এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  পড়াবই  বই কথা কও

  • ইভান দেনিসোভিচের ষাট বছর

    সোমনাথ গুহ
    পড়াবই | বই কথা কও | ২৫ জুলাই ২০২১ | ২৬২৬ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • খেতে বসে এখন আমার সুকোভের কথা মনে পড়ে যায়, সুকোভ গ্যাং ১০৪ এর কয়েদি (জেক) নম্বর shcha854, তুষারাবৃত মেরু অঞ্চলে মাইনাস ২৭ তাপমাত্রায় যার পরনে একটা ভিতরের জামা, একটা বাইরের জামা, একটা জারকিন ও কালো জ্যাকেট, বেল্টের পরিবর্তে যার লোমজ প্যান্ট দড়ি দিয়ে বাঁধা, যার মাথায় একটা ধ্যাবড়ানো টুপি, যার হাতে পাতলা ছেঁড়া দস্তানা, পায়ে কয়েক স্তর পুরু ন্যাকড়ার ওপরে ফেল্ট বুট যেটার বুড়ো আঙুলের ফুটো দিয়ে প্রবেশ করে সাইবেরিয়ার হিমশীতল বায়ু যা প্রতি মুহূর্তে তার হাড়পাঁজরায় অকালমৃত্যুর সম্ভাবনা ঘোষণা করে। সুকোভ তাড়াহুড়ো করে খাওয়া পছন্দ করে না। তার প্রাপ্য ৫৫০ গ্রাম পাউরুটি হাতে নিয়ে হাওয়ায় ঝুলিয়ে সে বোঝার চেষ্টা করে ওজনটা ঠিক আছে কি না। আট বছরের ক্যাম্প জীবনের অভিজ্ঞতায় সে অবধারিতভাবে জানে সেটা কিছুটা কম কারণ জেকদের রেশনে ছোটো বড় সব বাবুদের হিস্যা আছে। মরুকগে যাক, এসব তার গা সওয়া হয়ে গেছে, হাঁসের পিঠ দিয়ে জল গড়িয়ে যাওয়ার মতো। কুড়ি গ্রাম মতো কম হবে। রুটিটার একটা টুকরো মুখে দিতে গিয়ে তার খেয়াল হল প্যারেডের সময় হয়ে গেছে। গোল্ডেন রুল তাড়াহুড়ো করে খাওয়ার অর্থ, খাবার নষ্ট করা; খেয়ে কোনও লাভ হয় না, শুধু গলাঃধকরণই হয়, মনে হয় পেটটা খালিই থেকে গেল।

    এটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ এখানে কোনও কিছুই মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকার পক্ষে অনুকূল নয়। বরং প্রতিটা মুহূর্তে জীবনসংশয়। কয়েদিদের তিনবেলার খাবার সীমিত, অতি সীমিত, যতটুকু না হলেই নয় ততোটুকুই মাত্র, সেটার সাথে আছে বরফশীতল শৈত্যপ্রবাহের মধ্যে গাধার খাটুনি। প্রবল প্রতিকূল আবহাওয়া, হাড়ভাঙা পরিশ্রম, এবং নামমাত্র খাবারের ত্রহ্যস্পর্শে প্রতিটি কয়েদির বেঁচে থাকাই দায়। তীব্র ক্ষুধা তাড়িয়ে বেড়ায় প্রতিটি বন্দিকে, বাসন ধোয়ার জায়গায় একে অন্যের বাটি চাটার জন্য পশুর মতো ঠেলাঠেলি করে, পেটের জ্বালায় নির্লজ্জ ভাবে অন্যের এঁটোকাঁটা কাচিয়ে খায়। সুকোভকে সব সময় ছক করতে হয়। রাঁধুনির চোখ এড়িয়ে কী করে দু বাটি অতিরিক্ত লপসি গ্যাঁড়ানো যায়, শহুরে সম্পন্ন জেক ৎসজার, যে নিয়মিত বাড়ি থেকে পার্সেল পায়, তাকে কী ভাবে হাতে রাখা যায়, বাবুদের কী ভাবে এড়িয়ে চলা যায় ইত্যাদি। যেমন ঐ বরফভূমিতে বারো ঘণ্টা হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের পর ক্যাম্পে ফিরেই সে পার্সেল ঘরে ৎসজারের জন্য লাইন রাখতে চলে যায়। ৎসজার মস্কো, আইজেনস্টাইন নিয়ে আলোচনা করা মানুষ, সে চাষাভুষো সুকোভকে কিছু দান করতে পারলে শ্লাঘা অনুভব করে। তাছাড়া তার মতো একটা সখী মানুষের সুকোভকে প্রয়োজন। জীবন যেখানে নির্দয়, যেখানে কাক কাকের মাংস খায়, সেখানে সুকোভের মতো এরকম করিৎকর্মা একজনকে প্রয়োজন যে পরিবেশের ঘাঁতঘোঁত জানে, যে জানে তার মধ্যেও কী করে টিকে থাকতে হয়। সে সুকোভকে তার পার্সেল থেকে সসেজ, বিস্কুট, সিগারেট দেয় কখনো অতি প্রীত হয়ে হেলায় তার রাতের খাবারও দিয়ে দেয়। সুকোভের সেটা হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো। এমনিতে জলখাবারের লপসি কিছুটা ঘন হয়, রাতেরটা জোলো। এই ব্যাপারে বাবুদের অকাট্য যুক্তি আছেঃ দিনে তো কয়েদিগুলোর থেকে যতটা পারা যায় কাজ নিংড়ে নিতে হবে সুতরাং ব্যাটাদের পেটে কিছু দাও, রাতে কিছু একটা দিলেই হল, অর্ধপেট হোক বা খালি তাদের তো ঘুমাতেই হবে! কিন্তু একটা এক্সট্রা পেয়েও তো শান্তি নেই। তারপর মেসগুমটিতে ঢোকার জন্য ধস্তাধস্তি, ট্রে নিয়ে টানাটানি ও সেটার ওপর দশটা বাটি চাপিয়ে ঠাসা ভিড়ের মধ্যে দিয়ে এক ফোঁটা তরল না ছলকে টেবিলে জায়গা করে নেওয়া... তারপর সেই পরম পবিত্র মুহূর্ত!

