১.০ পৃষ্ঠভূমি ও লক্ষ্য
পাঁচবছর আগের আজকের দিন, মানে নভেম্বরের ৮ তারিখ। সকালবেলা উঠে চায়ে চুমুক দেবার সময় খবরের কাগজের ব্যানার হেডলাইন দেখে আক্কেলগুড়ুম! গত রাত্তির বারোটার সময় থেকে ৫০০ এবং ১,০০০ টাকার নোট আর আমাদের দেশের লিগ্যাল টেন্ডার নয়! মানে ওই নোটগুলো দিয়ে আমরা কোন দোকানে কিছু কেনাকাটা করতে পারব না। আরে, আমার মেয়েকে যে কাজের মাসির এবং ড্রাইভারের মাইনে দিতে হয়— সব ওই নোটে! এছাড়া বাড়িওলা ক্যাশে বাড়ি ভাড়া নেয় আর খবরের কাগজের বিল, ওষুধের দোকান, মাসকাবারি মুদীর দোকান সবাইকে যে নগদে দিতে হয়! এবং ওই বড় নোটে। জানলাম আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গতকাল রাত আটটায় এই ঘোষণা করেছেন। ওঁর বক্তৃতা সব চ্যানেলে আবার দেখাচ্ছে; কেন যে কাল রাত্তিরে নিউজ না দেখে নেটফ্লিক্সে সিনেমা দেখছিলাম!
উনি যা করেন দেশের ভালর জন্যেই করেন। বেশ সাহসী এবং আউট অফ দ্য বক্স ভাবনা চিন্তা করতে পারেন। কিন্তু একটু সময় দেবেন তো! আমার গিন্নি আমার পেনশনের টাকার থেকে কিছু সরিয়ে ওঁর শাড়ির ভাঁজে রাখেন, সব ৫০০ ও ১০০০ টাকায়। আমি টের পেয়েও টের না পাওয়ার ভান করি; সেগুলোর কী হবে?
ব্যাঙ্কে চাকরি করেছি। যোগ দেবার একমাসের মধ্যে, মানে জানুয়ারি ১৯৭৮ সালে রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া ৫০০, ১০০০, ৫০০০ ও ১০০০০ টাকার নোট ব্যান করেছিল, কিন্তু সেগুলো বাজার থেকে তুলে নেওয়ার আগে সময় দিয়েছিল যাতে পাবলিকের অসুবিধে না হয়। এরকম রাত্তিরে মাত্র ৪ ঘন্টার সময় নয়, এ তো একেবারে ‘উঠল বাই, কটক যাই’ কেস!
ব্যাপারটা বোঝার জন্য বিভিন্ন চ্যানেলে প্রধানমন্ত্রী মোদীজি, বিত্তমন্ত্রী অরুণ জেটলী ও বিত্ত সচিব শক্তিকান্ত দাসের বক্তব্য মন দিয়ে শুনে যা বুঝলাম, তা’হল এই:
এর ফলে দেশে দুটো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হবে।
২.০ সাফল্যের পদ্ধতি ও রোডম্যাপ:
২.১ প্রধানমন্ত্রী তাঁর গলায় আবেগ ঢেলে বললেন গরীব খেটে খাওয়া মানুষেরা যখন দেখে যে অসৎ সরকারী অফিসারদের তোষকের তলায় বিশাল কালোটাকার পাহাড় ওই বড় নোটগুলোর মাধ্যমে সঞ্চিত রয়েছে আর তারফলে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাচ্ছে তখন তাদের কেমন অসহায় লাগে না? এবার হয় তারা ওই টাকা ভয়ের চোটে নষ্ট করে দেবে আর নইলে ব্যাংকে জমা করে সরকারকে ফিরিয়ে দেবে। যারা সৎ, যাদের টাকা সাদা, তারা ব্যাংকে ওই টাকা জমা করে বদলে সমমূল্যের ছোট নোট ( ৫ থেকে ১০০, ২০০ টাকা) নিতে পারবে। আর রিজার্ভ ব্যাংক ৫০০ ও ২০০০ টাকার নতুন নোট ছাপিয়ে আগামী ১০ তারিখ থেকে ব্যাংকে সাপ্লাই দেবে। তখন ওই নতুন বড় নোটও এটিএমে পাওয়া যাবে, একটু ধৈর্য ধরতে হবে, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৬ পর্য্যন্ত।
