বন্ধুস্থানীয় কারোর কোনো কাজ নিয়ে রিভিউ করার একটা সমস্যা হল, নিরপেক্ষতা বজায় রাখা। প্রশংসা করার সময় প্রায়ই নিজেকে প্রশ্ন করতে হয়, এ প্রশংসা বন্ধুটির কাজের প্রশংসা করছি, নাকি বন্ধুত্বের। সুদীপ্তর লেখা “সমকামিতা ও বিবর্তন” রিভিউ করার সময় সে সমস্যা নেই – কেননা কাজটি নিজের গুরুত্বেই অতুলনীয়।
বইটির প্রসঙ্গে ঢোকার আগে একটু প্রকাশনার কথা না বললে অন্যায় হবে। অন্য যৌনতা নিয়ে লেখা এখন বেশ “ইন থিং”, ফলে এই বিষয়ে লেখার এবং প্রকাশকের এখন আর অভাব নেই। কিন্তু গুরুচন্ডা৯ আজ থেকে প্রায় বারো-চোদ্দ বছর আগে যখন এই বিষয়ে কাজ শুরু করে, তখন মেনস্ট্রিম প্রকাশনায় কুইয়ার থিম-এর কাজ বেশ বিরল ছিল। সেই জায়গা থেকে আজ অবধি গুরুচন্ডা৯ ধারাবাহিকভাবে এই ইস্যুতে বিভিন্ন লেখা প্রকাশ করে এসেছে। আমার নিজেরও কিছু কাজ গুরু থেকে বেরিয়েছে। সেইসব কাজের কথা মাথায় রেখেও বলা যায় সুদীপ্ত পালের এই বইটি নিজগুণে অনন্য।
আসলে এই বইটাতে সুদীপ্ত দু’টি দুরূহ কাজ সম্পন্ন করেছে। প্রথমত সহজে বিজ্ঞান বলা, আর দ্বিতীয়ত বাংলায় বিজ্ঞান বলা। এই দু’টিই যে কতটা কঠিন কাজ – সেটা যারা কখনো চেষ্টা করেছেন, তাঁরাই জানেন। সেই কাজটা আরো কঠিন হয়ে যায়, যখন আপনি এমন কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতে বসেন, যার অনেকটাই এখনো কুয়াশায় ঢাকা। সমকামিতার কারণ এখনো তর্কাতীতভাবে জানা যায়নি। এর পেছনের একটা কারণ বিষয়টির জটিলতা, অপর কারণটি রাজনৈতিক। সমকামিতা জেনেটিক না এপিজেনেটিক না হরমোনাল না সামাজিক এই নিয়ে বহু পরস্পরবিরোধী তত্ত্ব আছে। এই জট পাকানো বিষয়টিকে বইটিতে সুন্দরভাবে গুছিয়ে ধাপে ধাপে পরিবেশন করা হয়েছে, যাতে সহজে গ্রহণ করা যায়, কোথাও ধাক্কা খেতে না হয়। যেখানে যেখানে প্রয়োজন, সেখানে সুদীপ্ত খুব সুন্দরভাবে একদম গোড়ার কথাগুলোও পরিষ্কার করে দিয়েছেন।
সমকামিতার কারণ জানার ব্যাপারে যে কুয়াশা, তার রাজনৈতিক দিকটিও খুব ইন্টারেস্টিং। সুদীপ্ত এই বিষয়টা ছুঁয়ে গেলেও বেশি বিশ্লেষণে যাননি। সম্ভবত প্রসঙ্গান্তরে চলে যাওয়ার সমস্যা এড়াতে। যদিও বইটির শেষ প্যারাগ্রাফে এই বিষয়ক গবেষণার রাজনৈতিক সামাজিক সমস্যাগুলোকে উনি তুলে ধরেছেন। সুদীপ্তর তুলে ধরা বিষয়গুলি ছাড়াও যৌনতার বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণায় অধুনা আপত্তি আসে কুইয়ার সমাজের মধ্যে থেকেও। ঘরপোড়া গরু হওয়ায়, যৌনতার উৎস জানার গবেষণা রাজনৈতিক সামাজিক চাপে কনভার্সন থেরাপিতে বদলে যেতে পারে, এই ভয়টা অনেকেই পান। ভিন্ন যৌনতা যখন ধীরে ধীরে স্বীকৃতি পাচ্ছে, তখন “গে জিন” খুঁজে পাওয়া গেলে, তা যে অস্বাভাবিক বলে চিহ্নিত হবে না – তারই বা নিশ্চয়তা কোথায়? ফলে, বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণায় কুইয়ার সমাজের আপত্তিকে পুরোপুরি অমূলক বলতে পারছি না। সুদীপ্তকে অনুরোধ করব – কখনো সময় পেলে সেই বিষয়েও কিছু লিখতে।
সুদীপ্তর এই লেখার আরেকটা গুণ রয়েছে, যার প্রশংসা করতেই হয়। বিজ্ঞানের লেখায় অনেকেরই একটা প্রবণতা থাকে, আলটিমেট ট্রুথ বলে দেওয়ার। কিন্তু বিজ্ঞান যে সতত পরিবর্তনশীল – সেই ধারণাটা পাঠক অবধি পৌঁছে দিতে অনেকেই পারেন না। আসলে সমস্যা হয়, “বিজ্ঞান পরিবর্তনশীল” একথাটা বললেই অনেক ছদ্মবিজ্ঞানের সমর্থক উপস্থিত হয়ে যান এই বলে, যে “হয় হয়, বিজ্ঞান জ়ানতি পারে না”। তাই বিজ্ঞানের অনিশ্চয়তা উপস্থাপনের সময় খুব পরিষ্কার করে নিশ্চয়তা আর অনিশ্চয়তার সীমানা টেনে দিতে হয়। কাজটি কঠিন, কিন্তু সুদীপ্ত এই বইতে সেই কাজটা সহজেই করেছেন।
যেখান থেকে শুরু করেছিলাম, সেখানেই আবার ফেরত যাই – বইটির গুরুত্ব। সমকামিতার বিষয়ে যে সামাজিক ট্যাবু – তার অনেকটাই কিন্তু অজ্ঞানতার কারণে। ইংরেজিতে প্রচুর রিসোর্স থাকলেও, বাংলা ভাষায় বিষয়টাকে সহজে বোঝানোর বই এখনো বিরল। তাও আবার ছোট করে, বিজ্ঞানের আলোয়, কিন্তু বিজ্ঞানের কচকচি বাদ দিয়ে এই বিষয়ে এরকম লেখা চট করে পাওয়া যায় না। সেই কারণেই বইটি অনন্য এবং অবশ্যপাঠ্য।
তবে চারটি বিষয় রয়েছে, যা আমার মনে হয়েছে যে লেখক-প্রকাশক পরবর্তী সংস্করণে পাল্টানো যায় কিনা ভেবে দেখতে পারেন। এক, বইটির নাম। বইটির নাম সমকামিতা ও বিবর্তন বললে বইটির পরিসরকে ছোট করা হয় বলে আমার মনে হয়। বইটির নাম সম্ভবত বিজ্ঞানের আলোয় সমকামিতা বললে বইটির বিস্তারকে বেশি ভালো ধরা যেত। দ্বিতীয়ত, সব পরিভাষার বাংলা হয়তো প্রয়োজনীয় নয়। এপিজেনেটিক-এর নাম সম্ভবত এপিজেনেটিক রাখলেই বেশি ভালো বোঝা যায়, অধিবংশাণুবিদ্যা বলার থেকে। তৃতীয়ত, রেফারেন্স আরো বেশি দিলে বোধ হয় উৎসাহী পাঠকদের পরবর্তীতে পড়াশুনো করতে আরেকটু বেশি সুবিধে হতো। আর শেষ বলার কথাটি হল, একটু ছবি দেওয়ার কথা কি ভাবা যায়?
সুদীপ্ত এবং গুরুচণ্ডা৯র কাছ থেকে বিজ্ঞান বিষয়ক এ’রকম আরো বই পাওয়ার আশায় রইলাম।