আমরা বেশীর ভাগই জানি বাটিকের জামাকাপড় কি জিনিস – নিজে না পরলেও অন্তত শুনেছি ‘বাটিক প্রিন্ট’ ব্যাপারটা। যাঁরা আগে বাটিক নামটি শোনেন নি, তাদের জন্য খুব সহজ ভাবে বলতে গেলে বাটিক হল কাপড়ের উপর ডিজাইন তৈরীর এক বিশেষ পদ্ধতি। এই বাটিক কি নতুন জিনিস? না – একদমই নয়! বাটিকের ইতিহাস অনেক প্রাচীন – প্রায় ১৫০০ থেকে ২০০০ হাজার বছর আগে থেকে নাকি এই বাটিক পদ্ধতি জনগণ জানত এবং পৃথিবীর নানা প্রান্তের লোকেরাই সেই পদ্ধতি ব্যবহার করে কাপড়ের উপরে ডিজাইন করত। এবার তাহলে পরের স্বাভাবিক প্রশ্ন – বাটিক পদ্ধতির উৎপত্তি কোথায়?
পৃথিবীর আরো নানাবিধ জিনিসের মত বাটিকের উৎপত্তি নিয়েও টানাবাহানা আছে – বিশেষ করে যখন আজকে যাকে বাটিক বলি তেমন ডিজাইনের কাপড় দেখা গেছে ভারত, চীন, মিশর থেকে শুরু করে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার নানা জায়গায়। এই সব জিনিস নিয়ে বিতর্ক শেষ হয় না – কথায় বলে বিশ্বাসে মিলায় বস্তু! তবে মোটামুটি আজকাল যা স্বীকৃত তা হলে বাটিক পদ্ধতির উৎপত্তি হয়েছিল আজকের দিনের ইন্দোনেশীয়া দেশের জাভা দ্বীপে। বাটিক শব্দটির উৎপত্তি জাভা থাকে, মূল শব্দ ছিল ‘আমবাথিক’। জাভানীজ ভাষায় ‘আমবা’ মানে হচ্ছে চওড়া বা বৃহৎ এবং ‘থিক’ শব্দের অর্থ ‘বিন্দু’। এই ভাষাতেই বাথিকান শব্দের অর্থ আঁকা বা লেখা। কালের ক্রমে ইন্দোনেশীয়ার মূল স্রোতে যখন বাথিকা মিশে গেল তখন ‘থিক’ শব্দবন্ধ উচ্চারিত হতে লাগল ‘টি’ দিয়ে এবং সেই থেকেই আজকের বাটিক শব্দটি।
একদম সাদামাটা ভাবে বলতে গেলে বাটিক তৈরী হয় এই ভাবে – একটা কাপড়ের টুকরোয় আপনি কিছু একটা ছবি ছাপা এঁকে নিলেন, মানে যেই ছবি আপনি ছাপা দেখতে চান আর কি। এবার সেই এলাকাটা প্রথমে মোম গলা বা অন্য কোন স্পেশাল পেষ্ট দিয়ে ঢেকে দিলেন, মূলত গলানো মোমই ব্যবহার করা হয় এই কাজে। এই মোম লাগানো হয়ে গেলে কাপড় টিকে রঙ করা হয় – প্রথমে এর উপর দিয়ে যে রঙ চাইবেন সেই রঙের ব্রাশ বুলানো হয় এবং তারপরে সেই রঙে চুবানো হয়। এবার শুকিয়ে নিন রঙ – এর ফলে হয় কি যে জায়গা গুলি আপনার মোম দিয়ে ঢাকা ছিল সেই জায়গাটাতে রঙ ধরবে না, কিন্তু বাকি কাপড়ে রঙ হবে। এটা হল একবার মোম দিয়ে খুবই সাধারণ ডিজাইন। বুঝতেই পারছেন যত জটিল ডিজাইন চাইবেন বা যত রঙের মিশ্রণ চাইবেন কাপড়ে তত বার আপনাকে এই পদ্ধতি রিপিট করতে হবে। কিছু কিছু বাটিকে তো ২০ বারের মত এই মোম গলানো এবং রঙ করার পদ্ধতি রিপিট করা হয় একটুকরো কাপড়ে। খুবই পরিশ্রম সাধ্য কাজ।
