অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন ধ্বনির মধ্যে হয়তো আশা বেঁচেছিল তখনও। রাস্তার এপাশ ওপাশ দিয়ে, এ গাড়ি ও গাড়ি কাটিয়ে যখন এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালের দিকে যাচ্ছিল সেই আপৎকালীন যান, রোগীর পরিবারের সদস্যদের মনে প্রায় নিভে আসা সলতের আগুনের মত হয়তো উষ্ণতা ভর করে ছিল, তখনও। দুটো হাসপাতাল ঘোরা হল। শয্যা পেলেন না হৃদরোগে ভোগা ৭৫ বছরের বৃদ্ধ। অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের মধ্যে বিষাদ মাখছিল ক্রমশ। দৃশ্যের যবনিকা পতন হল এক দুর্ঘটনায়। দক্ষিণ কলকাতার দুটি রাস্তার সংযোগস্থলে অ্যাম্বুলেন্সের পেটের মধ্য সজোরে ধাক্কা মারল একটি বেসরকারি বাস। ধাক্কার অভিঘাত এমনই ছিল যে ওই আপৎকালীন যানের দরজা খুলে গেল চকিতে। রাস্তায় ছিটকে পড়ে যান অ্যাম্বুলেন্সের চালকের পাশের আসনে বসে থাকা বৃদ্ধের পুত্রবধূ। জ্ঞান হারান। তা ফিরেও আসে কিছুক্ষণ পর। বৃদ্ধের জ্ঞান আর ফেরেনি অবশ্য।
তিলোত্তমা মহানগরীর বিখ্যাত খবরের কাগজের পাতার এক কোণে সম্প্রতি জায়গা করে নিয়েছিল এই খবর। শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রেপো রেটের অদলবদল, রোদ্দুর রায়—এসবের মধ্যে এমন খবর মুখ লুকিয়ে ছিল লজ্জায়। এ ধরনের খবরের কোনও ফলো আপ খবর হয় না। আপাত গুরুত্বপূর্ণ খবরের মধ্যে অনেক সময়ই ঢুকে যায় পাতা ভরানোর জন্য। প্রিন্ট মিডিয়ার ভাষায় যার নাম ‘ফিলার’। মধ্যরাত্রে আরও কোনও ব্রেকিং নিউজ ঢুকে পড়লে এমন খবর পাতার লেআউট থেকে মাউসের এক ক্লিকে উঠে যায়। ভ্যানিশ। তবে যাদের জীবনে শূন্যতা নেমে আসে হঠাৎ, ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে গেলেও তার সেই দুঃখে কখনও খাদ মেশে না। মনের মধ্যে থেকে যায় আজীবনের সম্পদ হিসেবে। আর সেই সম্পদের গায়ে লেপটে থাকে কাঁটা। হয়তো রক্তও।
সমাজ নিয়ে যাঁরা মাথা ঘামান, তাঁদের মধ্যে কেউ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলছেন, ‘লোকটাকে হঠাৎ এভাবে মরে যেতে হল কেন?’ এই অপ্রিয় প্রশ্নের গায়ে আরও একটা জিজ্ঞাসা চিহ্ন জুড়ে থাকে। এই বৃদ্ধ বয়সে এক সরকারি হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ঘুরতে হল কেন তাঁকে? যদি প্রথম হাসপাতালেই ভর্তি করে নেওয়া হত ওই মানুষটিকে, তাহলে হয়তো ভদ্রলোককে এমন বেঘোরে প্রাণ দিতে হত না। খবরের কাগজের সূত্রেই জানতে পারলাম, মধ্য কলকাতার এক সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানকার চিকিৎসকরা বৃদ্ধকে পরীক্ষা করে ভর্তি হয়ে যাওয়ার কথা বলেন। তবে দশ বারোতলা সেই সুপারস্পেশালিটি হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ যে বার্তা দিয়েছিলেন, সোজা কথায় তার মানে দাঁড়ায়, ‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই, ছোট এ তরী।’ শয্যা অমিল। অতএব অ্যাম্বুলেন্সে ভর করেই রোগীকে ফের ছুটতে হল আরেকটি সরকারি হাসপাতালে। হয়তো রাস্তায় যাওয়ার সময় রোগীর আত্মীয়রা দেখেছিলেন আকাশ ঢেকে দেওয়া নানা বেসরকারি হাসপাতালের গর্বিত বিজ্ঞাপন। কয়েক লক্ষ খরচা করলে যেখানে জীবনের ‘দাম’ পাওয়া যায় অনেক। মফস্বলের ওই পরিবারের হয়তো সেই আর্থিক সামর্থ্য ছিল না। ফলস্বরূপ, চোকাতে হল চরম মূল্য।
