এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ভ্রমণ  দেখেছি পথে যেতে

  • হল্যান্ডের গল্প – ৩ – অ্যানা ফ্র্যাঙ্ক এবং একটি ভাঙাচোরা আকাশ

    সুদীপ্ত লেখকের গ্রাহক হোন
    ভ্রমণ | দেখেছি পথে যেতে | ২৮ মে ২০২৩ | ১০৫০ বার পঠিত | রেটিং ৫ (৩ জন)
  • “ঠিক এই স্থানের উপর একটা গোটা অক্ষত আকাশ আর কখনো দেখা যাবে না”

    ঠিক এই কথাটাই প্রসিদ্ধ ডাচ শিল্পী ও লেখক জ্যান ওয়াকার্স শেষের একটি বাক্যে লিখে দিয়েছিলেন অ্যামস্টারড্যামের আউশভিৎস মেমোরিয়ালের পাশে একটি ফলকে। পুরো লেখাটা পড়ার পরেও দৃষ্টি ঝাপসা হয়েছিল কি? বলতে পারি না, কারণ গত পঞ্চাশ বছরে আমরা পৃথিবী জুড়ে আরও অনেক রকম, অনেক ধরণের পাশবিক নৃশংসতা দেখে ফেলেছি আর এখনো দেখে চলেছি প্রতিনিয়ত ‘মানুষ’ নামের প্রাণীটির হাত ধরে, এবং একই প্রজাতির প্রাণী হওয়ায় সে কালিমা আমাদের শরীরেও লেগেছে, লাগছে।

    নেদারল্যান্ডস বা হল্যান্ডের কথা বললে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা তো মাথায় আসেই, তার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায় অ্যানা ফ্র্যাঙ্কের কথাও।  ক্লাস সেভেন বা এইটে কোনোভাবে হাতে এসেছিল সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনবদ্য অনুবাদে ‘আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরী’। আমারই বয়সী একটি মেয়ে, যে বয়সে আমরা স্কুলে যাচ্ছি, ক্রিকেট-ফুটবল খেলছি, কেউ আঁকছি, কেউ গান গাইছি, কেউ বা তবলায় হাত পাকাচ্ছি, সেই বয়সেই, অ্যানা নামের একটি মেয়ে লুকিয়ে পড়েছে অন্ধকার ঘরে, বাইরে বেরনো বন্ধ, স্কুলে যাওয়া, বন্ধুদের সাথে দেখা করা, খেলাধূলা, এমনকি গান-বাজনা পর্যন্ত বন্ধ, পাছে কেউ দেখে না ফেলে, পাছে কেউ শুনে না ফেলে। বাড়ির বাইরে থেকে বোঝার কোনো উপায় নেই যে ভেতরে কয়েকটা গুপ্ত ঘরে লুকিয়ে রয়েছে আটটা তাজা প্রাণ (ডুসেল, আরেক প্রতিবেশী  অবশ্য পরে যোগ দেন)। পড়তে পড়তে আনা-র সঙ্গে যেন আমিও ঢুকে পড়েছিলাম সেই গুপ্ত কক্ষে, ভাগ করে নিচ্ছিলাম অজানা আশঙ্কার মুহূর্তগুলো! সে-কথায় পরে আসি আবার।

