শাহবাগ আন্দোলনে লাভবান হয়েছিল আওয়ামীলীগ বা বলা চলে আওয়ামীলীগ ক্যাশ করছিল আন্দোলনকে। এই জন্য গালি খেতে হয় এখনও সবাইকে। প্রশ্ন হচ্ছে আওয়ামীলীগ ক্যাশ করল বাকিরা কী করল? যে বিএনপি এখন গলা ফাটাচ্ছে জামাত রাজাকার বলে তারা তখন কী করেছিল? সেদিন যদি বিএনপি শাহবাগের পাশে দাঁড়াত এই বাংলাদেশের রাজনীতি ভিন্ন রকম হত, গল্পটা অন্য রকম হত। আওয়ামীলীগ এক তরফা ২০১৪ সালের নির্বাচন করার সাহস পেত না। বিএনপি সেদিন পাশে না এসে উল্টো বলে দিল সব নাস্তিক! গোপনে আঁতাত করল মতিঝিল দখল করে হেফাজতের ঘাড়ে ভর দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের! এই দায় কার?
প্রতিনিয়ত তখন শাহবাগকে কটাক্ষ করে বিএনপির নেতারা নানান বিবৃতি দিত। সব মেয়েছেলে এক সাথে রাত করে থাকে, বেল্লাপনা করে, নানান অশ্লীল কাজ করে, কত যে রগ রগে বর্ণনা আসা শুরু হল। আমি একজন আন্দোলনের কর্মী হিসেবে একদিন ঠিক করলাম আজকে পুরো এলাকা ঘুরে দেখব কোথায় কী হচ্ছে দেখব। একদিকে টিএসসি পর্যন্ত এসেছে মানুষের ঢল অন্য দিকে তৎকালীন শেরাটন হোটেল পর্যন্ত। আরেক দিকে মানুষের বসে আছে মৎস্য ভবন পর্যন্ত বিপরীত দিকে চলে গেছে কাঁটাবন পর্যন্ত। এইটাই পুরো অংশ। ঘুরলাম, মানুষ বসে আছে, কেউ ঘুমাচ্ছে, কেউ গান গাচ্ছে, কই অশ্লীল কাণ্ড গুলো হচ্ছে খুঁজে পেলাম না। ভাবলাম এইটা হলে ছবির হাটের দিকেই হতে পারে। গেলাম। নাহ! অথচ দৈনিকই শুনতাম যে এখানে নানান অপকর্ম ঘটে চলছে। আমার দেশ পত্রিকায় ছাপা হল শাহবাগে প্রতি রাতে ধর্ষণের স্বীকার হচ্ছে নারী! কাঁচা মিথ্যা কথা প্রকাশ করায় তখন থেকেই শীর্ষে ছিল তারা!
শাহবাগ আন্দোলনের সবচেয়ে বড় গৌরব হচ্ছে এই আন্দোলনটা শত ভাগ অহিংস ছিল। আজকে যে পরিমাণ মানুষ সরকার ফেলে দিল তারচেয়ে কোন অংশে কম ছিল না শাহবাগের দৈনিক হাজিরা। এরা দাবি আদায়ের জন্য যে সহিংস পথ বেছে নিয়েছিল তা শাহবাগের দরকার পড়েনি। অথচ দাবির মান বিচার করলে শাহবাগের দাবি কোটার থেকে ঢের ঢের বিশাল ব্যাপার বলা চলে। আমরা তখন সরাসরি আওয়ামীলীগকে জামাতের সাথে আঁতাতের সন্দেহে রাজপথে নেমেছিলাম। কাদের মোল্লার ভি চিহ্ন, পুলিশের সদস্যরা জামাতের কর্মীদের ফুল দিচ্ছে এমন বেশ কিছু ঘটনা আমাদেরকে ভাবতে বাধ্য করেছিল যে তলে তলে আঁতাত করছে আওয়ামীলীগ।
তো সহিংস হওয়ার যুক্তি ছিল আমাদের। কিন্তু আমরা সেই রাস্তায় যাইনি। হেফাজতের পাল্টা কর্মসূচিও শাহবাগকে সহিংস করতে পারেনি। শাহবাগে তখন কয়েক লক্ষ লোক দৈনিক হাজির হচ্ছে, কত মিটার হবে, দুই একশ মিটার দূরে, বিএসএমইউয়ের কেবিনে রাজাকার শিরোমণি গোলাম আজম চিকিৎসা নিচ্ছিল, একটা আঙ্গুলি হেলনে তুলাতুলা হয়ে যেত গোলমাল আজম। অথচ সেই পথে যায়নি। শাহবাগ আন্দোলন করে আইন সংশোধন করে, আইনের পথেই বিচার নিশ্চিত করেছিল কুখ্যাত সব রাজাকারদের।
