আরো অনেকের মত কুলদা রায়ের সাহিত্যের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় আন্তর্জালের লেখালেখির মাধ্যমে। কিন্তু যে লেখাটি পড়ে আমি তাঁর রচিত ছোটোগল্প সম্পর্কে উন্মুখ হয়ে উঠি সেটা ছিল শারদীয় অনুষ্টূপ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘মার্কেজের পুতুল’।তারপর থেকে তাঁর যে বইগুলি এখানে প্রাপ্তব্য সেগুলি জোগাড় করে পড়তে শুরু করি। তাঁর প্রথম যে বইটি গুরুচণ্ডালি প্রকাশনা থেকে ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল, সেই ‘কাঠপাতার ঘর ,আগান কথা বাগান কথা’—নির্দিষ্ট কোনো ঘরানার বই হিসেবে তাকে দেখা , তাকে সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব নয়। স্মৃতিকথা, মুক্তগদ্য, গল্প, এমনকি ব্যাঙ্গাত্মক রাজনৈতিক গল্প—সবকিছু আলাদা আলাদা ভাবে এই বইতে আছে। আবার অনেক লেখায় মিলে মিশেও আছে।কিন্তু একটি শব্দে যদি এই বইয়ের প্রাণসত্তাকে বর্ণ্না করতে হয় তবে বলতে হয় ‘চিত্ররূপময়’, জীবনানন্দের মতই। গদ্য যেহেতু, তাই আরো অনুপুঙ্খময়। তবে আমি মার্কেজের পুতুল গল্পটিকে কেন্দ্রে রেখে আমার আলোচনা শুরু করতে চাই। আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্পর্কে ন্যূনতম যেটুকু ধারণা আছে তার থেকেই আমার মনে হয় এটি বাংলা ভাষায় রচিত একটি আন্তর্জাতিক মানের গল্প। এই গল্পে বিভিন্ন স্থান ও কালের মাত্রাকে মিলিয়ে দিয়ে লেখক যে আখ্যানটিকে গড়েছেন সেখানে চরিত্র হিসেবে এসেছেন গ্যাবো তথা প্রখ্যাত লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, কবি পাবলো নেরুদা, প্রখ্যাত গায়িকা শাকিরা থেকে কবি বিষ্ণু দে, লেখক সৃষ্ট চরিত্র শ্যামাপদ আর জ্যোৎস্না বেগম তথা রাধারাণী। অবৈধভাবে আমেরিকাতে আসা লাতিন আমেরিকান অভিবাসী থেকে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদবাস্তুর ইতিহাস, ভূগোল , জীবনযন্ত্রণাকে মিলিয়ে দেয় এই গল্প।এই রকম গল্প ভাবতে সাহস লাগে। কুলদার লেখায় আমরা যাকে যাদু বাস্তব বা কুহকী বাস্তব বলি তার প্রচুর উদাহরণ আছে। কিন্তু সেটা কোনো আরোপিত আঙ্গিক নয়। গ্রামবাংলার যে যাপন তার অন্তর্গত বাস্তবতার গভীরতর স্তরটিকে ধরার জন্যই কুলদার অবলম্বন এই আঙ্গিক। এই গল্পেই যেমন ধর্ষিতা রাধারাণী ওরফে জোৎস্না বেগমের মৃতদেহ যখন গঙ্গায় ভাসছে তখনকার বর্ণনা—‘পাবলোর ( এই পাবলো মানে পাবলো নেরুদা) মনে হল – মেয়েটি মৃত নয়। নিদ্রিত সুন্দরী। জলের ঝাপটায় তার চোখ খুলে খুলে যাচ্ছিল। কিন্তু আশ্চর্য সুন্দর সেই চোখদুটো। কোনো অভিযোগ নেই। যেন কারো প্রতীক্ষা করছে। লোকগুলো বারবার সেই খোলা চোখদুটোর পাপড়ি বন্ধ করে দিচ্ছিল। কিন্তু সবাইকে হতবাক করে জলের ঝাপটায় খুলে খুলে যাচ্ছিল । সে জল কিন্তু নদীর নয় । উদ্গত অশ্রু।বেশি নয় । এক ফোঁটা। ভারী। নদীর জলের সঙ্গে কোনোভাবেই মেশে না। কিন্তু সে জল নদীর জলকে ধীরে ধীরে রক্তবর্ণ করে দিচ্ছে। মাছি উড়ছে তাঁর ক্ষতবিক্ষত মুখটিতে। সেই মুখটি থেকে দুটি শব্দ বের হলো—হা কৃষ্ণ।