তাই যদি হাতে বানানো এবং খুব জটিল কারুকাজ করা বাটিক প্রিন্টের কাপড় কিনতে চান, তা খুব দামী। এ তো গেল পরিশ্রমের দাম, এবার যে কাপড়ে বাটিক আঁকা হচ্ছে সেই কাপড়ও যদি দামি হয় (যেমন ধরুণ স্পেশাল সিল্ক বা স্পেশাল সুতি/লিনেন ইত্যাদি) তাহলে সব মিলিয়ে খুবই দামী হয়ে যায় বাটিক। যদি কেউ দাবী করেন যে তিনি সস্তায় বাটিকের কাপড় কিনে নিয়ে এসেছেন, তাহলে আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন যে সে জিনিস হাতে বানানো হয় – আমাদের জামদানীর মতন কেস! মেসিনে বানানো জামদানী ২০০০ টাকায় বিক্রী হচ্ছে – হাতে বানানো আসল জামদানীর দাম যেখানে মনে হয় মিনিমাম ১০-১৫ হাজার থেকে শুরু হবার কথা। এবার হাতে বানানো আসল জামদানী কিনবেন নাকি আসল বাটিক সেটা আপনার ব্যাপার – এ ব্যাপারে আমার কিছুই বলার নেই। বলার কথা একটাই হাতে বানানো আসল জিনিস কিনতে চাইলে পকেট হালকা হবার জন্য প্রস্তুত থাকুন।
বুঝতেই পারছেন এত লেবার-ইনটেনসিভ কাজ হবার জন্য এই টেকনিক ইউরোপের দিকে জনপ্রিয় হওয়া দামের দিকে থাকে বিশেষ করে এখনকার যুগে – এটা বেশ চাপের। এমন জিনিস উন্নত দেশগুলিতে বানালে সেগুলো কেবল লাক্সারি জামাকাপড় হিসাবেই থেকে যাবে, সাধারণের নাগালে থাকবে না। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে এই জাভা দ্বীপ থেকেই বাটিক ছড়িয়ে পড়েছিল ইউরোপে বণিকদের দ্বারা – ডাচেরা সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে প্রথম ইউরোপে নিয়ে যায়। লন্ডন থেকে ১৮১৭ প্রকাশিত ‘হিষ্ট্রি অফ জাভা’ বইতে সর্বপ্রথম বর্ণিত হয় বাইরের জগতের কাছে এই বাটিক টেকনিক। ধীরে ধীরে অনেক ইউরোপীয়ান এই বাটিক নিয়ে ইন্টারেষ্ট নেন – এবং কলোনীয়াল যুগের শেষের দিকে ডাচ এবং চীন দেশের লোকজন বাটিক শিল্পের উন্নতির জন্য অনেক কাজ করেন।
আজকের দিনে বাটিক ডিজাইন দ্বারা অনুপ্রাণিত অনেক কিছু শিল্প সামগ্রী, পেন্টিং, ঘর সাজাবার জিনিস, বা ফ্যাব্রিক ও আপনি পাবেন ইউরোপ বা আমেরিকায় – কিন্তু এরা ওই অনুপ্রাণিতই! আসলে বাটিক যেভাবে হাতে করে বানানো হয়, আজকের ইউরোপের বা আমেরিকার বাটিক সেই ভাবে বানানো নয়।