    অ্যানা ফ্র্যাঙ্কের বাড়ি এখন একটি মিউজিয়াম, তার টিকিট-ও সেই অনলাইনেই কেটে নিতে হল অনেক চেষ্টা-চরিত্র করে, অবশেষে সেই দিন এল। যথারীতি সকাল থেকেই বৃষ্টি, আমার টিকিট বিকেল সাড়ে চারটেয়, তবে এখানে ভ্যান গঘ মিউজিয়ামের মত সময়ের চাপ নেই, রাত দশটা অবধি খোলা। সেইমত আবার চলে এলাম অ্যামস্টারড্যাম সেন্ট্রাল, ততক্ষণে আবার বৃষ্টি কমে গিয়ে আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার, রোদ উঠে গেছে। এখান থেকে মিনিট কুড়ি হাঁটা, দেড় মাইল মত। তবে এবার সরাসরি গন্তব্যে না গিয়ে এখানকার ওল্ড চার্চ দেখে নেবো ভাবলাম। প্রথমে সেন্ট্রাল স্টেশনটাই পুরোটাকে দেখলাম একটা ক্যানাল পার করে বঁদিকে সরে এসে তার অপর পার থেকে। রঙের দিক থেকে আমাদের হাওড়া স্টেশনের সাথে বেশ মিল, তবে দেখতে খুবই সুন্দর। অথচ হাওড়া স্টেশনের সামনেও গঙ্গা রয়েছে, নৌকোয় বা লঞ্চে করে গেলে কিছু কিছু জায়গা থেকে দেখতে তো ভালোই লাগে, কিন্তু মূল পার্থক্য চারপাশের এলাকা আর গঙ্গার ঘাটগুলোর পরিচ্ছন্নতা, আর তার সাথে জনঘনত্বের সমস্যা তো আছেই! বিকেলে হাল্কা কিছু খাবার খেয়ে নেবো ভেবে আজ গেলাম এখানকার বিখ্যাত মানেকিনপিস ফ্রাই খেতে, বস্তুটি কিছুই নয়, চাট্টি মোটা মোটা করে কাটা ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, দেওয়ার সময় উপরে খানিক মেয়োনিজ ছড়িয়ে দেয়, খেয়ে বুঝলাম, অতীব ওভার-হাইপড একটি বস্তু! 
     
    অ্যামস্টারড্যাম সেন্ট্রাল স্টেশন



     
    এখান থেকে এগোতে থাকি গুগল ম্যাপ দেখে, প্রায় আধ কিলোমিটার চলার পর একটা ক্যানালের  ডানদিকে চোখে পড়ল ওল্ড চার্চের বিশাল অবয়ব। ত্রয়োদশ শতকে তৈরী এই স্থাপত্য অ্যামস্টারড্যামের সবচেয়ে পুরনো বাড়ি। প্রথমে পাশ থেকে দেখছিলাম পুরো চার্চটাকে, কিন্তু এত সুন্দর যে বুঝতেও পারি নি, পরে পাশ থেকে একটা লম্বা চুড়ো উঁকি দিতে মনে হল, আরও খানিকটা ঘুরে সামনে যেতে হবে। গিয়ে দেখলাম, ঠিক তাই, এতক্ষণ পাশ থেকেই দেখছিলাম বটে। মজার ব্যাপার হল, চার্চের ঠিক পাশ দিয়ে ঘুরে গেলেই অ্যামস্টারড্যামের পৃথিবী-বিখ্যাত রেড লাইট ডিস্ট্রিক্ট (এখানকার দেহ-ব্যবসা একেবারে আইনতঃ সিদ্ধ)। তা লোকজন শুধু ধর্ম নিয়েই বা থাকবে কেন, শরীরও রাখতে হবে বৈকি! এ-কথায় মনে পড়ল, হল্যান্ডে গাঁজা বস্তুটিও আইনতঃ সিদ্ধ। আর আমার মত অধূমপায়ীর কিছুটা পীড়ার বিষয় অ্যামস্টারড্যামের  রাস্তা, অলিগলি জুড়ে বিরাজমান গাঁজার গন্ধ! চোখ-কান খোলা রাখলে এমনকি আপনার হাতে-হাতেও রাস্তায় চলতে চলতেই বিকিকিনি করে ফেলতে পারেন ও-বস্তুটির, এতটাই সহজলভ্য। সেই যে প্রথম পর্বে বলেছিলাম কফিশপের কথা। এই কফিশপগুলি আসলে হল এখানকার গাঁজার আড্ডাখানা, বেশ রমরমিয়ে চলছে আইন মেনে, চোখের সামনেই দেখি একে অন্যকে ছোটো ছোটো প্যাকেট বাড়িয়ে ধরছে, কেউ মশলা বানাচ্ছে নিকোটিনের সাথে মিশিয়ে, কেউ বা কলকে ভাগ করে নিচ্ছে, মনের সুখে টান দিচ্ছে আর ভকভকিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে রাস্তা ঢেকে দিচ্ছে! এ-ও এক দেখার বস্তু বটে! 
     
    ওল্ড চার্চ - পাশ থেকে

     
    ওল্ড চার্চ - সামনে থেকে

     
    একটি শপিং মলের ছাদে

     

     
    বললে পেত্যয় যাবেন না, এটি একটি ক্যাফে!! 

     
    ম্যাগনা প্লাজা - একটি শপিং মল ও তার সামনে ট্রাম 

    যাক, ঘড়িতে চারটে বাজতে দেখে এবার রওনা দেওয়া গেল অ্যানা ফ্র্যাঙ্ক হুইস তথা অ্যানা ফ্র্যাঙ্কের বাড়ির দিকে। নানা অলি গলি পার হয়ে, ক্যানাল পার হয়ে অবশেষে এসে পৌঁছোলাম সেই বাড়ির সামনে! কিন্তু বই-তে পড়া সে-বাড়ি কই! এ যে দেখি ঝাঁ চকচকে একখানা তিন-চারমহলা বাড়ি, কিছুটা অংশ সুন্দর কাঁচে ঢাকা, ঝকঝকে প্রবেশপথ আর তার সামনে ছোটো একটা ভিড়, দু-চারজন রক্ষী ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভেবে উঠতে পারলাম না এ-বাড়ির বয়স কি করে শতাধিক হতে পারে! টিকিট স্ক্যান করিয়ে ভিতরে ঢুকে জ্যাকেট ইত্যাদি সব জমা দিয়ে অডিও জ্যাক কানে গুঁজে মিউজিয়ামের চৌহদ্দি-তে ঢোকা গেল। এখানে ফোটোগ্রাফি নিষিদ্ধ। 
     
    মিউজিয়ামের এক-একটি ঘর পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গল্প এগোতে থাকে। অডিও যন্ত্রের সাথে আছে একটা স্ক্যানার আর প্রতিটি ঘরে একটি নির্দিষ্ট স্থানে সেটি স্ক্যান করলেই কানে বাজতে থাকে সেই ঘরের সংগ্রহ বিষয়ে বিশদ বর্ণনা। তবে সব গল্প বা বর্ণনাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, অ্যানা আর তার পরিবারকে ঘিরে। প্রথম ঘরেই রয়েছে কিশোরী অ্যানার একটি ছোট্টো পূর্ণাবয়ব ভাস্কর্য, এরপরের ঘরে ঢুকলেই ঘরের দু-দিকের দেওয়াল জোড়া অ্যানার বিভিন্ন রকমের ছবি ফুটে উঠছে ডিজিটাল পর্দায়, তারপর এক-একটি ঘরে কখনো মার্গট, কখনো সপরিবারে অ্যানা, কখনো তাঁদের পারিবারিক বন্ধুরা যাঁরা ছিলেন তাঁদের গোপন আস্তানার শরিক, তাঁদের ছবি ও গল্প চলতে থাকে, সঙ্গে বেজে উঠতে থাকে নাৎসিদের (বা নাজি-দের) হিংস্র যুদ্ধ-দামামা, তৈরী হতে থাকে ভয়ের বাতাবরণ, চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে একটা প্রাণোচ্ছল শহরের জীবন কিভাবে থমকে যেতে থাকে, গুটিয়ে যেতে থাকে ভয়ে, দুশ্চিন্তায়, অনাহূত মৃত্যুর হাতছানিতে, গেস্টাপো আর নাজি-বাহিনীর ইহুদী-বিদ্বেষী ফতোয়ায় (যেমন জামায় ছটা হলুদ তারা লাগানো, শুধুমাত্র ইহুদী দোকান থেকেই ইহুদীরা জিনিস কিনতে পারবে, গাড়ি-ঘোড়াও চড়া যাবে না এরকম সব)। একটি ঘরে কাঁচের শো-কেসে সাজিয়ে রাখা অ্যানার মার্বেল রাখার টিনের বাক্স, রঙ-বেরঙের মার্বেলগুলো-ও রয়ে গেছে এত বছর, অ্যানার হাতের স্পর্শ আছে ওদের গায়ে, ওরা কি আজ-ও মনে রেখেছে ফেলে আসা দিনগুলির কথা!
     
    অটো ফ্র্যাঙ্কের পরিবার প্রথমেই অ্যামস্টারড্যামের এই বাড়িতে থাকতেন না, মার্গট অর্থাৎ অ্যানার দিদির কাছে এইসময় চিঠি আসে অবিলম্বে নাজি জার্মানীতে কাজে যোগ দেওয়ার  আর তারপরেই অটো ফ্র্যাঙ্কের নামে শমন জারি হয়। দেরী না ক’রে অটো ফ্র্যাঙ্ক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন আত্মগোপনের। অবশেষে ১৯৪২ এর ৬ই জুলাই সপরিবারে এই বাড়িতে উঠে আসেন তাঁরা। সপ্তাহখানেক পরে সঙ্গী হলেন পড়শী ফান ডানের পরিবার। পরে এঁদের সাথে যোগ দেবেন ডুসেল। অটো ফ্র্যাঙ্ক প্রথম জীবনে ব্যাঙ্কিং এর ব্যাবসায় থাকলেও পরে অর্থমন্দায় সে ব্যাঙ্ক বন্ধ হয়ে যায়, এরপর তিনি শুরু করেন মশলার ব্যবসা। এই বাড়িই ছিল সেই ব্যবসার অফিস আর তারই ভিতর দিকের অলিন্দে প্রস্তুত করা হয়েছিল এই গুপ্ত কক্ষগুলি।
     
    “আদরের কিটি,
    রবিবার থেকে আজ – এই কয়েকটা দিন মনে হল যেন কয়েকটা বছর। কত কিছু যে ঘটে গেছে এর মধ্যে। গোটা পৃথিবীটা যেন মাটিতে উলটে পড়েছে। কিন্তু এখনো আমি প্রাণে বেঁচে রয়েছি , কিটি, বাবার মতে, সেটাই বড় কথা।“
    ৮ই জুলাই অ্যানা ফ্র্যাঙ্ক লিখেছিল তার ডায়রীতে, তাদের গোপন আস্তানায় বসে; ডায়রীকে-ই সে কিটি বলে সম্বোধন করছে কিনা তা নিশ্চিত নয়, তবে সুভাষ মুখোপাধ্যায় এমনটাই মনে করেছেন। নীচের এই ছোটো হলগুলো পার হয়ে যখন প্রথম সিঁড়িতে পা রাখলাম, শিউরে উঠলাম মনে হল, এখান থেকেই অ্যানা-দের লুকিয়ে থাকার গন্তব্যে যাওয়ার রাস্তা শুরু তবে! সরু কাঠের সিঁড়ি, কোনোমতে একজন-ই যেতে পারে। উপরে আরও দুটো ঘর ঘুরে একটা সরু অলিন্দ পার হতেই খানিকটা খোলা জায়গা, আর সামনেই সেই বিখ্যাত বুক-কেস দেখতে পেলাম। এর পিছনেই আটটা প্রাণ প্রায় বছর দুই লোকচক্ষুর আড়ালে নিজেদের লুকিয়ে ফেলেছিল, যতদিন না ১৯৪৪ এর ৪ঠা আগস্ট তাঁরা ধরা পড়েছিলেন নাজি বাহিনীর হাতে।
     
    বুককেসের পিছন দিয়ে ঢুকতেই আলো-আঁধারির জগৎ, এ-জগৎ অ্যানা-র ডাইরির দৌলতে খুব-ই চেনা! প্রথমেই বাঁহাতে ফ্র্যাঙ্ক পরিবারের বসার ঘর, তারপরেই মার্গট আর অ্যানার ঘর, একচিলতে ঘরে তাদের খাট দুটো এখনো বিদ্যমান, এইটুকু ঘরে দুই কিশোরীর দিনযাপন, যেখানে একজন নিঃশ্বাস নিলে আর একজনের গায়ে এসে লাগবে – ভাবলে অবাক হতে হয়! এর পাশের একটা ছোটো ঘরে বেসিন আর শৌচাগারের ব্যবস্থা; পাশের সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলে বেশ প্রশস্ত একটা ঘর, এখানে রয়েছে রান্নার ওভেন, সিঙ্ক, বসার জায়গা। এটা নাকি আগে ছিল একটা ল্যাবরেটরি। মশলাপাতি ইত্যাদি রাখার ভাঁড়ার ঘর-ও রয়েছে। ঘরগুলোর ভিতর দিয়ে হাঁটার সময় মচমচ আওয়াজে অদ্ভুত এক বাতাবরণ তৈরী হচ্ছিল – যেন এই বুঝি অ্যানা বা মার্গট দৌড়ে গেল পাশ দিয়ে! এই কাঠের মেঝের উপর দিয়ে কত না ঝড়-ঝাপটা বয়ে গেছে! এই সব ঘরের হয় জানলা নেই, নয়ত গাঢ় রঙ দিয়ে ঢাকা, যাতে বিন্দুমাত্র আলো বাইরে না যায়। এরপর ফান ডান দম্পতির ঘর আর পিটারের ঘর। এরপর চিলেকোঠার একটা সিঁড়িও সংরক্ষণ করা হয়েছে কাঁচের আবরণে। তারপর নেমে আসার পথে অ্যানা ফ্র্যাঙ্কের আসল ডায়রী, তার কিছু পাতার লেখা, ফ্র্যাঙ্ক পরিবারের নানা বইপত্র, চিঠি যা ১৯৪৪ এর ৪ঠা আগস্ট নাজি বাহিনী অবহেলায় ছুঁড়ে ফেলে গিয়েছিল তারই কিছু জিনিসের সংগ্রহ। মিপ আর এলি, ফ্র্যাঙ্ক পরিবারের দুই পরিচিত ও কর্মী এগুলি আবিষ্কার করেন, পরে তাঁরা অটো ফ্র্যাঙ্ক কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে মুক্তি পেয়ে ফিরে এলে তাঁর হাতে তুলে দেন। এডিথ, মার্গট আর অ্যানা অবশ্য আর ফিরতে পারেননি কোনোদিন, কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পেই একে একে অতি-পরিশ্রমে, অনাহারে, অপুষ্টিতে তাঁদের মৃত্যু হয়! একরাশ মন খারাপ নিয়ে স্যুভেনির শপ থেকে একটা স্মৃতি-পুস্তিকা কিনে যখন নামছি, তখন-ও মনে পড়ছে অ্যানার ডায়রীর কথা –
    “ওরা যেন জানতে না পারে যে আমি হাল ছেড়ে দিয়েছি; ওদের তৈরী ক্ষতগুলো ওরা যেন দেখতে না পায়, ওদের সমবেদনা আর দয়ালু চিত্তের পরিহাসগুলো আমার সহ্য হবে না, বরং তাতে আমার আরও ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করবে…”
    বাকেট লিস্ট? হ্যাঁ, অ্যানা ফ্র্যাঙ্কের বাড়ি তার মধ্যে পড়বে তো বটেই, কিন্তু এ-স্মৃতি সুখ বা দুঃখের নয়, এই স্মৃতি অহরহ নিজেকে, নিজেদের মনে করিয়ে দেওয়ার যে, আর কোনো অ্যানা ফ্র্যাঙ্ক-কে এমন অজ্ঞাতবাসের গুপ্ত অলিন্দে বসে ডায়রীতে মনের কথা জমিয়ে না রাখতে হয়, একমুঠো খোলা আকাশ যেন তার কাছ থেকে কেউ, কোনো ফ্যাসিস্ট শক্তি আর কোনোদিন ছিনিয়ে না নিতে পারে!
     
    ক্যানালের সামনে থেকে - অ্যানা ফ্র্যাঙ্কের বাড়ি, এই লাল ইঁটের অংশটুকু নতুন মিউজিয়ামের লাগোয়া - এটুকু রাখা আছে এখনো 

     
    এদিকে অ্যানার বাড়ির প্রবেশপথ,দেখে বোঝা দায়! 

     

    ২০, ওয়েস্টারমার্খট ঠিকানা থেকে বেরিয়ে দেখলাম ছটা বাজে, এখানে আলো মোটামুটি আটটা পর্যন্ত ভালোই থাকে; ঠিক করলাম আউশভিৎস মেমোরিয়াল আর হলোকাস্ট মেমোরিয়াল দেখে আসব। ম্যাপে দেখে নিলাম, আধ ঘন্টা মত হাঁটলে পৌঁছে যাব। চলতে শুরু করলাম, ড্যাম স্কোয়্যার পার হয়েই রাস্তা, আসার পথে বাড়িগুলো আরও একবার দেখে নিলাম, এ-যাত্রায় এই পথে আর আপাততঃ আসা হবে না। দু-তিনটে ক্যানাল পেরোনোর পর রাস্তাও বেশ ফাঁকা হয়ে এল, শহরের ভিড়-ভাট্টার বাইরে এই এলাকা। ঠিক মিনিট পঁচিশ পরেই দেখা পাওয়া গেল সেই পার্কের, ওয়ারথিমপার্ক; বাঁদিকের খোলা অংশ দিয়ে সরাসরি পার্কে ঢুকলাম বটে, ম্যাপেও দেখাচ্ছে পৌঁছে গেছি, কিন্তু কিছুই দেখতে পাই না, কোথাও কোনো ভিড় নেই, দু-একজন কুকুর নিয়ে পার্কে ঘুরছে, বেঞ্চে বসে আছে দু-একজন, ব্যস! বাঁদিকে ধরেই হাঁটতে শুরু করলাম, একটু পরেই অবশ্য দূর থেকে চোখে পড়ল কাঁচের মেমোরিয়াল। কিছুটা অযত্ন-রক্ষিত কি? সামনে দাঁড়িয়ে থমকে গেলাম! একটা কাঁচের বড় ফলকে ডাচ বা ওলন্দাজ ভাষায় লেখা রয়েছে ‘NOOIT MEER AUSCHWITZ’ অর্থাৎ ‘NEVER AGAIN AUSCHWITZ’। তার ঠিক সামনেই মাটির উপরেই একটি প্রশস্ত জায়গায় বড় ফ্রেমের নীচে রাখা আউশভিৎস থেকে আনা কিছু হতভাগ্যের চিতাভস্ম। আর চারপাশে ফুল রেখে গেছে কেউ, সারি দিয়ে পাথর সাজিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে গেছেন মানুষ। অবাক হলাম দেখে, এই ফ্রেমের কাঁচের নীচে একটি কাঁচের আস্তরণ রয়েছে যেটি অনেক জায়গায় ফেটে গেছে, চিড় ধরে গেছে। মনে হল, হয়ত কোনো ভাবে ফাট ধরেছে বা অনেকদিন রক্ষণাবেক্ষণ হয় নি, চারপাশে দ্বিতীয় প্রাণীও নেই, আমি আর কয়েকটা পায়রা আর ঘুঘু বাদ দিলে। তার পরেই পাশের দাঁড়িয়ে থাকা ফলক চোখে পড়ল। পড়তে গিয়ে টের পেলাম, চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে। লেখা টা এখানে থাক, এর ছবি খুব ভালো করে তুলতে পারি নি। একটি জ্যান ওয়াকার্স-এর এই স্মৃতিসৌধ নির্মাণ নিয়ে লেখা, অপরটি জিউ বা ইহুদী-দের উপর নাজি জার্মানীর অত্যাচার নিয়ে -
     
    জ্যান ওয়াকার্স লিখছেন –
    “Designing a memorial for the spot where the urn containing the ashes of victims of Auschwitz rests in Dutch soil, seems an impossible task. How do you find a form to mark a crime you know will never be erased – not in two, or even two thousand centuries from now, when our planet has ceased to exist? You rack your brains to conceive of an image that might convey the ignominy and suffering. You look up at the sky and cannot understand how the blue firmament could have stretched so serenely and indifferently above such horror, as though it were nothing but a field of flowers. And in a vision of justice, you see cracks appearing in that impassive blueness, as if the atrocities committed on the earth below have violated eternity forever. That is what gave me the idea of placing broken mirrors on that small patch of earth above the urn of ashes. Never again, on this spot, will the sky be whole.”
    অপর ফলক থেকে জানতে পারি, লক্ষাধিক জিউ-কে হল্যান্ড থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বিভিন্ন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। যার মধ্যে মাত্র পাঁচ হাজার জিউ বেঁচে ফিরে আসতে পেরেছিলেন পরবর্তীকালে! সবিবর ক্যাম্পে যে চৌত্রিশ হাজার জিউ-কে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, মাত্র ১৯ জন ফিরেছিলেন।
     
    আউশভিৎস মেমোরিয়াল 

     

     
    জ্যান ওয়াকার্সের কথা 

     
    জিউ-দের কথা 

    এসব তো ইতিহাস বলে, শেখায়। কিন্তু তারপরেও উপমহাদেশে দেশভাগ আসে, আসে ভিয়েতনাম, আসে ইরাক, আফগানিস্তান, প্যালেস্তাইন – লক্ষ লক্ষ মানুষের নিপাত ঘটে ধ্বংস ঘটে, মানুষের নির্মমতা সীমা ছাড়ায়- আমরা দেখি, রাগি, দুঃখ করি, আলোচনা-প্রতিবাদ করি, তারপরেও আমাদের আকাশ সম্পূর্ণ থাকে কোনো ভাঙাচোরা ছাড়াই। ইতিহাসকে বদলে দেওয়া আর তাকে সেভাবেই শিখে নেওয়া – সেও আমরা রপ্ত করে ফেলছি দিনে দিনে। ডারউইন আমাদের রক্তে ঢুকিয়ে দিয়েছেন অমোঘ শিক্ষা – ‘survival of the fittest’!
    পা সরছিল না, তবু একটা পাথর সাজিয়ে দিলাম স্মৃতিফলকের পাশে, পায়ে পায়ে পার্ক থেকে বেরিয়ে একটু এগিয়ে হলোকাস্ট মেমোরিয়ালে গিয়ে দেখি মেরামতির কাজের জন্যে আপাততঃ বন্ধ আছে কিছুদিন। মনে হল, ভালো-ই হল, হৃদয়ের-ও তো সহ্যের ক্ষমতা আছে, একদিনের জন্যে যথেষ্ট হয়েছে। ফেরার পথে ড্যাম স্কোয়ারে এসে উপরে দেখলাম ঘন নীল আকাশ কোথাও ছেদ নেই, অসম্পূর্ণতা নেই! হঠাৎ কোথা থেকে একঝাঁক পায়রা উড়ে এসে ছিন্নভিন্ন করে দিল সব, নীল আকাশকে ভেঙেচুরে দিয়ে আবার মিলিয়ে গেল প্যালেসের ওপাশে! ভাঙাচোরা আকাশের নীচে চলতে চলতে মনে পড়ে শঙ্খ ঘোষ -
     
    “এক মরণের থেকে আরেক মরণে যেতে যেতে
    আমার আমির থেকে জেগে ওঠে আরো আরো আমি
    আমিই শতাব্দী আমি আদিঅন্তহারা মহাদেশ
    আমি এই শতাব্দীর শহিদশিখর থেকে বলি
    মৃত্যুর ভিতরে আজ কোথাও মৃত্যুর নেই লেশ
    দেখো এ মৃত্যুর মধ্যে কোথাও মৃত্যুর নেই লেশ”
     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ভ্রমণ | ২৮ মে ২০২৩ | ১০৫০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • kk | 2601:14a:502:e060:473e:172a:e809:***:*** | ২৮ মে ২০২৩ ২৩:১৩520093
  • বাঃ
  • সুদীপ্ত | ২৯ মে ২০২৩ ১৯:২৭520101
  • ধন্যবাদ কে কে! 
  • সুকি | 165.225.***.*** | ২৯ মে ২০২৩ ১৯:৫০520102
  • আপনার হল্যান্ড/আমষ্টারডাম নিয়ে লেখা খুব ভালো লাগছে। অনেক দিন এই দেশে (আনা ফ্র্যাঙ্ক মিউজিয়ামের পাশেই থাকতাম) বসবাস করেছি বলে অনে কিছু মনে পড়ে যাচ্ছে। আরো লিখতে থাকুন। 
  • | ২৯ মে ২০২৩ ২০:৪৬520104
  • বড় ভাল লাগল। 
    আমি আনা ফ্রাঙ্কের ডায়রি বাংলায় পড়ি নি আর পড়েওছি বেশ বড় হয়ে। অনার্স পার্ট ট্যুএর সময়। পরে গ্রান্ডের নীচের ফরেন বুক স্টোর থেকে একটা মেরুণ রেক্সিনে বাঁধানো কপি কিনেছিলাম। তার মলাটে আনার হাসিহাসি মুখের ছবি ছিল না। 
    ওই ভেতরে ঢুকে বেরোবার পরে আরএ গিয়ে  কোথাও যেতে পারি নি। স্টেশান গিয়ে বসে ছিলাম ব্রাসেলসের।ট্রেনের জন্য।
  • সুদীপ্ত | ৩০ মে ২০২৩ ১৩:০৬520138
  • ধন্যবাদ সুকি!  নিমো গ্রামের গল্প কি আপনার? বড় ভালো লেগেছিল , বইটাও!  চরিত্র-গুলো আমাদেরই চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে,খপ করে ধরে ফেললেই হল smiley
     
    থ্যাঙ্কিউ দমদি , হ্যাঁ ইংরাজী অনুবাদ আমিও পরে পড়েছি , সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদটা বেশ ভালো ছিল। তবে তখন লাইব্রেরি (স্কুলের বা পাড়ার) থেকে নিয়ে পড়েছিলাম।  ওখানে থেকে বেরিয়ে মন তো খারাপ ছিলই,আর আউশভিৎস মেমোরিয়ালের ঐ লেখাটা খাঁড়ার ঘা!  
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল প্রতিক্রিয়া দিন