উনি পানাজীতে গোয়া সরকার আয়োজিত একটি সমারোহে আরো বললেন যে ওঁকে বিশ্বাস করে ৫০ দিন (নভেম্বরের ২০ + ডিসেম্বরের ৩০) পর্য্যন্ত সময় দেওয়া হোক। যদি উনি ব্যর্থ হন তাহলে জনতা তাঁকে চৌমাথায় দাঁড় করিয়ে যা শাস্তি দেবে তা উনি মেনে নেবেন।[1]
তারপর গুজরাতের দীশায় উনি ডেয়ারি প্ল্যান্টের উদ্ঘাটন করার সমারোহে আবার বললেন যে ডিমনিটাইজেশন গোটা দেশে ব্যাপ্ত টেররিজম, করাপশন ও ফেক কারেন্সির কারবারের শেকড় শুদ্ধ উপড়ে ফেলে দেবে। এই বিমুদ্রীকরণ সৎ ও নিপীড়িত নাগরিকদের ক্ষমতায়নের উদ্দেশ্যে নিবেদিত। ফের বললেন যদি আমি ব্যর্থ হই, ভুল করে থাকি তাহলে চৌমাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে জনতার দেওয়া শাস্তি মাথা পেতে নেব।[2]
মানতেই হবে দেশ স্বাধীন হবার পর কোন প্রধানমন্ত্রী জনতার উদ্দেশে এমন বলিষ্ঠ ঘোষণা করেননি।
২.২ এরপর বাস্তবে কী হল?
চারদিকে ধন্য ধন্য পড়ে গেল। জনতা খুশি মনে ওঁকে ৫০ কেন ১০০ দিন দিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে গেল একটা নতুন নোট পাবে বলে। কিন্তু একটা সমস্যা হল। মার্চ ২০২১ নাগাদ রিজার্ভ ব্যাংক ১৬ লাখ কারেন্সি নোট জারি করেছিল যার মধ্যে ১৪ লাখই ছিল ওই ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট! এতসব নোট সাততাড়াতাড়ি ছাপানো সম্ভব নয়, সাপ্লাই দেয়া দূর কী বাত! আর এটিমে জায়গা কতটুকু? নোটের র্যাশনিং হল। ফলে সব রাজ্য সমান সুবিধে পেল না। দিল্লিতে হাহাকার। রফা হল একজন প্রতিদিন একটা ২০০০ টাকার নোট পাবে।
তাই সই, জনতা খুশি মনে লাইনে দাঁড়াল । গরীব মানুষের বিশ্বাস এবার বড়োলোকেরাও লাইনে দাঁড়াবে। এই দৃশ্য দেখার আশায় এবং দুটো ২০০০ টাকার নোট পাব বলে আমিও মেয়ের সঙ্গে সকাল সাতটা থেকে লাইনে দাঁড়ালাম। কিন্তু যেখানেই যাই বিরাট লাইন। আমাদের নম্বর আসতে আসতে এটিএমে টাকা ফুরিয়ে যায়। তাই এগারোটা নাগাদ দক্ষিণ দিল্লি থেকে কনট প্লেস অব্দি অন্ততঃ ছ’বার লাইনে দাঁড়িয়ে শেষে দু’জনে এক একটা ২০০০ টাকার নোট নিয়ে বিজয়ীর হাসি হেসে বাড়ি ফিরলাম। এই প্যারেড চলল সাতদিন। উইক ডে’তে সকাল এবং রাত নটায়, কারণ মেয়েকে অফিস যেতে হবে।
জনতা খুশি, আমরা তো বরাবরই দাঁড়িয়ে থাকি, সে র্যাশনের লাইন হোক বা রেলওয়ে টিকিটের লাইন। কিন্তু এবার বড়লোকেররাও আমাদের মতই পথে নামবে, রাস্তায় এসে লাইনে দাঁড়াবে। এই সরকার জনগণের সরকার, সবাইকে সমান চোখে দেখে, একই নিক্তিতে মাপে,-- ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশোয়াস’।
