৮ই মার্চের ক’দিন আগে থেকেই খবরের কাগজের পাতায় সর্বজয়া নারীদের কথায় পড়ি। আর সেই সঙ্গে মনের গভীরে একটা সংশয়ও দানা বাঁধে, যে নারীদিবস কি তাহলে নারীকে দশভুজা হয়ে ওঠারই বিধান দিচ্ছে! সে যাই হোক, জীবনে আমরা কিন্তু কিছু নারীকে দেখতে পাই যাঁদের জীবনের কাছে এসে এইসব গড়পড়তা কথাকে থমকে যেতে হয়। এমন একজন ছিলেন, বিজ্ঞানী প্রফেসর মঞ্জু রায়, আমাদের মঞ্জু-দি, প্রয়াত হয়েছেন ২০২১ সালের জুলাই মাসে। আমার সৌভাগ্য আমি তাঁকে কাছ থেকে দেখেছি, তাঁর কথা তাঁর মুখ থেকে শুনেছি আর দুঃখ এটাই যে তাঁর কথা তাঁর জীবদ্দশায় সেভাবে লিখে উঠতে পারিনি।
স্বাধীনতার বছরেই (১৯৪৭) জন্মেছিলেন ত্রিপুরায়, পিসীর বাড়িতে। তবে নিজের বাড়ি বাংলাদেশের ময়মনসিং জেলার ‘ছরছতী’ গ্রামে। ১২ ভাইবোনের সবচেয়ে বড় দিদি। ছোটবেলা কেটেছে পরিবারের সঙ্গে লড়াই করে, পড়াশোনা / পরীক্ষা দেওয়া বন্ধ করে দেওয়ার বিরুদ্ধে, বিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে। লুকিয়ে ইস্কুলে গেছেন, মুসলিম কন্যা সেজে বোরখা পরে পরীক্ষা দিয়েছেন, পাত্রপক্ষকে ঢিল ছুঁড়ে তাড়িয়েছেন, সবই গল্পের মত। অবশেষে কলকাতায় পিসীমার বাড়িতে এসে কলেজে ভর্তি হলেন। ডাক্তারী পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন, অর্থাভাবে পড়া হয়নি। স্নাতক স্তরে ভর্তি হলেন শারীরবিদ্যায়, খরচ চালাতে দুধের ডিপোয় এমনকি পরিচারিকা হিসেবেও কাজ করেছেন। এসব কথা কোনোদিন গোপন করেননি, নিজেই বলেছেন বিভিন্ন কথাবার্তায়; আবার তেমন বিস্তারিতও বলেননি, কোনো গর্ব বা লজ্জা কিছুই ছিল না, এতটাই সহজভাবে নিয়েছিলেন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর স্তরে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে মঞ্জু রায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগে গবেষণায় যোগ দিলেন প্রফেসর অমরনাথ ভাদুড়ির কাছে। তারপর গবেষণাই করেছেন সারাজীবন। গবেষণার বিষয় ছিল ক্যান্সারের ওষুধ আবিষ্কার। ডঃ মঞ্জু রায় এবং তাঁর স্বামী ডঃ শুভঙ্কর রায় একসঙ্গে কাজ করে কর্কট রোগ বা ক্যান্সারের চিকিৎসায় মিথাইল গ্লাইওক্সাল নামক যৌগটির কার্যকারিতা প্রমাণ করেছিলেন এবং ক্যান্সারের ওষুধ হিসেবে এই যৌগটিকে সাধারণ মানুষের নাগালে আনতে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। কাজ করেছেন ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স (IACS, যেখানে সি ভি রমনও কাজ করেছেন) এবং বসু বিজ্ঞান মন্দিরে; শান্তিস্বরূপ ভাটনগর পুরস্কার সহ বহু পুরস্কার