জাভা দ্বীপ বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বা ভারতে এখনও অনেক বাটিক ডিজাইনে কেবল প্রাকৃতিক রঙ (ন্যাচারাল ডাই) ই ব্যবহার করা হয় কেবলমাত্র। আগে লিখেছি বাটিক প্রিন্ট কেমন বানানো হয় খুব সোজা ভাবে – কাপড়ের কিছুটা জায়গা ঢেকে সুরক্ষিত করা হয় যখন কাপড়টাকে রঙে ডোবানো হয়। তা কি ভাবে জায়গা/আঁকা কে সুরক্ষিত করা হয় তা মূলত দুই পদ্ধতির – ১) জাভানীজ পদ্ধতির মোম গলিয়ে সুরক্ষা (জাভানীজ ওয়াক্স রেজিষ্ট) আর ২) নানাবিধ জিনিস দিয়ে বানানো পেষ্ট দিয়ে সুরক্ষা (পেষ্ট রেজিষ্ট)।
মোম গলিয়ে বাটিক পদ্ধতি কিন্তু জাভা ছাড়া ভারত, চীন বা মধ্য প্রাচ্যেও দেখা গেছে – কে আগে শিখেছিল কার থেকে – এ নিয়ে ধোঁয়াশা থাকবেই। কিন্তু যেটা বলা যায় মোম দিয়ে বাটিকের ডিজাইনের দিক থেকে জাভা ডিজাইনই সত্যিই অনন্য – তা সে ডিজাইনের জটিলতাই বলুন বা সূক্ষ্মতা। জাভার বাটিক যাকে বলে স্ট্যান্ড-আউট। এবং সেই জন্যই এই পদ্ধতিকে জাভা রেজিষ্ট নামে অবহিত করা হয়। তা না হলে অনেকে দাবী করেন এই পদ্ধতি আসলে জাভাতে আসে দ্বাদশ শতাব্দীতে ভারত নতুবা তখনকার পার্শিয়া থেকে। আবার কেউ বলে না পার্শিয়া নয়, হয় ভারত নতুবা শ্রীলঙ্কা থেকে এসেছিল এই পদ্ধতি জাভাতে। তবে যেখান থেকেই আসুক না কেন, সবাই একমত যে দ্বাদশ শতাব্দীর পর থেকেই জাভাতে বাটিকের প্রচলন ব্যপক ভাবেই হয়। শুধু সামাজিক জীবনেই নয়, সাংস্কৃতিক ভাবেও বাটিক বেশ বড় জায়গা করে নেয় সেই দেশের ইতিহাসে। এবং তার নানা উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায় জাভার নানা জায়গায়। ১৩শ শতাব্দীর পর থেকে যে সব হিন্দু-বৌদ্ধ মন্দির তৈরী হয়েছিল তাদের অনেক জায়গায় খোদাই করা মূর্তির পরিধানে নানা ধরণের বাটিকের মোটিফ দেখা যায়।
এই জাভা মোম রেজিষ্ট পদ্ধতি আবার দুই ভাবে কাপড়ে প্রদান করা হয়ে থাকে এবং তার উপর ভিত্তি করেই জাভার বাটিক প্রধানত দুই প্রকার
১) টুলিস বা হাতে আঁকাঃ এই পদ্ধতিতেই বানানো হয় সবচেয়ে সূক্ষ্ম, সুন্দর এবং দামী বাটিক। এ ডিজাইনের গোটাটাই হাতে দিয়ে মোম ঢেলে আঁকা, যে ছোট্ট সামগ্রী/যন্ত্র দিয়ে এই মোম ঢালা হয় তার নাম ‘টাজানটিং’ (অনেক সময় এই যন্ত্রটিকে ক্যান্টিং ও বলে) । কত সময় সাপেক্ষ এই বাটিক বানাতে তার একটা উদাহরণ রাখা যাক – মোটামুটি ভালো ডিজাইনের দুই মিটার মত বাটিক বানাতে লাগে মোটামুটি ৩০ থেকে ৫০ দিনের মত। এর মধ্যে ১৫ দিন মত শুধু লাগে মোম ঢেলে ডিজাইন আঁকতে কাপড়ের গায়ে। তাই