সত্যি কথা, বিভিন্ন চ্যানেলে দেখলাম নব্বই পেরোনো প্রধানমন্ত্রীর মাতা হুইল চেয়ারে বসে নোট বদলে গেলেন। তবে ১০০ জনের বেশি বয়স্ক লোক লাইনে দাঁড়িয়ে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন। আমরা ভাবলাম, ওদের হয়ত ঘরে থেকেও এ’রম হতে পারত। একটা বড় বিপ্লবী কাজে এরকম কিছু মূল্য চোকাতে হয়।
জি টিভির অ্যাংকর সুধীর চৌধুরি এবং আজ তক চ্যানেলের থেকে জানলাম -- নতুন যে ২০০০ টাকার নোট আসছে তাতে ‘ন্যানো জিপিএস চিপ্স’ লাগানো আছে। ফলে এর নকল করা অসম্ভব। স্যাটেলাইট থেকে ধরা পড়ে যাবে। কালো টাকা এবং কালোবাজারীদের এবার রেহাই নেই।
কয়েকমাস পরে উত্তর প্রদেশে বিধান সভা নির্বাচন হল। ২০১৭ সালের নতুন বিধানসভায় বিরোধীরা একেবারে ধুয়ে মুছে সাফ! যোগী আদিত্যনাথ বিরাট জনসমর্থন পেয়ে মুখ্যমন্ত্রী হলেন।
একই সময়ে এল জিএসটি যাতে ছোটখাট দোকানকেও অনলাইন ভাউচার জেনারেট করে ট্যাক্সের হিসাব স্বচ্ছ করতে হবে। এবার সহজে ক্রেতাকে ঠকানো যাবে না। নোটবন্দী ও জিএসটি! দুইয়ে মিলে দেশের উন্নতি অবধারিত। আগে কেন যে কেউ এমন করে ভাবেনি!
৩.০ বিবাদী স্বরঃ
কিন্তু সবাই এক সুরে গলা সাধেনি। বিপক্ষের নেতাদের কথা বাদ দিলাম। যাঁরা বললেন যে এই স্বপ্নাদ্য মাদুলিগোছের হাতুড়ে ওষুধ ভাল করার জায়গায় মন্দ করবে তাঁদের মধ্যে দুজনের বক্তব্য তুলে ধরছি:
এক, পূর্ব প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, যিনি কেম্ব্রিজ স্কুল অফ ইকনমিক্সের ডক্টরেট এবং অক্সফোর্ডের ডি ফিল। শুধু তাই নয়, উনি ৮০’র দশকে রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন এবং পরে ভারত সরকারের বিত্তমন্ত্রীও হয়েছিলেন। ইনি বামপন্থী ন’ন, বরং এঁর অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন ৯০ এর দশকে ভারতে উদারীকরণের দামামা বাজে। উদার শিল্পনীতি ও বিত্তীয় নীতি ঘোষণা করা হয়। ডিমনিটাইজেশনের এক বছর পূর্ণ হলে গুজরাতে এক সভায় উনি বললেন যে এ হল “অর্গানাইজড লুট অ্যান্ড লীগালাইজড প্লান্ডার”[3]। ৮ নভেম্বর, ২০১৬ ভারতের গণতন্ত্রে একটি ‘ব্ল্যাক ডে’। এর ফলে ভারতে জিডিপি বৃদ্ধির হার কমে গিয়ে ৭% হবে। মার খাবে ইনফর্মাল সেক্টর এবং তার ফলে অনেক লোকে কাজ হারাবে।
কিমাশচর্যম্! গোড়ায় অনেক ব্যঙ্গবিদ্রূপ সহ্য করতে হল, কিন্তু বছর ঘুরলে দেখা গেল রাষ্ট্রীয় আয় বা সম্পূর্ণ আভ্যন্তরীণ উৎপাদ ( গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট) কাঁটায় কাঁটায় ৭% । শুরু হল জিডিপির অধোগতি। মার্চ ২০২০ নাগাদ, করোনা তাণ্ডবের আগে সেটা নেমে গেল ৪% এ, এবং বেরোজগারির হার বেড়ে ৬.৭% যা গত ৪৫ বছরে সবচেয়ে খারপ। ৫ ট্রিলিয়ন ইকনমির স্বপ্ন ভেঙে খানখান।
