এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • হেদুয়ার ধারে - ১১৭

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৭ এপ্রিল ২০২৪ | ৩০২ বার পঠিত
  • | | | | | ৬  | ৭  | ৮  | ৯  | ১০  | ১১  | ১২  | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬  | ১৭  | ১৮ | ১৯ | ২০ | ২১ | ২২  | ২৩  | ২৪  | ২৫  | ২৬ | ২৭ | ২৮  | ২৯  | ৩০ | ৩১  | ৩২  | ৩৩  | ৩৪ | ৩৫ | ৩৬  | ৩৭  | ৩৮  | ৩৯  | ৪০  | ৪২  | ৪৩  | ৪৪  | ৪৫  | ৪৬ | ৪৭  | ৪৮  | ৪৯  | ৫০  | ৫১  | ৫২ | ৫৩ | ৫৪ | ৫৫ | ৫৬ | ৫৭ | ৫৮ | ৫৯ | ৬০ | ৬১ | ৬২ | ৬৩ | ৬৪ | ৬৫ | ৬৬ | ৬৭ | ৬৮ | ৬৯ | ৭০ | ৭১ | ৭২ | ৭৩ | ৭৪ | ৭৫ | ৭৬ | ৭৭ | ৭৮ | ৭৯ | ৮০ | ৮১ | ৮২ | ৮৩ | ৮৪ | ৮৫ | ৮৬ | ৮৭ | ৮৮ | ৮৯ | ৯০ | ৯১ | ৯২ | ৯৩ | ৯৪ | ৯৫ | ৯৬ | ৯৭ | ৯৮ | ৯৯ | ১০০ | ১০১ | ১০২ | ১০৩ | ১০৫ | ১০৬ | ১০৭ | ১০৮ | ১০৯ | ১১০ | ১১২ | ১১৩ | ১১৪ | ১১৫ | ১১৬ | ১১৭ | ১১৮ | ১১৯ | ১২০ | ১২১ | ১২২ | ১২৩ | ১২৪ | ১২৫ | ১২৬ | ১২৭ | ১২৮ | ১২৯ | ১৩০ | ১৩১ | ১৩২ | ১৩৩ | ১৩৪ | ১৩৫ | ১৩৬ | ১৩৭ | ১৩৮ | ১৩৯ | ১৪০ | ১৪১ | ১৪২ | ১৪৩ | ১৪৪ | ১৪৫ | ১৪৬ | ১৪৭ | ১৪৮ | ১৫০ | ১৫১ | ১৫২ | ১৫৩ | ১৫৪ | ১৫৫ | ১৫৬ | ১৫৭ | ১৫৮ | ১৫৯ | ১৬০ | ১৬২ | ১৬৩ | ১৬৪ | ১৬৫ | ১৬৬ | ১৬৭
    নিখিলবাবুর বাড়িতে সকাল এগারোটা নাগাদ বাঁকুড়া থেকে এক ভদ্রলোক এলেন। নিখিলবাবুর আজ দেড়টার আগে ক্লাস নেই।
    নীচে কোচিং ক্লাসের ঘরে এসে বসলেন।
    ----- ' বল শঙ্করী ... কি খবর ... চাষ আবাদ ভাল চলছে তো ? '
    শঙ্করীপ্রসাদ গুঁই ধুতি আর ফুলশার্ট পরে গায়ে একটা মাখনরঙা চাদর গায়ে দিয়ে বসে আছে।
    ----- ' বলল চাষ আর কোথায় ? শুধু আখ আর পোস্ত। আলুও তো তেমন হচ্ছে না। আপনি আবার কবে যাবেন ওদিকে ? শীতটা একটু কমলে গেলে ভাল ... বড্ড ঠান্ডা এখন ... '
    ----- ' মাসের মাঝামাঝি একবার যাওয়ার ইচ্ছে আছে। দেখি কি হয় ... অনেক কাজ আছে ওখানে ... '
    ------ ' আসুন আসুন ... আমি সব বলে কয়ে রাখব। ওখানে অনেক লোকই আপনার কথা শুনতে চায়। অসুবিধে হবে না। আপনাদের আদিবাড়ি আমাদের গাঁয়ে ... এটা আমাদের গর্ব ... '
    ----- ' লোকজন কথা শুনছে ? '
    ----- ' হ, শুইনছে ... তবে বুইঝছে কিনা জানিনা ... '
    ----- ' অ ... তা ঠিক, বুঝছে কিনা বলা মুশ্কিল ... আমাকে একবার যেতে হবে ... '
    ----- ' তা আসুন না স্যার ... আমরা কি অত বুঝাতে পারি ... তাই মনে হয় বোঝছে না ঠিক ... '
    নিখিলবাবু স্বগতোক্তি করলেন, ' বুঝছে না তা নয়, আসলে বুঝতে চাইছে না ... সাধারণ মানুষ বড় সুবিধাবাদী ... তবে তাদের মস্তিষ্কের কোষে কোষে ঢুকিয়ে দিতে হবে ভাবনাগুলো ... '
    ----- ' আজ্ঞে কি বললেন স্যার ? ' শঙ্করী বলল।
