“সিংহ রাশি বৃষ লগ্ন, শুক্রের জাতক
নক্ষত্র মঘার বশ, মূষিক পাতক।
চরিত্র কূহকময়, স্বভাবে শামুক
মূলত রহস্যপ্রিয়, গেরিলা কামুক।
কবি নই, বাকধূর্ত; স্বেচ্ছাশবাসীন
চলন তানপ্রধান, পর্বসাম্যহীন।”
প্রবুদ্ধসুন্দর কর। বাংলা কবিতার ক্ষণজন্মা এই কবিতাপুরুষকে নিয়ে এতো তাড়াতাড়ি লিখতে হবে, ভাবনায় আসেনি। অথচ এই কাজটাই করতে হচ্ছে কঠিন সত্যকে মেনে নিয়ে। প্রবুদ্ধসুন্দর ও তাঁর কবিতা নিয়ে চর্চার অবকাশটুকু প্রবুদ্ধসুন্দর নিজেই কিছুটা সহজ সমীকরণে নির্ণয় করে গেছেন। উপরে উদ্ধৃত ‘বায়ডাটা’ শিরোনামে কবিতা থেকে তাঁকে চিহ্নিত করতে পারবেন একজন কবিতা পাঠক। ‘সংকর’ জাত প্রবুদ্ধসুন্দর তাই অবলীলায় লিখতে পারে, ‘বাবা বেগবান অশ্ব/ মা, উদ্ভট সংসারের ভারবাহী গাধা/ আমি খচ্চর, বাংলা কবিতা লিখি।’
প্রবুদ্ধসুন্দরের অকাল প্রয়াণের পর এই যে আমি লিখতে বসেছি, এও বুঝি এক ‘পরচর্চা’। পরিজন, অসংখ্য স্বজন, সুজনকে শোকে নিমজ্জিত রেখে কবি চলে গেলেন অনন্তের পথে। তাঁর কলম এসব টের পেয়ে গিয়েছিল আগেই। তাই দেখতে পাচ্ছি তাঁর অমোঘ উচ্চারণ, ‘যার ঘর পোড়ে, আমাদের পরচর্চা/ তাঁকে গোরু বলে ডাকে।/বারবার পুড়ে লেলিহ সিঁদুরে/ তার এই গোরুজন্ম সার্থকতা পায়। ‘কবিতার ছলে তাঁকে আমরা ‘তালিকা’ লিখতে দেখেছি চাতুরীতে ভরা মানুষের মুখ ও মুখোশের। ‘ফটোগ্রাফার আমাদের হাসি চেয়েছিল/ বিমা-কোম্পানির দালাল, আমাদেরই তেলে/ আমাদের ভেজে ফেলতে চেয়েছিল/ মুখ্যমন্ত্রীরা চেয়েছিল ম্যান্ড্রেক হয়ে উঠতে।/ ফটোগ্রাফার, দালাল আর মুখ্যমন্ত্রীর ভীড়ে/ তুমি ভাড়াবাড়ির জানালায়/ নতুন পর্দা টাঙাতে চেয়েছিলে।/ আর, আমি, কারা কারা কী কী চেয়েছিল/ এ নিয়ে একটি দীর্ঘ তালিকা তৈরি করতে চেয়েছিলাম।’
শুধু কবি নয়, প্রবুদ্ধসুন্দর অগণিতের মানুষ বন্ধু হতে পেরেছিল। হতে পেরেছিল নবীনের কলমে বসন্তের হাওয়া বাতাস হতে। আর সেইসব টের পেতো তাঁর সাদা পৃষ্ঠা। সেখানে লেখা হতো, ‘অনাব্য নদীর চিঠি আসে দূর মহকুমা থেকে/ সেই চিঠি জুড়ে থাকে স্রোতকাতরতা।’ বড় বেশি দূর অবধি দেখতে পারত তাঁর মন। দেখত বলেই, ‘কবিজন্ম’ শিরোনামে প্রবুদ্ধসুন্দর লিখে গেছে অসাধারণ পঙক্তিমালা। ‘ধরা যাক, বেশ কটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হল/ ক্রমে ক্রমে নির্বাচিত, শ্রেষ্ঠ কবিতা/ শেষে, কবিতাসমগ্র।/ এক দুটো পুরস্কার, সম্বর্ধনাসহ। / বলুন মিলনকান্তি, আমাদের কবিজন্ম তবে/ এ নালেই যাবে?’