তখন কারও কারও খেয়াল হল ২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপী মন্দায় যখন গোটা বিশ্বের উন্নত অর্থনীতি ধুঁকছিল, এমনকি চীনেও মন্দা বেড়ে গেছল, তখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এই মনমোহন সিং এরই আর্থিক নীতি ভারতে মন্দার অভিঘাত অনেকখানি আটকাতে সমর্থ হয়েছিলে।
কিছুদিন পরে আরও অনেক অর্থনীতিবিদ, যেমন রিজার্ভ ব্যাংকের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন ও প্রাক্তন মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রাহ্মনিয়ান নোটবন্দীর ভুলের ব্যাপারে মুখ খুললেন।
অ্যাকাডেমিক জগতের মধ্যে আমি উল্লেখ করতে চাই ইন্সটিট্যুট অফ সোশ্যাল সায়েন্সের ইকনমিক্সের ম্যালকম আদিশেষাইয়া চেয়ারের অধ্যাপক অরুণ কুমারের কথা। উনি ২০১৭ সাল থেকেই নিয়মিত মুখর থেকেছেন নোটবন্দীর সমালোচনায়। ওঁর মুখ্য আপত্তিগুলো এইরকম:
এই নীতি অর্থনীতির ব্যাপারে কতকগুলো ভুল ধারণার উপর দাঁড়িয়ে, তাই জন্মলগ্ন থেকেই এই নীতির কপালে ব্যর্থতার তিলক লেগে রয়েছে। যেমন:
৪.০ সরকারের নীতির প্রশংসকেরাঃ
কিন্তু সরকারের নীতির সমর্থকেরা হাল ছাড়েননি। আমি কোভিডের মহামারীর প্রভাবের কথা বাদ দেব, তাই মার্চ ২০২০ পর্য্যন্ত যা পেয়েছি তাতেই আলোচনা সীমিত রাখব। কারণ লক্ষণ যা দেখা যাচ্ছিল, কোভিড সেটাকে বাড়িয়ে দিয়েছে মাত্র।
ওঁরা ক্রমশঃ গোলপোস্ট সরিয়ে গেছেন।
আগে বললেন -লক্ষ্য ক্যাশলেস ইকনমি। একবছরের মাথায় যখন বুঝলেন সেটা হবার নয়, তখন বললেন লো ক্যাশ ইকনমি। তারপরে বললেন আমরা চাই নগদ ও জিডিপির প্রতিশত কমাতে।
ধরুন, স্টেট ব্যাংকের চিফ ইকনমিস্ট সৌম্যকান্তি ঘোষ। উনি মনে করেন যে এই নীতির সুফল দীর্ঘমেয়াদী; সেটা দেখার জন্য আমাদের কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। যেমন ভারতের ইকনমির ৮০% ইনফর্মাল সেক্টর। এর ফলে সরকারের বাজেট এস্টিমেট, উন্নয়নের দর, রোজগার বৃদ্ধির দর( যা শুধু ফর্মাল সেক্টরের ডেটা নিয়ে কথা বলে) ছায়াবাজি হয়ে যায়। মোদী সরকারের নোটবন্দী ও জিএসটির যুগলবন্দীর ফলে লোকে বাধ্য হয়ে ডিজিটাল ইকনমির দিকে ঝুঁকবে। ফলে লেনদেনে স্বচ্ছতা আসবে। এবং ক্রমশঃ ইনফর্মাল সেক্টরের আয়তন ছোট হয়ে ফর্মাল সেক্টরের ভাগ বড় হবে, যেটা ভাল খবর। নিঃসন্দেহে।
কিন্তু আমি আওড়াব ইকনমিক্সের মহাপুরুষ লর্ড কেইনসের ( যিনি ১৯৩০ শের বিশ্বব্যাপী মন্দা থেকে শিখে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংল্যান্ডের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব যোগ্যতার সঙ্গে পালন করেছিলেন) অমর বাণীঃ In the long run, we are all dead.