কৃষ্ণ, রাধা, সুবল, সুদামা, পীর, ফকির, পরী, জিন--- এরা সবাই এই বাংলাদেশেই বেঁচে আছে, কুলদার গল্পে, তার স্মৃতিতে , আখ্যানে । ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম আসলে বিস্মৃতির বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম --- মিলান কুন্দেরার এই প্রবাদপ্রতিম বাক্যটি যে কুলদার সর্বশেষ গল্পগ্রন্থের প্রথমে উৎকীর্ণ হয়ে আছে , তা এমনি নয়। কুলদা , দু দুবার গৃহচ্যুত, দেশচ্যুত হতে বাধ্য হওয়া কুলদা সেই সংগ্রামই করছেন তাঁর লেখার মাধ্যমে সেটা সাহিত্যের পাঠকরা বোঝেন, আমার মত পরোক্ষ উদবাস্তুরা, যাঁদের পূর্বপুরুষরা দেশত্যাগ করে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন তাঁরা তো বোঝেনই। তাঁদের দৈনন্দিন যাপনে না হোক, স্মৃতির খেয়ায় পূর্বপুরুষের সেই উচ্ছিন্ন বেদনার ভার এখনও অনিকেত অনুভূতি বয়ে আনে।
দারিদ্র্য, প্রাকৃতিক বিরূপতা, সাম্প্রদায়িক মৌলবাদের বিপদ –এসব কুলদার লেখায় এসেছে। কিন্তু এগুলি তাঁর আখ্যানের ধ্যানবিন্দু নয়। ভালবাসা— সাধারণ মানুষের উপচে পড়া ভালোবাসা, সম্প্রদায় নির্বিশেষে, মানুষের প্রতি, মনুষ্যেতর প্রাণীর প্রতি, প্রকৃতির প্রতি, গাছপালার প্রতি, শিল্পের প্রতি—এ যেন ভালোবাসার ফলবতী হয়ে ওঠার আখ্যান। আর কেন যেন মনে হয় এই ভালোবাসা বাংলার মাটিতে, বাংলার জলহাওয়ায়, বাংলার মানুষের কাছেই প্রাপণীয় কেবল। তখনই বোঝা যায় কুলদা আসলে বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস লেখেন। একমাত্র মরমীয়াবাদী দৃষ্টি, যা তাঁর আছে, তাই দিয়েই এই ইতিহাস লেখা সম্ভব। এই মর্মবেদনা যা উদ্গত হয় ভালোবাসা থেকে, যা আমাদের সংশ্লিষ্ট করে জীবনপ্রবাহে।
এই জীবনপ্রবাহর স্বীকৃতিতে রচিত হতে পারে ‘সুবলসখার বিবাহ বৃত্তান্ত’ র মত গল্প যেখানে পটভূমিতে যে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ থাকে তা কেবল আন্দাজ করে নিতে হয়। বাংলার মানুষ তার ভালোবাসার আত্মসম্মান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে প্রতীক্ষায়। আসবে, তাদের আকাঙ্খিত ভালোবাসার মানুষ আসবে। অভাব, অনটন সবকিছুর মাঝেও ভালোবাসা বেঁচে থাকবে প্রতীক্ষায়। অন্তত এই গল্পকে আমি এই ভাবেই বুঝেছি।এই প্রতীক্ষাই তো’ বৃষ্টিচিহ্নিত জল’ গল্পের অঞ্জলির গোটা জীবনকে চালিত করে। কালাচাঁদের মূর্তি আর একটি বাঁশিকে আঁকড়ে , একবার শোনা সুরের টানে, একবারের দেখা কি না দেখা তীর্থনাথের জন্য তিনি বেঁচে থাকেন জীবনভর। এইরকম জীবনভর দায়বদ্ধতা ভালোবাসার প্রতি যে শুধু মানুষকে ঘিরেই আবর্তিত হয় এমন নয় , সেটি অনেক কিছু নিয়েই হতে পারে। গান, কবিতা, সার্কাস, যাত্রাপালা --- এগুলো যে প্রাত্যহিক জীবনের চেয়ে বড় হয়ে উঠতে পারে, আত্মত্যাগ আর নিষ্ঠার পরীক্ষা নিতে নিতে শিখিয়ে দিতে পারে সেই জীবনবোধ যা মানুষকে বিশিষ্ট করে তার প্রমাণ কুলদার অনেক গল্পেই আছে। যেমন ‘ মেঘনাদ বধ’ গল্পে বাংলার মাস্টারমশাই শেখ জহুরুল ইসলাম বা জহুর স্যার সারাজীবন ধরে, এমনকি মৃত্যুর আগে পর্যন্ত আঁকড়ে থাকেন একটিই বই – মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় জুহুর স্যারকে যখন পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তাদের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায় সেখানে আর্মির মেজরের সামনে জুহুর স্যার নির্ভীককন্ঠে আবৃত্তি করেন- মেঘনাদবধ কাব্যের প্রথম সর্গ থেকে।চাকরি থেকে বিতারণ, ক্রমশ একা হয়ে যাওয়া , এসবের মধ্যেও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই কাব্যগ্রন্থটির পাঠদানই জুহুর স্যারের অভীপ্সা হয়ে থেকে যায়। বাংলার সংস্কৃতির প্রতি এরচেয়ে গভীর, এরচেয়ে অর্থপূর্ণ নমস্কার আর কী হতে পারে যা কুলদা এই গল্পের জুহুর স্যারের মাধ্যমে রাখলেন বাংলা ছোটোগল্পের অঙ্গনে ?
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের মত কুলদার গল্পেও অনেক চরিত্র বিভিন্ন গল্পে দেখা দেয় – যেমন লেখকের ঠাকুর্দা বিধূ রায় যিনি যাত্রাপালায় কৃষ্ণচরিত্রে গান ও অভিনয় করেন, তাঁর পরিবারের আরো অনেক সদস্য, লক্ষনৌ থেকে পত্তনিদার সিকদারবাড়িতে মুজরো করতে আসা গন্নিবিবি, গুণিন কেশীর মা, অতীত ইতিহাস জানা অমৃত মুচি,বায়সবিদ্যা জানাারেক গুণিন বাবুরাম পাগল। এই গল্পগুলি আসলে এক বৃত্তান্ত থেকে আরেক বৃত্তান্তে গড়িয়ে পড়ে, অঙ্কের ভাষায় বলতে গেলে তারা কোনোভাবেই মিউচুয়ালি এক্সক্লুসিভ নয়। তাই এক যাপন থেকে আরেক যাপনে, এক অতিকথা থেকে আরেক অতিকথায়, এক চরিত্র থেকে আরেক চরিত্রে বড়সড় কোনো বিচ্ছেদ চোখে পড়ে না। যেন মানুষের ইতিহাস ধ্বংসে আর নির্মাণে বুকের মধ্যে ধরে রেখেছে আবহমানকালের বাংলাদেশকে।
আরেকটি বিষয়কে কুলদা প্রায় প্রতিটি গল্পে উস্কে দিতে পারেন, পাঠককে চ্যালেঞ্জের সামনে ফেলে দিয়ে –সেটা হচ্ছে চরিত্রের পরিচিতি বা আইডেন্টিটি সঙ্ক্রান্ত প্রশ্নটি । একই চরিত্র বা চরিত্রের সম্ভাবনাকে যুগপৎ বিভিন্ন ভৌগোলিক তলে, এমনকি বিভিন্ন কালপর্বে পাই আমরা। এভাবেই অনেক অতিকথার জন্ম হয়। এটা কোনোভাবেই পাশ্চাত্যের পরিচিতির সংকট নামক দার্শনিক সমস্যার দ্যোতক নয়। বরং এটা চরিত্রের বহুস্তরীয় উদবর্তন। চরিত্রের এই নমনীয়তা বা উদবর্তন গ্রামীণ সমাজের , ধর্মনির্বিশেষে, বিশ্বাস ও জীবনবোধের অংশ। অন্তত কুলদা জীবনের যে বৃহত্তর সত্যকে ধরতে চান, শুধুমাত্র অভিজ্ঞতাবাদী বয়ানের ওপর ভরসা না করে, সেখানে এই কৌশল তাঁর আখ্যানের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। আর কিছু না হোক লেখকের সর্বশেষ প্রকাশিত গল্পগ্রন্থের শীর্ষক গল্পটি ‘ যে সুচিত্রা সেন কিডন্যাপ হয়েছিলেন’ -- গল্পটি পড়লেই পাঠক বুঝতে পারবেন জনশ্রুতি, মিথ, স্মৃতি এবং সর্বোপরি আখ্যাননির্মাণের কুশলতা এই পরিচিতির প্রশ্নটিকে কীভাবে বহুকৌণিক বিচ্ছুরণে দেখাতে পারে। অতি সাম্প্রতিক গল্প’ ক্রশফায়ারের পরে যা যা ঘটেছিল’ গল্পে আবার পরিচিতির বিভ্রমকে রাষ্ট্রশক্তি কীরকম ভয়াবহভাবে ব্যবহার করতে পারে সেই সম্ভাবনা এক ভয়াবহ পরিণতির সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় পাঠককে। আমরা স্তব্ধ হয়ে যাই গল্পটি পাঠ করে।
‘জ্যোতিদিদির বিড়াল’ গল্পে আমেরিকা ও বাংলাদেশ, সংবাদ ও আখ্যান, দুই দেশের দুই বিপন্ন নারী যাঁরা আসলে একীভূত -- এখানেও আশ্চর্য নৈপুণ্যে পরিচিতির প্যারাডক্স এবং যাদু বাস্তবতাকে ব্যবহার করা হয়। গল্পের শেষটা ভালোবাসার মায়ায় ভরে থাকে। যেভাবে এই মায়া ছড়িয়ে থাকে ‘গুলাবগুলি’র মত গল্প যেখানে ব্যাপারি জ্যেঠির সঙ্গে স্নান করতে গিয়ে ডুবে মারা যায় রহিম নামে একটি বালক। ব্যাপারি জ্যেঠির কাছে সব বালকই গোপাল। গল্পের শেষের দিকে একটুখানি উদ্ধৃত করি—
জেঠিমা রূপসুন্দরী দাসী সোনার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বলে – অ গোপাল, মোর রহিম গোপাল গেলে কই ?
তার চোখ উদ্ভ্রান্ত। এই দশা তার কাটে না।
সোনা জেঠিকে ধরে আছে । সোনা জানে – তাকে ধরে থাকতে হবে। তারপর জেঠি এলিয়ে পড়বেন—ঘুমিয়ে পড়বেন সোনার কোলে। সোনার কোল ছাড়া আর কি আছে এই ভবে? এই কোল থেকে কে কেড়ে নেয় গো দাইমা, দাইমা গো।
ভালোবাসার এই হাহাকার বাংলাদেশের আকাশে বাতাসে মিশে আছে। কুলদা রায় জানেন তাকে কলমের ডগায় নামিয়ে আনতে।
আবার এই পরিচিতির গল্প লিখতে লিখতে ‘পরেশ মাস্টারের পরিবার’ গল্পে আমরা যখন ডায়েরির ছেঁড়া পাতার মধ্যে কার্ল মার্কসের একটি উদ্ধৃতি দেখি তখন মনে হয় সেখানে ক্ম্যুনিস্টদের যে ভুল স্বীকার এবং সংশোধনের কথা বলা হয়েছে তা এই গল্পের ব্যক্তিগত স্তরকে কোনো রাজনৈতিক মাত্রা দিচ্ছে কিনা ? সচেতন পাঠকের ক্ষেত্রে উত্তরটা অস্তর্থক হওয়াটাই স্বাভাবিক। অন্য দিকে খুব সরল ন্যারেটিভে, ছোটো ছোটো বাক্যে শুধু পরিচিতির প্যারাডক্সকে সামনে রেখে ‘ কোমল পুষ্প’ নামে যে অমোঘ গল্পটি লিখেছেন কুলদা , তা কোথাও রমানাথ রায়ের উত্তরাধিকারকে মনে করিয়ে দেয় আমায়। পরিচিতির বিষয়টিকে ব্যবহার করে আরেকটি সার্থক গল্প ‘ শবনম অথবা হিমিকালিপি’। তবে ‘ মথি উদয়ের তারা’ গল্পে এবং ‘কাকচরিত’ গল্পে আবার তিনিই মিথকে ভেঙ্গেছেন, কিছুটা যুক্তিবাদী ঢং্যে, যদিও সেখানে কোনো ব্যঙ্গ নেই, আছে নির্দোষ কৌতুক। কৌতুকভরে যেন কিছুটা সমালোচনা আছে মহম্মদ ইউনুসের মাইক্রোক্রেডিট সংক্রান্ত কাজকর্মের ‘শুয়াচান পাখি’ গল্পে। কিছু গল্পে নমঃশূদ্রদের নেতা যোগেন মণ্ডলের রেফারেন্স আছে। কিন্তু বাইরের রাজনীতি নয়, মানুষের যৌথ যাপনের গল্পই বেশি করে কুলদার গল্পে উঠে আসে।সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষবাষ্প কীভাবে ছড়িয়ে পড়ে তা যেমন আছে ‘ যে গ্রামের সবাই ধর্ষিত হয়েছিল’ গল্পে আবার যেন সেই বিষবাস্পকে গল্পের শেষে সকৌতুকে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আধুনিক আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের মগজ ধোলাইয়ের কথা আছে ‘লাদেনের জুতা’ গল্পে।
ধর্ম নিয়ে রাজনীতি এবং প্রশাসনিক মদতের কথা আছে ‘জন্মকাল’ গল্পে যেখানে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বিপন্নতার কথা আছে, কিন্তু কোথাও মুসলমানদের ভিলেন করে দেওয়া নেই । ‘গুলাবগুলি’ গল্পে সাময়িক অবিশ্বাসকে কাটিয়ে যখন মুসলিম পাড়ার ভেতর দিয়ে বিভূতি কাকার সঙ্গে নববধূ মেরি আর জামাই রূপকুমার যায় তখন ছবেদালি জোর করে তাদের নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে বিভূতিকাকাকে বলে, মাইয়া কি তোমাগো একারই – আমাগো মাইয়া না ? এই হচ্ছে বাংলাদেশের আত্মার স্বরূপ।
গল্পে ঐতিহাসিক ডকুমেন্টেশনের ধাঁচকে কাজে লাগিয়েও যে মিথের নির্মাণ এবং রূপান্তরের সুন্দর আখ্যান রচনা করা যায় তার উদাহরণ ‘ দি র্যালে সাইকেল’ আর ‘বিদ্যেসুন্দর’ গল্পদুটি। বিশেষত ‘বিদ্যেসুন্দর’ গল্পে বিদ্যেধর নামে একটি গ্রাম এবং গদাধর নামে এক রক্ষাকর্তা পুরুষকে নিয়ে যুগল মিথের নির্মাণে গড়ে ওঠে গল্পের কাঠামো। কুলদা নিউইয়র্কের পটভূমিতে যখন গল্প লেখেন ‘ ফ্লাই উইদাউট উইং’ – সেখানেও পরীদের নিয়ে আসেন। কিন্তু সেখানে যেন পরী কিঞ্চিৎ বেমানান। বাংলাদেশের গানের সুরে পরীদের যাত্রাপথ যেভাবে নির্মিত হয় সেইটা দেখানোতে কুলদা অনেক স্বচ্ছন্দ বোধ করেন, বোঝা যায়।
তবে যে কোনো সাহিত্যিকের মতই কুলদার আখ্যানরীতিও সব গল্পেই চূড়ান্ত সিদ্ধিতে পৌঁছেছে , এমনটা নয়। আসলে যাদু বাস্তবতার প্রয়োগরীতিতে অত্যন্ত সতর্কতার দরকার পড়ে। তৃতীয় বিশ্বের বাস্তবতায় যাদু, অতিকথা, লোকবিশ্বাস –এগুলোর গুরুত্ব আছে বলেই সেগুলি আখ্যানের অংশ হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু যে কৃৎকৌশলের ফলে বাস্তবতার সেই স্তরটিকে অনায়াসে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়, ন্যারেটিভের চোরকুঠুরিতে প্রবেশ করার পর একসময় যাদুকে আমরা যাদু বলেও চিনতে পারিনা, বাস্তবতার অংশই হয়ে ওঠে তা—সেসব লাতিন আমেরিকার সাহিত্যিকদের রচনাতে আমরা দেখেছি। আর শুধু যাদু বাস্তবতাই বলি কেন, বাস্তবতার প্রাথমিক স্তরকে ভেঙ্গে ফেলার পর যা ঘটতে থাকে ইওরোপের প্রসিদ্ধ সাহিত্যিকদের লেখাতেও আমরা দেখিনি কি? ধরা যাক কাফকার ‘ মেটামরফসিস’ গল্পটি পড়তে গিয়ে কয়েক লাইন পরেই আমরা ভুলে যাই যে একজন মানুষের এভাবে পোকায় রূপান্তর ঘটতে পারে না। গল্পের বাস্তবতা আমাদের বাস্তবতাকে অধিগ্রহণ করে। এখানেই লেখকের চূড়ান্ত অর্জন। কুলদা রায় সেই মানে অনেক গল্পেই পৌঁছেছেন। কিছ কিছু জায়গায় পৌঁছাতে পারেন নি। মানে সেখানে হয়ত ন্যারেটিভের মধ্যে বিষয়টির আত্তীকরণ সেভাবে ঘটে নি। এছাড়া তার গল্পে মাল্টিপল ন্যারেটিভ যেমন মার্কেজের পুতুলের মত গল্পে চূড়ান্ত সিদ্ধিতে পৌঁছেছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা আবার পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখতে কিছুটা অসুবিধা তৈরি করে। হয়ত ছোটোগল্পের কাঠামোর জন্য এটা সবসময় যথার্থ হয় না। যদিও আধুনিক উপন্যাসের ক্ষেত্রে এই রীতি আমরা হামেশাই দেখি। এছাড়াও কুলদা আমাদের গল্পের মধ্যে প্রায়ই অনেকগুলি সম্ভাবনার সামনে দাঁড় করিয়ে দেন। পাঠক যেন একটা রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে যেখান থেকে অনেকগুলি রাস্তা তার সামনে খোলা আছে। সেই পথগুলিতে লেখকের সঙ্গে কিছুটা হাঁটতে ইচ্ছে হতে পারে পাঠকের। কিন্তু ছোটোগল্পের কাঠামোতে সেই সম্ভাবনাগুলি নিজেদের একটুও মেলে ধরার সুযোগ পায় না। অনেক সময় মনে হয় একটা ছোটো জায়গায় তাদের ঠুসে দেওয়া হয়েছে। আরেকটু বড় পরিসর পেলে হয়ত আরেকটু হাত পা ছড়িয়ে ভাবনাগুলো ডালপালা মেলতে পারত। সম্প্রতি আন্তর্জালে দেখলাম কুলদা রায়ের উপন্যাস বেরোতে শুরু করেছে, ধারাবাহিক ভাবে। সবে চারটি পর্ব বেরিয়েছে, এখনই এ নিয়ে মন্তব্য করা যাবে না। তবে কুলদা রায়ের কাছে আমাদের যে বিরাট প্রাপ্তির প্রত্যাশা ইতিমধ্যে জেগে উঠেছে আর যে ছোটো ছোটো অপ্রাপ্তির অস্বস্তি আছে- তার উভয়েরই নিরসন ঘটবে ,এমনটা আশা করাই যায়। বাংলার আকাশ বাতাস, জল স্থল, মানুষ ও প্রকৃতিকে যিনি এত ভালোবেসেছেন বাংলা সাহিত্যের বরণডালা তাঁর জন্য সজ্জিত থাকবে না এমনটা কি হতে পারে ?
আলোচিত বই ঃ
(১) কাঠপাতার ঘর, আগান কথা -বাগান কথা , গুরুচণ্ডালী,২০১৩ ও ২০১৬
(২) বৃষ্টি চিহ্নিত জল, সোপান , ২০১৫
(৩) মার্কেজের পুতুল ও অন্যান্য গল্প, সোপান,২০১৯
(৪) যে সুচিত্রা সেন কিডন্যাপ হয়েছিলেন,গুরুচণ্ডালী, ২০২২
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।