অনলাইনে বাঁচতে বড় সাধ হয় আমাদের। বিখ্যাত মোবাইল সংস্থা প্রযুক্তির জেরে তামাম দুনিয়াকে হাতের মুঠোর মধ্যে ধরে ফেলার আশা দেখায়। নামজাদা ব্যাঙ্কের নেটব্যাঙ্কিং পরিষেবা তাদের বিজ্ঞাপনে জানান দেয়, ‘আজকের দিনে কেউ আবার ব্যাঙ্কে যায় নাকি? এক ক্লিকে পুরো ব্যাঙ্কের পুরো শাখা আপনার দোরগোড়ায়।’ আন্তর্জালে কিছু জানতে চাইলেই যে মন্দিরের দরজা খোলে, দেখি সেখানে সিংহাসনে অধিষ্ঠান করে রয়েছেন টেরাবাইটের দেবতা। কত জানবে জানো। রিয়েল টাইম ইনফরমেশন নিয়ে কাজ কম হচ্ছে না দুনিয়ায়। মাত্র ঘণ্টা দু'য়েক পরে কোন এয়ারলাইন্সের কোন বিমানে কটা আসন বাকি আছে, তা আমরা চাইলেই জানতে পারছি মুহূর্তে। ঘণ্টা দু'য়েক বলা ভুল, আগামী এক বছরের যাবতীয় বিমানের আসন সংরক্ষণ নিয়ে যাবতীয় তথ্য খোঁজ করলেই উপচে পড়ে মোবাইলে। পছন্দের সরকারি বাস কতক্ষণ পরে আসবে তা জেনে নিয়ে বাস স্ট্যান্ডে যেতে পারছি সময় মেপে। সিনেমা দেখার ইচ্ছে হলে চোখের পলকে কেটে ফেলা যাচ্ছে টিকিট। প্রিয় মাল্টিপ্লেক্সে কটা সিট আছে, বাহারি অ্যাপের কৃপায় তা আগে থেকেই জেনে নেওয়া যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, সংরক্ষণ করে নেওয়া যাচ্ছে পছন্দমত সিট। জয়েন্টের কাউন্সেলিংয়ের সময় রিয়েল টাইম প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে জানতে পারছি কোন কলেজে এই মুহূর্তে আর কটা আসন বাকি। যার সুবিধার জন্য বুক করে দিয়েছি অ্যাপ ট্যাক্সি, এই মুহূর্তে তিনি কোন রাজপথ কিংবা গলিতে রয়েছেন, এমন তথ্যে ইচ্ছে হলেই ধারা-স্নানের সুযোগ করে দিয়েছে হাল আমলের প্রযুক্তি। রিয়েল টাইম আপডেটকে যদি ভালবেসে ‘মুহূর্ত-নামা’ নামে ডাকি, তাহলে বলা যেতে পারে, এই কথাকে নিক্তি মেপে আরও নিখুঁত করার জন্য জোর গবেষণা চলছে বিশ্বজুড়ে। মাস খানেক আগে একটা নতুন অ্যাপের বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম। জানতে পেরেছিলাম, আরও অনেক কাজের মধ্যে এই অ্যাপটা ঠিক কোন জায়গায় আপনার গাড়িটা পার্ক করতে পারবেন, তার সন্ধানও দিতে পারে। এর অর্থ হল, দুটি পাশাপাশি গাড়ির মধ্যে যদি ছ-ফুট বাই সাত-ফুটের আয়তাকার ফাঁক থেকে থাকে, অ্যাপকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিলে এমন তথ্যও শেয়ার করে নেওয়া যাবে পরিচিত বৃত্তে।
মুহূর্তনামায় এমন গলা পর্যন্ত ডুবে গিয়েও খুঁতখুঁতে মানুষরা কপাল কুঁচকচ্ছেন বড্ড। তাঁরা বলছেন, সবই তো হল! শুধু শারীরিক অসুস্থতার আপৎকালীন সময়ে যে তথ্যের জন্য চাতক পাখির মত বসে থাকি আমরা, তা নিয়েই কারও কোনও হেলদোল নেই। কথাগুলো আমাদের ভাবাতে বাধ্য। ভাবলে অবাক হতে হয়, প্রযুক্তির এই রিয়েল টাইম আপডেটের ছাতার তলা থেকে চিরকালই ব্রাত্য রয়ে গেল আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। অনামী হাসপাতাল কিংবা নার্সিং হোমের কথা না হয় বাদই দেওয়া গেল, শহরের কোনও নামী হাসপাতালেও এই মুহূর্তে কটি শয্যা ফাঁকা রয়েছে তা জানার কোনও পরিকাঠামো আমরা তৈরি করে উঠতে পারলাম না এখনও। এ ভুখা দেশের সবচেয়ে বেশি মানুষ বিপদে সরকারি পরিকাঠামোর যে হাসপাতালগুলির শরণাপন্ন হন, তাদের নিয়ন্ত্রকরা এমন বিষয় নিয়ে কোনোদিনও মাথা ঘামিয়েছেন কিনা জানা নেই। কথায় আছে, ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়। উপায় খোঁজার জন্য অবশ্য প্রথমটি থাকা জরুরি। কোনও অজ্ঞাত কারণে তার মধ্যে মিশে রয়েছে হাহাকার ধ্বনি।
একটি নামজাদা বেসরকারি হাসপাতালে সম্প্রতি দেখেছিলাম, অপারেশন থিয়েটার লাগোয়া প্রতীক্ষালয়ে যে বিরাট স্ক্রিনটি বসানো রয়েছে, সেখানে তালিকায় ভেসে আসছে রোগীর আইডেন্টিফিকেশন আইডি এবং অস্ত্রোপচারের বর্তমান অবস্থা। প্রতীক্ষালয়ের এক পোস্টার বলছিল, রোগীকে বেড নম্বর ধরে ডাকি না আমরা। রোগীর পরিচয় তার রেজিস্ট্রেশন নম্বর। আঁচ করেছিলাম, রোগীর ব্যক্তিগত তথ্যর সুরক্ষার জন্যই হয়তো এমন ব্যবস্থা। স্ক্রিনে ভেসে উঠছিল দশ বারো জন রোগীর রেজিস্ট্রেশন নম্বর, যে ডাক্তারবাবু অস্ত্রোপচার করছেন তাঁর নাম, কি ধরণের অস্ত্রোপচার হচ্ছে তার দু-এক কথায় বিবরণ এবং শেষে লেখা ছিল বর্তমান অবস্থা। শেষ কলামের লেখাগুলো বদলে যাচ্ছিল কিছুক্ষণ পর। ‘ওটি ইন প্রোগ্রেস’ লেখাটা যখন মুছে গিয়ে ভেসে আসছিল ‘অস্ত্রোপচার শেষ, রোগীকে বেডে দিয়ে দেওয়া হয়েছে’, তখন ওই রোগীদের আপনজনের মুখে খেলা করতে দেখেছিলাম স্মিত আনন্দ। খুব উৎসাহ নিয়ে হাসপাতালের এনকোয়ারিতে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘অপারেশন নিয়ে যে রিয়েল টাইম আপডেট প্রতি মুহূর্তে দিচ্ছেন আপনারা, হাসপাতালের শয্যা নিয়ে সেটা কেন দিচ্ছেন না আপনাদের ওয়েবসাইটে?’ ঝলমলে রিসেপশনিস্টের মুখ বদলে গিয়েছিল হঠাৎ। ঝাঁঝিয়ে উঠে বলেছিলেন, ‘আপনি কি নিজেকে ভগবান মনে করেন? সরুন তো মশাই। নেক্সট।’
আন্তর্জাল আর লাইভ আপডেটের যুগে কত তথ্য জরুরি আর কতটুকুই বা অতি জরুরি—এ নিয়ে আমরা ভাবতে শিখব কবে? মরণাপন্ন যে রোগীকে নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ঘুরে চলেন রোগীর দিশাহারা আত্মীয়জনেরা, এমন তথ্য তাঁদের হাতের নাগালে থাকলে হয়তো প্রাণে বেঁচে যেতেন বহু মানুষ। এমনটা করা গেলে অতি ব্যস্ত হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে একদিকে যেমন বাড়তি ভিড় নিয়ন্ত্রণে থাকত, অন্যদিকে তুলনামূলক ভাবে কম ব্যস্ত হাসপাতালগুলো হয়তো আরও মন দিয়ে রোগীদের নিরীক্ষণ করতে পারত। হৃদরোগের ক্ষেত্রে যে ‘গোল্ডেন আওয়ার’-এর কথা সবসময় বলে থাকেন চিকিৎসকেরা, হাসপাতালের দরজায় প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ফলে সার্বিকভাবে সেই সময়ের কতটা অপচয় হচ্ছে, তা নিয়ে কেউ সমীক্ষা করেনি কখনও। বাস্তবের কালিমাখা চিত্রটা ফুটে উঠবে বলেই হয়তো এমন সমীক্ষা করাতে ভরসা পান না আমাদের জনপ্রতিনিধিরা। বাকিটা জানেন সূর্যের আলো মাখা ইউটিউবার!
খুব দেরি হয়ে যাওয়ার আগে কাজে লেগে পড়া জরুরি। আমার এক তথ্য-প্রযুক্তিবিদ বন্ধুকে বলতে শুনেছিলাম, ‘যে দেশে আইআরসিটিসি-র আসন সংরক্ষণের মত একটা বিরাট কর্মযজ্ঞ চলতে পারে, সেদেশে হাসপাতালের বেড অনলাইনে ম্যানেজ করা বাঁ হাতের কাজ। নস্যি।’
যা প্রয়োজন, তা হল সদিচ্ছা।