প্রবুদ্ধসুন্দর কর সম্পর্কে সম্প্রতি কবি মিলনকান্তি দত্ত লিখেছেন, “… বন্ধুতা প্রিয় ছিল, শত্রুতাকাঙ্ক্ষীও ছিল। ইংরেজি সাহিত্যের অন্তেবাসী। কিন্তু, বিশ্বসাহিত্য, ছন্দবেদ, চিত্রকলা, সঙ্গীত, ধর্ম ভাবনা, রাজনীতি, সংস্কৃত ধ্রুপদী সাহিত্য, বানান চর্চা বিচিত্রবিধ বিষয়ে পড়াশোনা ছিল। বোদ্ধা ছিল। উচ্চ মেধা। প্রখর স্মৃতিশক্তি। তবু সে ছিল ভ্রষ্ট আদম। স্বর্গ চ্যুত। অথচ মর্ত্য বিষয়ে চরম প্যাশনেট। ইন্দ্রজাল কমিক্স, মায়া-তাঁত, নৈশ শিস, যক্ষের প্রতি-ভূমিকা, এসিড-বাল্ব তাঁর ইত্যাকার কাব্য নামেই সপ্রমাণ রহস্যসত্তার আত্মঘাত। জীবনানন্দ বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ বিষয়ে মনে করতেন, একসময় ‘শ্লেষে লিখিত মহাকবিতা আসতে পারে’__ প্রবুদ্ধর কবিতা ছিল শ্লেষের এপিক। শ্লেষ এমনকি নিজের সম্পর্কেও। নাগরিক কবি সমর সেনের সঙ্গে একটা জায়গায় মিল আছে, কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্বাসে নয়। তিনিই অগ্রজ, যিনি অনুজের মুখে হেডলাইন এবং তিনিই বিভাবসু, যিনি অগ্রজের ঈর্ষায় স্মিত। প্রবুদ্ধকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। নিন্দায় হোক, নন্দনায় হোক। অন্তত সেইসব তরুণের ক্ষেত্রে, যাদের কাছে সে ছিল কবিতার এক্রোপলিস! …”
ব্যক্তিগতভাবে প্রবুদ্ধসুন্দরের সাথে আমার নৈকট্যের বয়স ত্রিশ পেরিয়েছে আগেই। প্রবুদ্ধসুন্দর আমার কাছে তাই ভালোবাসার অক্ষরে মোড়া পনেরো পয়সার পোস্টকার্ডমাত্র নয়। তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু।
‘ছোটেলাল কবিতা পাঠা।’
‘কী সব রাবিশ লিখছিস!’
‘মনিকা তোতা ভোঁতাকে নিয়ে ভালো থাকিস।’
এইসব নৈকট্যের মাঝে বন্ধু আমার, একদিন দূরে চলে গিয়েছিল জীবদ্দশায়। আজ আরও অনেক দূরে। ধরাছোঁয়ার বাইরে। ‘বন্ধুকে’ তাই বুঝি লিখে গিয়েছে, ‘পোস্টারিটি ম্যানিফেস্টোমাত্র/ মূলত তুমিও সখা কোলাহল প্রিয়…’।
অস্ত্র বলতে কেবল বৃক্কের কথাই ভেবেছিল বন্ধু আমার । বলেছিল, ‘বৃক্ক সচল রাখুন/ ভুলে যাবেন না, অনেক কিছুর উপরই পেচ্ছাব করে যেতে হবে আমাদের।' অথচ অগ্ন্যাশয়ের আগুনে পুড়ে গেল ফিনিক্স পাখি!