বাদাম যেভাবে বাজার ছেয়ে ফেলেছিল, তাকে দ্রুত ধরে ফেলছে আমব্রেলা সং।
ইউটিউব খুললে বেশ কিছু সাজেশন দেখায়। ভিডিওগুলো যেন বলে, আয় আয় চই চই। সেখানে ইদানীং বার বার ফিরে আসছে এক ছাত্রীর মুখ। গোটা কয়েক ভিডিও চালিয়ে দেখলাম। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় ইংরিজিতে পাশ নম্বর না পেয়ে যখন আরও অনেক ছাত্রীর সঙ্গে বিক্ষোভ দেখাতে গিয়েছিল সে, হঠাৎ করে উদয় হয়েছিলেন এক ইউটিউবার। এ ধরণের বিক্ষোভে চাটনি মিশে থাকে বেশ। ওই ইউটিউবার এবং ছাত্রীর মধ্যে কথোপকথনের নির্যাস ছিল অনেকটা এরকম।
-তুমি আন্দোলনে নেমেছ কেন?
-রাষ্ট্রবিজ্ঞান আর ইতিহাসে আমরা লেটার পাওয়া সত্ত্বেও ইংরেজিতে ফেল করিয়ে দিয়েছে।
-আমব্রেলা বানানটা করো তো।
এমন প্রশ্নে বিক্ষোভকারী ওই ছাত্রী ঈষৎ বিরক্ত হয়েছিল। বলল, এ আবার কি? আপনি কি এসব জিজ্ঞেস করতে এখানে এসেছেন?
-বানানটা বলো।
-এ এম আর এলো এ।
-ঠিক করে বলো।
একটু হতচকিত হয়ে যাওয়া সেই ছাত্রীর মুখ থেকে এবারে বেরোয়, এ এম আর ই এলো এ।
এই মিনিট খানেকের ভিডিওই বাজার মাত করে দিয়েছে বলা চলে। আন্তর্জালের ভাষায় যাকে বলা যেতে পারে রীতিমতো ভাইরাল। কত হাজার ভিউ হলে কোনও ভিডিওর কপালে ভাইরাল তকমা জোটে জানি না। তবে এই ভুল বানানের ভিডিও ক্লিপিংয়ে মন ও প্রযুক্তির মাধুরী মেশানোর বিষয়ে কোনওরকম খামতি দিতে নারাজ এ যুগের ইউটিউবাররা। দেখলাম, মেয়েটির বানান বলার ক্লিপিংয়ের মধ্যে মিশে গিয়েছে ভুবন বাদ্যকরের চীনা বাদাম, ডিজে বিট সহ। দেখলাম, ভুল বানানের কয়েক সেকেন্ডের ক্লিপিংয়ের পরেই এঁটে দেওয়া হয়েছে প্রায় উন্মুক্ত পিঠের মহিলাদের নাচ। বানান বলার অপারদর্শিতার সঙ্গে সেখানে জড়িয়ে ছিল মুজরো সংগীত। মহিলারা নাচছেন, আর ফিনফিনে শাড়ি ঘুরছে ছাতার মত। বিভিন্ন চলচ্চিত্র থেকে কুড়িয়ে নেওয়া কিছু অশ্লীল দৃশ্য, অপ্রাসঙ্গিক কিছু অ্যানিমেশন বুনে দেওয়া হয়েছে ঝিনচ্যাক ব্র্যান্ডের বাহারি সোয়েটারের মত। বঙ্গ রাজনীতির বিভিন্ন জনপ্রতিনিধির নানা সময়ে করা কিছু উটকো মন্তব্য তালে তাল দিয়েছে ওই ছাত্রীর বানান বলার প্রসঙ্গে। দুই কিংবা আড়াই লক্ষ ভিউ টপকে যাওয়া এমন প্রতিটি ভিডিওর শেষে উপচে পড়েছে কমেন্ট। বড় বেরঙিন আজকাল। হাসির খোরাকের এই নয়া সংযোজনে নেট দুনিয়ার আবাসিকরা ইউরেকা বলে চিৎকার করে উঠেছেন আর্কিমিডিসের মত। আমরা মজেছি। মজছি আরও। আর বানান বলার এই ভুল ক্লিপিংকে কেন্দ্র করে প্রতিদিনই নতুন ভিডিও জুড়ছে নেট-দুনিয়ায়। তৈরি হচ্ছে কার্টুন, ভালবেসে আমরা যাকে মিম বলে ডাকি।
