আবার কালো এক রাত হাজির হইছে। রাত দেড়টার সময় যখন লিখতে বসেছি তখনও তুমুল অ্যাকশন চলছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। দেশের সব খবরের চ্যানেল গুলো লাইভ দেখাচ্ছে। রীতিমত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে ঢাবির ক্যাম্পাস, নীলক্ষেত এলাকা। কয়েকটা চ্যানেলের সরাসরি দেখেও আমি এখন পর্যন্ত নিশ্চিত না পুলিশ কোন পক্ষের সাথে আছে! পুলিশ সাত কলেজের ছাত্ররদের দিকেও টিয়ার শেল মারছে আবার ঢাবির ছাত্রদের দিকেও মারছে। তাই বুঝা মুশকিল যে হচ্ছে কী!
সাত কলেজ কী, কিসের আন্দোলন এগুলা সবার জানা নাই, একটু এইটা বলে নেই, না হলে বুঝার উপায় নাই যে আসলে কী হচ্ছে এখানে।
সাত কলেজগুলো হলো ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুরের সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ। ২০১৭ সালে সরকার এই সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত করে দেয়। তখন এইটা নিয়ে কেউ তেমন প্রশ্ন তুলেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট পাবে এইটা ভেবে হয়ত খুশিই হয়েছে। এর আগে এই সাত কলেজ ছিল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট নিশ্চয়ই বেশি পছন্দের হবে ছাত্রদের? অন্তত তেমনটাই আসাহ করেছিল সবাই। কিন্তু কার্যক্ষত্রে দেখা গেল ভিন্ন দৃশ্য।
কিছুদিন যেতেই বুঝা গেল এইটা ঠিক কাজ হয়নি। কেন? কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিজেই নিজেদের ছাত্রদের নিয়ে হিমশিম খায়, পরীক্ষা খাতা দেখা সহ নানা ভেজালে তারা থাকে সব সময়। এখন এই বাড়তি সাত কলেজের দায়িত্ব কীভাবে পালন হবে? এদের পরীক্ষা সিলেবাস নিয়ে নানান ভেজাল লাগা শুরু হল। ২০১৯ এসে আন্দোলনই শুরু হল। এরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে যেতে চায়। তখন এইটা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে, আন্দোলন হয়েছে, পুলিশ গুলি চালিয়েছে। গ্যাঞ্জাম শেষ হয়নি, কিন্তু থেমে ছিল তখনকার মত করে। এরপরে বিভিন্ন সময় এইটা নিয়ে কথা হয়েছে। সাত কলেজ নিয়ে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের কথা বলেছে কেউ। অন্যদিকে তিতুমির কলেজ নিজেই আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় হতে চায়, ঢাকা কলেজের চাওয়াও তেমনই। এই নিয়ে ইউনুস সরকারের আমলেও এক দফা আন্দোলন হয়ে গেছে। কিন্তু এইটা যে শেষ হয়নি, যে কোন সময় শুরু হবে এইটা সবার জানা ছিল। গতকাল সেই দিন এসে হাজির হয়েছে।
গতকাল কী হয়েছে? গতকাল সাত কলেজের ছাত্ররা গিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের সাথে দেখা করতে। পাঁচ দফা দাবি নিয়ে গেছিল তারা। শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো হলো:
১. ২০২৪-২৫ সেশন থেকেই সাত কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় অযৌক্তিক কোটা পদ্ধতি বাতিল করতে হবে।
২. শ্রেণিকক্ষের ধারণক্ষমতার বাইরে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো যাবে না।
৩. শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে হবে।
৪. নেগেটিভ মার্ক যুক্ত করতে হবে।
৫. সাত কলেজের ভর্তি ফি’র স্বচ্ছতা নিশ্চিতে মন্ত্রণালয় গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির সঙ্গে সমন্বয় করে ঢাবি ব্যতীত নতুন অ্যাকাউন্টে ভর্তি ফি’র টাকা জমা রাখতে হবে।
এখন দাবি তো পরে, ভিসি না কি তাদের সাথে কথাই বলেনি। উল্টো বলেছে তোমরা কারা? এইটা ছাত্রদের খুব লেগেছে, তারা অপমানিত বোধ করেছে! প্রতিবাদ স্বরূপ তারা সাইন্স ল্যাব এলাকার রাস্তা দখল করে বসে। সাত কলেজের তিন শতাধিক শিক্ষার্থী প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা সায়েন্স ল্যাব মোড় অবরোধ করে রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে মিছিল নিয়ে আসেন। তাঁরা নীলক্ষেত মোড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণের সামনে অবস্থান নেন। এখন তাদের দাবি হচ্ছে ভিসিকে ক্ষমা চাইতে হবে আর তাদের পাঁচ দফা মেনে নিতে হবে।
এখান থেকে শুরু দ্বিতীয় পর্ব। ঢাবির ছাত্ররা এগিয়ে আসে। শুরু হয় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া! যা এই লেখা যখন লিখছি তখন পর্যন্ত চলামান। মৃত্যুর খবর শুনিনি, আহত হয়েছে বেশ কয়েকজন। ইডেন কলেজের নারী শিক্ষার্থীরাও বের হয়ে এসেছে। অবস্থা যথেষ্ট খারাপ। হাসনাত নামের এক সমন্বয়ক নিজেকে নায়ক ভেবে এসেছিলেন সব ঠাণ্ডা করতে। অল্পের জন্য জীবন নিয়ে যেতে পেরেছে বলে মনে হল ভিডিও দেখে। তাকে সবাই মিলে ধাওয়া দিয়েছে। তিনি তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে দ্রুত এলাকা ছাড়েন।
বিপদ হচ্ছে অথর্ব নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিয়ে। কেউই এগুলা কীভাবে সামলাবে জানে না। পুলিশ জানে একটাই উত্তর, দেও লাঠি! চালায় দেও টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড, মারও গুলি! সব এই তরিকায় সমাধান করতে গিয়ে কই থেকে দেশ কই চলে গেল এখন পর্যন্ত হুশ হয় নাই এদের?