বুঝতেই পারছেন এই জিনিস কেমন দামী হবে। আর তাই প্রথম দিকে কেবম মাত্র বড়লোক, রাজা মহারাজা, সামন্ত, সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী এদেরই কেনার ক্ষমতা ছিল এমন ধরণের বাটিক। তাহলে অন্য কোন উপায় কি নেই যা দিয়ে তাড়তাড়ি ডিজাইন বানানো যায় যাতে করে সাধারণের কেনার ক্ষমতার মধ্যে আসে এই বাটিক? আজকের দিনে শুধু বড়লোক নয়, সাধারণের মধ্যেও বাটিক খুব জনপ্রিয় – এবং তার জন্য এই দ্বিতীয় পদ্ধতির অবদান অনেক।
২) টাজাপ বা স্ট্যাম্প দিয়ে মোম ঢালা – এটা অনেকটা সেই ব্লক প্রিন্টের মত। হরেক ডিজাইনের ছাঁচ বানানো আছে, সেই ছাঁচ দিয়ে পটা পট ছাপ মেরে যাও। তবে এখানে মনে রাখবেন এটা যে এই ছাপ কিন্তু রঙের নয়! তামার ছাঁচ বানানো হয় সাধারণত, এবং সেই দিয়ে ছাপ দেওয়া হয় মোমের! হাতে এঁকে মোম ঢালাকে ছাঁচ দিয়ে মোম ঢালা দ্বারে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে। আর বাকি স্টেপ গুলি দুই পদ্ধতিতেই এক। কিভাবে চিনবেন কোন বাটিক ছাপ মারা আর কোন বাটিক হাতে আঁকা? হাতে কোন কাজ করলে তাতে কিছু খুঁত থাকবেই – মানে সব সরলরেখা, সব রেখা তো আর একপ্রকারের হবে না! মানে পাশাপাশি দুটি প্যাটার্ণে কিছু না কিছু পার্থক্য আপনি লক্ষ্য করবেনই। আর ছাপ মারলে সেই সমস্যা থাকে না – একের পর এক নিখুঁত ভাবে রিপিট হয়ে যাবে ডিজাইন। আর যেহেতু এটা এক মেকানিক্যাল পদ্ধতি, তাই চাইলেই ডিজাইন প্রচুর জটিল করে ব্লক বানানো যায়। খুব জটিল প্যাটার্ণের (জ্যামিতিক বা প্রাকৃতিক) যদি বাটিক দেখেন একদম নিখুঁত, তাহলে সেটা ছাঁচ দিয়ে ছাপ বানানোই খুব সম্ভবত। বুঝতেই পারছেন অনেক তাড়তাড়ি কাজ হয়ে যায় ছাপ বুটিক এ, আর তাই দামেও কম। পাঁচ বছর আগের হিসাব অনুযায়ী এই পদ্ধতিতে ইন্দোনেশিয়াতে প্রায় চার কোটি মিটার বাটিক বানানো হয়েছিল।
মোম ছাড়া আর এক যে পদ্ধতির কথা লিখেছিলাম তা হল ‘পেষ্ট রেজিষ্ট’। সময়ের দিক থেকে দেখতে গেলে এটা কিন্তু আদিমতম বাটিক পদ্ধতি, অর্থাৎ মোম পদ্ধতির অনেক আগে থেকেই এর প্রচলন। এখনো এর প্রচলন দেখা যায় ভারত, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, আফ্রিকা সহ আরো অনেক জায়গায়। তা কি দিয়ে বানানো হয় এই পেষ্টটা? হরেক কিসিমের জিনিস মিশিয়ে এবং হরেক রকম পদ্ধতিতে এই পেষ্ট বানানো হয়। তবে ভাত এবং ময়দা থেকে বানানো পেষ্ট সর্বাধিক জনপ্রিয় ছিল। জাপানে যেমন ভাত এবং ময়দার সাথে মেশানো হয় লবণ ও জিঙ্ক সালফেট পাওডার। এবার এদের রান্না করা হয় যতক্ষণ না স্বচ্ছ ক্রীমের মতন হচ্ছে সেই পেষ্টটা – এবার ঠান্ডা না হওয়া পর্যন্ত সেই পেষ্ট নাড়তে হবে।
