অতঃপর এঁদের প্রশ্নমালা গড়ায় কী চাকরি করি, বেতন কত ইত্যাদিতে। বাধ্য হয়ে বলতে হল এত ব্যক্তিগত প্রশ্ন পছন্দ করছি না। ইতোমধ্যে ট্রেনের রানিং স্ট্যাটাস দেখাচ্ছে ট্রেন ঢুকবে ৪.৫০এ, নির্ধারিত সময়ের আধঘন্টা পরে। এক ভদ্রমহিলাও এসে আলাপ জমান, বদরপুরের কোনও এক হাসপাতালের নার্স। লম্বা সপ্তাহান্তের ছুটিতে বাড়ি এসেছিলেন। লেটের পরিমাণ আধঘন্টায় নেমে আসায় সকলেই খানিক নিশ্চিন্ত। সিগনাল হয়, প্ল্যাটফর্মে আরো দু’চারজন আসছেন আস্তে আস্তে। তবে মাইকে কোন ঘোষণা নেই, টিকিট কাউন্টারও বন্ধ। আমার টিকিট সেকেন্ড এসি, সে কামরা প্ল্যাটফর্মের কোথায় পড়বে কে জানে!
৪.৫৫ নাগাদ হুড়মুড়িয়ে ঢুকল ট্রেন। মোটামুটি মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে ছিলাম এওয়ান কামরা দেখি সাঁইসাঁই করে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। মোটে ৫ মিনিট দাঁড়াবে - দে দৌড় দে দৌড়। কামরার সামনে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো টিকিট পরীক্ষক ব্যস্ত হয়ে জিগ্যেস করলেন ‘তিরিশ তিরিশ?’ আমার এক সেকেন্ডের জন্য মনে হল নাহ বার্থ নম্বর বোধহয় অন্য কিছু, তাও বললাম হ্যাঁ হ্যাঁ, সাথে নামটাও। উনি বললেন আরে ৩০ আপার বার্থ আছে আপনি ৪৭ নম্বরে চলে যান ওইটে লোয়ার। তখন দেখি দরজায় আরো একজন দাঁড়ানো, তিনি একটু পিছিয়ে ওঠার জায়গা দিলেন। সেই তিনিই আগে আগে গিয়ে ৪৭ নম্বর আসন থেকে নিজের ব্যাগ ইত্যাদি নিয়ে পাশের কামরায় চলে গেলেন। সিটের নীচেটা বিলকুল জ্যাম হয়ে আছে দুটো ব্যাগ আর স্যুটকেশ ত্যাড়াব্যাঁকা করে রাখায়। গদাম গদাম করে সেসব ঠেলে কোণায় পাঠিয়ে জায়গামত ব্যাগ ট্যাগ ঢুকিয়ে বালিশ কম্বল টেনে শুয়ে প্রায় সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়লাম। কিন্তু যাঁর নামে ৪৭ নম্বর আসনখানি বরাদ্দ ছিল তিনি গেলেন কোথায়? নাকি তিনিও রেলের কর্মচারি, খালি আসনে বসেছিলেন। যাই হোক না কেন টিকিট পরীক্ষকের এই অযাচিত উপকারে খুবই খুশী হলাম, বলাই বাহুল্য।
সকাল ৮.৫০ নাগাদ ট্রেন হেলেদুলে শিলচরে ঢুকল, ওই ৩০ মিনিট লেট আর কভার হয় নি। যাইহোক সে তেমন কিছু না, নেমে দেখি সামনে খাড়া ওভারব্রিজ। কোনোদিকে কোনো লিফট বা এসক্যালেটর আছে কিনা খবর নিয়ে যাই নি, এদিকে এক সাধারণ পোষাকের মালবাহক সমানে ঘ্যানঘ্যান করছে তাকে ব্যাগগুলো দেবার জন্য। অগত্যা তাকেই বললাম আইজলের গাড়ি যেখান থেকে ছাড়ে সেখানে যাবো। আমার কেন যেন ধারণা হয়েছিল স্টেশন থেকেই আইজলের গাড়ি পাওয়া যাবে। দেখা গেল তা নয়, আইজলের গাড়ি ছাড়ে সার্কিট হাউসের সামনে থেকে, ওইখানেই মিজোরাম ভবন থেকে সরকারের তরফে ইনার লাইন পারমিট ইস্যু করা হয়।