আরে আগে লোকে খেয়েপরে ততদিন বাঁচবে তবে তো পরিবত্তনের সুফল টের পাবে!
৫.০ এখন পাঁচ বছর পরে: কী চেয়েছি আর কী যে পেলাম?
আসুন, এক এক করে লক্ষ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখি।
কালো টাকা ধরা পড়া:
২০১৬ সালের নভেম্বর মাসের গোড়ায় বাজারে ক্যাশ ছিল ১৭.৯৭ লক্ষ কোটি টাকা যার ৮৬% বা ১৫.৪৪ ট্রিলিয়ন ( লক্ষ কোটি টাকা) ছিল ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট। দু’বছর বাদে রিজার্ভ ব্যাংক জানিয়েছে যে ৩০ জুন, ২০১৭ নাগাদ সরকারের কাছে অচল ঘোষণা করা কারেন্সির ৯৯.৩% ফিরে এসেছে। [6]
এসব কি কালো টাকা? রিজার্ভ ব্যাংক তা বলছেনা । কারণ ওদের হিসেবে কালো টাকা তো মাত্র ১% থেকে ৬ %। এভাবে বিশাল কালো টাকা ধরা পড়েছে বলে আজও জানা যায়নি। তবে রিজার্ভ ব্যাংকের ২০১৬-১৭ সালের বার্ষিক রিপোর্টে জানা গেছে যে সে বছর নতুন নোট ছাপানোর খরচ হয়েছিল ৭৯৬৫ কোটি টাকা, যা আগের বছরের থেকে (৩৪২০ কোটি) ১৩৩% বেশি এবং এর ফলে ভারত সরকার রিজার্ভ ব্যাংকের থেকে প্রতিবছর যে লাভ করে তা’ ৫৪% কমে গেছল।[7]
কেন্দ্রীয় সরকারের স্ট্যাটিসটিক্যাল ডেটা (সি এস ও) থেকে জানা যাচ্ছে ২০১৬-১৭ সালে ভারতের জিডিপি ছিল ১৫১.৮৪ লাখ কোটি (ট্রিলিয়ন)। কালো টাকা ছিল ১৬০০০ কোটি টাকা বা তার ০.১% ।
অধ্যাপক অরুণকুমার বলছেন ১% ও কালো টাকা কম হয়নি।[8]
না, কোন বড় ব্যবসায়ী বা আমলা টাকা জমা দেওয়ার লাইনে দাঁড়াননি। তাঁদের টাকা জমা হয়েছে তাঁদের কাজের লোক, নিম্নপদস্থ কর্মচারিদের মাধ্যমে। সবচেয়ে বেশি টাকা জমা হয়েছে দেশ জুড়ে বিভিন্ন ব্যাঙ্কে জিরো ডিপোজিটে খোলা গরীব মানুষের জনধন যোজনা অ্যাকাউন্টে। তবে তাঁদের নিষ্ক্রিয় অ্যাকাউন্টে হঠাৎ এত টাকা কোত্থেকে এল এ’নিয়ে কোন জবাবদিহি করতে হয়নি।
এ ব্যাপারে বড় ভূমিকা দেশ জুড়ে বিভিন্ন কোওপারেটিভ ব্যাঙ্কের, বিশেষ করে গুজরাত রাজ্যের। নোটবন্দীর প্রথম পাঁচদিনে তারা প্রচুর নিষিদ্ধ নোটের ডিপোজিট পেল। তারপর ১৪ তারিখ থেকে কোওপারেটিভ ব্যাংকে ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট জমা করা নিষিদ্ধ হল। কিন্তু এর মধ্যে আমেদাবাদ ডিস্ট্রিক্ট কোওপারেটিভ ব্যাংক পেল ৭৪৫.৫৯ কোটি টাকা যার একসময়ের চেয়ারম্যান ও ২০১৬ সালে অন্যতম ডায়রেক্টর কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী অমিত শাহ। এর পরে আসবে রাজকোট জেলা কোওপারেটিভ ব্যাংকের নাম যার চেয়ারম্যান জয়েশভাই বিট্টহলভাই গুজরাতের অন্যতম মন্ত্রী, এরা ডিপোজিট পেয়েছে ৬৯৩.১৯ কোটি টাকা।[9] এগুলো কালোটাকা নয়, কালোটাকা গেল কোথায়?
করাপশান খতম হওয়াঃ
ট্রান্সপেরেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ২৬/১১/২০ তারিখের রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে করাপশন এবং ঘুষের হার ডিমনি’র পর কমার বদলে বেড়ে গেছে। ভারত ২০১৬ সালে করাপশানের নিরিখে দুনিয়ার ১২৩ দেশের মধ্যে ৭৯তম ছিল, কিন্তু পাঁচবছর পর ০৮ নভেম্বর ২০২১ তারিখে ওদের প্রকাশিত ডেটা অনুযায়ী সাত ধাপ নেমে গিয়ে ৮৬তম অবস্থানে রয়েছে, যেখানে পাকিস্তান ৮৭। [10]
জাল নোট খতম হওয়াঃ
ন্যাশনাল ক্রাইম রিপোর্ট ব্যুরো্র (এনসিআরবি) হিসেবে দেখা যাচ্ছে ডিমনি’র পর দু’গুণ জাল নোট ধরা পড়েছে। তার ৫৬% হল নতুন জারি করা ২০০০ টাকার নোট, জানা গেছে তাতে কোন ন্যানো চিপ্স থাকে না, ফলে বাচ্চা ছেলেরাও কম্পিউটার থেকে ওইরকম নোট প্রিন্ট করছে। [11]
এখন রিজার্ভ ব্যাংক নতুন ২০০০ টাকার নোট ছাপানো বন্ধ করে দিয়েছে। বাজারে চালু ওই মানের নোটের ২৭% চলন থেকে তুলে নিয়েছে।[12]
আতংকবাদ খতম হওয়াঃ
ডিমনি’র সময়ের বিত্তমন্ত্রী (প্রয়াত) অরুণ জেটলি এবং বর্তমান বিত্তমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন মনে করতেন ডিমনি’র অন্যতম প্রত্যক্ষ লাভ হবে নগদ লেনদেন কমে ডিজিটাল লেনদেন বেড়ে যাওয়া এবং এর ফলে আতংকবাদী হামলা কমে যাওয়া।[13]
কিন্তু সাউথ ইস্ট এশিয়া টেররিজম পোর্টাল জানাচ্ছে বর্তমান গ্লোবাল টেররিজম ইন্ডেক্সে পাকিস্তান ৭ নম্বর, আর ভারত ৮ নম্বর। আরো জানা যাচ্ছে যে গত পাঁচ বছরে বস্তার এবং অন্যত্র মাওবাদী হামলা বেশ কমেছে, কিন্তু কাশ্মীরে ২০০ ছাড়িয়ে গেছে। তালিকাটি দেখা যাক:
বর্ষ মাওবাদী হামলার ঘটনা কাশ্মীরে জঙ্গী হামলা
২০১৫ --- ৮৬
২০১৬ ২৬৩ ১১২
২০১৭ ২০০ ১৬৩
২০১৮ ২১৮ ২০৬
২০১৯ ১৭৬ ১৩৫
২০২০ ১৩৮ ১৪০
২০২১ ১০২ ১২২*
*এই তথ্য অসমাপ্ত, গত দু’মাস ধরে কাশ্মীরে জঙ্গী হামলায় এক ডজনের মত ভারতীয় জওয়ান প্রাণ হারিয়েছেন। হামলাকারীদের খোঁজ এখনও চলছে।
আর জাল নোট দ্বিগুণ বেড়ে যাওয়ার তথ্য উপরে দিয়েছি। অর্থাৎ জাল নোট ও আতংকবাদের মধ্যে প্রত্যক্ষ কার্যকারণ সম্বন্ধ নিতান্তই নগণ্য।
ক্যাশলেস ইকনমির দিকে এগিয়ে যাওয়া:
১৫ কোটি লোকের এখনও কোন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই। ২৫ কোটি নিম্নবিত্ত খেটেখাওয়া মানুষের জন্য নগদ ছাড়া কাজ হয়না। ভারতের বিশাল ইনফর্মাল ইকনমি ও মধ্য ছোট এবং ঘরোয়া ব্যবসার ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের জন্যেও চাই নগদ। রিজার্ভ ব্যাংকের রিপোর্ট বলছে ক্যাশ ২০১৭তে সামান্য কমেছিল, তারপর ফিরে এসেছে দ্বিগুণ বেগে।[14]
বর্ষ বাজারে উপলব্ধ নগদ টাকা জিডিপি’র %
২রা নভেম্বর, ২০১৬ ১৭.৯৭ লক্ষ কোটি ১১.৬
৮ই নভেম্বর, ২০২১ ২৮.৩০ লক্ষ কোটি ১৪.৫[15]
ডিজিটাল ইন্ডিয়া এবং ফর্মাল ইকনমি:
হ্যাঁ, এই লক্ষ্যে ভারত অনেক এগিয়ে গিয়েছে। স্টেট ব্যাংকের মুখ্য অর্থনীতিবিদ সৌম্যকান্তি ঘোষ খুশি যে ২০১৬ সালে ভারতের ইকনমির ৫২% ছিল ইনফর্মাল সেক্টর। এখন সেটা ১৫ থেকে ২০% সংকুচিত হয়েছে। অধিকাংশ দোকান ক্যাশলেস বা ডিজিটাল পেমেন্ট নিচ্ছে। ২০১৮ সালের ডিজিটাল লেনদেনকে ১০০ ধরলে তিনবছরে এটা দাঁড়িয়েছে ২১৭ তে। ডিজিটাল পেমেন্ট প্ল্যাটফর্মে সবচেয়ে বেশি বিজনেস বেড়েছে ইউ পি আইএর, প্রায় ৩০০%। নিঃসন্দেহে কোভিড এবং লকডাউন ও ওয়ার্ক ফ্রম হোম এর একটা বড় অনুঘটক।
কিন্তু একইভাবে এই সময়েই লোকের নগদ রাশি রাখার প্রবণতাও বেড়েছে। এই প্যারাডক্সের একমাত্র সম্ভবপর ব্যাখ্যা হল ডিজিটাল ইন্ডিয়া বৃদ্ধি পেয়েছে ডিমনির জন্য নয়, বরং ভারত সরকারের ডিজিটাল ইনফ্রাস্ট্রাকচারের প্রসার, জিএসটি অধিকাংশ পণ্যদ্রব্য এবং সেবা প্রদায়ে বাধ্যতামূলক করা ও এমপ্লয়ীজ প্রভিডেন্ট ফান্ড রেজিস্ট্রেশনে বৃদ্ধির ফলে।
৬.০ কিছু প্রশ্নঃ
৬.১ এমন কেন হল? দেশের আর্থিক অবস্থা তিনবছরের মধ্যে ভালোর জায়গায় খারাপ কেন হল? উঁহু,কোভিড নয়, ডিমনির প্রথম তিনবছরে কোথায় কোভিড? ৮ নভেম্বর, ২০১৯ নাগাদ ভারত কেন সারা বিশ্বে কোথাও কোভিড- ১৯ মহামারীর রূপ ধারণ করেনি।
এ’বছরের গোড়ায় মনমোহন সিং কেরালায় রাজীব গান্ধী ইন্সটিট্যুট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ এর উদবোধনী বক্তৃতায় বলেছেন যে ২০১৬ সালের ওই “ ইলকসিডারড ডিমনিটাইজেশন ডিসিশন” আজকের ক্রমাগত বেড়ে যাওয়া বেকারি, ইনফর্মাল সেক্টরের দুর্গতি (যা আমাদের অর্থব্যবস্থার ৫২%) জন্যে দায়ী।[16] উনি বর্তমান সরকারের আর্থিক নীতিকে দিশাহীন বলে বর্ণনা করেন।
নীচের তালিকাটি দেখা যাক।
বর্ষ জিডিপি দর (%)
২০১৬ ৮.২
২০১৭ ৭.০
২০১৯ ৪.০
মাঝারি ছোট ও ক্ষুদ্র শিল্পএর অবস্থা ভাল নয়।
বেকারত্বের হারঃ ২০১৮-১৯ নাগাদ ৬.৭%, গত ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ।
৬.২ কম নগদ মানে কি কম করাপশন ?[17]
এই প্রশ্নটি তুলেছেন অধ্যাপক অরুণ কুমার। উনি মনে করেন ডিমনিটাইজেশনের কথিত সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের নির্ণয়ের পেছনে রয়েছে করাপশনের ব্যাপারে কিছু ভুল ধারণা; যেমন কালো টাকা নগদে লুকিয়ে রাখা হয়। আর লেনদেন যত নগদে কম, অনলাইনে বেশি হবে তত করাপশনের সম্ভাবনা কমবে।