এই পেষ্ট এবার অনেক পদ্ধতিতে লাগানো যায় কাপড়ে – তা সে হাতের আঙুলে, বা তুলি করে, বা কেক-এর ডেকরেশন যেমন করে টিউব বা ত্রিকোণ কাপড়ের/কাগজের জিনিস চাপ দিয়ে যাই হোক না কেন। মোম টেকনিকের সাথে এই পেষ্ট টেকনিকের এক প্রধান পার্থক্য হচ্ছে এই যে, মোম পদ্ধতিতে পুরো কাপড়টাই রঙে ডুবানো হয়, কিন্তু এই পেষ্ট পদ্ধতিতে কাপড়ের এক দিকটাই কেবল রঙ করা হয়। পেষ্ট লেপনের পরে এবার রঙের গুঁড়ার সাথে আঠার মত কিছু একটা মিশিয়ে একটা থিকথিকে দ্রবণের মত তৈরী করা হয়। এবার সেটা ব্রাশ দিয়ে বোলাও কাপড়ের উপরে! থিকথিকে করার মূল কারণ হচ্ছে যাতে রঙ গড়িয়ে অবাঞ্ছিত জায়গায় না চলে যায়। এখানে কাপড়ের টুকরো রঙে না ডুবানোর জন্য, এক বারেই আপনি নানা রঙ লাগাতে পারবেন, যেখানে যেমন চাইবেন। রঙ শুকানোর জন্য স্টিম বাথ দেওয়া হয় কাপড়কে এবার। সাধারণত কাপড় মোটামুটি এক ঘন্টা মতন স্টিমে রাখা হয় – মোটা কাপড় হলে অবশ্য বেশী সময় লাগে। এই স্টিম বাথ থেকে কাপড় বের করে ঠান্ডা জলে তাকে ধোয়া হয় বারবার যতক্ষণ না সব পেষ্ট পুরোপুরি উঠে যাচ্ছে। সব পেষ্ট উঠে গলে তাকে শুকালেই ব্যাস বাটিক তৈরী!
ইন্দোনেশীয়ার দেশটাকে যতটা পারা যায় ঘুরে দেখার ইচ্ছে ছিল অনেকদিনের – ইন্দোনেশিয়ার বালি তো অনেকবারই যাওয়া হয়ে গেল – কিন্তু জাভা এলাকাটা? এই সেই জাভা যার কথা আমরা ইতিহাসে অনেক পড়েছিলাম। মোটামুটি ভাবে জাভাকে তিনভাগে ভাগ করা হয় – পশ্চিম জাভা (যেখানে আছে এখনকার জাকার্তা বা আগেকার বাটাভিয়া শহর, এছাড়া আছে বানদুং শহর ইত্যাদি)। মধ্য জাভা – এখানে আছে সেই পুরানো সময়য়ের বিখ্যাত শহর যোগজাকার্তা (এখানেই আছে বিখ্যাত বরবুদুর স্তূপ, বা পারামবান মন্দির)। পূর্ব জাভায় আছে আগেকার দিনের বিখ্যাত বন্দর সুরাবায়া। তো এই জায়গাগুলোও ঘুরে ফেললাম। কোথায় কোথায় যেতে হবে বিখ্যাত জায়গাগুলোর বাইরে, তা আমাকে সব ডিটেলসে বুঝিয়ে দিত আমার ইন্দোনেশীয়ান বান্ধবী শ্রীওয়াঙ্গি। তার পুরো নাম শ্রীওয়াঙ্গি তেজারশ্মি – নাম শুনেই বুঝতে পারছেন বহুকাল আগের হিন্দু ধর্মের সাথে সম্পর্কের কথা। কয়েকশো বছর আগেও এরা সবাই হিন্দু ছিল – ইসলাম ধর্ম ইন্দোনেশীয়ায় প্রাধান্য পাবার আগে।