যাকে ঘিরে এত আয়োজন, শোনা গিয়েছে নদীয়ার ওই ছাত্রীটি নাকি ভাল নেই একদম। খবরের কাগজ জানান দিচ্ছে, টিটকিরির শরশয্যার মধ্যেই সে শুয়ে রয়েছে আজকাল। ইউটিউবে ভিডিওটির জন্ম নেওয়ার পর থেকেই কার্যত সে ঘর বন্দি। মাত্র এ কদিনের মধ্যে তিন তিন বার আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছে। নিজেকে শেষ করে দেওয়ার বাসনা কতটা উদগ্র হলে সপ্তাহখানেকের মধ্যে কেউ তিন বার এমন কাজ করার চেষ্টা করে, তা আঁচ করা যায়। বাড়িতে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েও যে ও বেঁচে গিয়েছে, তা বলা ভুল হবে। অজ্ঞতার জন্য হঠাৎ বিখ্যাত হয়ে ওঠা মেয়েটির বাড়ির সামনেও ভীমরুলের মত ছোবল মেরে চলেছে রঙ্গ ব্যঙ্গ টিটকিরি। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে জনতার একাংশ ছুঁড়ে দিচ্ছেন উল্টোপাল্টা মন্তব্য। ভার্চুয়াল দুনিয়ার কথা না হয় ছেড়েই দেওয়া গেল, মেয়েটির বাড়ির দেওয়ালেও হয়তো প্রতিদিনই লেখা হয়ে চলেছে অজস্র কমেন্ট। ম্যাজিক কালির মত তা চোখে দেখা যায় না। কিন্তু বাড়ির বাসিন্দারা তা পড়তে পারছেন ঠিকঠাক। মেয়েটি নাকি কথাবার্তা বলছে না। স্বাভাবিক খাওয়া দাওয়া বলতে যা বোঝায়, ছেড়েছে তাও। ভিডিওটি যারা পোস্ট করেছিলেন এবং যারা দেখেছেন এবং মজেছেন, তাদের অবশ্য এ সব খবরে কিছু যায় আসে না।
ভিউয়ের সংখ্যা আকাশ ছুঁলে শুনেছি টাকা পাওয়া যায়। আন্তর্জালের ঈশ্বর নিশ্চয়ই তাঁদের পকেট ভরাচ্ছেন সস্নেহে।
এক খুঁতখুঁতে মানুষকে এই ঘটনা সম্পর্কে বলতে শুনেছিলাম, ‘হেলাফেলা সারাবেলা।’ প্রবল কপাল কুঁচকে তিনি বলেছিলেন, ‘যে থুতুটা আমরা ছেটানোর চেষ্টা করছি ছাত্রীটিকে ঘিরে, তা দিনের শেষে এসে পড়ছে আমাদের গায়েই।’ টিভি চ্যানেলের প্যানেল বৈঠকে শিক্ষাবিদদের কিছু অংশ কপালে বলিরেখা প্রকট করে বলছেন, ‘এই ভুল বানান বলার আসল দায় ছাত্রীটির উপরে নয়, বর্তায় আমাদের দিকেই।’ অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, যে পড়ুয়া বারো ক্লাসের পরীক্ষার পরেও আমব্রেলা বানান বলার ক্ষমতা রাখে না, সেই অপরাধ পরীক্ষার্থীর নয়, মাথা নত করার দায়িত্ব নিতে হবে আমাদের এবং রাজ্যের এই তামাম শিক্ষাব্যবস্থাকে। দায় এড়াতে পারেন না স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রীও।