এবং সম্মানও পেয়েছেন সারাজীবনে। ৩০০-র বেশি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন এবং ৩০ এর বেশি গবেষককে পি এইচ ডি পেতে গাইড করেছেন। কিন্তু আসল কথা হল, জীবদ্দশায় তাঁর ওষুধ সারা ভারতের কয়েকশো ক্যান্সার রোগীকে সারিয়ে তুলেছে, এই মূহুর্তেও (তাঁর মৃত্যুর একবছর পরেও!) অনেকেই তাঁর ওষুধের ওপর নির্ভর করে বছরের পর বছর মোটামুটি স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন। সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছেন অনেকেই, যাঁদের বেঁচে থাকার মেয়াদ ছিল কয়েকমাস মাত্র। বহুবছর আগে একটি বেসরকারী ওষুধ কোম্পানি এই আবিস্কারটি কিনে নিতে চেয়েছিল, উনি রাজী হননি। পুরস্কার নয়, অর্থ তো নয়ই, নিজের আবিষ্কারকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়াই ছিল ওঁর স্বপ্ন। কিন্তু এখনও সেই স্বপ্ন পূর্ণতা পায়নি, আটকে আছে নানা নিয়মের বেড়াজালে।
এহেন বিজ্ঞানী তাঁর কর্মজীবনে নিজের কর্মস্থলেই চূড়ান্ত বিরোধিতা ও শত্রুতার শিকার হয়েছেন। ক্যান্সারের মোকাবিলায় তাঁর কাজকে বার বার ‘কাকতালীয়’, ‘ভুল’ এমনকি ‘মিথ্যা’ বলে প্রচার করা হয়েছে। পেশাদার চিকিৎসক না হয়েও চিকিৎসা করেছেন বলে (সেই চিকিৎসায় রোগী সুস্থ হয়ে উঠলেও!) তাঁর বিরুদ্ধে এমনকি আইনি ব্যবস্থাও নিতে চেষ্টা করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, এইসব কাদা ওঁর গায়ে লেগে আপনিই ঝরে পড়েছে। কর্মজীবনের শেষ পর্যায়ে এসে এই শত্রুতার কারণে মঞ্জুদিকে IACS-এ ওঁর সারাজীবনের গবেষণাগার ছেড়ে দিতে হয়েছে। পরোয়া করেননি, কলকাতার অপর প্রান্তে বসু বিজ্ঞান মন্দিরে নতুন গবেষণাগার তৈরি করে কাজ চালিয়ে গেছেন জীবনের শেষ দিন অবধি।
তবে এহ বাহ্য। আন্তর্জাতিক স্তরের বিজ্ঞানী হয়েও ডঃ মঞ্জু রায় সারাজীবন রয়ে গেছিলেন আদ্যন্ত একজন নারী, একজন সংসারী মানুষ, একজন প্রগতিশীল সমাজসেবী সংবেদনশীল ডানপিটে মহিলা, যে কারণে তাঁর কথা বার বার মনে করা। তাঁর স্বামী ডঃ শুভঙ্কর রায় সারাজীবন গবেষণা করেছেন কিন্তু চাকরি করেননি স্বেচ্ছায়। অর্থাৎ সংসার চালাবার উপার্জন মঞ্জুদি একাই করেছেন কিন্তু তাই নিয়ে তাঁদের দুজনের কারুরই কোনো দ্বিধা বা সঙ্কোচ ছিল না। কাজের প্রয়োজনে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়েছেন, যখন বাড়িতে থেকেছেন, দাপটে সংসার করেছেন। ওঁর কন্যা দিয়া-র কথায় বাড়িতে জমায়েত হলে ৬০-৭০ জনের রান্না মা একাই করবেন এটাই ছিল স্বাভাবিক। দুই সন্তানকে নিজে পড়িয়েছেন, সেলাই করে শাড়ি থেকে