“ছায়াছবি মানেই আলোছায়ার খেলা। আবার ছায়াছবির জগতে যারা ঘুরে বেড়ান তাঁদের জীবনেও আলোছায়ার খেলা কম নেই। তারই কিছুটা পরিচয়... সাহিত্য নয় কথকতা।”
এভাবেই লেখা রয়েছে বইটির প্রথম খণ্ডের ব্লার্ব। যাঁরা রসিক পাঠক, তাঁরা বইয়ের ব্লার্ব পর্যন্ত খুঁটিয়ে পড়েন। পাঠাতিরিক্ত এক ক্ষুদ্র সারাংশে বইটির বিষয়বস্তুর সারমর্ম ধরা থাকে এখানে। আমি প্রথমেই জানাই, এই অংশটি আমি পড়েছি একেবারে শেষে। যখন বইটির একেবারে শেষ পাতায় পৌঁছে দেখি আর নেই কিছু বাকি, অথচ পিছনে পড়ে রয়েছে এক সমুদ্র প্রমাণ বিশাল অভিজ্ঞতা, কেবলই উথলে উঠছে ‘শেষ হয়ে হইল না শেষ’, ঠিক তখন বইয়ের এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশে চোখ পড়ে।
সাহিত্য নয়, কথকতা। পড়তে পড়তে মনে হয়, কথকতাও নয়, চিত্রনাট্য। সাবলীল গদ্যের টানে টেনে নিয়ে যাওয়া চলচ্চিত্রই যেন। প্রতিটি ছোট ছোট অভিজ্ঞতা আর তার আগে-পরে বহু ফ্ল্যাশব্যাক মুহূর্তকে লেখক ধরেন কখনও ক্লোজ শট, কখনও মিড শট, কখনও লং শটে। তাঁর ক্যামেরার চোখে কখনও ভি শান্তারাম, কখনও বিমল রায়, কখনও গুলজার। ছোটখাটো চেহারার ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত আদ্যন্ত বাঙালি যে মানুষটি বাংলা সাহিত্যের পুনর্নির্মাণ করেছেন সেলুলয়েডে, তাঁর নির্ভার স্মৃতিচারণে কী অবলীলায় ধরা পড়েছে ষাট-সত্তর দশকের বোম্বে থেকে কলকাতা। শচীনকর্তার বাড়ি থেকে হেমন্ত কুমারের সঙ্গে আড্ডা, বিমল রায় থেকে সত্যজিৎ রায়ের সাহচর্য, ম্যাডাম কাননবালা থেকে মিসেস সেনের কাছের মানুষ, মহানায়ক উত্তম থেকে ম্যাটিনি আইডল রাজ কাপুরের সখ্যতা... বর্ণময় জীবন কি একেই বলে?
‘শন শন করে হাওয়া দিচ্ছে। পাল্লা দিয়ে সাইকেল রিকশাটাও ছুটছে বন বন করে। আমার হাতের মুঠোয় একটা চিরকুট। তাতে লেখা ১ নম্বর রিজেন্ট গ্রোভ। কানন দেবীর বাড়ির ঠিকানা। আমাকে বলা হয়েছিল, টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপোয় যে কোনও রিকশাওয়ালাকে বললেই গন্তব্যে পৌঁছে দেবে। কিন্তু কাজের বেলায় দেখা গেল ব্যাপারটা সহজ নয়। রিজেন্ট গ্রোভ নামটা শুনে সবাই এ ওর মুখের দিকে চায়। অবশেষে গৃহস্বামিনীর নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই সমস্বর দাবড়ানি, ‘আরে! তাই বলুন। কাননবালার বাড়ি। ও তো সুয্যিনগরে। কী সব এলেবেলে নাম বলছেন!’-- শ্রীমতী পিকচার্সের কর্ণধার কানন দেবী ‘যে ভবিষ্যতে কোনও একদিন আমার জীবনের মোড় ঘোরাবার প্রধান কাণ্ডারি হয়ে দাঁড়াবেন তা কি স্বপ্নেও ভাবতে পেরেছি?’ শ্রীমতী পিকচার্সের ‘নববিধান’ ছবিতে বিনে মাইনের অ্যাপ্রেন্টিস হওয়ার সুযোগ না পেলে...। এই শ্রীমতী পিকচার্সের ছবি ‘রাজলক্ষ্মী আর শ্রীকান্ত’ শুরুর সময়েই আলাপ গাঢ় হয় উত্তম আর মিসেস সেন-এর সঙ্গে। এই উত্তম সম্পর্কে তরুণ বাবু লিখছেন, ‘বাংলা ছায়াছবির একচ্ছত্র রাজকুমার, অর্থাৎ, যাকে বলে, ম্যাটিনি আইডল হওয়া সত্ত্বেও, অভাবনীয় জনপ্রিয়তার চূড়ায় দাঁড়িয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন করে নেওয়া সত্ত্বেও, ফিল্ম ইণ্ডাস্ট্রির গড়ে দেওয়া নকল ‘গ্ল্যামার কিং’-এর মুখোশ আর বেশবাস পরে গজদন্তমিনারবাসী, লার্জার-দ্যান-লাইফ ইমেজের ঘেরাটোপে বন্দি, সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে প্রায় স্বপ্নলোকের অলীক কোনও নায়কের অভিনয় দিনের পর দিন চালিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও আসল উত্তমকুমার তার মেজাজে আর স্বভাবে ছিল একদম এর বিপরীত। অসম্ভব আটপৌরে, হৃদয়বান, বন্ধু মহলে তুমুল আড্ডাবাজ এক হই-হই করা যুবক ... আমাদের ইন্ডাস্ট্রি একটা প্রকাণ্ড শক্তপোক্ত সোনার খাঁচা বানিয়ে, তার ভেতর তাকে পুরে, পায়ে সোনার শেকল বেঁধে, বরাবরের জন্যে দূর আকাশের তারা নবানিয়ে রেখে দিল। মেগাস্টার বানাবার জন্যে মানুষের সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়ে দিল। ফলে আসল মানুষটা চাপা পড়ে রইল জন্মের মতো। দুর্ভাগ্য আমাদের।’ এরকমই একজন তাঁর মিসেস সেন। যাঁর সম্বন্ধে নিজস্ব মূল্যায়ন অকপটে দিয়েছেন লেখক। ‘এতগুলো বছর ধরে বাংলা ছবির আনক্রাউন্ড কুইন-এর সিংহাসনটি দখল করে বসে থাকা একেবারেই অবাস্তব আর অসম্ভব। শিল্পীদের চোখমুখ হল তাদের অন্তরের আয়না। যে মহিলা তাঁর জীবন দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছেন, কী করে খ্যাতির শিখরে উঠতে হয়, সেখানে দীর্ঘস্থায়ী সাম্রাজ্য বিস্তার করতে হয়, আবার সময় এলে স্বেচ্ছায় নিজের চারপাশে গভীর যবনিকা টেনে লোকচক্ষুর সামনে থেকে চিরতরে সরে যেতে হয়... এই মহিলা আমাকে শিখিয়েছিলেন -- নিজের কাজকে সিরিয়াসলি করতে গেলে চরিত্রে ‘গোঁ’ জিনিসটা থাকা দরকার। বলেছিলেন, ওটাকে ছাড়বেন না কোনোদিন।’
এইরকমভাবেই এক-একটি বাড়ি, এক-একজন মানুষ তাঁর জীবনের পথে গভীর ছাপ রেখে গেছেন।