যারা সেদিন শাহবাগে গিয়েছিল তারা আজকে কোথায়? এইটা একটা বড় প্রশ্ন। এই যে এই শক্তিটাকে নষ্ট করে দিয়েছিল আওয়ামীলীগ তার দায় আওয়ামীলীগ নিবে কী? যে নাস্তিক ট্যাগ লাগা শুরু হল তা থামেনি। যে প্রশ্ন কোনদিন এই বাংলায় উঠেনি সেই প্রশ্ন তখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াল। টপাটপ কল্লা পড়তে লাগল, আওয়ামীলীগ সরকার নীরব হয়ে রইল! রাজীব হায়দার দিয়ে শুরু, শেষ কে জানে কই কাকে দিয়ে! অভিজিত রায়ের মতো নক্ষত্রকে হারিয়ে যেত হলে এখানেই! সরকার অ্যাসাইলামের ব্যবস্থা করে বিদেশ পাঠিয়ে দিতে থাকল। যারা সামনের সারির যোদ্ধা তারা আর প্রায় কেউই রইল না!
ফলাফল চোখের সামনে। যে শাহবাগ উত্তাল হত তুমি কে আমি কে বাঙালি বাঙালি বলে সেখানেই স্লোগান উঠল তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার! এই কষ্টের কোন মাপজোক আছে? এমন ভয়ংকর একটা প্রজন্ম তৈরি হয়ে গেল চোখের সামনে অথচ কেউ কিছুই বুঝল না! মেটিকুলাস ডিজাইন বলে আর যাই বলি না কেন, এমন একটা প্রজন্ম তৈরির সমস্ত দায় আওয়ামীলীগের, এতে কোন সন্দেহ নাই। আমরা, আমি জেন জি নিয়ে মশকরা করছি, এরা কিছুই শোনে না, পড়ে না, জানে না, জানতে চায়ও না এগুলা বলে গেছি সব সময়। অথচ বিরোধী শক্তি তা বলে বসে থাকেনি, ওরা যেভাবে শুনতে চায়, যেভাবে জানতে চায় সেভাবেই শুনিয়েছে, জানিয়েছে! আমি জানি খুব স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে লিখছি আমি। সমাজ বিজ্ঞানীরা, নৃ তাত্ত্বিকেরা এই সব নিয়ে ভালো বলতে পারবে যে কেন একটা প্রজন্ম সম্পূর্ণ ভুল দিকে চলে গেল!
আওয়ামীলীগ দ্বারা ব্যবহারিত হওয়া, সেই কারণে জামাতের দ্বারা শাহবাগি গালি তৈরি হওয়া এই সবই সত্য। এইটাও সত্য যে এই টাই এখন পর্যন্ত জামাতিদের সবচেয়ে বড় মাথাব্যাথা। ওরাও জানে এখানে হাজিরা দেওয়া লাখ লাখ মানুষ দিকভ্রান্ত হতে পারে, ভুল করতে পারে কিন্তু শেষ পর্যন্ত চেতনার মৃত্যু নাই। শাহবাগের চেতনাকেই তাদের সবচেয়ে বড় ভয়। তাই নানা ভাবে শাহবাগকে অপমান করা হয়, শাহবাগকে নিয়ে নানান কুৎসিত গল্প ফাঁদা হয়, শাহবাগকে গালিতে রূপ দেওয়া হয়। শাহবাগের জ্বালা তারা এখন পর্যন্ত অনুভব করে। তাই শাহবাগকে কেন্দ্র করে তাদের সব আয়োজন করা হয়। শাহবাগেই সমাবেশ করতে হয় হেফাজতের! কারণ আর কিছু না, জ্বালা মেটানোর চেষ্টা!
শাহবাগের চেতানাই হয়ত সামনের পথ দেখাবে বাংলাদেশকে। সেই আশায়ই রয়েছি আপাতত।