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর খাতা দেখে বন্ধ খামে নম্বর জমা দিয়েছেন যে শিক্ষকরা, তাঁদের অনেকেই অবশ্য খামের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন দীর্ঘশ্বাস। অর্থহীন নম্বরের যে বন্যা উত্তরপত্রের একুল ওকুল দুকূল ছাপিয়ে দিচ্ছিল ক্রমশ, ভাবা হয়েছিল এবারও হয়তো এমনটাই হবে। আধুনিক মূল্যায়ন পদ্ধতিতে জানার পরিধি যত কমে, প্রাপ্ত নম্বরের ভর তত বাড়ে। গত কয়েক বছরের ক্যালেন্ডারের পাতা আমাদের এমনটাই শিখিয়েছে। ক্রমশ খাদে নামতে নামতে মধ্যরাতে নাইট গার্ডের বাঁশির মত হয়তো হঠাৎ চৈতন্য হয়েছিল পর্ষদের কর্তা ব্যক্তিদের। ভেবেছিলেন, এভাবে চলতে দেওয়া যায় না। তাই, ফেল! ওয়াকিবহাল শিবিরের একজন বিশেষজ্ঞ দিনকয়েক আগেই বলেছিলেন, ‘স্ক্রুটিনি করার অধিকার আছে সবার। তবে মুস্কিলটা হল, যদি ঠিকঠাক পুনর্মূল্যায়ন করা হয়, তাহলে অধিকাংশ পড়ুয়ারই নম্বর বাড়ার বদলে কমবে আরও। প্রথম বার খাতা দেখার সময়ে উথলে উঠেছিল যে দয়া, দ্বিতীয়বার তা থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ।’
সমাজের ভাল মন্দ নিয়ে মাথা ঘামান যাঁরা, তাঁদের অনেকে অবশ্য নিভৃতে ক্ষোভে ফুঁসছেন। ভুল বানানের ভিডিওটির প্রতিটি লাইক তাঁদের গায়ে ফুটছে আলপিনের মত। এক সমাজবিদকে বলতে শুনেছিলাম, ‘এক্ষেত্রে অবজেক্ট এক ফেল করা পড়ুয়া বলেই কি মস্করার এতটা সাহস দেখাতে পারলাম আমরা?’ আরেকজন উগরচ্ছিলেন, ‘ফার্স্ট-সেকেন্ড হওয়ার পরে অত্যন্ত কুৎসিত ভাবে যে ছাত্রছাত্রীরা অনস্বীকার্য কথাটা লেন্সের সামনে আওড়ায় তা নিয়ে ঠাট্টা করার দেমাক আমাদের আছে তো?’ অকৃতকার্য ওই ছাত্রীর মনের ইচ্ছের মধ্যে ওম যুগিয়েছিল এক বিশ্বাস। ওই বিশ্বাসে হয়তো পাপ মিশে ছিল। বিক্ষোভ দেখালেই মার্কশিট এর লাল দাগ বদলে যেতে পারে সবুজ কালিতে, এমনই বাসনা হয়তো লালন করেছিল ও। শুধু ও নয়, ওর বন্ধুরাও। ম্যাজিক প্রাপ্তি হয়নি। এই অপ্রাপ্তিতে দিনের শেষে কে কার কাছে নতজানু হল, তা নিয়ে বিরাট বড় প্রশ্নচিহ্ন আমাদের গলা পেঁচিয়ে ধরে। সিবিআই না ডাকলেও মাথায় অক্সিজেনের অভাব বোধ হয়। দমবন্ধ লাগে।
হিজিবিজবিজ আরও কিছু প্রশ্ন মাথার মধ্যে হুল ফোটায়। রাস্তায় বেরোই। দেখি হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন আমাদের জনপ্রতিনিধিরা। নিজেদের মার্কশিটে নিজেরাই নম্বর দিয়ে তাঁরা বলেন, কবে যে বড় হলাম চুপিসারে। যে শিবির কিংবা অনুষ্ঠানের জন্য আহ্বান করছেন তাঁরা, দেখেছি এমন ব্যানার কিংবা ফ্লেক্সে