    ----- ' না, কিছু না .... আরও ভালভাবে বোঝাতে হবে আর কি ... যাব আমি শিগ্গীর ... পুরুলিয়াতেও যাবার প্ল্যান করছি ... '
    ----- ' হ, চলেন চলেন .... যদি বলেন বটে আমিও যেতে পারি ... '
    ----- ' হ্যাঁ, দরকার তো হবেই। আমি একা আর কতদিক সামলাব ? এদিক থেকেও কিছু ভাল লোক পেয়েছি। কিছু করতে পারুক না পারুক, আমার কথাগুলো বোঝার মতো অনুভূতি তাদের আছে .... এই তো কিছুদিন আগে ক'জন একসঙ্গে এসেছিল। খুব মন দিয়ে আমার কথা শুনল। একটা ইউনিভার্সিটির মেয়েও ছিল। খুব সেনসিটিভ বলে মনে হল ... '
    শঙ্করী আশাবাদী গলায় বলল, ' তা ভাল ... তা ভাল। একজন পুলিশ অফিসার ছিলেন, তিনিও যথেষ্ট অভিজ্ঞ ও চিন্তাশীল। তাছাড়া, সাগর মন্ডলের কথা তো তোমাকে জানিয়েছি ...
    ----- ' হ হ .... বুঝ্যাছি .... একবার দেখতে চাই ... '
    ----- ' হ্যাঁ ... ও একাই একশ। এরকম যদি আরও দশটা ছেলে পেতাম ... আর পিছন ফিরে তাকাতাম না ... '
    শঙ্করী চুপ করে রইল।
    নিখিলবাবু বললেন, ' অমিয় পারিয়া কেমন আছে ? একবার আসতে বোল না। অবশ্য আমি যাব কিছুদিনের মধ্যে ... '
    ----- ' হ্যাঁ বলব বলব। ওর এখন অবস্থা খুব খারাপ। জমি মরে গেছে। চাষ করে লাভ হচ্ছে না। কেই বা সাহায্য করবে ... কোনরকমে চলছে। জমির মালিকও কোন মাথা ঘামাচ্ছে না। কলকাতায় বসে আছে গ্যাঁট হয়ে।
    শুনে নিখিলবাবু বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন।
    বললেন, ' ও ... তাই নাকি ? এসব তো আমি ঠিক বুঝি না। ঠিক আছে, অমিয়র কাছ থেকে জেনে নেব ... তুমি কিন্তু সংগঠনকে বাঁধার চেষ্টাটা চালিয়ে যেও ... আমরা একদিন সফল হবই... '
    রোদের সঙ্গে জানলা দিয়ে হু হু করে ঠান্ডা হাওয়া ঢুকছে। শঙ্করী গায়ের চাদরটা খুলে আবার ভাল করে জড়িয়ে নিল।
    সে হাসিমুখে নিখিলবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, ' আমি আমার যতদূর সাইধ্য করব স্যার ... চেষ্টার ত্রুটি হবেক লাই ... ভয় জিনিসটা আমার বরাবরই কম ... '
    ----- ' হ্যাঁ পাশে থেক ... তা'লেই হবে।
    ---- ' আছি স্যার... '

    রাত্রি আর সাগর বিবেকানন্দ রোডের মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ওখানে দেখা হওয়াটা যে আগে থেকে ঠিক করা ছিল তা না। দেখা হয়ে গেল।
    সাগর আসছিল চালতাবাগানের দিক থেকে আর রাত্রি আসছিল শ্রীমানি মার্কেটের দিক থেকে। দুজনে দেখা হয়ে গেল মোড়ের মাথায়।
    রাত্রি হাসিমাখা মুখে বলল, 'কোথায় গিয়েছিলে ? '
    ----- ' এ...ই মাণিকতলায় ... একটু কাজ ছিল ... '
    কি কাজ ছিল, রাত্রি সেটা জিজ্ঞাসা করার ধার কাছ দিয়ে গেল না।
    বলল, ' ও ... ' বলে একটা মামুলি কথা বলল, ' ক'দিন ধরে বেশ ঠান্ডা পড়েছে না ? '