মালবাহক ছেলেটি এক অটোওলার সাথে কথাবার্তা বলে আমাকে বসিয়ে গেল ৫০০ টাকার নোট ভাঙিয়ে আনতে। এসে দিব্বি অটোর সামনে সওয়ার হয়ে বসে বলল ‘দিদি আমি এই সামনে বাজারে নেমে যাব, বাজারটা করে বাড়িতে দিয়ে আসি’। বুঝলাম আমার থেকে নেওয়া ২০০/-টাকায় ওর বাজারের খরচ উঠে গেছে। বা কে জানে হয়ত গোটা একবেলার রোজগারই উঠে গেছে! তা সে যাক, এদিকে সার্কিট হাউসের সামনে পৌঁছে অটোওলা আবার তার চেনা এক সুমোওলার দোকানে নিয়ে গেল। কাউন্টারে বসে আছেন অবিকল সুর্মা ভোপালি। তাঁর প্রথম প্রশ্ন আইএলপি আছে? না মিজোরাম সীমান্তে করাব, শুনেই এককথায় নাকচ।
নাহ সীমান্তে আইএলপি হয় না, এখানে সার্কিট হাউসে হয়। সে অফিস আজ আর কাল বন্ধ কাজেই গাড়ি দেব না। যাব্বাবা এত্ এত ভ্লগ দেখেছি সীমান্তে গিয়ে ফর্ম ভরলেই হেসে হেসে স্ট্যাম্প মেরে আইএলপি দিয়ে দেয় আর এ বলে হয় না! সুর্মা ভোপালি অনমনীয়, হয় তুমি আইএলপি দেখাও, কপি দাও নয়ত গাড়ির টিকিট দেব না। আরে আমার আইজলের চাতলাং গেস্ট হাউসে বুকিং আছে ফেরার টিকিটও আছে আবার কি চাই পারমিট পেতে? তাছাড়া যেতে না দিলে আমি এখন যাবই বা কোথায়? সে লোক নির্বিকার মুখে বলে এই রাস্তায় কত্ত হোটেল, থেকে যাও কোথাও। আর নয়ত ফ্লাইটে চলে যাও ওখানে আটকায় না। এদিকে শিলচর ট্যু আইজল ডায়রেক্ট ফ্লাইট নেই, ভায়া কলকাতা আগেই দেখেছি।
ওদিকে ন’টার গাড়ি ছেড়ে গেছে পরের গাড়ি দুপুর বারোটায়। ভাবলাম দেখি যদি ছোট কোনও গাড়ি পাওয়া যায় রিজার্ভে নেবার। তা আশেপাশে প্রায় সব দোকান বন্ধ। উল্টোদিকে একটু দূরে আরেকটা শিলচর ট্যু আইজল সুমো সার্ভিসের দোকান, কিন্তু তাদের গাড়ি পাওয়া যাবে কিনা তারাই জানে না। ড্রাইভাররা নাকি ফোন তুলছে না। অগত্যা সুর্মা ভোপালি সকাশে ফেরত আবার। জোর দিয়ে বললাম আমি যাবই টিকিট দিন। সে বলে সীমান্তে আটকালে কি গেস্ট হাউসে ফোন করে কথা বলিয়ে ছাড়িয়ে নিতে পারবে? গেস্ট হাউসে আজ ২৬ তারিখ স্রেফ চৌকিদার ছাড়া আর কেউ থাকবে না তাঁরা আগেই ফোন করে জানিয়েছেন, নিজের খাবার দাবারও সঙ্গে নিয়ে ঢুকতে বলেছেন। কাজেই সেসব প্রশ্নই নেই।
এবারে বলে সীমান্তে আটকালে গাড়ি কিন্তু টাকা ফেরাবে না আর ফেরত আসতে আলাদা চার্জ লাগবে। আমি এইবারে আমার ঠান্ডা ইস্পাতের মত গলাটা বের করে বললাম সবকটা সীমান্তেই পারমিট ইস্যু হয় আমাকে মিজোরাম সরকার থেকে জানিয়েছে। নিতান্তই আটকালে আমি ওখানেই থেকে যাবো তোমাদের ফেরানোর কথা ভাবতে হবে না। এতক্ষণে ভোপালিসায়েবের কানে জল ঢুকল, নড়েচড়ে বসে জানালেন আমরা আরো কয়েকটা অনুরোধ পেয়েছি, একজন অফিসারকে অনুরোধ করেছি এসে পারমিটগুলো সই করে দিতে। তবে ৫০০/- টাকা লাগবে। পার্মিটের খরচ ৩৫০/- মানে কড়কড়ে দেড়শোটি টাকা অতিরিক্ত নেবে।
