হকার উচ্ছেদ হলে লাভ কার? একটা কথা খুবই চালু, যে, পথচারীদের সুবিধে হয়। কথাটা ভুল না। ফুটপাথ পথচারীদের জন্যই বানানো। ফাঁকা হলে হাঁটাচলার সুবিধে। শুধু তাই না, পথচারীরা ফুটপাথে হাঁটলে শহরে একটা শৃঙ্খলা আসে। গাড়িঘোড়ারা রাস্তা দিয়ে চলতে পারে। তাদের গতি বাড়ে। হর্ন দেওয়া কমে। বায়ু, শব্দ, সবরকম দূষণই কমে। কিন্তু এটা তো একটা দিক। সরাসরি আর্থিক লাভ কি কারো হয়? বিশেষ করে ভারতবর্ষের মতো উন্নয়নশীল দেশে?
উত্তরটা সোজা না। ভারতবর্ষ এক বিচিত্র দেশ। এখানে গগনচুম্বী হাইরাইজের নিচেই থাকে বস্তি। টাইমকলের পাশেই থাকে বোতলবন্দী মিনারাল জল। আর সবচেয়ে বেশি বৈপরীত্য হল বেচাকেনায়। ফুটপাথে আর রাস্তার পাশের খুচরো দোকানের জঙ্গলের উল্টোদিকেই থাকে চকচকে শপিং মল। একদিকে চলে চৈত্র সেল আর হালখাতা, অন্যদিকে ফাদার্স, মাদার্স, ভ্যালেন্টাইনস ডে। একদিকে হাতিবাগান-ছাপ খুচরো পসরা, অন্যদিকে ব্র্যান্ডের চূড়ান্ত।
হকার বা খুচরো বিক্রেতাদের সঙ্গে এই মলদের সম্পর্কটা ঠিক কি? একটা বৈপরীত্য নিশ্চিতভাবেই আছে, কিন্তু একেবারেই আদায়-কাঁচকায় কি? এক কথায় বলা কঠিন। কারণ, খুচরো বিক্রেতারা আছেন ইংরেজ আমলে তৈরি হওয়া ঘিঞ্জি শহরে তো বটেই, তার অনেক আগে থেকেই। আর মল ব্যাপারটা একেবারেই নতুন। ভারতবর্ষে প্রথম শপিং মল তৈরি হয়েছিল, এমনকি তিরিশ বছর আগেও না। ১৯৯৯ সালে, দিল্লির 'আনসালস প্লাজা' দিয়ে। তারপর মুম্বাই, চেন্নাই। ২০০৩ সালে খোলে কলকাতার প্রথম মল এলগিন রোডের ফোরাম, কিছুদিনের মধ্যেই ২০০৪ সালে কলকাতার কাছে সল্টলেকেও তৈরি হয় সিটি সেন্টার ওয়ান। তারপর দ্রুতগতিতে তৈরি হতে থাকে নানা মল। ভারতবর্ষে প্রথম দফায় মলবিপ্লব শুরু হয়ে যায়।
প্রথম দফায় এই মলগুলো চালু হবার সময়ই খুচরো বিক্রেতাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকে নানা সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। মলের মডেলটা পাশ্চাত্য। বিশেষ করে আমেরিকার মতো দেশে বড় মল এবং বিরাট বড় বিক্রেতাদের পাল্লায় পড়ে খুচরো দোকানদের কী হাল হয়েছে, সে উদাহরণ সামনেই ছিল। ওয়ালমার্ট বা টার্গেটের মতো দৈত্যরা সেখানে কার্যত খুচরো বাজার দখল করে নিয়েছে। একমাত্র ছোটো ছোটো জায়গায় টিকে আছে কিছু পুরোনো ধাঁচের দোকান, যাদের বলা হয় মম-অ্যান্ড-পপ-স্টোর। বাকি সবই দৈত্যদের কব্জায়। অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন, যে, ভারতেও খুচরো বিক্রেতাদের এইরকম হালই হতে চলেছে।
কিন্তু প্রথম দফার ওই বিস্ফোরণে খুচরো বিক্রেতাদের খুব বড় সমস্যা হয়েছে বলে শোনা যায়নি। কিছু কিছু জায়গায় কিছু দোকান বন্ধ হয়েছে, কিন্তু পাইকিরি হারে বিপর্যয় কিছু হয়নি। এর অনেক কারণ থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু একটা বড় ব্যাপার হল সংখ্যা। উইকিপিডিয়ার হিসেব অনুযায়ী গোটা ভারতে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ১৮ টা মল ছিল। ভীষণ নির্ভরযোগ্য তথ্য কিছু না, কিন্তু আসল সংখ্যাটা যদি দ্বিগুণও হয়, তবে গোটা ভারতের জনসংখ্যার তুলনায় সেটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র। দ্বিতীয় বড় কারণটা হল অর্থনৈতিক মন্দা। ২০০৮ সালে আমেরিকা থেকে শুরু হয়ে বিশ্বব্যাপী মন্দা দেখা যায়। ফলে মলের সংখ্যা যে গতিতে বাড়বে ভাবা হয়েছিল, বাড়েনি।
মন্দা কাটার পর ২০১১ সাল নাগাদ শুরু হয় দ্বিতীয় বিপ্লব। মল তৈরি হতে থাকে দ্রুতগতিতে। বড়, মাঝারি শহরগুলো ছেয়ে যেতে শুরু করে মলে। একটা হিসেব পাওয়া যায়, যে, ২০১৭ সালে, গোটা ভারতে ৬০০ টার মতো মল তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এর বেশিরভাগটাই ২০১১র পরে। মলগুলো নানারকম ছিল, কিন্তু যদি কেউ ২০১১র পরের মলগুলোর একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য মনে করে দেখেন, তো মনে করতে পারবেন, এগুলো আগের মলগুলোর থেকে আলাদা। নতুন মলগুলোয় এবং পুরোনো গুলোও বদলে ফেলা হয় এমন ভাবে, যে, সেগুলো আর শুধু কেনাকাটার জায়গা নয়, সময় কাটানোর জায়গা হয়ে ওঠে। সম্পূর্ণ শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত, অজস্র রেস্তোরাঁ, খেলার জায়গা এবং অবশ্যই একটি মাল্টিপ্লেক্স। আন্দাজ করা যায়, মলের দোকানগুলো জিনিস বেচলেও, মলগুলো আসলে বিক্রি করছিল জীবনযাত্রার ধরণ। শনিবার বা রবিবার মধ্যবিত্তরা সময় কাটাতে মলে আসবে, মলগুলোই হবে গন্তব্য, এবং লোকে এসে পড়লে পয়সা তো খরচ করবেই, এইটাই ছিল লক্ষ্য।
ভারত সরকার, প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে, এই পুরো প্রক্রিয়াটার পিছনে ছিল, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এই পুরো সময়টাতেই বিক্রির ক্ষেত্রে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগের নিয়মকানুন শিথিল করা হয় এবং মলগুলোর একটা বড় অংশই ছিল বিদেশী পুঁজির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ। এরই মধ্যে ২০১৬ সালে হঠাৎ একদিনের ঘোষণায় ভারতে চালু করে দেওয়া হয় নোটবন্দী। নগদ টাকায় লেনদেন কার্যত দীর্ঘদিনের জন্য খোঁড়া হয়ে যায়। একই সময় চালু হচ্ছিল ই-কমার্সের নানা ব্যবস্থা, অ্যাপ, এবং টাকাহীন লেনদেনের নানা ব্যবস্থা। নোটবন্দীর ক্ষেত্রে কারণ দেখানো হয়েছিল, কালো টাকা উদ্ধার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কয়েকবছর পরে দেখা যায়, প্রায় কোনো কালো টাকাই উদ্ধার করা যায়নি, ফলত গোটা নোটবন্দীকেই একটা বৃহৎ কেলেঙ্কারি বলা যেতেই পারে। এই সময় সরকারকে সরাসরি দেখা গেছে অ্যাপ দিয়ে লেনদেনের পৃষ্ঠপোষকতা করতে। সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে, অ্যাপ, বড় খুচরো কোম্পানি, এবং মলগুলোর সুবিধা করে দিতেই এই সিদ্ধান্ত। শুধু এদেরই সুবিধা করে দিতে নিশ্চয়ই না, আরও অনেক সুবিধাভোগীও অবশ্যই ছিল, কিন্তু এরা যে সেই তালিকার অন্তর্গত, সে নিয়ে সন্দেহের বিশেষ অবকাশ নেই।
কিন্তু এত কিছুর পরেও মলগুলো দারুণ কিছু করে ফেলল এমন না। ২০১৫ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, দিল্লির ৯৫ টা মলের মধ্যে মাত্র ১৩টা উল্লেখযোগ্য লাভের মুখ দেখেছে। বাকিরা হয় লোকসানে চলছে, কিংবা কোনোক্রমে টিকে আছে। কারণ? শহরের কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ২০১৪ সালে একটা সমীক্ষা হয়েছিল, যে, তারা কোথায় জড়ো হতে পছন্দ করে। এক-পঞ্চমাংশ জানায় মলে। সংখ্যাটা পার্কে যেতে ইচ্ছুকদের প্রায় দ্বিগুণ। এই ৮-১৬ বছর বয়সীরা মলে ভিড় জমায় বটে, কিন্তু খদ্দের না। একই ভাবে মহিলারাও প্রচুর মলে যেতে পছন্দ করেন, কিন্তু সেটা কেনাকাটির জন্য না, মূলত সামাজিক জমায়েত, বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে ঘুরতে যাবার জন্য। ফলে লাইফস্টাইল বা জীবনচর্যার অংশ হিসেবে মলগুলো তৈরি হয়েছে ঠিকই, তাতে ভিড়ভাট্টাও চমৎকার, কিন্তু সেটা খদ্দেরের সংখ্যা বাড়ায়নি। একটা হিসেবে পাওয়া যায়, যে, ভারতীয় মলে যারা যায়, তাদের প্রতি পাঁচজনের চারজনই সিরিয়াস খদ্দের নয়।
খদ্দেররা তাহলে যায় কোথায়? এ কোনো গোপন কথা না, ভারত একটা গরীব দেশ। তার হিসেব দেবার আলাদা করে আর প্রয়োজন নেই। কিন্তু স্রেফ জীবনচর্যার জন্য কয়েকগুণ বেশি দাম দিয়ে জিনিস কেনার লোক ভারতে খুবই কম। নানা সমীক্ষাতেও দেখা যায়, লোকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কমদামী জিনিস কেনে, মলেও ছাড়েই মানুষের আগ্রহ বেশি। এবং এটাও কোনো গোপন কথা না, যে, মলের বাইরের খুচরো দোকানেই জিনিসের দাম অনেক কম। তাদের ব্র্যান্ডের মূল্য চোকাতে হয়না, পরিকাঠামোর খরচাও কম, এবং তারা দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত এক সরবরাহ ব্যবস্থার অংশ। এই খুচরো বিক্রেতাদের গোটা ব্যবস্থাটাই এত আঁটোসাঁটো এবং একই সঙ্গে স্থিতিস্থাপক, যে, এমনকি নোটবন্দীর আক্রমণেও ভেঙে পড়েনি। মলের বিক্রিবাটা বাড়ার বদলে বহুক্ষেত্রেই তারা ধারে জিনিস দিয়েছে, অনলাইন লেনদেন আয়ত্ত্ব করে নিয়েছে, এবং মানুষকে কম দামে জিনিস দিয়ে গেছে। ফলে ১৬-১৭ সালে এসে, নোটবন্দীর পরে, ব্যাপারটা প্রথম জোরালোভাবে চোখে পড়ে, যে, ভারত আর আমেরিকা একেবারেই এক না। ফেরিওয়ালা, হকার, খুচরো দোকানদাররা এখানে এমন একটা ব্যবস্থা বানিয়েছে, যা বেশিরভাগ খদ্দেরকে টেনে নিচ্ছে এবং সেই ব্যবস্থা এতই শক্তিশালী, যে এমনকি অর্থনৈতিক আঘাতেও ভাঙেনা।
২০১৮ থেকে ২০২৪, ৬ বছরেও এই পরিস্থিতি বদলায়নি। কোনো তরফেই। এর মধ্যে সরকারের তরফে বিক্রিবাটায় বিদেশী পুঁজিকে আরও উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। আবার উল্টোদিকে কোভিড এসে মলের কেনাকাটা কমিয়ে অনলাইন বিক্রি বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু এত অনলাইন কেনাকাটিতেও খুচরো বিক্রেতাদের দোকান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে শোনা যায়নি। এই ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া কঠিন, কিন্তু হকারদের এখনও যা রমরমা, তাতে কারবারে খুব বড় সমস্যা হয়েছে বলে মনে হয়না। উল্টোদিকে রয়টারের ২০২৩ সালের একট রিপোর্টে পাওয়া যাচ্ছে, ভারতবর্ষে মলগুলোর বিপুল পরিমান জায়গা ফাঁকা পড়ে আছে। মল মালিক এবং নির্মাতাদের এর জন্য বিপুল পরিমানে ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতির অংকট কম না। ৬৭০০ কোটি টাকা।
ফলে অর্থনৈতিকভাবে দুটো শত্রুশিবির এখন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে প্রবল প্রতাপান্বিত দেশী-বিদেশী পুঁজির গাঁটছড়া, যারা তুড়ি মেরে খুচরো বিক্রির বাজারটা দখল করে নেবে ভেবেছিল। কিন্তু কার্যত প্রচুর ম্যানেজমেন্ট-শিক্ষিত, বলিয়ে-কইয়ে হবার পরেও তারা বিপুল পরিমানে ক্ষতিই করে চলেছে। আর ঠিক উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আছে, হতদরিদ্র ভারতবর্ষ। চকচকে নয়, ট্যাঁকের জোর নেই, প্রভাব-প্রতিপত্তি তো নেইই। পুঁজিই আনে দক্ষতা, কর্মসংস্থান এই সব উচ্চশিক্ষিত বুলিতে তারা বিশ্বাস করেনা। কিন্তু তারপরেও তারাই টিকে শুধু নেই, মুঠোয় করে ধরে আছে, বাজারের আধিপত্য।
এই অর্থনৈতিক যুদ্ধক্ষেত্র এবং যুযুধান দুই প্রতিপক্ষ নিয়ে সন্দেহের বিশেষ অবকাশ নেই। দেশী-বিদেশী পুঁজির রাজনৈতিক প্রভাব নিয়েও সন্দেহ থাকার কথা না। এই অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গ সমেত ভারতের নানা জায়গায় হঠাৎ যে রাজনৈতিক বুলডোজারবাজি দেখা যাচ্ছে, তার সঙ্গে এই যুদ্ধের সম্পর্ক থাকাও খুবই স্বাভাবিক। হঠাৎই দীর্ঘদিন ঘুমিয়ে থাকার পর, বুলডোজাররা নইলে এমনি এমনি চলতে শুরু করেনা। কোথাও একটা সমীকরণ, যোগাযোগ আছেই। তবে আরও একটা ব্যাপারেও কোনো সন্দেহ নেই। যে, যার যতই প্রভাব থাক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক, গণতন্ত্রে প্রত্যেকের কিন্তু একটাই ভোট। সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের গায়ে হাত পড়লে গদি ওল্টানো একরকম নিশ্চিত। বুলডোজার দিয়ে ভাঙা যায়, কিন্তু ভাঙন আটকানো যায়না।