কিন্তু বইয়ের পাতায় স্মৃতিচারণের সময় এত মানুষ, তাঁদের সঙ্গে দীর্ঘ বোঝাপড়া ওঠাবসা বন্ধুত্ব বিচ্ছেদ যেমন থাকে তেমনই থাকে নিজেকে জাহির করার প্রবণতা। প্রচুর পরিচিতি, অসংখ্য ছবির অভিজ্ঞতা, সমালোচকের উপচে পড়া প্রশংসা আর দর্শকের ভক্তির ঝুলি পাঠকের কাছে উপুড় করার সময় ক্রমাগত আত্মসর্বস্বতা গ্রাস করে অজান্তেই। করতে বাধ্য। মানুষ আত্মপরিচয়ের খোলসে মোড়া থাকবে, এ তো অতি স্বাভাবিক প্রবণতা। আর আশ্চর্য হই এখানেই, যখন দেখি নিজেকে সম্পূর্ণ সরিয়ে দর্শকের আসনে বসিয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সাদা-কালো থেকে রঙিন ছবিতে ক্রমাগত ‘প্যান’ করছেন ক্যামেরা; নির্মোহ দৃষ্টিতে যা দেখছেন, তাকে পরিবেশন করছেন সরস ভঙ্গিতে। অপূর্ব গদ্যে মাখামাখি হয়ে ছবিতে তৈরি হয় এক অবর্ণনীয় সুস্বাদ। যে স্বাদ আর গন্ধ শুধু বাঙালি হেঁসেলের একচেটিয়া। আর ভূমিকাতে লেখেন, ‘এ আমার আত্মজীবনী না। মনের মধ্যে রাশি রাশি ছবি দিনে দিনে ধূলিধূসর হতে হতে অস্পষ্ট হয়ে আসছে। একেবারে হারিয়ে যাওয়ার আগে কয়েকটিকে সামান্য ঝাড়পোঁছ করে হাজির করা গেল...’ ‘সামান্য’ কয়েকটিতে পেরিয়ে যায় দুটি খণ্ডে সাজানো প্রায় ন’শো পাতার বই ‘সিনেমা-পাড়া দিয়ে’।
যে সময়কার কথা বলছেন, তখন স্টুডিওতে কারও কোনও সমস্যা হলেই চারপাশের সবাই ঝাঁপিয়ে পড়তেন। ইউনিটে ইউনিটে কোনও ভেদাভেদ ছিল না। এক ইউনিটের সহকারী পরিচালক এসে অন্য ইউনিটের ছবিতে ক্ল্যাপস্টিক দিয়ে যাচ্ছে, অবলীলায়। এটাকে ওঁরা সম্মানহানির ব্যাপার বলে মনে করতেন না বা এর বিনিময়ে পারিশ্রমিকের আশাও ছিল না তাঁদের।
পাহাড়ি সান্যাল থেকে কালোদা ওরফে অসিতবরণ, পদ্মাদেবী থেকে ছবি বিশ্বাস, ভানু-জহর-নৃপতির অনুগামী অনুপ হয়ে তাঁর যাত্রাপথে অসংখ্য শিল্পীর ভিড়। তাঁদের প্রত্যেকের জন্য এই বইয়ের পাতায় পাতায় যথোপযুক্ত সম্মানজনক ভূমিকা রেখেছেন তরুণ বাবু। ভূমিকা নির্বাচনে তাঁর মুনশিয়ানা, চরিত্রচিত্রণে তাঁর অনায়াস দক্ষতা, প্রত্যেকের সঙ্গে তাঁর সহজ সরল সাবলীল সম্পর্ক একটা সময়ের দলিল। যে সময়ে ‘বাংলা বই’ তৈরি হত। যে সময়ে মানুষ ছবির পর্দায় ভালো বাংলা গল্পের সার্থক চিত্রায়ন দেখে হাসত, কাঁদত, ভালবাসতে শিখত।
প্রথম খণ্ড শেষ হয় ‘বালিকা বধূ’র জন্য ইন্দিরাকে খুঁজে পাওয়ার পর। ইন্দিরা চ্যাটার্জির মৌসুমী চ্যাটার্জি হয়ে ওঠার ইতিহাস বলেই ঝপ করে যেন ফেলে দেন সেই কালো বোর্ড, ‘বিরতি’। আর ইন্টারভ্যালের পর যখন পর্দা ওঠে, দর্শক একেবারে সেই একই মনোযোগ নিয়ে ডুবে যান পরের পর্বে।
দ্বিতীয় খণ্ডের সমাপ্তি বড় যন্ত্রণার। শেষ যাত্রায় চলেছেন বাংলা ছবির মহানায়ক, পিছনে পড়ে রইল এক আশ্চর্য ছবির ভাবনা। যে শুরু না হওয়া ছবির নাম ‘টিনের তরোয়াল’।