জ্বলজ্বল করছে ‘আহ্বায়ক’ শব্দটির সম্পূর্ণ ভুল বানান। রবীন্দ্রজয়ন্তীতে রবি বানান অস্তাচলে যায়। অনুপ্রেরণার মধুসূদন-জন্মদিনে মধুর মধ্যে গরল মেশে। রক্তদান শিবিরের ব্যানারে দেখেছি আদ্যোপান্ত ভুল বানান। উদ্বোধকের দরজায় তালা মেরে ফ্লেক্সে বিরাজ করেন ‘উদ্ভোদক’। মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের ‘সুভেচ্ছা’ জানিয়ে পৌরপিতা পৌরমাতারা সমাজসেবা করেন। যে সরকারি প্রকল্পগুলো দিন বদলে দেওয়ার দাবি জানায়, তার খুব সরল বানানগুলো কম্পিউটারের লেআউটে ফেললেই বদলে যায় রাতারাতি। আমাদের জনপ্রতিনিধিরা এমন বানান ‘অ্যাপ্রুভ’ করেন। তাই তো তা ছাপা হয় হাজারে হাজারে। ল্যাম্পপোস্টের শোভা বাড়ে। মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে। জনদরদী নেত্রী হাজার লোকের সামনে সরকারের মাথায় পালক লাগিয়ে গরমেন্ট গরমেন্ট বলে চিৎকার করেন সোল্লাসে। আম আদমির হাততালি ডেসিবেলের ব্যাকরণ ভাঙে।
এক রসিক শিক্ষাবিদ হাই তুলে বলেছিলেন, সমাজ চালানোর ভার যাঁদের হাতে, ‘বাংলাতেই তাঁদের এই হাল। ভাগ্যিস ইংরিজিতে কিছু ছাপাতে হয় না।’
লাইকখাওয়া, সাবস্ক্রিপশন লোভী ইউটিউবাররা কই? ভুল বানানের মনীষীদের জন্মদিনে সভা করে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন করেন যাঁরা, তাদের সামনে বুম উঁচিয়ে কেন হাজির হতে পারেন না এমন ইউটিউবাররা? জোরে কণ্ঠ ছেড়ে কি প্রশ্ন করা যায় না, দুঃস্থ মানুষদের কম্বল ‘বিতাড়নের’ যে পরিকল্পনা নিয়েছেন আপনি, তাতে কী শীত মানবে আদৌ? খড়গের মত মোবাইলের ক্যামেরা তাক করে কোনও ইউটিউবার কি জিজ্ঞাসা করতে পারেন, পিছনের ইয়াব্বড় ফ্লেক্সে যা ছাপিয়েছেন মশাই, তার আসল বানান কি জানা আছে আপনার? কিংবা, এই বানানটা যে ভুল সেটুকুও কি আপনারা জানেন অন্তত? খবরের কাগজে পাতাজোড়া কোটি টাকার বিজ্ঞাপনে দিনের পর দিন যেভাবে ছাপা হয়ে চলেছে হিন্দি কিংবা ইংরিজি থেকে ডাব করা অর্থহীন বাংলা শব্দ, তা নিয়েও আমরা আশ্চর্য ভাবে নীরব। প্রতিপক্ষ আপাত-শক্তিশালী বলেই কি মুখে কুলুপ এঁটে থাকতে পছন্দ করি আমরা?
মোবাইলের ক্যামেরায় শান দিচ্ছেন যাঁরা, পরের ভিডিও করার আগে এসব নিয়ে একটু ভেবে দেখলে পারেন। ঝুলন্ত ডাল থেকে ফল ছিনিয়ে নেওয়া খুব সোজা। শিকড়ের সন্ধান করতে গেলে মাটি খুঁড়তে হয়। তাতে ঘাম ঝরে। এর জন্য যে শাবলের প্রয়োজন তাতে ধার থাকা চাই।
মেয়েটি এখন কেমন আছে তা জানার বড় লোভ হয়। ইউটিউবের কাছে এর উত্তর নেই।