আদি
------
এখনো রক্তপাত আর প্রাণহানির হিসেবনিকেশ চলছে। চলছে আগের ইতিহাসের সঙ্গে মিলিয়ে তুলনামূলক আলোচনা। হিংসার বাড়াবাড়ি দেখে অনেকে বলছেন, পঞ্চায়েত ভোট বন্ধ করে দেওয়াই ভালো। কেউ কেউ বলছেন, আচ্ছা, পঞ্চায়েত ভোটকে দলীয় রাজনীতির আওতায় আনলো কে ? সিপিএম বুঝি ? নাহলে তো কেমন’ আগে কী সোন্দর দিন কাটাইতাম’ মোডে দিন চলতো আমাদের। কিন্তু এই অবস্থানে পৌঁছে যাওয়াটা যে কী সমস্যার, সেটা বোঝা উচিত আমাদের। তার জন্য শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, সামগ্রিকভাবে ভারতবর্ষের রাজনীতিতে ব্যবস্থা হিসেবে পঞ্চায়েতের গুরুত্ব কিভাবে রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক ধারণায় রূপ পেয়েছে সেটা একটু দেখে নেওয়া প্রয়োজন।
ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ আর স্বায়ত্তশাসনের ধারণা থেকেই পঞ্চায়েতের জন্ম। ১৮৮২ সালে ভাইসরয় লর্ড রিপনের প্রস্তাবনায় এই ভাবনার বীজ দেখা যায়। ১৯০৭ সালে ব্রিটিশ সরকার বিকেন্দ্রীকরণের জন্য ছয় সদস্যের এক কমিটি গঠন করে যার একমাত্র ভারতীয় সদস্য ছিলেন রমেশ চন্দ্র দত্ত। এই কমিটি গ্রামীণ প্রশাসন চালানোর জন্য পঞ্চায়েতী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে। ১৯০৯ সালে কংগ্রেসের লাহোর অধিবেশনে পঞ্চায়েত প্রধান নির্বাচন এবং কার্যকরী আর্থিক অনুদানের পক্ষে প্রস্তাব নেওয়া হয়। ১৯১৩ সালে কংগ্রেসের করাচি অধিবেশনে গৃহীত প্রস্তাবে দুঃখ প্রকাশ করে বলা হয় যে এব্যাপারে কোনো সুপারিশই কার্যকর হয় নি। চার বছর পর কলকাতা অধিবেশনে ড অ্যানি ব্যাসান্ত এবং সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসন এবং পৌরসভার জন্য জোরালো সওয়াল করেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ১৯২২ সালের গয়া কংগ্রেসে একই দাবি তোলেন। ১৯২৫ সালে মাত্র আটটি রাজ্য স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন আইন পাস করে। যদিও পঞ্চায়েতের অধীন গ্রামের সংখ্যা ছিলো যেমন কম, তার কার্যাবলীর এক্তিয়ারও ছিলো খুব সীমিত।
গান্ধীজীর নেতৃত্বে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভ পর্যন্ত কংগ্রেসের দেশ গঠন ভাবনায় পঞ্চায়েত কেন্দ্রীয় অবস্থানে ছিলো। অথচ সংবিধানের প্রথম খসড়ায় পঞ্চায়েতের কোনো উল্লেখই ছিলো না। গান্ধীজী জানতে পেরে সেটা দ্রুত সংশোধনের কথা বলেন। এমনকি জওহরলাল নেহরু নিজেও প্রথম দিকে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা নিয়ে খুব আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু ১৯৫৭ সালের পর থেকে আমৃত্যু নেহেরু, নিজের দলের ভেতরে অনেক বিরোধিতা সত্ত্বেও , পঞ্চায়েত ব্যবস্থার প্রবর্তনে উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। নেহেরু ভয় পেতেন যে তাঁর মৃত্যুর পর পঞ্চায়েত ব্যবস্থার অগ্রগতি যেটুকু হয়েছে তা হারিয়ে না যায়। তার ভবিষ্যৎবাণীকে সত্য করে সরকার ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত চলে আসা পঞ্চায়েতী রাজ মন্ত্রকটিই তুলে দেয়। যথারীতি সংবাদমাধ্যমও বলতে থাকে পঞ্চায়েতী ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে।