বর্তমান প্রতিবেদকের মধ্যে অরুণকুমারের কথাটায় অনেকখানি সত্যি রয়েছে। কারণ কয়েকমাস আগে রামমন্দির নির্মাণ ট্রাস্টের বিরুদ্ধে সরকারি এবং বাজার দরের চেয়ে অনেক বেশি দরে জমি কেনার অভিযোগ উঠলে ওদের পক্ষ থেকে বলা হয় যে গোটা লেনদেন নগদে নয়, ডিজিটাল পেমেন্টের মাধ্যমে হয়েছে, অতএব করাপশানের প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু এই সরল বিশ্বাসের বিপরীতে নীচের তালিকায় দেখা যাচ্ছে
দেশ জিডিপির অনুপাতে নগদ ১৮০ দেশের মধ্যে করাপশন র্যাংক[18]
জাপান ১৮ ১৯
ভারত ১২-১৪ ৮৬
নাইজেরিয়া ১.৪ ১৪৪
অর্থাৎ নামমাত্র ক্যাশ লেনদেন করা আর্থিক ব্যবস্থা করাপশনে জাপান ও ভারতের থেকে অনেক অনেক এগিয়ে। মোদীজি কি কালোটাকা খুঁজতে কানাগলিতে ঢুকে গেলেন?
ডিমনি নিয়ে শেষ কথা বলেছেন ‘দেশভক্ত’ নিউজ পোর্টালের আকাশ ব্যানার্জি।
এই গোটা ব্যাপারটায় কার লাভ হল?
ওঁর উত্তর:
কিন্তু শেষ প্রশ্ন:
ইদানীং মোদীজির ২০ বছরের সক্রিয় রাজনৈতিক জীবন নিয়ে বিজেপির পোস্টার ও প্রচারে সাফল্যের ২০ খতিয়ানের বর্ণনায় ডিমনিটাইজেশন নেই কেন?[19]
==================================================
ছবি - সুনন্দ পাত্র
[1] হিন্দুস্থান টাইমস, ১৩ নভেম্বর, ২০১৬।
[2] ইন্ডিয়াটাইমস ডটকম, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৬।
[3] দি হিন্দু, ৮ নভেম্বর, ২০১৭।
[4] দি হিন্দু, ৮ জুলাই, ২০১৭।
[5] ঐ; ২৯ আগস্ট, ২০১৮।
[6] দি হিন্দু, ২৯ অগাস্ট, ২০১৮ এবং দ্য ক্যুইন্ট, ৮ নভেম্বর, ২০২১।
[7] জাগরণ জোশ, নিউজ পোর্টাল, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০।
[8] স্ক্রোল ডট ইন, ৬ নভেম্বর, ২০২১।
[9] বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ২১ জুন, ২০১৮।
[10] বিজনেস টুডে, ৮ নভেম্বর, ২০২১।
[11] ইন্ডিয়া টুডে, ঐ।
[12] বিজনেস টুডে, ঐ।
[13] এ এন আই ও বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ২৫ জুলাই, ২০১৯।
[14] ডি এন এ, ৮ নভেম্বর, ২০২১।
[15] ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ঐ।
[16] ঐ, ২ মার্চ ২০২১।
[17] অরুণ কুমার, স্ক্রোল ডট ইন, ৬ নভেম্বর, ২০২১।
[18] ট্রান্সপেরেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডেক্স, ২০২০।
[19] দেশভক্ত পোর্টাল, ৮ নভেম্বর, ২০২১।