মিজোরাম যেতে ইনার লাইন পার্মিট লাগে এ তো জানতামই, নভেম্বরে দেখেছিলাম সরকারি ওয়েবসাইট থেকে ৭ দিন পরের তারিখের জন্য অ্যাপ্লাই করা যাচ্ছে। ওদিকে অসহ্য কাজের চাপে আর সল্ট লেকের মিজোরাম ভবনে যাবার সময় পাই নি। ফলে ১৯শে ডিসেম্বর অনলাইনে অ্যাপ্লাই করে রেখেছিলাম। সে যখন ২৩শেও অ্যাপ্রুভ হয় নি তখন সাইট খুঁজে এক ফোন নম্বরে ফোন করে ব্যপার জানালে তিনি আকাশ থেকে পড়ে বলেন আরে সাইট তো এখনো ফর্ম্যালি লঞ্চ হয় নি। ওটা বিটা ভার্সান টেস্টিঙের জন্য খোলা। বোঝো কান্ড!!তো সেটা সাইটে লেখা নেই কেন বাপু? এর কোনও সদুত্তর তিনি দিতে পারেন নি।
তবে মজার ব্যপার হল এই কথোপকথনের পরে সাইটে ঢুকে রিফ্রেশ করে দেখি লাল টকটকে রঙে চওড়া পট্টিতে ওয়ার্নিং মেসেজ আসছে ‘এই সাইট এখনও লঞ্চ হয় নি, আইএলপির জন্য নিকটস্থ মিজোরাম সরকারের দপ্তরে যোগাযোগ কর। দপ্তরের লিস্ট পেতে এখানে ক্লিক কর’। যাই হোক এবারে ভোপালির সাকরেদ ছোকরাকে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট আর ৫০০/- টাকা দিলাম, ৭০০/- টাকা দিয়ে সুমোর টিকিট কাটলাম। জানা গেল বারোটা নয় দেড়টায় ছাড়বে পরের গাড়ি। এক ভদ্রলোক আইজলে চাকরি করেন কোন এক কন্সট্রাকশান ফার্মে, শিবসাগর টাউনে বাড়ি, ট্রেন আধাঘন্টা লেট করায় ন’টার গাড়ি মিস করেছেন, বলেন ওরে বাবা দেড়টায় ছাড়লে তো সাড়ে আটটা হয়ে যাবে পৌঁছাতে।
এক মহিলাও অপেক্ষা করছিলেন, আসাম রাইফেলসে কর্মরতা, তিনসুকিয়া থেকে কত কিলোমিটার দূরে যেন বাড়ি, ছুটি কাটিয়ে বাড়ি ফিরছেন, খুবই রেগে যান। সুর্মা ভোপালি নির্বিকার মুখে অন্যান্যদের টিকিট কাটা, ফোন করা ও ধরায় ব্যস্ত। এই ভদ্রলোকের এক বছরের পারমিট ছিল কর্মসূত্রে, নভেম্বরেই শেষ হয়েছে। তিনি বললেন ওটাই দেখাবেন আর কোম্পানির কাগজ। এতদিন ওয়ার্ক ফ্রম হোম চলছিল, এইবারে ডেকে পাঠিয়েছে। অসম রাইফেলসের ভদ্রমহিলার পার্মিট লাগে না, আইডি কার্ড দেখালেই নাকি চলে। বাকীদের বানাতে হবে। দোকানে মাল রেখে আমি বেরোলাম খাবার দাবারের ব্যবস্থা দেখতে।