১৯৭৭ সালের ১২ই ডিসেম্বর । ঐদিন গঠিত হয় অশোক মেহেতা কমিটি। ভারতের পঞ্চায়েতী ব্যবস্থায় এটি একটি নির্ণায়ক মুহূর্ত। ১৯৭৮ সালের ২১ শে জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের কাছে কমিটির রিপোর্ট জমা পড়ে। অকংগ্রেসি রাজ্যগুলি যেমন পশ্চিমবঙ্গ, কর্ণাটক ও অন্ধ্র প্রদেশে এই প্রথম কার্যকরী পঞ্চায়েতের কাজ শুরু হয়। মনে আছে, বছর দশেক পরে কংগ্রেসের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীরাজীব গান্ধী পশ্চিমবঙ্গ ও কর্ণাটকের নাম সারা দেশের কাছে মডেল হিসেবে তুলে ধরেছিলেন। ভারতে গ্রামীণ ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ ছিলেন কেরালার প্রথম কম্যুনিস্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী ই এম এস নাম্বুদ্রিপাদ। তাঁর মতে গণতন্ত্রের বিকাশের চারটি স্তম্ভ হোলো কেন্দ্র, রাজ্য, জেলা এবং পঞ্চায়েত। প্রতিরক্ষা, বিদেশ নীতি, মুদ্রা এবং গণসংযোগের মত কয়েকটি ক্ষেত্র কেন্দ্রের হাতে রেখে বাকি সব কিছু রাজ্য এবং সেখান থেকে ক্রমান্বয়ে জেলা এবং আরো নিচের নির্বাচিত সংস্থার হাতে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন ই এম এস । তবে এখনো ভারতবর্ষের অনেক রাজ্যে সংবিধানের ৭৩ তম সংশোধনী অনুসারে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচনের ব্যবস্থাই হয় নি। যদিও হিংসা এবং প্রাণহানির ঘটনা সর্বাংশেই নিন্দনীয় এবং এসব আটকাতে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত কিন্তু এটাও মনে রাখা উচিত যে পঞ্চায়েতের রাজনীতিকে গ্রামীণ মানুষ নিজেদের বাস্তবতার ভেতর অনেক বেশি পরিমাণে অনুভব করেন বলেই তাতে তাঁরা অংশীদারী হিসেবে জড়িয়ে পড়েন বেশি।
পঞ্চায়েতী ব্যবস্থার অন্যতম শত্রু ছিলো আমলাতন্ত্র-- অ্যানি বেসান্ত থেকে ই এম এস সেই রোগের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন। এব্যাপারে সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার কথা বলতে গিয়ে ই এম এস বলেছিলেন, জাতীয় এবং রাজ্য স্তরে গণতন্ত্র এবং নিচের পর্যায়ে আমলাতন্ত্র—এভাবেই ভারতের সংবিধানে শাসনতন্ত্রকে বাঁধা হয়েছে। যেখানে পঞ্চায়েত রাজ নেই সেখানে আছে কালেক্টর রাজ, বিডিও রাজ এবং মুখিয়া রাজ, আছে ঔপনিবেশিক ঢংয়ে।
মধ্য
---------
পঞ্চায়েত ভোটে রাজনৈতিক দলের প্রতীকে অংশগ্রহণ নিয়ে বিতর্ক একসময় অনেক হয়েছে। জয়প্রকাশ নারায়ণের মত সর্বোদয়বাদী এবং গান্ধী অনুগামী গ্রাম স্বরাজের প্রবক্তারা দলহীন গণতন্ত্রের প্রবক্তা ছিলেন। জয়প্রকাশের মতে আমাদের জনগণের বেশিরভাগই অজ্ঞ এবং অশিক্ষিত। পঞ্চায়েতে রাজনৈতিক দলের অনুপ্রবেশে তারা রাজনৈতিক দলের দাবার বোড়েতে পরিণত হবে। সারা ভারত পঞ্চায়েত পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে ১৯৬১ সালে জয়প্রকাশ নারায়ন রাজ্যগুলিকে এমন পরামর্শও দেন যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন করা হোক ঐকমত্যের ভিত্তিতে। তখন অবশ্য ৩০ শতাংশ পঞ্চায়েত নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীনই হোতো। শুনতে যতই ভালো লাগুক এই ঐকমত্যের আড়ালে আসলে গ্রামে গ্রামে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের কর্তৃত্বই ধরে রাখতেন। রাজনৈতিক দলগুলি তাঁদের নিজেদের দিকে নিয়ে এসে বরং অবৈধভাবে ক্ষমতাভোগ করতো। তাই ১৯৭৮ সালে অশোক মেহেতা কমিটি সরাসরি রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের সুপারিশ করে। রাজনৈতিক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে কর্মসূচী ভিত্তিক রাজনীতিকে তা আরো সুসংহত করবে এটা স্পষ্ট ছিলো। সিপি আই এমের যেমন বক্তব্য ছিলো কোনো একক ব্যক্তির পক্ষে গ্রামীণ কায়েমী স্বার্থ, জাতপাতের আধিপত্য—এসবের বিরুদ্ধে লড়াই করা প্রায় অসম্ভব। এটা একমাত্র রাজনৈতিক দল করতে পারে। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, ১৯৮৭ সালে কর্ণাটকে প্রথমবার রাজনৈতিক দলভিত্তিক পঞ্চায়েত নির্বাচন গ্রামীণ ক্ষমতার কুক্ষিগত আধিপত্য ভেঙ্গে নতুন চেতনার বিকাশ ঘটাতে পেরেছিলো।