    সুকোভ কোনও সময় টুপি পরে খাবার খায় না। সেটা খুলে সে হাঁটুর ওপর রাখে। তার দিয়ে তৈরি করা একটি চামচ যেটা সেই ১৯৪৩ সাল থেকে তার সঙ্গী সেটা সে তার পায়ের ছেঁড়া ন্যাকড়াগুলোর মধ্যে থেকে বার করে। চামচ দিয়ে দুটো বাটির তরল নাড়িয়ে দেখে। গরম, ধোঁয়া উঠছে। এক চামচ সে মুখে দেয়, আরও এক চামচ। উষ্ণতা তার শরীরের জমে থাকা হিম ভেদ করে অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। আঃ স্বর্গীয়! তার মুখ উদ্ভাসিত, কোনও কষ্টই তার কাছে আর কষ্ট নয়। লপসিটা সে নাড়ায়, চলে যাবে, মাছের একটা সেদ্ধ ক্ষীণ কাঁটাও আছে যেটার সঙ্গে ফুলকো পাখনার টুকরাটাকরা লেপটে আছে। প্রতিটি কাঁটা সে শুষে নিঃশেষিত করে ফেলে, ছিবড়ে করে টেবিল ভরিয়ে দেয়। ৎসজারের বাটিতে আবার একটা বরফঘেয়ো আলু! কোনও তাড়াহুড়ো নেই তার, ধীরে সুস্থে খায়। আলুটা মিষ্টি, কিন্তু শক্ত। সুকোভ একটা বাটির তরল শেষ করে অবশিষ্টটা কাচিয়ে দ্বিতীয় বাটিতে ঢেলে দেয়। সেটাও চেটেপুটে চকচকে করে দিয়ে তবে তার শান্তি।

    সকালটা কিন্তু শুরু হয়েছিলো সলিটারি সেলে নির্বাসিত হওয়ার আতঙ্ক দিয়ে। এমনিতে সুকোভ পাঁচটায় ভোরের ঘণ্টা বাজতেই উঠে পড়ে। তাতে করে সে প্রায় দেড় ঘণ্টা হাতে পায় যে সময়টা সে টুকটাক কাজ করে সামান্য কিছু রুবল রোজগার করে। শরীরটা একটু ম্যাজম্যাজ করাতে সে ছারপোকায় গিজগিজে বাঙ্কে শুয়ে গড়াগড়ি দিচ্ছিল। কোথা থেকে এক ওয়ার্ডার এসে হাজির। তিনদিন ‘গহ্বরে’, তার নিদান। গহ্বর বলতে ঐ সেলগুলো যেগুলো আদপে মরণকূপ। দেয়াল পাথরের, মেঝেটা সিমেন্ট। কোনও জানলা নেই। একটা স্টোভ আছে সেটার তাপমাত্রা ততোটাই যা দেয়ালের বরফ গলাতে প্রয়োজন হয়। মেঝেতে বরফগলা জলের মধ্যে বোর্ডের ওপর শুতে হয়। দিনে ৩০০ গ্রাম পাউরুটি বরাদ্দ, লপসি তিনদিনে একবার। দশ দিন এই কূপে থাকলে নির্ঘাৎ টিবি, পনেরো দিন থাকলে “ছয় ফুট মাটির তলায়”। সেই ওয়ার্ডার, যে জাতিতে তাতার হঠাৎ তার কী মনে হল সুকোভকে সে খালি মেঝে পরিষ্কার করিয়েই মাপ করে দিল। মেসগুমটিতে সে যখন ঢুকল এঁটোখেকো ফেতুকভ তার জলখাবার আগলে রেখে দিয়েছে যদি কিছু উচ্ছিষ্ট পাওয়া যায়। সুকোভ তাকে পাত্তাও দিলো না। সকালে দু রকমের লপসি, দুটোই তার দেরি হয়ে যাওয়ার কারণে ঠান্ডা হয়ে গেছে। লপসির আনাজ ঋতুর ওপর নির্ভর করে। গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে জুন যেমন তারা শুধু মুলোই পেয়েছে, এই বছর বরফে কালচে হয়ে যাওয়া বাঁধাকপি। জুনে সাধারণত শস্যদানা থাকে যা বেশ উপাদেয়, জুলাইয়ে অখাদ্য কাঁটা লতা। দ্বিতীয় লপসিটা বরফে জমে গেছে। এটার মূল উপাদান কাকপায়া ঘাস বা চাইনিজ ঘাস, একেবারেই বিস্বাদ, খেলেও মনে হয় কিছুই খাইনি। কুছ পরোয়া নেই এতেই চালাতে হবে, কাঁদুনি গেয়ে লাভ নেই। সুকোভ প্রতিটি দানা চেটেপুটে খায়, ঝকঝকে চামচটা পায়ের ন্যাকড়ায় গুঁজে রাখে। বাইরে তখনো অন্ধকার, শুধু একটা সবজেটে আলো ছড়িয়ে পড়ছে। একটা হিমশীতল শয়তানি বাতাস শিরশির করে শরীরে ছুঁচ ফোটাচ্ছে। সুকোভ পোশাকের মধ্যে গুটিয়ে যায়, মাথাটা বুকে গুঁজে দিয়ে জ্যাকেটের কলার তুলে দেয়। সারাদিনের দাসত্বর জন্য সে এখন তৈরি।

    সুকোভ রাজমিস্ত্রি, ইট গাঁথনিতে তার জুড়ি নেই। ফোরম্যান ত্যুরিনের তার ওপর আস্থা আছে। অর্ধনির্মিত পাওয়ার হাউসের ওপরের তলাটার দেয়াল তুলতে হবে, এটাই সেদিন গ্যাং ১০৪ এর নির্দিষ্ট কাজ। কোনও ঘরাঞ্চি নেই, কপিকল নেই কংক্রিটের বড় সব পাটাতন কাঁধে পিঠে করে দোতলায় তুলতে হবে, যাকে বলে হারকিউলিয়ান কাজ। তাও তো ভালো তাদের ‘সমাজতান্ত্রিক বসতি’ বলে যে জায়গাটা তৈরি হবে সেখানে তাদের ডিউটি পড়েনি। সেখানে হাঁটু সমান বরফের মধ্যে শুধু খুঁটি পোঁতো আর কাঁটাতার লাগাও। আশেপাশে কোনও ছাউনি নেই, কোনও চুল্লি নেই, বিন্দুমাত্র গরম পাবার কোনও সম্ভাবনা নেই; পরিশ্রমই সেখানে গরম হওয়ার একমাত্র উপায়। ত্যুরিন ম্যানেজ মাস্টার। কারো তেলা মাথায় হাত বুলিয়ে নিজের গ্যাংয়ের ডিউটির জায়গাটা ঠিক পাল্টে নিয়েছে। ততক্ষণে সূর্য মাথার ওপরে। দুপুর একটা, আবার খাবার সময়, কয়েদিদের নিজস্ব সময়। ঘুমের সময় ছাড়া, জলখাবারের দশ মিনিট এবং মধ্যাহ্ন ও নৈশভোজনের পাঁচ মিনিট কয়েদিদের একান্ত। বাকি সময় খালি কাজ আর বাবুদের গালমন্দ আর লাথিঝাঁটা।

    সেদিন দুপুরে লপসিতে ওটস ছিল, বেশ সুস্বাদু। অতো ভিড়ের মধ্যেই সুকোভ পাবলোর সাথে কাউন্টারের মুখে পৌঁছে গেছিল। কাউন্টারে পাঁচটি অর্ধচন্দ্রাকার কোটর। তিনটি খাবার পরিবেশনের জন্য, একটি রোগভোগের জন্য যাদের বিশেষ খাবার দেওয়া হয় তাদের জন্য, আর পঞ্চমটি এঁটো বাটি জমা দেওয়ার জন্য, যেখানে বুভুক্ষু জনতার উপচে পড়া ভিড়, মনুষ্যেতর হাহাকার। কোটরের ভিতর দিয়ে রাঁধুনি, লপসির ডেকচি কিছুই দেখা যায় না, সুকোভ খালি রাঁধুনির লোমশ হাতের ওঠানামা খেয়াল করে। ডিব্বা হাতা দিয়ে সে বাটিতে লপসি ঢালে। সুকোভ জানে পিণ্ডগুলো সব নীচে তলিয়ে গেছে, মাঝখান থেকে তরল বাটিতে ভরলে সেগুলোতে তাও কিছু পদার্থ পাওয়ার আশা থাকে। রাঁধুনি গুনতে থাকে দুই, চার, ছয়…একটু অন্যমনস্ক হতেই সে গুলিয়ে ফেলে এবং অতি তৎপর সুকোভ মুহুর্তের মধ্যে দুটো বাটি সাইড করে দেয়। টেবিলে বসে সে এমন দুটো বাটি বেছে নেয় যেগুলো বেশ ঘন। দুটোই সে নিঃশেষিত করে। জারকিনের পকেট থেকে পাউরুটিটা বার করে একটা অংশ ছিঁড়ে নিয়ে বাটিগুলোর অবশিষ্টাংশ কাচিয়ে নেয়, তারপর রুটিটা কুটিকুটি করে খায়। রুটির বাকি অংশ আবার পকেটে ঢুকিয়ে দেয়। সে জানে, “পেট একটা অকৃতজ্ঞ শয়তান, অতীতের দাক্ষিণ্য সেটা মনে রাখে না, আগামিকাল আবার খাইখাই করবে”।

    বিলাসিতা বলতে সিগারেট যেটা ৎসজারের অনুগ্রহে সে মাঝেমধ্যে পায়। আর তামাক সে কেনে দুজন ল্যাটভিয়ানের থেকে যারা সব সময় এক সাথে থাকে, একসাথে খায়, শোয়, খালি নিজেদের মধ্যে কথা বলে, যেন যমজ। কিলডিগস আর এক ল্যাটভিয়ান, সদাহাস্যময়, মজাদার মানুষ যে অনর্গল রুশ ভাষায় কথা বলে যেতে পারে। যে কোনও কঠিন কাজে সে সুকোভের পার্টনার। জোড়া ল্যাটভিয়ানের মতো জোড়া এস্টোনিয়ান আছে। তাদের একজন ছিল বাল্টিক সমুদ্রের জেলে, আরেকজন পরিবারের সাথে সুইডেন চলে গেছিলো, হঠাৎ তার মাথায় ক্যাড়া চাপে নিজের দেশে গিয়ে পড়াশোনা করতে হবে। ব্যাস ফিরে আসা মাত্রই বিদেশি যোগাযোগের দায়ে গ্রেপ্তার। ত্যুরিনের দোষ সে কুলাকের ছেলে, যে ত্যুরিন গ্যাংয়ের সবার অভিভাবকের মতো, বাবুদের শ্যেন দৃষ্টি থেকে যে অন্যদের আড়াল করে। সুকোভ নিজেও তো বোকা, জার্মানদের শিবির থেকে পালিয়ে নিজের সৈন্যদের সঙ্গে তার দেখা হয়ে যায়। সে যদি বলতো যে বনে হারিয়ে গেছিলো তাহলে হয়তো সে বেঁচে যেত। সত্যি কথাটা বলা মাত্র চরবৃত্তির অভিযোগে বেধড়ক মার, জার্মান গুপ্তচর বলে স্বীকারোক্তি লিখিয়ে নেওয়া, গ্রেপ্তার এবং দশ বছরের নির্বাসন। সব যুদ্ধবন্দিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ চরবৃত্তি, কারো সাজা দশ, কারো পঁচিশ। আলোশকা শুধুমাত্র ব্যাপটিস্ট হওয়ার কারণে পঁচিশ বছর শান্টিং। গোপচিক যার গালে এখনো কৈশোরের গোলাপি আভা সে বেচারা ইউক্রেনের বিপ্লবীদের দুধ দিতে গিয়ে ধরা পড়ে যায়। কোনও কাজে ছেলেটা পিছপা নয়, ভরপুর এনার্জি। ফেতুকোভ ঠিক তার উল্টো। সে হ্যাংলা, অন্যের ফেলে দেওয়া সিগারেট তুলে টানে, অন্যের বাটির এঁটোকাঁটা চাটতে গিয়ে প্রায়ই মার খায়। সুকোভের করুণা হয় তার জন্য। এতো দুর্বল আর ছিঁচকাঁদুনে, এই নির্মম পরিবেশে কতো দিন টিকে থাকতে পারবে সন্দেহ? সুকোভ গ্যাং ৮৪র কয়েদি নম্বর YU 81র কথা শুনেছে। প্রায় তিরিশ বছর সে ক্যাম্পে আছে এবং আশ্চর্যভাবে প্রতিবারের বন্দিমুক্তিতে সে উপেক্ষিত রয়ে গেছে। তার মাথায় একটি চুল নেই, মুখে একটি দাঁত নেই, তার চোখে অপার শূন্যতা; তিন দশকের নিগড়ের ফলে সে এক খোদাই করা জীবন্ত কাঠপুতুলে পরিণত হয়েছে। গ্যাং একটা পরিবার। কারো জন্য অন্যেরা বিপদে পড়লে তার কপালে যেমন দুঃখ আছে, আবার কেউ বাবুদের দ্বারা হেনস্থা হলে তাকে বাঁচানোর প্রচেষ্টাও আছে। যখন কাউকে মরণকূপে নিয়ে যাওয়া হয় তখন সবাই সমস্বরে তাকে উৎসাহিত করে- উৎফুল্ল থাকো, ওরা যেন কোনও ভাবেই তোমাকে দমিয়ে না দিতে পারে।

    রাতের খাবার সেরে সুকোভ যখন মেসগুমটি থেকে বেরিয়ে আসে চাঁদটা তখন আকাশের চূড়ায় উঠে গেছে, চারিদিকে আলোয় আলো। তার গ্রামে এই আলোকে বলে ‘নেকড়ের রোশনাই’। গ্রামে এখন কোলখোজের (খামার) কাজে কেউ উৎসাহিত নয়। নতুন প্রজন্ম এখন শহরে কাজ খুঁজতে যায়। কার্পেট নাকি এখন খুব ফ্যাশান। সুকোভ কি ফিরে গেলে সেখানে বেমানান হয়ে যাবে? সে বুঝতে পারে না সে মুক্তি চায়, না চায় না। জীবন কোথায় বেশি সহজ, এখানে না গ্রামে। তার একটাই গর্ব সে নিজের ব্যাক্তিত্ব অটুট রাখতে পেরেছে। সে তার কাজ উপভোগ করে, এর জন্য সবাই তাকে সম্মান করে। বেঁচে থাকার জন্য সে নানা ছল করে কিন্তু সে কারো তাঁবেদারি করে না। আট বছর আগে প্রথম যখন সে ক্যাম্পে এসেছিলো এক পোড়খাওয়া কয়েদি তাকে বলেছিলঃ “শোন ছেলে এখানে টাইগা’র নিয়ম চলে। তবুও অন্য যে কোনও জায়গার মতো এখানেও একজন মানুষ বেঁচে থাকতে পারে”। সুকোভ বেঁচে আছে, মাথা উঁচু করে দাঁতে দাঁত চেপে বেঁচে আছে।

    পুনশ্চ: আলেকসান্দ্র্‌ সলঝেনিৎসিনের প্রথম উপন্যাস ‘ওয়ান ডে ইন দ্য লাইফ অফ ইভান দেনিসোভিচ’ ১৯৫৯ সালে লেখা। ১৯৬২ সালে সেটি ‘নোভি মির’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সোভিয়েত রাশিয়ায় সেই সময় শিল্প সাহিত্যর ওপর অলিখিত কিছু নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল, তা সত্ত্বেও বইটা যে প্রকাশিত হয়েছিলো এটাই একটা বিস্ময়। যে যে বিষয়গুলি তখন উল্লেখ করা মোটেও বরদাস্ত করা হতো না তা হলঃ
    (১) বলপ্রয়োগ দ্বারা যৌথ খামার ব্যবস্থা চালু করা,
    (২) জাতি, ধর্ম, শ্রেণি নির্বিশেষে বহু মানুষকে গ্রেপ্তার ও নির্বাসিত করা,
    (৩) যুদ্ধকালীন সময়ের শাসনব্যবস্থা, নীতি, আইন ইত্যাদি এবং
    (৪) দেশজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিপুলসংখ্যক বন্দিশিবির।
    লেখক এই সব বিধিনিষেধ সম্পর্কে ভালোই অবহিত ছিলেন তাই পাণ্ডুলিপি জমা দেবার আগে তিনি নিজেই নিজের লেখা অনেক কাটছাঁট ও সংশোধন করেন। ১৯৬২ সালে নোভি মিরে প্রকাশিত আখ্যানে এই অংশগুলি অনেক রেখেঢেকে পরিবেশিত হয়েছিলো, তাই উপন্যাসের সেই বয়ানটি প্রামাণ্য নয়। অনেক পরে মূল এবং প্রামাণ্য উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। আলেকসান্দ্র্‌ সলঝেনিৎসিনের (১৯১৮-২০০৮) অন্যান্য উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ‘দ্য গুলাগ আর্কিপেলাগো’, ‘ক্যান্সার ওয়ার্ড’, ‘ইন দ্য ফার্স্ট সারকেল’ ইত্যাদি। ১৯৭০ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। ১৯৭৪ সালে তাঁর নাগরিকত্ব বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং তাঁকে পশ্চিম জার্মানিতে বিতাড়িত করা হয়। পরে তিনি পরিবার নিয়ে আমেরিকায় বসবাস শুরু করেন। পশ্চিমি দেশগুলোর অনৈতিক ভোগবাদী জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণার কারণে ১৯৯৪ সালে তিনি রাশিয়ায় ফিরে আসেন।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • পড়াবই | ২৫ জুলাই ২০২১ | ২৬২৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • b | 14.139.***.*** | ২৫ জুলাই ২০২১ ২২:২৬496093
  • গুলাগ আর্কিপেলাগ কী উপন্যাস ?

  • Somenath Guha | ২৬ জুলাই ২০২১ ০০:০০496098
  • প্রায়, এবং অনেকটাই আত্মজৈবনিক।

  • বিপ্লব রহমান | ২৮ জুলাই ২০২১ ০৭:৫৮496157
  • অনেক বছর পর রুশ সাহিত্য! বইটি পড়তে হবে 

  • Kaushik Saha | ২৮ জুলাই ২০২১ ১২:৪৪496158
  • @b


    Gulag Archipelago : An Experiment in Literary Investigation -  রাশিয়ান লেখক এবং রাষ্ট্রবিরোধী   মতাবলম্বী Aleksandr Solzhenitsyn  দ্বারা   1958 থেকে 1968 এর মধ্যে রচিত একটি তিন-খণ্ডের সত্যভিত্তিক  রচনা । প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল 1973 সালে, এবং পরের বছর ইংরেজী এবং ফরাসি ভাষায় অনুবাদ হয়।  রাশিয়ান ভাষায়, GULAG (ГУЛАГ) শব্দটি প্রধান ক্যাম্প অধিদপ্তরের (Главное управление лагерей - Glavnoye Upravlyonye Lageroi) সংক্ষিপ্ত রূপ।  GULAG দপ্তরের  অধীন সোভিয়েত রুশিয়ার সকল বন্দীশিবির বা ক্যাম্পসমূহকে Gulag Archipelago বা Gulag দ্বীপপুঞ্জ আখ্যায়িত করেছেন।  এই রচনায়  Gulag বন্দীদের  রিপোর্ট, সাক্ষাত্কার, বিবৃতি, ডায়েরি, আইনী নথিপত্র  এবং Solzhenitsynএর নিজস্ব অভিজ্ঞতাসহ বিভিন্ন উত্স থেকে উদ্ধৃতি এবং লেখকের নিজস্ব ব্যাখ্যা সংকলিত হয়েছে। 


    The Gulag Archipelago Paperback –  Aleksandr Solzhenitsyn  - ISBN-10 1843430851

  • পার্থপ্রতিম মন্ডল | 2405:201:800a:e008:70:fecf:4c82:***:*** | ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২৩:৫৫497816
  • সুন্দর আলোচনা। খুব ভালো লাগল।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন