বছর ছয়েক পরে রাঙামাটির পাহাড়ে ঝটিকা ভ্রমণ।
চিতার মতোই দলবিহীন বরাবর, অনেকটা সময় পাহাড়ে, বনে-বাদাড়ে, অশান্ত সময়ে সংবাদ সন্ধানে ছুটে চলা। সে এক রেসের ঘোড়ার জীবন।
এবার সঙ্গী ছোটবোন, স্কুল মাস্টার রূপা দত্ত। বান্দরবানের লামার পাহাড়ে ম্রো আদিবাসীর স্কুল ‘পাওমাং’ (ফুলের বাগান) করেছে। কয়েকমাস আগেই স্কুলটি দেখে মুগ্ধ।
পাহাড় যাত্রায় ট্রেন-বাসের টিকিট পাওয়াই দুস্কর। লক ডাউন পেরিয়ে আম জনতা ছুটেছে দিক-বিদিক। অনেক কষ্টে শ্যামলীর নাইট কোচে কৌনিক ও বক্র অবস্থানে আসন।
মাঝ রাতে কুমিল্লায় যাত্রা বিরতি। সুবিশাল, নোংরা ও ঘিঞ্জি রেঁস্তোরা যেন মাছের বাজার! শত শত নারী-পুরুষে, অধিকাংশই অনুর্ধ্ব ত্রিশে, যেন মচ্ছব। ভাদ্রের ভ্যাপসা গরমে হাফ প্যান্ট-জার্সিতে, বাহারি চুলের দলছুট এক নাবলক জানায়, পাহাড়ে নাকি তাদের বকেয়া পিকনিক!
কোন মুরোত্তোন ইচ্চুৎ তুই (কোন পাহাড় থেকে এসেছো তুমি)?
সারারাত নির্ঘুম, একঘেয়ে যাত্রা শেষে ভোর ভোর রাঙামাটির কোলে। গেস্ট হাউজের দুটি কামরায় ব্যাকপ্যাক ফেলা। ফ্রেশ হয়ে ‘সমাজ্জে’ (চাকমা ভাষায়, তুমি আমার সমাজের লোক) রেঁস্তোরায় আদি পাহাড়ি খাবারে ভাত-সব্জিতে ব্রেকফাস্ট।
পরে ঘড়ি ধরে সাবেক গেরিলা নেতা, সন্তু লারমার চায়ের নিমন্ত্রণে। আশি ছুঁই ছুঁই পাহাড়ি নেতার এখনো মেরুদণ্ড সোজা। সন্তু লারমা অকপটে ব্যাখ্যা করেন পার্বত্য জটিল পরিস্থিতি। রূপার স্কুল প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করেন ছয়ের দশকে পাহাড়ি ছাত্র সমিতির মাস্টার্স রেভিল্যুশান! পাহাড়ের ইনসার্জেন্টদের সম্পর্কেও কিছু হাল নাগাদ তথ্য।
তিনি চণ্ডালের বই ‘পাহাড়ে বিপন্ন জনপদ (সাংবাদিকের জবানবন্দিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের অকথিত অধ্যায়)’ পড়েছেন সদ্য। হাফ ছেড়ে বাঁচা, তেমন খর সমালোচনার মুখে পড়তে হয় না। মামুদের সম্পর্কে সামান্য সতর্কবার্তা, উহারাই পার্বত্যাঞ্চলের গড ফাদার কোং?
ফের ‘সমাজ্জে’তে ভাত-মাছ-সিঁদোল শুটকির ঝোলে আর্লি লাঞ্চ। ক্লান্তিকর দুপুর পেরিয়ে সন্ধ্যার মুখে রাজবাড়ি মোড়ে ‘টুগুং’ (পার্বত শিখর) রেঁস্তোরায় ‘মোনঘর শিশুসদনের’ প্রধান শিক্ষক ঝিমিত ঝিমিত চাকমা দাদার সঙ্গে সাক্ষাৎ। মূলত রূপার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়াই উদ্দেশ্য। ‘পাহাড়ে বিপন্ন জনপদ’ বই ঝিমিতদার স্কুল নিয়ে একটি লেখা আছে, ‘পাহাড়ে শিক্ষার বাতিঘর’।
ঝিমিত দার আড্ডায় যোগ দেন আরো দু-এক সমমনা। তিনি ছিলেন লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বন্ধু। নয়ের দশকে রাঙামাটি এলে ইলিয়াস ভাইয়ের হাত চিঠি এনে ঝিমিত দাকে পৌঁছে দেওয়া গেছে কতোদিন। ইলিয়াস ভাই ঝিমিতদার বাসায় দু-একবার বেড়িয়েও গেছেন। সে সব স্মৃতিচারণ উঠে আসে আলাপে। বৌদির কোভিড পজেটিভ, তাই এবার বাসায় বেড়ানো হয় না।
সন্ধ্যা পেরিয়ে ট্রাইবাল অফিসার্স এরিয়ায় অটো ধরে যাত্রা। বাঙালি ড্রাইভার পাহাড়িদের সম্পর্কে স্পষ্ট বিদ্বেষ ছড়ান। আমরা দুই ভাইবোন মনে মনে চমকাই। শান্তিচুক্তির দুই দশক পেরিয়েও গেল না আঁধার। পাহাড়ে শান্তি অধরাই থেকে যায়।
সে রাতে গিটারিস্ট টিনটিন চাকমার বাসায় জম্মেশ আড্ডা। যোগ দেন আরেক প্রাণসখা রোনাল্ড চাকমা। গত মার্চে রোনাল্ডের আলিকদমের আস্তনায় একদফা হুজ্জোত করা গেছে। আবার তাকে দেখে উল্লাস।
টিনটিনের আরেক গিটারিস্ট বন্ধু, স্ত্রী ও মাসিমাও যোগ দেন আলাপ-চারিতায়। একের পর এক আদি পাহাড়ি গান চলতে থাকে। আসে প্রচুর পাহাড়ি খাবার দাবার।
চকিতে মনে পড়ে বছর তিনেক আগে প্রয়াত ভাই মানবের কথা। মানব ভাই সাতের দশকে পপ সম্রাট খ্যাত আজম খানের গিটারিস্ট ছিলেন। একদা তার সঙ্গে অনেক কনসার্ট করেছেন। পক্ষাঘাত জীবনের শেষ দিনগুলোতে ডান হাতে গিটার ছুঁয়ে বসে থাকতেন। ব্রেন স্ট্রোকে দেহের বাম দিক অসাড় হয়ে গিয়েছিল। এলভিস শুনতেন, আর চোখ দিয়ে পানি গড়াতো, ‘লাভ মি টেনডার, লাভ মি ট্রু, ও মাই ডারলিং! আই যাস্ট কাম টু ইউ’…।
কোন সাগরত যেবে (কোন সাগরে তুমি যাবে)?
পরদিন কিছুটা অসুস্থ বোধ করায় রূপা আরেক বন্ধুর সাথে দেখা করে ফিরে যায় চট্টগ্রামে। চেনা অটো ড্রাইভার ধরে একাই চলে যাওয়া রাঙাপানির পাহাড়ে। সেখানে ‘প্রথমালোর’ সাবেক সাংবাদিক হরিকিশোর চাকমা দাদা থাকেন।
নয়ের দশকে হরিদা ছিলেন উজ্জ্বল পার্বত্য সাংবাদিক। প্রথমে সাদাকালো ‘আজকের কাগজ’, পরে দৈনিক ‘ভোরের কাগজের’ নির্ভিক সাংবাদিকতায় তিনি ছিলেন আদর্শ।
অশান্ত পার্বত্য পরিস্থিতিতে তার মটোর সাইকেলের পেছনে চেপে সংবাদের সন্ধানে পাহাড় থেকে পাহাড়ে ছুটে চলা গেছে কতোদিন! তখন হরিদার সংবাদে ভাগ বসানো যেন ছিল অধিকার! তিনি অবশ্য বেশ খুশীই হতেন। বলতেন, তথ্য মানুষের জন্মগত অধিকার!
তখন অনেক সংবাদে জীবের ঝুঁকি থাকলেও ছিল সত্য প্রকাশের দুরন্ত সাহস! দূর পাহাড়ে ঝুপড়ি চায়ের দোকানের বেড়ায় সেঁটে রাখা এমন সংবাদের ক্লিপিং দেখা গেছে কতোদিন!
ওই মটোর সাইকেলই কাল হলো শেষে। বছর তিনেক আগে মটোর সাইকেল দুর্ঘটনায় মস্তিস্কে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে হরিদার স্মৃতি এখন কিছু এলোমেলো। সৃজনশীল লেখনিতে ইতি ঘটেছে সহসাই।
রাঙাপানির এক তলার বাসায় দুর্বল চলাফেরায় দরজা খুলে দেন হরি দা নিজেই। তার কিশোর বয়সী তিন ছেলে এসে একে একে প্রণাম করে যায়। হরি দা এলোমেলো স্মৃতি হাতড়ে দু-চারটি কথা বলেন। বয়স বেড়েছে যেন ঝপ করে। চণ্ডালের বইটি উপহার পেয়ে যেন অতীত হাতড়ে দেখেন, পাতা উল্টান চরম মমতায়। এক ফাঁকে ছোটটি চা-বিস্কুট রেখে যায়। বছর দেড়েক পর স্কুল খুলবে জেনে খুশী।
কাছেই আরেক বন্ধু ‘প্রথোমালোর’ ফটো-সাংবাদিক সুপ্রিয় চাকমার বাসা। সে-ও অপেক্ষায় অনেকক্ষণ। টাইলস করা চমৎকার নতুন বাসা তার। ফটো-সাংবাদিকের ছেলেটি চিত্রকর, বৌদি গৃহিনী। সকাল বেলাতেই দু পাত্র ‘চোয়ানি’তে হয় সংক্ষিপ্ত আপ্যায়ন। দুই দফায় ডিস্টিল ভাতের রসটি বেশ কড়া পানীয়। হাসি-ঠাট্টায় স্মৃতিচারণে সুন্দর কাটে সময়।
মুইও যেম ত’ সমারে, মোরে নি তুই নিবে? (আমিও যাব তোমার সাথে, আমাকে নেবে?)
সে রাতে হানা দেওয়া গেল পাহাড়ের চারণ শিল্পী কালায়ন চাকমার বাসায়। ঘরোয়া আড্ডায় হারমোনিয়ামে একের পর এক শোনান আদি চাকমা আর বাংলায় গণসংগীত, প্রতুল ও ভূপেন। কিছু অনুরোধের গানও করেন। যোগ দেন আদিবাসী গানের দাল ‘মদলে’র গিটারিস্ট রিটন চাকমা, বন্ধু পল্লব চাকমা, ভাতৃবধু নিশি দেওয়ান।
মোতি ভূট্টা, বাঁশ কোড়ল থেকে শুরু করে জুমের (জুম, পাহাড়ের ঢালে বিশেষ চাষাবাদ) নানান শাক-সব্জি, বরাহ, চোঙ মাছ ইত্যাদি তরকারিতে রাতের খাবারে ছিল বাড়াবাড়ি।
এইসব হাসিগান আড্ডার ফাঁকে মনে ছুটে যায় ১৯৯৩-৯৪ সালের দিকে, নান্যাচরের মাওরুম গ্রামে। দূর পাহাড়ে এক ঐতিহ্যবাহী পাহাড়ি বিয়ের আসরে মাইক দখল করেন হাড্ডিসার কালো মতো এক ছেলে। গলায় গামছায় বাঁধা সিঙ্গেল রিডের একটি ছোট হারমোনিয়াম। নাম নাকি কালায়ন চাকমা, সেই প্রথম দেখা। এক সময় পিসিপি (পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ) করতেন, এখন গান বাজনা নিয়ে আছেন।
কালায়ন দা মাইক টেনে নিয়ে বলেন, আজ এই আনন্দের দিনে অনেক আনন্দ সঙ্গীত তো হলো। এবার একটি অন্যরকম গান হোক। আমি পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তবতা নিয়ে গান লিখেছি, তারই একটি আপনাদের শোনাতে চাই। এরপর তিনি বাংলা গানে শোনান রোমহর্ষক নান্যাচর গণহত্যার কথা। তার গানের প্রথম কলিটি এরকম :
‘১৭ তারিখ নভেম্বর/ ৯৩ ইংরেজী...’
ওই তারিখেই নান্যাচর বাজারে পাহাড়িদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে হামলা চালায় পাহাড়ে অভিবাসিত (সেটেলার) বাঙালিরা। খুব ঠাণ্ডা মাথায় দা দিয়ে কুপিয়ে খুন করা হয় অন্তত ২৯ জন পাহাড়িকে। একটি বিশেষ মহল সমর্থিত ওই হত্যাযজ্ঞে আহত হয়েছিলেন আরো অনেকে। ধর্ষিত হতে হয়েছে কয়েকজন পাহাড়ি নারীকে। ...
কালায়ন দা গানে গানে বর্ণনা করেন গণহত্যার কথা। মনে করিয়ে দেন লংগদু, লোগাং, বরকলসহ আরো অনেক হত্যাযজ্ঞ, অগ্নি সংযোগ, ধর্ষণ এবং জুম্ম নিধনের কথা।...
পুরো বিয়ের অনুষ্ঠানটি যেন একটি গানেই পরিনত হয় শোক সভায়। শত শত নিমন্ত্রিত অতিথি শব্দহীন কান্নায় আকুল হন। বার বার গামছায় চোখ মোছেন তারা। কেউ কেউ বুক ফাটা আর্তনাদ চাপা দিতে মুখ চেপে ধরেন গামছায়, কি খাদির আঁচলে।
চণ্ডাল আর থাকতে না পেরে সামিয়ানা ছেড়ে উঠে পড়ে। বিয়ের অনুষ্ঠানের বাইরে এক ঝোপের আড়ালে হরহর করে অনেকটা বমি করতে থাকে, যেন নিজ বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর পাপসকলও বেরিয়ে আসতে চায় ওই বমনে গিলা-কলিজা ফুঁড়ে। …
সে সময় এই নিয়ে প্রথমে লিটল ম্যাগে কিছু খুচরো লেখা, পরে ব্লগ লিখন, ও এখন বইয়ে একটি পর্ব জুড়ে দেওয়া, ‘আমার বন্ধু কালায়ন চাকমা’।…
(সমাপ্ত)