চাদর-পর্দা-পাপোশ হাতের কাজে ভরিয়েছেন, ছাদ জুড়ে বাগান করেছেন, দরকারে নৌকো চালিয়েছেন, সংসারের খুটিনাটি নজর রেখেছেন, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে রেখেছেন প্রায় সকলের জন্য। জীবনে কিছুর জন্য কিছু বাদ রাখেননি, সাফল্যের জন্য তাঁকে পুরুষ হয়ে উঠতে হয়নি, নারীত্ব তাঁর কাছে ছিল একটা উদ্যাপন এবং নারীসুলভ কোমলতা ছিল তাঁর অহঙ্কার। আত্মীয়-প্রতিবেশি কেউ অসুবিধেয় পড়লে যাকে প্রথমে ফোন করেছেন, তিনি মঞ্জুদি। তাঁর আত্মীয়-স্বজন এমনকি পাড়া-প্রতিবেশি যাঁরা গ্রামের দিকে এমনকি বাংলাদেশেও থাকেন মঞ্জুদির কলকাতার বাড়ি ছিল তাঁদের নানারকম কাজের জন্য (মূলত চিকিৎসা) এসে থাকার জায়গা। তাঁর বাড়িতে কিছু ঘর তোলাই হয়েছিল এই রকম মানুষদের জন্য। যাদের সঙ্গে ওঁর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল তাঁরা দিন ও রাতের বিভিন্ন সময়ে ওঁকে ফোন করে প্রায়ই শুনেছেন যে উনি থানায় বা হাসপাতালে বসে আছেন।
ভরসন্ধেবেলা ব্যস্ত এইট-বি বাসস্ট্যান্ডে এক যুবক মার খাচ্ছে দেখে যিনি ঝাঁপিয়ে পড়ে তার শরীরের ওপর শুয়ে পড়ে তাকে বাঁচাতে পারেন তিনি ডঃ মঞ্জু রায়, সাফল্য, ব্যর্থতা, শত্রুতা কিছুই যাঁকে সেভাবে টলাতে পারেনি। তাই কর্মরতা মহিলারা সংসারের কাজ করেন না বা প্রতিষ্ঠিত নারী উপার্জনহীন পুরুষকে বিয়ে করেন না, মেয়েদের বিরুদ্ধে এই সব অভিযোগ একটি জীবনেই নস্যাৎ করে দিয়েছেন ডঃ মঞ্জু রায়। নিজেই নিজেকে দশভূজা বানিয়েছিলেন না দশভূজা হয়েই জন্মেছিলেন, সে কথাও আমাদের পক্ষে বুঝে ওঠা অসম্ভব। মানুষ মঞ্জুদির ভালোমন্দ সবকিছু বিচারের মত ঘনিষ্ঠতা আমার সঙ্গে ওঁর ছিলনা। কিন্তু এখানে উল্লেখ করা অনেক ঘটনাই আমার চোখে দেখা এবং কিছু হয়ত চোখে দেখিনি কিন্তু শুনে মনে হয়েছে ওঁর পক্ষে এরকম কাজ করা সম্ভব।
ডঃ শুভঙ্কর রায় এবং মঞ্জুদি কেউই যে জীবদ্দশায় তাঁদের সারাজীবনের স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখে যেতে পারলেন না, এ দুঃখ আমাদের যাবার নয়। তবে বহু টালবাহানার পর কেন্দ্রীয় সরকার এই ওষুধের চূড়ান্ত পর্যায়ের পরীক্ষামূলক প্রয়োগের খরচ বহন করতে রাজি হয়েছেন এবং ‘লাইফ কেয়ার’ নামে একটি সংস্থার মাধ্যমে ওষুধটি বাজারে আসা অপেক্ষা করছে। এই অবধি মঞ্জুদিও জেনেই গেছেন। কিন্তু ওঁর হঠাৎ চলে যাওয়ার কারণে এই ওষুধের বাজারে আসার সম্ভাবনাও কমে গেছে, সেটাই সবচেয়ে বেশি দুঃখের কথা। ওঁর নিজের চলা থেমে গেছে কিন্তু আমরা যারা ওঁর সঙ্গে ছিলাম, এখনো হাঁটছি। জানিনা আরও কতটা পথ হাঁটলে তবে পৌঁছোনো যাবে।