    ----- ' হ্যাঁ ... বিকেলের পর থেকে আরও বাড়ছে। আর ... মেরে কেটে দশ বারো দিন। তারপর এ কামড় আর থাকবে না। তুমি কি ইউনিভার্সিটি থেকে ? '
    ------ ' আগের স্টপে এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলাম একটা নোট কালেকশানের জন্য। ভাবলাম এইটুকু রাস্তা হেঁটেই চলে যাই। আমি হাঁটতে খুব ভালবাসি ... হা হা ... '
    ----- ' আমিও তাই ... চারিদিকে হাঁটি। ভাগ্যিস হাঁটছিলে, তাই তো দেখা হয়ে গেল ... আমি তোমার কথা ভাবতে ভাবতেই হাঁটছিলাম ... '
    ------ ' তাই নাকি ? কি ভাবছিলে ? ' রাত্রি ছেলেমানুষের মতো প্রশ্ন করে।
    ----- ' কি আবার ? ভাবছিলাম যে ইশশ্ ... এইসময়ে যদি তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় ... কি অদ্ভুত ঠিক তাই হল ... খুব ভাল লাগছে ... '
    বলে সাগরও একটা বালখিল্যসুলভ প্রশ্ন করল, ' তোমার ভাল লাগছে না ? '
    রাত্রি প্রশ্নটা শুনে মৃদু হাসিভরা চোখে কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে রইল সাগরের মুখের দিকে।
    ----- ' ইয়েস স্যার ... খুব ভাল লাগছে। খু..ব ভাল ... '
    উত্তম সুচিত্রার আধাবাস্তব স্বপ্নিল রোমান্টিক ফিল্মের মতো মিছরি গোলা মিষ্টি রোমান্টিক সিকোয়েন্সের সৃষ্টি হল শীতার্ত জানুয়ারির বিকেল পাঁচটা নাগাদ বিবেকানন্দ রোডের মোড়ে। এ পৃথিবীতে সবই হয়। একজনের সঙ্গে আর একজনের বয়সের তফাত প্রায় পনের বছরের।
    সাগর বা রাত্রি কেউই ব্যস্ততার লক্ষণ দেখাল না। কেউই সরে যেতে চাইছে না। কেউ কারো কাজকর্ম বা পড়াশোনার কথাও জিজ্ঞাসা করছে না। যত অকাজের কথাই ফেনিয়ে উঠছে দুজনের মনে। এই তিন চার মাসে ক'বারই বা দেখা হয়েছে দুজনের। এ তো কিশোর কিশোরীর প্রেম নয় যে অনবরত সাক্ষাতের উন্মুখতা থাকবে। বরং অসাক্ষাতের মধ্যে নিবিড় তৃষ্ণার একটা চারাগাছ সযত্নে লালন পালন করাটা বজায় থাকে। তাছাড়া রাত্রি যথারীতি স্বাভাবিক এবং স্বচ্ছন্দ হলেও সাগরের আড়ষ্টতা ভাঙেনি এখনও। সে যেন এখনও ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারেনি। স্বল্প দেখা সাক্ষাতের ফলে তার মনের তলায় অতি স্পর্শকাতর এক ইচ্ছার দীপ সন্তর্পণে জ্বালিয়ে রেখেছে। মাঝে মাঝেই হারাবার ভয়ের বাতাস লেগে সে দীপশিখা তিরতির করে কাঁপতে থাকে।
    ভাবে, তার চেয়ে দেখাশোনা কম কম হওয়াই ভাল। স্বপ্নটা তো বেঁচে থাক। পরে যা হয় হবে।
    কিন্তু রাত্রির এখন খোলামেলা হাবভাব দেখে সাগর বুকে একটু জোর পেল।
    সে বলল, ' আমার কাছে কুড়ি টাকা আছে ... '
    রাত্রি ভ্রু তুলে বলল, ' তো ? '
    ----- ' না মানে, চাচা-তে বসলে হয় না ? একটা করে ফাউল কাটলেট হয়ে যাবে ... '
    ----- ' ও ও ও ... তাই বল ... '
    সাগর তার প্রস্তাবটা সরাসরি নাকচ হবার আশঙ্কা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
    রাত্রি বলল, ' ও: ... দাঁড়াও তো ... দেখছি ... '
    বলে কাঁধের ঝোলার মধ্যে থেকে একটা পুঁচকে ব্যাগ বার করে ভিতরে আঙুল দিয়ে হিসেব করে নিয়ে বলল, ' ঠিক আছে ... হয়ে যাবে ... '
    ----- ' কি ? '
    ----- ' আমার কাছেও কুড়ি টাকার মতো আছে ... চল চল ... '
    দুজনে চাচার হোটেলে গিয়ে ঢুকল। সাগর মুখোমুখি চেয়ারে বসতে যাচ্ছিল।
    রাত্রি তার পাশের চেয়ারটা দেখিয়ে বলল, ' এখানে ব'স না ... '
    সাগর রাত্রির পাশে গিয়ে বসল। দুজনে মিলে পরামর্শ করে দুটো ব্রেস্ট কাটলেটের অর্ডার দিল।
    যে অর্ডার নিল সে কারো দিকে না তাকিয়ে বলল, ' ভেতরেও বসতে পারেন ... খালি আছে ... '
    বলে চলে গেল। 'ভেতরে' মানে, পর্দা টানা প্রেমিক যুগলের জন্য নিরিবিলি টু সিটার।
    রাত্রির বোধহয় আপত্তি ছিল না। কিন্তু সাগর বলল, ' ঠিক আছে ... এখানেই তো ভাল লাগছে...'
    রাত্রি বাধ্য মেয়ের মতো বলল, ' আচ্ছা ঠিক আছে ... '
    রাত্রি খুশি হল যে, কথাটায় আসল সাগরসুলভ দৃঢ়তার ঝলক দেখা গেল।
    রাত্রি বলল, ' টাউন স্কুলের ওখানে রামধন মিত্র লেন আছে না ... চেন ? '
    ------ ' কেন চিনব না ? ওই রাস্তা ধরে উত্তরদিকে সোজা হাঁটলে ভূপেন বোস এভিনিউতে পৌঁছে যাবে। '
    ----- ' একজ্যাক্টলি। ওখানে আমার ক্লাসমেট সঞ্চারীর বাড়ি। জয়েন্ট ফ্যামিলি। একদিন ওদের বাড়ি গিয়েছিলাম ওর মায়ের বানানো আচার খেতে। সঞ্চারী ওর জেঠুর ঘরে নিয়ে গেল। ওখানে ওর জ্যাঠতুতো দাদা, অমল না কি যেন নাম, সে গীটার বাজিয়ে শোনাল। সব রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর। কি অপূর্ব বাজায় তোমায় বলে বোঝাতে পারব না ... সুরগুলো যেন এখনও কানে লেগে আছে ... '
    সাগরের মনে এ কথাটার কোন অভিমানী প্রতিক্রিয়া ফেনিয়ে ওঠার সম্ভাবনা কিন্তু অঙ্কুরেই বিনষ্ট হল।
    রাত্রি সরল ভঙ্গীতে বলল, ' তোমাকে একদিন নিয়ে যাব সঞ্চারীদের বাড়ি। দেখবে কি দারুণ বাজায় ... '
    ----- ' তাই নাকি ? '
    ----- ' হ্যাঁ মশাই। এই তো সেদিন রূপবাণীর মোড়ে দেখা হল। সিনেমা দেখতে এসেছিল। যেতে বলল ওদের বাড়ি গীটার শোনার জন্য। আমি বলেছি সময় পেলে যাব একদিন। সঞ্চারীর মা নাকি লঙ্কার আচার বানিয়েছে ... '
    সাগর 'ভদ্দরলোক' দের মতো পরিশীলিত শব্দবন্ধে বলল, ' ইন্টারেস্টিং ! '
    রাত্রি চমকে উঠে ঘাড় ঘোরাল সাগরের দিকে।
    সাগরের কন্ঠে কিন্তু বিশুদ্ধ বিষাদ ছাড়া আর কিছু পাওয়া গেল না। ঈর্ষার কোন চিহ্ন পাওয়া গেল না।
    সাগর বলল, ' আমার তো কোন গুণই নেই। আমার জীবনে আর কি বা আছে ... '
    এরপর যা এখনও হয়নি সেটাই হল। রাত্রি তার একটা হাত সাগরের হাতে রাখল। আর একটা হাত দিয়ে সাগরের মুখটা আস্তে করে নিজের দিকে ঘুরিয়ে তার চোখে মায়াবিধূর চোখ রেখে বলল, ' তুমি তো সব গুণের আধার ... রত্নাকর ... এক মহাসাগর ... সেটা নিখিল ব্যানার্জী স্যারের চেয়ে ভাল আর কে জানে ? রতনে রতন চেনে ... '
    ওয়েটার ভদ্রলোক সস এবং স্যালাড সমেত দু প্লেট কাটলেট নামিয়ে দিল টেবিলের ওপর। চলে যাবার সময়ে আবার একবার বলল, ' ভেতরেও জায়গা আছে ... বসলে বসতে পারেন ... '

    খেতে খেতে সাগর দু একটা প্রয়োজনীয় কথায় এল। মানে, তার জন্য প্রয়োজনীয়।
    ----- ' কি করব কিছু বুঝতে পারছি না। এখন নতুন জমানা আসছে। সব কিছু যেন বদলে যাচ্ছে। এতদিন যেভাবে চলছিল সেভাবে বোধহয় আর চালানো সম্ভব নয় ... '
    ----- ' আবার এই লোকহিতকর, মানে বিপদে পড়া মানুষকে উদ্ধার করার কাজও ছেড়ে দেওয়া সম্ভব নয় .... তাই তো ? '
    রাত্রি সাগরের কথার পাদপুরণ করল।
    ----- ' হুমম্ .... অনেকটা সেইরকম। তাছাড়া এতগুলো ছেলে কোন ব্যক্তিগত স্বার্থের কথা মাথায় না রেখে আমার জন্য জান বাজি রেখেছে তাদের সঙ্গে তো বেইমানি করা হবে ... '
    ------ ' আরে শোন ... তুমি কেন বেইমানি করবে। আমি সেটা করতে দেবই না। নিখিল স্যারও তো তোমার সবটা জানেন। তিনি নিশ্চয়ই তোমাকে প্রপারলি গাইড করবেন। আর জান বাজি রাখার কথা বলছ ? আমিও তোমার জন্য জান বাজি রাখব। চিন্তা করছ কেন ? '
    ----- ' না না ... তা কখনোই করবে না তুমি। তুমি পড়াশোনা ছাড়া আর কিছু করবে না বলে দিলাম। ওটা একটা বিরাট জোরের জায়গা ... '
    ----- ' ঠিক আছে রে বাবা ... পড়াশোনা শেষ করেই করব। কিন্তু আমাদের তো কিছু একটা দাঁড় করাতে হবে, নইলে ভবিষ্যতে আমাদের চলবে কি করে ... '
    -----' হুঁ ... সেটাই তো দিনরাত চিন্তা করছি। আমার হার্ডওয়্যারের দোকানটা নতুন করে চালু করা যেতে পারে। এখন তো প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে।
    তবে ওখানে দোকান দাঁড়াবে না। এই সাইডে সরিয়ে আনতে পারলে ব্যবসা চলতে পারে। লোকালিটির ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে ... '
    ------ ' হমম্ ... '
    ওয়েটার এসে জিজ্ঞেস করল, ' চা খাবেন নাকি ? '
    ------ ' হ্যাঁ হ্যাঁ ... ' রাত্রি বলল।
    মিনিট তিনেকের মধ্যে দুকাপ চা এসে গেল।
    ওয়েটার বলল, ' আর কিছু লাগবে ? '
    ----- ' পয়সা নেই ... আবার অন্যদিন হবে ... ' সাগর চায়ে চুমুক দিল।
    বিনয়ে বিগলিত হয়ে ওয়েটার বলল, ' কি যে বলেন দাদা ... হ্যাঃ হ্যাঃ ... '
    ওয়েটার ভদ্রলোককে কেমন যেন একটু বেশি গায়ে পড়া মনে হতে লাগল রাত্রির। ভদ্রলোকের পঞ্চাশ বাহান্ন বছর বয়স হবে।
    যাই হোক, কাউন্টারে টাকা মিটিয়ে মৌরি চিবোতে চিবোতে দুজনে রাস্তায় নামল আবার।
    হেদুয়ার দিকে দেখিয়ে রাত্রি বলল, ' ওদিকে যাবে তো ? '
    ----- ' হ্যাঁ ওদিকেই ... '
    ---- ' চল হেঁটেই যাই ... এ রাস্তাটা দিয়ে হাঁটতে আমার খুব ভাল লাগে। '
    ------ ' আমারও ... এ রাস্তাটার একটা আলাদা টান আছে ... চল ... '
    পিছন থেকে কে যেন বলল, ' দাদা ... দুমিনিট সময় হবে ? '
    সাগর আর রাত্রি পিছন ঘুরল। দেখে যে ওই ওয়েটার ভদ্রলোক কিছু নিবেদনের ভঙ্গীতে তাদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
    সাগর ভদ্রলোকের কাছাকাছি গেল।
    ----- ' কিছু বলবেন ? '
    ----- ' দাদা আমার নাম অভয়চরণ পাল। স্কটিশ চার্চ স্কুলের ওদিকে থাকি ... গুলু ওস্তাগর লেনে ... খুব বিপদে পড়েছি দাদা ... '
    সাগর তার চেনা মাঠের চেনা খেলার আভাস পেল।
    সে ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল স্থির দৃষ্টিতে। রাত্রিও তাকিয়ে আছে ওর মুখের দিকে। সাগর তার নিজস্ব ভঙ্গীতে জিজ্ঞাসা করল, ' আপনি আমায় চেনেন ? '
    ------ ' এটা কি বললেন দাদা ... আপনাকে ক'জন না চেনে ? '
    ----- ' এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না ? আমি কোথাকার কে ? '
    রাত্রি পাশ থেকে ফুট কাটল, ' তুমি হলে মহাসাগর ... '
    সাগর বলল, ' যাকগে, ওসব বাজে কথা বাদ দিন .... আপনার সমস্যাটা কি ... মানে বিপদটা কিসের ? '
    ----- ' সমস্যাটা আমার মেয়েকে নিয়ে। বছরখানেক হল বিয়ে দিয়েছি। ছেলেটা খুবই খারাপ। আগে একদম বুঝতে পারিনি। শ্বশুর শ্বাশুড়িও একইরকম। নানারকম অত্যাচার তো করেই। তার ওপর আর একটা সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার আছে ওদের। ঘরের বৌকে দিয়ে টাকা রোজগারের জন্য জোর খাটাচ্ছে ঘরে লোক ঢুকিয়ে। এক অবিবাহিত ননদও আছে এর মধ্যে .... '
    রাত্রি লক্ষ করল সাগর মন্ডলের চোখের তারা স্থির হয়ে আছে অভয়চরণের মুখের ওপর। চোখমুখ পাল্টে গেল এক মুহুর্তে। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে।
    এটা মোটেই নব বরষার জলে ভেজা সাগর মন্ডল নয়।
    সে বলল, ' ঠিক আছে। আর বলতে হবে না। মেয়ের শ্বশুরবাড়ি কোথায় ? '
    ----- ' বারুইপুরে ... '
    ----- ' মেয়ে এখন কোথায় ? '
    ----- ' কোনরকমে পালিয়ে এসেছে ওখান থেকে। আমি কি যে করি ... আমার বউ খুব কান্নাকাটি করছে। মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে হুমকি দিয়ে আমাকে চিঠি পাঠিয়েছে মেয়েকে এক্ষুণি ফেরত পাঠাগার জন্য। নইলে নাকি নানা মামলায় ফাঁসিয়ে আমাদের লাইফ বরবাদ করে দেবে ... পয়সাওয়ালা লোক ওরা। ফার্নিচারের কারবার ... '
    ----- ' পুলিশকে জানিয়েছিলেন নাকি ? '
    ----- ' না ... থানা পুলিশ করার মতো বুকের পাটা আমাদের নেই। তাছাড়া লোকলজ্জার ভয়টাও একটা বড় ব্যাপার ... মানে, বুঝতেই তো পারছেন .... '
    অভয়চরণ কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কৃপাপ্রার্থীর মতো সাগরের মুখের দিকে তাকিয়ে।
    সাগর অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ আছে। এবার বলল, ' হমম্ ... বুঝতে পেরেছি। আপনি ওদের একটা চিঠি লিখুন .... লিখবেন যে আপনি আপনার মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি ফেরত পাঠাতে চান। ওনারা যেন এসে তাদের বৌমাকে নিয়ে যান ... '
    ----- ' কিন্তু ওরা তো ভীষণ ধুরন্ধর ... ওরা বলবে আমাকেই দিয়ে যেতে আমার মেয়েকে ... '
    ----- ' ঠিক আছে ... দেখুন না কি বলে ... এখন চলুন ... '
    ----- ' কোথায় ? '
    ----- ' গুলু ওস্তাগর লেনে। আপনাদের পাড়াটা দেখে আসি। আপনার পরিবারের সঙ্গেও আলাপ হবে ... '
    ----- ' কিন্তু এখন তো ডিউটি চলছে। এখন কি করে ... '
    ----- ' ঠিক আছে ... চলুন আমি ছুটি করিয়ে দিচ্ছি। আপদকালীন পরিস্থিতি বলে কথা। ছুটি দেবে না মানে ? রাত্রি এস তো ... আমরা দুজনেই যাই...তারপর যাব অভয়বাবুর বাড়ি। দুজনেই ...'
    রাত্রির চোখ আবেশে নত হয়ে এল।
    মনে পড়ল 'পথের বাঁধন'। ক'টা শব্দ যেন ঘুম ভেঙে জেগে উঠল মনে ---- পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থী.... আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী।

    ( চলবে )

    ********************************************
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | | | | | ৬  | ৭  | ৮  | ৯  | ১০  | ১১  | ১২  | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬  | ১৭  | ১৮ | ১৯ | ২০ | ২১ | ২২  | ২৩  | ২৪  | ২৫  | ২৬ | ২৭ | ২৮  | ২৯  | ৩০ | ৩১  | ৩২  | ৩৩  | ৩৪ | ৩৫ | ৩৬  | ৩৭  | ৩৮  | ৩৯  | ৪০  | ৪২  | ৪৩  | ৪৪  | ৪৫  | ৪৬ | ৪৭  | ৪৮  | ৪৯  | ৫০  | ৫১  | ৫২ | ৫৩ | ৫৪ | ৫৫ | ৫৬ | ৫৭ | ৫৮ | ৫৯ | ৬০ | ৬১ | ৬২ | ৬৩ | ৬৪ | ৬৫ | ৬৬ | ৬৭ | ৬৮ | ৬৯ | ৭০ | ৭১ | ৭২ | ৭৩ | ৭৪ | ৭৫ | ৭৬ | ৭৭ | ৭৮ | ৭৯ | ৮০ | ৮১ | ৮২ | ৮৩ | ৮৪ | ৮৫ | ৮৬ | ৮৭ | ৮৮ | ৮৯ | ৯০ | ৯১ | ৯২ | ৯৩ | ৯৪ | ৯৫ | ৯৬ | ৯৭ | ৯৮ | ৯৯ | ১০০ | ১০১ | ১০২ | ১০৩ | ১০৫ | ১০৬ | ১০৭ | ১০৮ | ১০৯ | ১১০ | ১১২ | ১১৩ | ১১৪ | ১১৫ | ১১৬ | ১১৭ | ১১৮ | ১১৯ | ১২০ | ১২১ | ১২২ | ১২৩ | ১২৪ | ১২৫ | ১২৬ | ১২৭ | ১২৮ | ১২৯ | ১৩০ | ১৩১ | ১৩২ | ১৩৩ | ১৩৪ | ১৩৫ | ১৩৬ | ১৩৭ | ১৩৮ | ১৩৯ | ১৪০ | ১৪১ | ১৪২ | ১৪৩ | ১৪৪ | ১৪৫ | ১৪৬ | ১৪৭ | ১৪৮ | ১৫০ | ১৫১ | ১৫২ | ১৫৩ | ১৫৪ | ১৫৫ | ১৫৬ | ১৫৭ | ১৫৮ | ১৫৯ | ১৬০ | ১৬২ | ১৬৩ | ১৬৪ | ১৬৫ | ১৬৬ | ১৬৭
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন