা টিকে থাকছে, তাও ভরে যাচ্ছে কেবলমাত্র প্রথম প্রজন্মের ছাত্রে। শিক্ষকরা "ওরা কেউ পড়েনা" বলে দায় এড়াচ্ছেন। যে রাজ্যে সরকারি কাজে নিজের ভাষা বাধ্যতামূলক না, বিচারে নিজের ভাষার কোনো জায়গা নেই, যে দেশে সংসদে নিজের ভাষা বিশেষ কেউ বলেনা, সরকারি থেকে বেসরকারি সংস্থাগুলো একবার মাল বেচে দেবার পর ক্রেতার ভাষার কোনো তোয়াক্কা করেনা, সেখানে এটাই ভবিতব্য।