আইজল যাবো ঠিক করার পর বুকিং ডট কম থেকে একটা হোটেল বুক করে রেখেছিলাম। বুকিঙ ডট কমে বুকিঙের সময় কোন টাকাপয়সা দিতে হয় না, সোজা হোটেল বা হোমস্টেতে গিয়ে দিতে হয়। নভেম্বরে যখন দেখলাম মিজোরাম পর্যটন বিভাগের ওয়েবসাইটে ট্যুরিস্ট লজ বুক করা যাচ্ছে তখন চাতলাং ট্যুরিস্ট লজে ২৬, ২৭, ২৮ তিনদিনের জন্য দিনপ্রতি ১০০০/-টাকা দিয়ে ডাবলবেড রুম বুক করে নিয়ে বুকিঙ ডট কম থেকে ক্যান্সেল করে দিয়েছিলাম। ট্যুরিস্ট লজ বুকিঙে পেমেন্ট করে দেবার পর মেসেজ এলো যদি ৪ ঘন্টার মধ্যে রুম বুকিং কনফার্মেশান না আসে তাহলে অমুক নাম্বারে ফোন করুন।
তা আমি আর ৪ ঘন্টা অপেক্ষা না করে তক্ষুণি সেই নাম্বারে ফোন করেছিলাম। যে ভদ্রলোক ধরেছিলেন তিনি আমাকে ধরতে বলে কিসব খুটখাট করলেন। ব্যাস রুম বুকিঙের কনফার্মেশান মেসেজ চলে এলো। যা বুঝলাম মিজোরাম পর্যটন বিভাগের ওয়েবসাইট সেমি অটোমেটেড। টাকা জমা পড়েছে দেখে ম্যানুয়ালি কেউ একজন কনফার্ম করেন আর কি। তো সেসব তো নভেম্বরে মিটেছিল। কিন্তু ডিসেম্বরের শুরুতে এক ভদ্রমহিলা ফোন করে জানিয়েছিলেন ২৬শে ডিসেম্বর গোটা মিজোরাম ছুটি, ট্যুরিস্ট লজে কেউই থাকবে না। যেহেতু আমার বুকিং আছে কাজেই একজন চৌকিদার থাকবে দরজা খুলে দেবার জন্য। আমি যেন খাবার দাবার সঙ্গে করে নিয়ে তবেই ঢুকি।
তখন তো জানতাম দুপুরে পৌঁছাব, কাজেই একটু চিন্তিত হয়েছিলাম যে দুপুর রাত আর বিকেলের টুকটাক সবই নিয়ে যেতে হবে পোঁটলা বেঁধে। এখন যা পরিস্থিতি দেখছি তাতে শুধু রাতের খাবারটুকু নিলেই চলবে আর কি। শিবসাগরের ভদ্রলোক জানালেন সুমো ছাড়ার পরে সামনে কোথায় মণিপুর মার্কেট আছে, সেখানে ব্রেক দেয় খাবার জন্য। জানা গেল শিলচর টাউনে কেউ দশ টাকার কয়েন নেয় না। পাঁউরুটি জেলি কেক কিনে চা খেয়ে আবার এসে বসলাম ভোপালিসায়েবের আখড়ায়। এরপরে অনন্ত প্রতীক্ষা। দশটা, এগারোটা, বারোটা ঘড়ির কাঁটা ঘুরেই চলে সুমোরও পাত্তা নেই, আইএলপিরাও না। বেলা একটা নাগাদ সুমো এলো বটে, আইএলপির তখনও দেখা নেই।
এবারে বাথরুমে যাওয়া দরকার। ভোপালি বলে দিল পাশের চায়ের দোকানে খোঁজ করতে। চায়ের দোকানে জানা গেল ওই যে উলটোদিকের মিজোরাম ভবন, ওখানেই আছে বাথরুম। আসাম রাইফেলসের ভদ্রমহিলাকে নিয়ে সেখাএন গিয়ে দেখি চত্বরের সিকিউরিটি কিছুতেই ঢুকতে দেবে না। সুমোওলাদের নাকি নিজেদের বাথরুম আছে, লক করে রাখে আর সব প্যাসেঞ্জারকে এখানে পাঠায়। সঙ্গিনী যতক্ষণ তর্ক করছেন ততক্ষণে আমার মাথায় খেলল এখানেই তো আইএলপি হচ্ছে, দেখি তো গিয়ে। বললাম আইএলপির ফর্ম জমা আছে স্ট্যাটাস জানব, সুরক্ষাকর্মীরা পথ ছেড়ে দিলেন।
সরকারি ভবন টবন যেমন হয় আর কি, মস্ত বড় চত্বর। আইএলপি (এবং বাথরুমও) প্রথম বাড়িটা ছেড়ে তার পেছনেরটায়। বাথরুম দিব্বি বড়সড়, মোটামুটি পরিস্কার, দশ টাকা লাগবে জনপিছু ব্যবহারের জন্য। তো মূল্য দিয়ে যা ব্যবহার করতে হবে সেখানে যেতে দিতে সিকিউরিটিদের এত আপত্তি কেন? অদ্ভুত তো! পাশের ঘরেই একজন বসে বিভিন্ন কাগজ দেখছেন আর ঘপাঘপ স্ট্যাম্প মারছেন। গিয়ে আলাপ জুড়লাম। হ্যাঁ এইগুলো আইএলপি তো বটেই। প্রায় শ’খানেক জমা পড়েছে। বুঝলাম সুমোওলার এক্সক্লুসিভ কিছু নয় আরো নানাজনে আবেদন করেছে। ছুটির কথা জিগ্যেস করে জানা গেল আজ ২৬ তারিখ ওঁদের ঘোষিত ছুটি কিছু নয়। তবে প্রচুর কর্মীই ছুটি নিয়ে রেখেছেন।
সুমোর দোকানে ফিরে দেখি সুর্মা ভোপালি চলে গেছেন, পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের এক ছোকরা বসা কাউন্টারে। গাড়ি ছাড়বে দুটো’র সময়। আমার আইএলপি এলো পৌনে দুটো। কিন্তু চারজন বিহারীর আইএলপি এখনো আসে নি। বেশ কিছুক্ষণ ধরেই চারজন বিহারীর কথা শুনছিলাম বটে, এরা কারা কে জানে! তবে কিছু একটা সমস্যা সম্ভবত এঁদের আছে যে কারণে পার্মিট হতে সময় লাগছে। কী সমস্যা জিগ্যেস করলে সুমোওলারা পরিস্কার করে বলতে চাইছে না। তো যাই হোক সেসব মিটিয়ে পার্মিট এনে গাড়ি ছাড়ল দুপুর ২.২০তে। মালপত্র তো সব গাড়ির ছাদে উঠল। কিন্তু গাড়ির ভেতর, যাকে বলে কাঁঠালিবোঝাই করে আমাদের ওঠালো। সামনে সারথি ছাড়া আরো দুজন, পেছনের দুটি সিটে চার চার আটজন।
একদম পেছনের সিটে যে চারজন তারাই সেই ‘চারজন বিহারি’ যাদের জন্য এত দেরী। বেলা তিনটে নাগাদ মণিপুরী মার্কেট। প্রায় সব হোটেলেই খাবার দাবার শেষ। ভাত ডাল ঝপাঝপ বানিয়ে দিতে রাজী হলেন এক দোকানি। এদিকে আমার মোটেই ভাত খাবার ইচ্ছে নেই, হাঁটতে হাঁটতে খানিক এগিয়ে এক দোকানে বলল রুটি সবজি হবে, তবে রুটি বানাতে বিষ মিনিট আধাঘন্টা লাগবে। এছাড়া পোলাও আছে দিতে পারে। অতক্ষণ অপেক্ষা করার ইচ্ছে নেই, যত তাড়াতাড়ি হয় এখান থেকে বেরোন দরকার, বেলা পড়ে আসছে। পোলাওই নিলাম, উপরে একহাতা সালুন ঢেলে দিল, আসলে ছোলার তরকারির ঝোল আর খানিক গাঠিয়া। পোলাওটা খুবই শুকনো ঝরঝরে ভাত, ছোলা আরো কিসব দানাশস্য মেশানো যেন।
আমি তাড়াহুড়ো করলে কি হবে অন্য অনেকেই ভাত ডাল সবজি ইত্যাদি খেলেন, সর্বোপরি সারথি প্রথমে কোথা থেকে এক মেকানিক ধরে এনে চাকা ও ইঞ্জিনে কিসব সারাই করালেন। তারপর কোথায় চলে গেলেন, ফিরলেন যখন ইয়াব্বড় সাইজের খান দশেক বস্তা নিয়ে। সেসব আবার ছাদে তুলে বাঁধাছাঁদা হল, গাড়ি ছাড়ল বিকেল ৩.৫০। কিছুদুর গিয়ে পুলিশে আটকালো, গাড়ির মাথায় মাল পাচার হচ্ছে অভিযোগে তল্লাশি চলল খানিক। সারথি অনেক বলেকয়ে এসব আমার বাড়ির জিনিষ, গ্রামে কিছু পাওয়া যায় না বলেটলে শেষমেষ আইজলের পথে ছুটল গাড়ি। আমার ডানপাশে জানলার ধারে অসম রাইফেলসের সেই মহিলা, নিজেকে আদিবাসি’ বলে পরিচয় দেন, কথোপকথন হিন্দিতে, বাড়িতে ফোন করে জানালেন পৌঁছাতে রাত দশটা হবে।
বাঁ দিকে এক ভদ্রলোক বাঙালি, কর্মোপলেক্ষে সারা ভারত ঘুরে বেড়ান, পুণেতেও ছিলেন সাত বছর, এখন উত্তরপূর্বে, বাড়ি উত্তরবঙ্গের মালবাজার। তাঁর পাশে তাঁর অফিসেরই এক যুবক সঙ্গী। শিবসাগরের ভদ্রলোকও বাঙালি, অহোমিয়া বলতে পারেন মাতৃভাষার মতই। তিনি বসেছেন সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে। আমার পাশের বাঙালি ভদ্রলোক ঘুমিয়ে পড়লেন এবং ...ঢুলে পড়তে লাগলেন আমার কাঁধে। এদিকে কোথাও সরে যাবার মত এক চিলতে জায়গাও নেই। বাধ্য হয়েই কড়া করে বলতে হল। তাতে সাময়িক কাজ হলেও সারা রাস্তা চলেছে এই উৎপাত। আশ্চর্য্য হল ইনি কঠোরভাবে ডানপন্থী, প্রতিবারই নিজের ডানদিকে হেলে পড়ছেন। একবারও বাঁদিকে নয়। ফলে কনুই বাগিয়ে গোঁত্তা মেরে মেরে তাঁকে সোজা রাখতে হল।
আসাম মিজোরাম সীমান্তে সারথি আইএলপিগুলো নিয়ে নেমে গিয়ে ছাপ মারিয়ে আনলেন, আরো ৫০/- করে নিলেন সবার কাছ থেকে, নাকি অফিসে দিতে হয়। পাশের মহিলা খুব চেঁচামেচি করলেন, ওঁর যদিও পার্মিট লাগে না। আমাদেরও বললেন গিয়ে অফিসে দেখতে, কিন্তু ধুর আর এনার্জি নেই। সীমান্ত পেরোবার আধঘন্টার মধ্যেই ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেল। এই সুমোরা নাকি ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে যায় না, অন্য একটা রাস্তা ধরে যায়, সে পাহাড়ে পাহাড়ে এঁকেবেঁকে চলা। সারথিমশাই নাকি সারাদিন খান নি, একটা ছোট্ট রেস্টুরেন্টের পাশে দাঁড়ালেন। কিন্তু সেখানে আজ খাবার বানাবার কেউই নেই। প্রায় বন্ধই বলা চলে। আর একটু আরেক জায়গায় দাঁড়ালেন। এখানে অল্প কিছু খাবার যা ছিল প্যাক করে দিল।
ছোটখাট গ্রাম যা পেরোচ্ছি সব জায়গায়ই দোকানপাট বন্ধ। এবারে আমার টেনশান শুরু হল। গেস্ট হাউস থেকে যে মহিলা ফোন করেছিলেন তিনি বলে দিয়েছিলেন দুপুরে ঢুকে বিকেলে বেরোলেও যেন রাত আটটার মধ্যে ঢুকে যাই। এদিকে আমি তো আটটার মধ্যে পৌঁছাতেই পারব না। যদি কেউ দরজা খুলে দেবারও না থাকে! তাহলে কী হবে! সকাল থেকে বহুবারই গেস্ট হাউসে ফোন করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু ফোন প্লাগ খুলে রাখা। তাও আরো কয়েকবার করলাম, কিন্তু নাহ। শেষে মরীয়া হয়ে বুকিং কনফার্মেশানের জন্য যে নম্বরে ফোন করেছিলাম কলহিস্ট্রি থেকে খুঁজে সে নম্বরেই কল করার চেষ্টা করি। এদিকে ভোডাফোনে সিগনাল নেই্, ওদিকে ওই চেপ্টেচুপ্টে বসায় দুইহাতে ফোন ধরাও যাচ্ছে না ঠিক করে।
যাইহোক এয়ারটেলে সিগনাল আছে, ফোন সংযোগও হল। কিন্ত তিনি ধরলেন না, থেমে থেমে বার চারেক চেষ্টা করে হতাশ হয়ে বসলাম। মনে মনে ভাবছি দরজা না খুললে ১০০ ডায়াল করে পুলিশ ডেকে সাহায্য চাইবো কিনা, তাছাড়া কোন উপায়ও মাথায় আসছে না। এদিকে গাড়ি চলেছে বিভিন্ন জায়গায় কয়েকটা করে বস্তা নামাতে নামাতে। এক জায়গায় তো রীতিমত শুকনো মাছের বস্তা নামল টের পেলাম গন্ধে। পাশের মহিলা আবারো রেগে চেঁচামেচি করায় সারথিও গেল বেজায় রেগে। প্রথমে বলল আর চালাবো না এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবো। কিন্তু অত সরু রাস্তায় কতক্ষণ আর দাঁড়াবে ...তাছাড়া ওই পেছনের চারজন বলে আরে দোস্ত পৌঁছে দাও, সাতদিন জেলে ছিলাম। আজ ফিরে দুটো খেয়ে ঘুমাবো শান্তিতে।
অ্যাঁ বলে কী রে!? আমরা জনা চারেক একসাথে প্রায় চেঁচিয়ে উঠেছি ‘জেলে! জেলে কেন?’ জানা গেল এই ১৮-২০ বছরের ছেলেগুলো বিহারের পরিযায়ী শ্রমিক। আগে দুবার নেপালে গেছে কাজ করতে, এবারে বেশী টাকা পাবে জেনে মিজোরামে এসেছিল। কবে পার্মিট ফুরিয়ে গেছে জানে না, নিজের দেশের মধ্যে প্রতি ৭ দিনে পার্মিট করাতে হবে এ কথা শুনলেও ঠিক বোঝে নি। তিনমাস হল ফুরিয়ে গেছে পার্মিট। একদিন পুলিষ ধরে দেখতে চাইলে পুরানো কাগজই দেখিয়েছে। ব্যাসস পুলিশ সোজা গ্রেপ্তার করে আসাম পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে। যে ঠিকাদারের হয়ে রাস্তা বানাতে এসেছিলো তারাই জামিন করিয়েছে, পার্মিট সুমোওলা বানিয়ে দিয়েছে।
চারজনই মুসলমান হওয়ায় প্রশাসনিক ঝামেলা বেশী পোহাতে হয়েছে বলাই বাহুল্য।
গাড়ি চলছে বেশ ধীরে। সারথীমশাইয়ের রাগ এখনো পড়ে নি মনে হয়। এই গোলমালে খেয়াল করি নি এখন দেখি সেই ভদ্রলোক কল ব্যাক করেছিলেন। আরে বাহ, খুশী হয়ে কল করি। কিন্তুইতোমধ্যে এয়ারটেলের সিগনালও খুবই স্তিমিত। দুপক্ষ থেকেই বার কয়েক চেষ্টার পর কথা হয়, জানাই সমস্যাটা। ক্ষমা চেয়ে বলি এই উৎসবের মরশুমে তাঁকে বিরক্ত করা মোটেই উচিৎ হচ্ছে না জানি, কিন্তু নিতান্ত নিরূপায় হয়েই অগত্যা। তিনি যদি কোনোভাবে চাতলাং ট্যুরিস্ট লজে জানিয়ে দিতে পারেন যে আমি সাড়ে ন’টা নাগাদ হয়ত পৌঁছাব, আরেকটু দেরীও হতে পারে। তিনি অমায়িকভাবে জানান তাঁর কোন অসুবিধে হয় নি, এখন বাইরে আছেন, একটু পরেই জানিয়ে দেবেন চাতলাং ট্যুরিস্ট লজে।
তাঁর উষ্ণ অভ্যর্থনা ‘ওয়েলকাম ট্যু মিজোরাম’ শুনে নিশ্চিন্ত হই। এদিকে পাশের মহিলা আমাকে কল করার জন্য ক্ষমা চাইতে শুনে ভারী বিরক্ত। নিশ্চয়ই সেই ভদ্রলোক অন ডিউটিতে, তাই ফোন ধরেছেন তাতে ক্ষমা চাইবার মত কী হল? এটাই তো ওঁর কাজ। বোঝানোর চেষ্টা করি পর্যটন দপ্তরের আবার এরকম ২৪ ঘন্টা সাপোর্ট হয় নাকি? আর হলে তো সাইটেই নম্বর দেওয়া থাকত, তা তো নয়। এছাড়া ২৬শে ডিসেম্বর তো মিজোরাম রাজ্যে ঘোষিত ছুটি। কিন্তু তিনি মানতে নারাজ। গাড়ি আইজল শহরে ঢোকে রাত ৮.২০ নাগাদ। জায়গায় জায়গায় রাস্তার ধারে মন্ডপ বানিয়ে লোকে খাওয়া দাওয়া নাচগান করছে। সুসজ্জিত নারীপুরুষ রাস্তায় হাঁটছে, কোথাও গিটার বাজিয়ে গান গাইছে।
কোথাও একজন ইউকেলেলে নিয়ে গান গাইছে আর বাকীরা গোল হয়ে ঘিরে তালে তালে হাততালি দিচ্ছে। গোটা শহর প্রায় রাস্তায় নেমে আনন্দ করছে। হঠাৎ দেখে মনে হল ন্যু ইয়র্কের টাইম স্কোয়ার সাথে অজস্র গাড়ি ও বাইক। আলোয় আলোয় ঝলমলে শহরে কোথাও কোন বিশৃঙ্খলা নেই, রাস্তার দুইপাশ দিয়ে আসা ও যাওয়ার পথের গাড়ি চলেছে, ভীড়ে ভীড়াক্কার রাস্তায় গাড়ির গতি অতি মন্থর। কিন্তু কেউ হর্ন বাজাচ্ছে না, কেউ কাউকে ওভারটেক করার চেষ্টাও করছে না। গাড়ি নির্দিষ্ট স্ট্যান্ডে পৌঁছাতে সাড়ে ন’টা। যেখানে নামাল তার উল্টোদিকে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। রাস্তা পেরোতে হবে। সাত ঘন্টা সুমোতে তিনজনের সিটে চারজন চেপ্টে বসে থেকে হাত পা তখন রীতিমত টলমল। শিবসাগরের ভদ্রলোক জানান কোন ট্যাক্সিই বেজায়গা থেকে যাত্রী তুলবে না।
আমাকেই ওপারে যেতে হবে। রাস্তার মাঝে জেব্রা ক্রসিং করা আছে। তো রাস্তার অর্ধেক তো খালি দেখে পেরোলাম। বাকী অর্ধেকে বাইক আসছে হু হু করে। একদম সামনের জন দাঁড়িয়ে গেলেন। আমি ইতস্তত করছি কারণ তাঁর পেছনে পাশে আরো বাইক আসছে দেখছি। উনি আমায় ইশারা করলেন এগোতে আর একইসাথে বাঁ হাত তুলে পাশের বাইককে থামতে ইশারা করলেন। এগোলাম এবং আশ্চর্য্য পরপর বাইকগুলো এসে থেমে যেতে লাগল আগেরজনের ইশারায়। অতঃপর এক মহিলা টলমলে পায়ে পিঠে এক বিশাল বোঁচকাটাইপ পিঠু নিয়ে আর ডানহাতে এক চাকাব্যাগ টেনে খানিক ক্যাবলার মত মাথা ঝুঁকিয়ে ঝুঁকিয়ে থ্যাঙ্কিউ থ্যাঙ্কিউ বলতে বলতে দিব্বি পেরিয়ে গেল আর একসারি দুরন্ত বাইক স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল যতক্ষণ না ওপারে একেবারে ফুটপাথ অবধি সে পৌঁছায়।
পথচারীর প্রতি এই ব্যবহার ব্রাসেলসে, লাক্সেমবার্গে দেখেছহি বটে কিন্তু আমার দেখা ভারতের আর কোন শহরে এই জিনিষ দেখিনি। নিতান্ত রাস্তায় নেমেই পড়লে গাড়িরা থামে বটে কিন্তু অকথ্য গালাগাল দেয় আর বাইকরা... থাক সেকথা।