অন্ত
---------
এটা ঠিক যে রাজনৈতিক দলের বিসংবাদ অনেক সময় উন্নয়নকে ব্যহত করতে পারে। এজন্য তৃণমূল স্তরে বিরোধী দলের স্বীকৃতি এবং মর্যাদা থাকা দরকার। বামফ্রণ্ট সরকারের সময় এরকম কতকগুলি ব্যবস্থা করা হয়েছিলো যাতে গ্রামীণ উন্নয়নের ক্ষেত্রে সর্বাত্মক অংশগ্রহণ ঘটে এবং শাসক দলের ওপর ‘ চেক অ্যাণ্ড ব্যালেন্স’ এর নীতি কার্যকরী হয়। যদিও আদপে এই নীতিগুলি অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া কেবলমাত্র খাতায় কলমে মান্যতা পেয়েছে কারণ স্বায়ত্তশাসনের নীতিকে গ্রাস করেছিলো পার্টির আমলাতন্ত্র। নয়তো গ্রাম সভা, গ্রাম উন্নয়ন সমিতি, গ্রাম সংসদ প্রভৃতিতে বিরোধী দল এবং জনগণের কণ্ঠস্বর শোনার যে আইন করা হয়েছিলো ১৯৯৪ সালের রাজ্য সরকারের আইনে তা এভাবে মাঠে মারা যেতো না। অন্তত সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রামের যে বিপর্যয় তা হয়তো এড়ানো যেতো যদি স্থানীয় গ্রামীণ মানুষের ভাবনার সঙ্গে সেতুবন্ধনের এই চমৎকার উপায়ের সদব্যবহার করা যেতো। ২০০৪ সালের পশ্চিমবঙ্গের সংশোধিত পঞ্চায়েত আইনে গ্রাম উন্নয়ন সমিতির অন্যতম সদস্য করা হয়েছে পঞ্চায়েত নির্বাচনে যিনি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছিলেন তাঁকে। ১৯৯৪ সাল থেকেই পঞ্চায়েত আইনের ২১৪ (ক) ধারায় জেলা পরিষদের অধ্যক্ষ বা চেয়ারপার্সনের পদটি বিরোধী দলের নেতৃত্বকে দেওয়ার রীতি রয়েছে। এই ধারণাগুলি অত্যন্ত সুচিন্তিত। কার্যক্ষেত্রে এর সুষ্ঠু প্রয়োগে বামফ্রন্ট বেশিরভাগ সময় ব্যর্থ হয়েছে বলেই এগুলিকে পরিহার করার প্রয়োজন পরে না। বিরোধী কণ্ঠস্বরের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এবং পঞ্চায়েত স্তরে দুর্নীতির ওপর নজরদারির জন্য এরকম আরো অনেক কার্যকরী ব্যবস্থার কথা ভাবা প্রয়োজন। কিন্তু যাঁরা পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় হিংসা এবং রক্তপাত দেখে পঞ্চায়েতের ধারণাটাকেই বিসর্জন দিতে চান তাঁরা কায়েমী স্বার্থেরই সুবিধা করে দেবেন। ক্ষমতায় এসে জ্যোতি বসু বলেছিলেন , এখন সরকার চলবে মহাকরণ থেকে নয়, গ্রাম বাংলা থেকে—সেটাই পঞ্চায়েতের মূল আদর্শ। আজ যখন বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী বলেন, আমিই দেখে নেবো পঞ্চায়েত, প্রার্থী ঠিক হবে কলকাতা থেকে, তখন মনে হয় উল্টোরথের যাত্রী হতে চাইছি আমরা। উন্নয়ন কাকে বলে তা নবান্ন ঠিক করে দেবে, গ্রাম পঞ্চায়েতগুলি হবে শুধু রাজ্য সরকারের তল্পিবাহক। বিরোধী দলের মর্যাদা, তৃণমূলস্তরের পরিকল্পনা, গ্রামীণ মানুষের সিদ্ধান্তগ্রহণ --- এসবের কোনো দায় বুঝি আর পঞ্চায়েতের থাকবে না। আজ দরকার পঞ্চায়েতের আদর্শকে প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম যা আসলে গ্রামীণ মানুষের গণতান্ত্রিক সংগ্রামেরই অংশ।পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে অভিসম্পাত দেওয়া, তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া কোনো কাজের কথা নয়।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।