বইয়ের উৎসর্গপত্রটি তাঁর নিজস্ব পছন্দের সিগনেচার।
“যে কেহ মোরে দিয়েছ সুখ, দিয়েছ তাঁরি পরিচয়
সবারে আমি নমি
যে কেহ মোরে দিয়েছ দুখ, দিয়েছ তাঁরি পরিচয়
সবারে আমি নমি”
গানটি দেখামাত্র মনে পড়ে যায় ‘সবারে আমি নমি’, চারের দশক থেকে পর্দায় কাঁপন ধরানো ছায়াছবির এক মহানায়িকা তাঁর আত্মজীবনীর নাম দিয়েছিলেন ‘সবারে আমি নমি’। রবীন্দ্রনাথের গানকে বাণিজ্যিক ছবিতে কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন সেই কাননবালা। একা একজন রবীন্দ্রনাথই তো পারেন সংস্কৃতিমনস্ক মানুষকে একসুরে বাঁধতে। পঁচিশ বছরে পঁচিশটি ছবিতে পরিচালক-সুরকার যুগলবন্দী ছিল অপ্রতিরোধ্য। সেই জুটির নাম তরুণ-হেমন্ত। যে জুটির অবিস্মরণীয় সমস্ত মণিমুক্তায় সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলা চিত্রজগত এবং অবশ্যই সঙ্গীত-দুনিয়া। সেই সুর কথা তাল লয়ের চলন বইয়ের ছত্রে ছত্রে আবহসঙ্গীতের মতো বয়ে যায়।
নিজেকে কোথায় কীভাবে আড়ালে রাখেন তরুণ মজুমদার, সেকথা আজ থাক। ভারতীয় সিনেমার ইতিহাস যারা লিখবেন, বাংলা ছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার নিয়ে যারা গবেষণা করবেন, সিনেমা জগতের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে যারা গণমাধ্যমে আলোচনা করবেন, সেই বিদগ্ধ মানুষের কাছে এই বইয়ের একরকম সমাদর। আর যে পাঠক এককালে নিমন্ত্রণ, ঠগিনী, সংসার সীমান্তে, বালিকা বধূ, পলাতক বা দাদার কীর্তি’র মতো ছবি দেখে বিহ্বল হয়ে এই বইটি হাতে তুলে নিয়েছেন, তাঁদের কাছে ছবির আড়ালের গল্প শোনার বিরল সৌভাগ্য। প্রতিটি ছবি তৈরির পেছনে আশ্চর্য সব খুঁটিনাটি গল্প সাজিয়ে দিয়েছেন পাঠকের দরবারে। কখনও কাঁচের স্বর্গ ছবিয়ে নায়ক চরিত্রে দিলীপের নির্বাচন, কখনও আসে আংটি চাটুজ্যের ভাই অনুপ কুমারের সিলেকশন। এমনকি ক্ষুদ্রতম এক চরিত্রে প্রায় শো-স্টপারের মতো যে অমূল্য সান্যাল অভিনয় করেছিলেন চোরের চরিত্রে, তার প্রতিও উচ্ছ্বাস গোপন করেননি পরিচালক। রইল বাকি তিন নম্বর দল। যারা শুধুই গপ্পো শুনতে চায়। তারাই যুগে যুগে ছায়াছবিকে বক্স অফিসের আনুকূল্য দেয়, তারাই বইয়ের একের পর এক সংস্করণ নিঃশেষ করে প্রকাশককে আনন্দ দেয়। তারাই তরুণ মজুমদারের মতো মানুষকে প্রণাম জানানোর যোগ্যতা রাখেন, এই বই সেই আমজনতার কাছে পরম আদৃত। যেখানে ফর্ম নয়, কনটেন্ট আসল। লেখা হোক বা ছায়াছবি, ‘বই’তে মারপ্যাঁচ ছাড়া সরলতার উদযাপন শিখতে হলে অবশ্যপাঠ্য ‘সিনেমা-পাড়া দিয়ে’।