শ্রীওয়াঙ্গির কথা আগে লিখেছিলাম কি? মনে আসছে না – পরে কোন দিন লেখা যাবে না হয় বিস্তারে। ওকে আমরা সংক্ষেপে ‘শ্রী’ বলে ডাকতাম। সে আমার বন্ধু শুধু নয়, কলিগও ছিল – খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে এবং প্রবল বড়লোক! আমি মাঝে মাঝেই জিজ্ঞেস করতাম, তোর চাকুরী করার দরকার কি? উত্তর দিত – আমার ভালোই লাগে টেকনিক্যাল কাজ করতে (শ্রী নিজে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার), আর তা ছাড়া বাড়িতে বসে বসে বোর হয়ে যাব তো! দেশে ফিরলে না হয় ব্যবসা সরাসরি দেখে সময় কাটত, কিন্তু সে সব তো ম্যানেজারেরা চালায়। একদিন ওকে জিজ্ঞেস করলাম তোর কটা ব্যবসা? স্টারবাক্সে কফি খেতে খেতে শ্রী গুনছে তার কটা ব্যবসা – পেট্রোল পাম্প, চারটে কনভিনিয়েন্স স্টোর (ফ্যামিলি মার্টের মত), হাই এন্ড রেষ্টুরান্ট জাকার্তা শহরে, বিশাল বড় সেলুন এবং স্পা (ইন্দোনেশিয়ার সিনেমা আর্টিষ্টরা এবং হাই ফাই লোকেরা সেই স্পা এর কাষ্টমার) ইত্যাদি ইত্যাদি – বারোটা মত ব্যবসা। ইন্দোনেশীয়া ঘুরতে চাই শুনে শ্রীই তার কনট্যাক্ট থেকে সব ব্যবস্থা করে দিল।
যোগজাকার্তা বেড়াতে গিয়ে বেশ কিছু বাটিক-এর দোকানে ঘুরলাম, গেলাম কয়েকটা ফ্যাক্টরিতে। এমনিতেও যদি আপনি কোন ট্যুর কোম্পানীর সাথে যান তাহলে তারা আপনাকে কোন না কোন বাটিক ফ্যাক্টরিতে ঘুরে দেখাবে। কমন ট্যুরে যেটা হয়, টুরিষ্ট কিছু ট্র্যাপ থাকে, আপনার গাইডের কমিশনের ব্যাপার থাকে। ফলে হালকা একটা চাপ থেকেই যায় কিছু কিনতে গিয়ে। কিন্তু শ্রী-র চেনাশুনার মাধ্যমে গিয়েছিলাম বলে সেই চাপটা ছিল না। বাটিক ফ্যাক্টরিতে ঘুরিয়ে দেখালো – বলল এই ফ্যাক্টরিতে কিনতে হবে না। ওদের ফ্যামিলি যেখান থেকে কেনে সেই স্থানীয় দোকানে যাবে। যোগজাকার্তায় বেশ কিছু ঝলমলে বাটিক দোকান আছে একদম মর্ডান – এত নানাবিধ বাটিকের কাজ আছে যে এবং তাদের কারুকাজ এত সুন্দর যে আপনার হাত নিশপিশ করবে। বেশ কিছু দোকান থেকে কেনাকাটা করলাম – শুধু জামাকাপড় নয়, বাটিক পেন্টিং ইত্যাদিও কেনা হল। সেই প্রবল কেনাকাটার দাপটে বুকে হালকা ব্যাথা এবং পকেটে বিশাল ঝটকা লাগলেও, পরে ভেবে দেখলাম, ভালোই হয়েছে সেই দিন ওগুলো কিনেছিলাম। না হলে আফসোস থেকে যেত -
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।