না, এদের হুশ নাই। ছাত্রদের আন্দোলনে লাশ না পড়লেও গতকাল লাশ পড়েছে ঢাকার বুকে। ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষকরা তাদের চাকরি জাতীয়করণে দাবি নিয়ে প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান নেয়। এরপরে তারা তাদের দাবি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতর দিয়ে মিছিল নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে যেতে চাইলে শাহবাগের সামনে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। জলকামান নিয়ে প্রথমে আক্রমণ হয়। এরপরে হয় লাঠিপেটা, টিয়ার শেল। ছাত্রদের আন্দোলন আর এদের আন্দোলনের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে এখানে যারা এসেছিল তারা সবাই পেটের দায়ে আসা লোক। বয়স্ক, মুরুব্বি মানুষ। এদেরকে পুলিশ যে বেধড়ক পেটাল এইটা অবিশ্বাস্য। ছবি গুলোর দিকে তাকিয়ে দেখা যায় না! মৃত্যুর খবর পত্রিকাতে আসে নাই। একজন লাইভে বলল দুইজনের মৃত্যু হয়েছে, এইটা নিশ্চিত! কেন এখনও স্মারকলিপি দিতে গিয়ে মৃত্যুর মুখে পড়বে মানুষ? মানে এইটার মানে কী? এত সস্তা কেন মানুষের জীবন?
শান্তির পায়রা দেশ চালাতে গিয়ে লেজেগোবরে করে ফেলেছে এইটা ও জীবনেও মানবে না। ওর গুণগানে মুগ্ধ একদল ছাগল আছে তারাও মানবে না। অথচ নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে সকলের। মাজার ভাঙা চলছে এখনও নিয়ম করে। হেফাজতে ইসলাম যখন ইচ্ছা করছে তখন যে কোন অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিচ্ছে। একদিকে সংস্কৃতি উপদেষ্টা ফারুকি বলছে মাজার ভাঙা আর বরদাস্ত করা হবে না অন্য দিকে পরেরদিনই ইসলামি ফাউন্ডেশনের গভর্নর বলছে এগুলা ভণ্ডদের এমনে বলে লাইনে আনা যাবে না, এদেরকে পিটাইতে হবে, কতল করতে হবে! ফলাফল চলিতেছে সার্কাস!
নায়িকা পরিমনি গিয়েছিল টাঙ্গাইলে এক দোকান উদ্বোধন করতে। হেফাজতে ইসলামের প্রবল বাধায় তা করতে পারেনি। চলে এসেছে সেখান থেকে। এর আগে একই পরিস্থিতিতে পরে আরেক মডেল অভিনেত্রী মেহজাবিন চলে আসছিল চট্টগ্রাম থেকে। পরিমনি দুর্মুখ বলে খ্যাতি আছে। সে ফিরেই একটা জ্বালাময়ী স্ট্যাটাস প্রসব করেছে ফেসবুকে। ফলাফল পুরান এক মামলায় কালকে ওয়ারেন্ট বের হয়েছে পরিমনির নামে! এই হইল বাক স্বাধীনতার নমুনা শান্তির পায়রার দেশে! বাকরুদ্ধ করার প্রক্রিয়া হিসেবে কিছুদিন আগে একটা প্রজ্ঞাপন জারি হইছে। কোন ছাত্র ছাত্রী যদি শান্তির দূতের নামে খারাপ কিছু বলে, ফেসবুকে পোস্ট করে তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিবে সরকার!
এত আন্দোলন, এত গণ্ডগোল হচ্ছে, এখন তো লীগ নাই, তাহলে? অনেকেই ধারনা করছে এগুলা বিএনপি করাচ্ছে! আমরা দোষারোপ করতে উস্তাদ! কোন ভুল নাই, কেউ ষড়যন্ত্র করছে, কেউ ফাঁসাচ্ছে এই হল বক্তব্য। অবশ্যই ষড়যন্ত্র আছে, কিন্তু তুমি করছ কী? এগুলা বলে কই নিয়ে যেতে চাও দেশকে?
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।