এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

  • পাইপার আলফা – মাঝসমুদ্রে আগুন, বদলে যাওয়া জীবন ও সুরক্ষা সংস্কৃতি

    সুকান্ত ঘোষ
    আলোচনা | বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি | ১০ জুন ২০২১ | ২৯৭৮ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • পর্ব – ১ | পর্ব –২

    দ্বিতীয় পর্ব

    যে কোন কারখানার মত এই অফশোর প্ল্যাটফর্মগুলিও কিছু বছর অন্তর অন্তর পুরোপুরি শাটডাউন করতে হয় সারা প্ল্যাটফর্ম জুড়ে রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য। এবার কোন প্ল্যাটফর্ম যদি খুব বেশি তেল গ্যাস উৎপাদন করে তাহলে এই শাটডাউন কোম্পানির টাকা ইনকাম করার ধান্ধাকে কীভাবে ব্যাহত করে বুঝতে পারছেন? আগের পর্বে যেটা বলেছিলাম, পাইপার আলফা ১৯৮৮ সালে হিসেব মত দিনে ৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের তেল এবং গ্যাস উৎপাদন করত। দুই সপ্তাহ শাটডাউন মানে অক্সিডেন্টাল পেট্রোলিয়ামের পকেটে গেল না ৭০ মিলিয়ন ডলার! আবার এদিকে শাটডাউন না করলেও নয় – এই প্ল্যাটফর্ম সোনার ডিম দেওয়া হাঁস!

    ফলে এক ব্যালেন্সের খেলা চলতে থাকে – যতটা সম্ভব দেরিতে শাটডাউন নেওয়া হতে থাকে। আর একটা কাজ করা হয় – পুরো প্ল্যাটফর্ম শাটডাউন না করে যতটা পারা যায় কাজ সেরে ফেলা। মানে যেখানে কাজ করতে চান শুধু সেইখানের আশেপাশে শাটডাউন করে টুক করে কাজ করে নিলেন। এবার বুঝতেই পারছেন আমি যেমন সহজভাবে লিখলাম জিনিসটা তত সহজ নয়! আপনাকে পদে পদে রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট করতে হবে। আমরা জানি যে আগুনের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস চাই তিনটি – দাহ্য পদার্থ, আগুনের উৎস এবং অক্সিজেন। এই তিন জিনিস মিলিয়ে তৈরি হয় ফায়ার ট্রাঙ্গেল - এর মধ্যে যে কোন একটা জিনিস সরিয়ে নিলেই আর আগুন লাগবে না। একটু ভাবলেই দেখতে পাবেন এর মধ্যে সবথেকে চাপ হচ্ছে অক্সিজেন নিয়ন্ত্রণ করা। কারণ আমাদের চারিদিকের বাতাসেই আছে প্রায় ২২% অক্সিজেন! তা এই জিনিস নিয়ন্ত্রণ করতে হলে চারিদিকে কৃত্রিম তাঁবু (হ্যাবিট্যাট) খাটিয়ে ভিতরের বাতাস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। হ্যাঁ, তাঁবু খাটিয়ে কাজ করা হয় করা হয়, তবে খুব খুব সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রে। সাধারণত দাহ্য পদার্থ এবং আগুনের উৎসের উপরে জোর দেওয়া হয়।

    অফশোর প্ল্যাটফর্মে বুঝতেই পারছেন দাহ্য পদার্থের ছড়াছড়ি – মানে বলতে গেলে আপনি একটা বোমার উপরেই বসে আছেন! তাই যে কোন ফায়ার সেফটির প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে এই দাহ্য পদার্থ (তেল এবং গ্যাস) যাতে ইক্যুইপমেন্ট বা পাইপলাইনের বাইরে না আসে। এই ভাবে দেখতে গেলে আমাদের অনেক ইঞ্জিনিয়ারের কাজের বিবরণ এক লাইনে দেওয়া যায় “আওয়ার জব ইজ টু কিপ দ্যা হাইড্রোকার্বন ইনসাইড দ্যা ইক্যুইপমেন্ট”। তা এই গ্যাস বা তেল পাইপের বাইরে বেরোবে কী করে? বেরোবে লিক করে। এবার এই লিক ক্ষয়ের কারণে হতে পারে বা ঠিকঠাক নাটবল্টু টাইট না দেওয়ার ফলেও হতে পারে। এই দাহ্য পদার্থের সোর্স অনুযায়ী অফশোর প্ল্যাটফর্মকে নানা ‘জোন’-এ ভাগ করা হয়। সাধারণত জোন ০, জোন ১ ও জোন ২। জোন ০ হচ্ছে সেই এলাকা যেখানে দাহ্য পদার্থ সবসময়েই মজুত থাকে, জোন ১ তে দাহ্য পদার্থ মাঝে মাঝে দেখা যেতে পারে সাধারণ অপারেশনের সময়, এগুলো আসে মূলত রিপেয়ার, লিক বা রক্ষণাবেক্ষণ কাজকর্মের সময়। জোন ২ তে দাহ্য পদার্থের উপস্থিতি নরম্যাল অপারেশনের সময় একদম রেয়ার, মানে কোন দুর্ঘটনা ঘটলেই তবেই এখানে দাহ্য পদার্থের উপস্থিতি দেখা যেতে পারে।

    এবার ধরুন কোন কারণে ফাঁক ফোঁকর দিয়ে গ্যাস বা তেল বেরিয়ে এল – তাহলে কি এবার আগুন ধরে যাবে এবং তার পরে বিস্ফোরণ? না – গ্যাস বা তেল লিক হলেই আগুন ধরবে না – চাই একটা আগুনের সোর্স! কোথাও থেকে একটু আগুনের ফুলকির দরকার। এই ফুলকি আসতে পারে ধাতুর ঘর্ষণে – এমনও দেখা গেছে যে একটু উঁচু থেকে বল্টু টাইট দেবার স্প্যানার হাত থেকে পড়ে গিয়ে নীচের লোহার মেঝে বা অন্য যন্ত্রপাতির সঙ্গে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে সেই ফুলকির সৃষ্টি হয়েছে। এই নিয়েও আমাদের মাঝে মাঝে নাড়া ঘাঁটা করতে হয় – মানে কত উঁচু থেকে কত ওজনের হাতুড়ি পড়লে সেই কাইনেটিক এনার্জির ঠিকঠাক সামর্থ থাকবে আগুনের স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি করার। এছাড়া আছে স্ট্যাটিক ইলেকট্রিসিটি – ওই যে আপনারা অনেক সময় জামাকাপড়, বা চিরুনি বা ট্রেডমিলে অনেকক্ষণ দৌড়াবার পর ধাতুর হ্যান্ডেলে হাত দিয়ে যে হালকা চিড়িক করে লাগে তাকেই বলে স্ট্যাটিক ইলেক্ট্রিসিটি। যদি পরিবাহী কিছুর সঙ্গে সম্পর্ক না রেখে আপনি এদিক ওদিক করেন তাহলে আপনার শরীরে কিছু স্ট্যাটিক ইলেকট্রিসিটির জন্ম হয় যা ডিসচার্জ হয়ে যায় যখন আপনি পরিবাহী কিছু স্পর্শ করেন। এবার কতটা স্ট্যাটিক ইলেকট্রেসিটি আপনার শরীরে জন্ম হয়েছে তার উপর নির্ভর করছে ডিসচার্জের সময় তা স্ফুলিঙ্গের সৃষ্টি করবে কিনা। অফশোরে এই স্ট্যাটিক ইলেকট্রিসিটি যাতে বেশি জমা না হয়ে যায় কিছুতে সেই নিয়েও অনেক ভাবনা ভাবতে হয়।

    এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে এত সব সমস্যার মধ্যে থেকে আপনাকে কেউ জোন ০ তে লাইভ (মানে যখন যন্ত্রপাতি চালু আছে) কাজ করার পারমিশন দেবে না। জোন ২ তে অনেক সময়েই কাজ চলে প্ল্যাটফর্ম পুরো শাটডাউন না করে – জোন ১ তে লাইভ যন্ত্রপাতিতে কাজ নির্ভর করে সেই প্ল্যাটফর্মের রিস্ক অ্যাসেসমেন্টের উপর।

    আবার পাইপার আলফার ঘটনায় ফিরে আসি – আগের পর্বেই এই প্ল্যাটফর্মের ইতিহাস নিয়ে লিখেছিলাম, তাই সেগুলোর আর পুনরাবৃত্তি করছি না। তবে হালকা করে রিক্যাপ করে নেওয়া যাক – এই পাইপার আলফা প্ল্যাটফর্মটি ছিল অক্সিডেন্টাল পেট্রোলিয়াম কোম্পানির, ১৯৭৬ সাল থেকে এখানে তেল উৎপাদন শুরু হয়। প্ল্যাটফর্মটি ছিল মডুউলার ডিজাইনের – এমনভাবে বিভিন্ন মডিউলকে সাজানো হয়েছিল যাতে করে সবচেয়ে বেশি রিস্কের অপারেশনের থেকে পার্সোনাল এরিয়া সবচেয়ে বেশি দূরত্ব থাকে। প্রথমে এই প্ল্যাটফর্ম থেকে প্রধানত তেল উৎপাদিত হত, কিন্তু পরে তেল উৎপাদন কমে যায় এবং গ্যাসের পরিমাণ বেশি হয়ে যাওয়াতে, এই প্ল্যাটফর্মকে গ্যাস উৎপাদনকারী প্ল্যাটফর্মে পরিণত করা হয়। মূল পদ্ধতি গুলো অনেকটা এক হলেও, তেল হ্যান্ডেল করার সঙ্গে গ্যাস হ্যান্ডেল করার বেশ কিছু পার্থক্য আছে। প্ল্যাটফর্মে কিছু পরিবর্তনের দরকার হয়ে পরেছিল, কিছু নতুন যন্ত্রপাতি ইত্যাদি। এই করতে গিয়ে ১৯৭৬ সালে পাইপার আলফা যেমন ভাবে মডিউলার সাজানো হয়েছিল সুরক্ষার দিক বিচার করে, সেই সুরক্ষা বেশ বিঘ্নিত হয়ে যায় গ্যাস প্ল্যাটফর্মে রূপান্তরের সময়। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আমরা পরে দেখব যে এমন পরিবর্তন কিভাবে সুরক্ষার বিষয়কে কম্প্রোমাইজ করে দিতে পারে। নীচের ছবিতে দেখা যাবে ১৯৮৮ সালে পাইপার আলফা প্ল্যাটফর্মের লে-আউট কেমন ছিল ওই সব পরিবর্তনের পরে।



    পাইপারআলফা প্ল্যাটফর্মের লে-আউট


    ১৯৮৮ সালের জুলাই মাসের ছয় তারিখ, যখন প্ল্যাটফর্ম পুরো শাটডাউনে ছিল না, তখন পাইপারআলফা প্ল্যাটফর্মে কিন্তু টুক-টাক বেশ কিছু হালকা এবং ভারী মিলিয়ে কাজ চলছিল। যেমনঃ

    অন্য একটা ফিল্ড (ক্যান্টার) থেকে তেল তোলার রাইজার (রাইজার মানে পাইপলাইনের সেই অংশটা যেটা সমুদ্রের তলদেশ থেকে খাড়া হয়ে উঠে প্ল্যাটফর্মে আসে)

    গ্যাস কম্প্রেশন করার মেশিনপত্র সারাই

    প্ল্যাটফর্মের কিছু স্ট্রাকচারাল জিনিসপত্র পালটানো

    গ্যাস পাইপলাইনের রক্ষণাবেক্ষণ কাজ

    প্রেসার রিলিফ ভালভগুলোতে কিছু সমস্যা দেখা দিচ্ছিল, সেগুলো ঠিক করা

    রাতে ডুবুরিদের জলে ডাইভ দিয়ে কাজকর্ম

    পুরোদমে প্ল্যাটফর্মের একদিকে ড্রিলিং চলতে থাকা


    বুঝতেই পারছেন একটা প্ল্যাটফর্মে এত কাজ চলা মানে সেটা কি ভজকট ব্যাপার। অফশোরে কাজকর্ম করতে প্রচুর প্ল্যানিং লাগে – কারণ একটা খুব ছোট্ট জিনিস ভুলে গেলে বা খুব ক্ষুদ্র জিনিস হাতের কাছে না থাকলে পুরো কাজ ভেস্তে যেতে পারে। আর এটা তো বিয়েবাড়ির রান্না নয় যে ফর্দ করে আনলেন ঠিক আছে, তবুও হয়ত চিনি কম পড়ল, আপনি কাউকে পাড়ার উত্তমের দোকানে পাঠিয়ে এক কিলো চিনি কিনে আনলেন! মাঝ সমুদ্রে কোন উত্তমের দোকান নেই! একটা পুঁচকে সাইজের ওয়াশার বা নাটবল্টুও প্রয়োজনমত সহজলভ্য হতে হবে অফশোরে হাতের কাছে।

    আর তাছাড়া আছে অনেক কাজ একসঙ্গে চলা – সাইম্যুলটেনিয়াস অ্যাক্টিভিটি প্ল্যানিং সেটাও একটা বড় ব্যাপার। কোথায় কিছু যদি শাট-ডাউন রাখতে হয় তার হিসেবনিকেশ – আগু-পিছু সব মিলিয়ে নেওয়া হবে। যাঁরা এইসব কাজের সঙ্গে পরিচিত তাঁরা জানেন যে, সফলভাবে এত কাজ কোন বিপদ ছাড়া সম্পূর্ণ করতে হলে ‘ওয়ার্কপারমিট’ ভালোভাবে মেনটেন করা খুব ক্রিটিক্যাল। ওয়ার্ক পারমিটের ভিতরে এখানে যাব না কারণ লেখা অনেক বড় হয়ে যাবে, শুধু এটুকু বলে রাখি, প্রতিটা কাজের জন্য থাকবে ওয়ার্ক পারমিট, সেই কাজের ডিটেলস, শুরু কখন এবং শেষ, কীকী ঝুঁকি আছে সেই কাজে সব ব্যাখ্যা করে রাখতে হয়। কোন কাজ যদি ঝুলে যায় বা দুর্ঘটনা হয়, তাহলে প্রায়শই দেখা গেছে যে এইসব পদ্ধতির কোন একটায় গাফিলতি থেকে গিয়েছিল – ইচ্ছাকৃত অবহেলা বা অনিচ্ছাকৃত ভুল। পাইপার আলফার দুর্ঘটনার তদন্ত তেমন কিছু গাফিলতি তুলে ধরেছিল – তবে সেই কথায় পরে আসছি। এবার দেখে নেওয়া যাক, ৬ জুলাই দিনটার দুর্ঘটনার ঘটনাক্রম কেমন ছিল

    সকাল ৭.৪৫

    প্রত্যেক কাজের জন্য ওয়ার্ক পারমিট ইস্যু করা হল। ওয়ার্ক পারমিট ইস্যু করা মানে সেই কাজটা নিরাপদে করা যাবে এমন এক গ্যারান্টি

    দুপুর ১২.০০

    যারা মেনটেনেন্সের কাজ করছিল তারা একটা সেফটি ভালভের কাজে হাত দিল। সেই সেফটি ভালভটা খুলে নিয়ে এল প্ল্যাটফর্মের ডেস্কে। তাদের লক্ষ্য ছিল এই যে সেই দিনের শিফট শেষ (সন্ধ্যা ৬টা) হবার আগেই এই কাজটা সম্পূর্ণ হয়ে যাবে।

    বিকেল ৫.১০

    দিনের শিফটের অ্যাক্টিভিটি লিডার রাতের শিফটের লিডারের সঙ্গে আলোচনা শুরু করল কাজের হিসাব বুঝিয়ে দেবার জন্য, তখনও পর্যন্ত এমন কিছু নজরে আসেনি সেই দুই লিডারেরই যাতে করে বেশি সচেতন বা বিশেষ পরিকল্পনা করতে হয়। সব কাজই প্রায় রুটিন কাজ –

    সন্ধ্যা ৬.০০

    ডে শিফটের কাজ শেষ হয়ে গেল। কিন্তু আগে যেমন ভাবা হয়েছিল, সেফটি ভালভের কাজ তখনো শেষ হল না। তবে এই ব্যাপারটা খুব একটা ভাবালো না – কারণ এই সেফটিভালভটা যে পাম্পের সঙ্গে জুড়ে ছিল সেটা ছিল শাটডাউন। তাই সেফটি ভালভের কাজ দিনের দিন সম্পূর্ণ না হলেও প্রোডাকশনের উপর কোন রকম প্রভাব ফেলবে না বলে এটা ঠিক হল যে বাকি কাজ পরের দিন দিনের শিফটে হবে। এরা এবার করল কী, পাম্পের সঙ্গে সংলগ্ন যে পাইপ থেকে এরা ভালভটা খুলে এনেছিল, সেই উন্মুক্ত পাইপে গিয়ে একটা ‘ব্লাইন্ড ফ্ল্যাঞ্জ’ আটকে দিল (মানে ধরুন একটা সলিড ধাতুর চাকতি পাইপের মুখটা বন্ধ করার জন্য)। কিন্তু সেই ব্লাইন্ড ফ্ল্যাঞ্জের নাট-বল্টু গুলো ঠিকঠাক টাইট দিল না – শুধু হালকা করে নাটগুলো এঁটে রাখল যাতে ফ্ল্যাঞ্জটা জায়গা থেকে পড়ে না যায়। কিন্তু এদিন যে পাম্পের কাজটা সম্পূর্ণ হয়ে যাবার কথা সেটা হল না, তা ঠিকঠাক ডকুমেন্ট করে রাখল না এরা। এই ভুল, অর্থাৎ ঠিক ঠাক ওয়ার্ক পারমিট ডকুমেন্ট না করা যে কতটা ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলেছিল, সেটা আমরা পরে দেখব। ভালো করে ডকুমেন্ট না করার ফলে শুধু রক্ষণাবেক্ষণ টিমের লোকজন ছাড়া আর কেউ জানলই না যে পাম্পের ভালভের কাজটা সম্পূর্ণ হয় নি! কন্ট্রোল রুম জানলো না -

    এখান একটু হালকা করে বলে রাখা যাক, যে কোন গুরুত্বপূর্ণ পাম্প, যেমন ছিল এই তেল পাম্পিং করার পাম্পটা, তাদের একটা করে ব্যাকআপ থাকে সাধারণত। মানে এখানে একটা পাম্প চালু ছিল, আর একটা পাম্পে মেনটেনেন্সের কাজ হচ্ছিল। আবার পরে কোন দিন পাম্প দুটোকে ঘুরিয়ে দেওয়া হবে – যেটা বসে ছিল সে করবে এবার কাজ, আর যে কাজ করছিল সে নেবে রেস্ট, জলটল খাবে একটু। পাইপার আলফায় এই বদলটা হত প্রতি দুই হপ্তায়।

    রাত ৯.৪৫

    কন্ট্রোল রুমে একটা অ্যালার্ম বেজে উঠল। তেল পাম্পিং করছিল যে পাম্পটা সেটা ট্রিপ করেছে। উপরের প্ল্যাটফর্মের ছবিতে যেখানে মডিউল C আছে, সেখানেই ছিল এই পাম্প দুটি (উপরের ছবিতে উল্লিখিত আছে “condensate injection pump” বলে)। এই পাম্প ট্রিপ করা অস্বাভাবিক কিছু নয়, মাঝে মাঝেই ট্রিপ করে – এবং প্ল্যাটফর্মে দায়িত্বে থাকা লোকজন জানে কিভাবে ট্রিপ ঠিক করে আবার পাম্প চালু করা যায়। তাই প্রথম অ্যালার্ম শুনে কেউ তেমন ঘাবড়ালো না। পাম্পের জায়গায় গেল ঠিক করতে – কিন্তু গিয়ে দেখল সেদিনের কেস বেশ জটিল। রোজকার পদ্ধতি অবলম্বন করে পাম্প আর চালু করতে পারলো না! বিশাল টেনশনে চলে এল সবাই – যারা এমন প্ল্যাটফর্মে থাকে তারা জানে এই প্রোডাকশন চালু রাখার চাপ কি বিশাল। তারা জানত এক রাত যদি পাম্প চালু না থাকে তাহলে প্রোডাকশন লস হবে প্রায় ২ মিলিয়ন ডলার (১৯৮৮ সালের হিসাবে)!

    এদের সামনে তখন একটাই রাস্তা – রক্ষণাবেক্ষণ চলছিল যে পাম্পটায় সেটা চালু করা। দায়িত্বে থাকা সুপারভাইজার ওয়ার্ক পারমিট চেক করল সেই সারাই হতে থাকা পাম্পের স্ট্যাটাস জানার জন্য। উপরে যেমন লিখেছি, ওয়ার্ক পারমিট ঠিক ঠাক মেনটেন না করার জন্য দেখা দিল প্রবলেম। পাম্পের কাজ করার লোকেরা কাজ যে সেদিন শেষ হয়নি সেটা ঠিক ঠাক ডকুমেন্ট করে কোন পেপার জমা দেয়নি দিনের শেষে। আর দুর্ভাগ্যবশতঃ সেদিন আরো একটা ওয়ার্কপারমিট ইস্যু করা হয়েছিল ওই পাম্পের সম্পূর্ণ ওভারহাউল করা হবে সেই মর্মে – কিন্তু পারমিটের হিসেব মত সেই কাজটা তখনো শুরু হয় নি। তো অ্যালার্ম শুনে সুপারভাইজার পাম্পের ওয়ার্কপারমিট খুঁজতে গিয়ে পেল এই ওভারহাউলের পারমিটটা - দেখল পাম্পে কাজ এখনো শুরুই হয় নি! ওদিকে যে মাঝে পথে মেন্টেনেন্স থেমে আছে পাম্পের অন্য ওয়ার্কপারমিটে, সেটা সম্পূর্ণ অজানাই থেকে গিয়েছিল এই সুপারভাইজারের। পাম্পে যখন মেরামতি চালুই হয়নি, তাহলে সেটা চালু করতে অসুবিধা কী – এই ভেবে সুপারভাইজার অর্ডার দিল সেই পাম্পটা চালাতে। সেই পাম্পের সেফটি ভালভ যে খোলা এবং তার থেকে বড় কথা খোলা পাইপের মুখে শুধু যে আলগা করে লাগানো ব্লাইন্ড ফ্ল্যাঞ্জ ঝুলছে তাও অজানা ছিল তাঁর।

    রাত ৯.৫৫

    সুপারভাইজারের কথা মত পাম্পটি চালানো হল। কিন্তু এবার সেই তেল আর গ্যাসের প্রেসার নিতে পারল না আলগা ভাবে লাগানো ফ্ল্যাঞ্জ – ফলে গ্যাস লিক করতে শুরু করল। কনট্রোল রুমে আবার অ্যালার্ম বাজলো এই ইঙ্গিত করে যে সেই পাম্পের জায়গায় গ্যাস লিক করছে। আস্তে আস্তে এই অ্যালার্মের জোর বেড়ে এটা বোঝালো যে ‘হাই গ্যাস’ লিক হয়েছে।

    রাত ১০.০০

    প্রথম বিস্ফোরণ। গ্যাস অ্যালার্ম শুনে কোন পদক্ষেপ করার আগেই সেই লিক হয়ে আসা গ্যাসে আগুন ধরে বিশাল বিস্ফোরণ ঘটল প্ল্যাটফর্মে পাম্প রাখার জায়গায় (উপরের ছবিতে লাল চিহ্ন দেওয়া জায়গায়)। পাইপার আলফা প্ল্যাটফর্মের কাছে থাকা একটা বোটের ক্যাপ্টেন রিপোর্ট করল প্ল্যাটফর্মের নীচে থেকে আগুনের নীল শিখা যেন ছিটকে বেরুচ্ছে। ওদিকে কনট্রোল রুমের অপারেটর এমারজেন্সি শাটডাউন বোতাম টিপল – ফলে বন্ধ হয়ে গেল সব পাওয়ার জেনারেটর এবং মূল তেল এবং গ্যাস লাইনের ভালভগুলি। থিওরিটিক্যালি দেখলে এই ভালভগুলি বন্ধ হবার ফলে প্ল্যাটফর্ম সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার কথা তেল এবং গ্যাসের সাপ্লাই ফ্লো থেকে এবং ফলে আগুন আর না ছড়াবার কথা। এখানে কিন্তু একটা কথা মনে রাখতে হবে, এই পর্বের প্রথমে যেমন লিখেছি, পাইপার আলফা প্রথমে বানানো হয়েছিল ‘অয়েল প্ল্যাটফর্ম’ হিসাবে, পরে পরিবর্তন করা হয় ‘গ্যাস প্ল্যাটফর্মে’। এই দুই প্ল্যাটফর্মে সেফটি পদ্ধতির কিছু পার্থক্য থাকে। যেমন পাইপার আলফা প্ল্যাটফর্মে যে ‘ফায়ার ওয়াল’ গুলো ছিল, মানে যেগুলো বিভিন্ন মডিউল, বিশেষ করে ঝুঁকি পূর্ণ এলাকা থেকে মানুষের থাকার জায়গাকে পৃথক করে রাখতে, তাদের সব ডিজাইন করা হয়েছিল ‘আগুন নিরোধক’ হিসাবে (তেল থেকে সাধারণত আগুন লাগে), ‘বিস্ফোরণ নিরোধক’ (যা গ্যাস থেকে হয় মূলত) হিসাবে নয়। প্রথম বিস্ফোরণ ফায়ার ওয়াল সব ধ্বংস করে দেয়া – এবং মডিউল B এর কাছে প্যানেল উড়ে গিয়ে একটা তেলের পাইপকে ফুটো করে দেয়, সেই থেকে আবার নতুন করে আগুন লাগে। আর তাছাড়া বিস্ফোরণের ফলে অ্যালার্ম প্যানেল সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল বলে কোন অ্যালার্ম সাউন্ড হল না আর।

    রাত ১০.০৫

    কন্ট্রোল রুম পরিত্যক্ত হয়ে গেল। পাইফার আলফা প্ল্যাটফর্ম ডিজাইন করার সময় এমন পরিস্থিতি বিবেচনায় আনা হয়নি যে যদি কন্ট্রোল রুম ধ্বংস হয়ে যায় এবং যাদের উপর সিদ্ধান্ত এবং পরিচালনার ভার দেওয়া তাছে, তারাই যদি কেউ আর প্ল্যাটফর্মে না থাকে, তাহলে কী হবে! লাউডস্পিকারে কোন ঘোষণাই করা হল না যে সবাই প্ল্যাটফর্ম পরিত্যাগ কর এই নির্দেশ দিয়ে। কোন ঘোষণার অভাবে আটকে যাওয়া লোকেরা অনুসরণ করতে লাগলো ‘এমারজেন্সি ইভাক্যুয়েশন প্রসিডিওর’ যাতে সবাইকে এমন অবস্থায় লাইফবোট স্টেশনে যেতে বলা আছে । কিন্তু আগুনের প্রকোপ এমনই বেশি যে, কেউ পোঁছতেই পারল না সেই লাইফবোট রাখার জায়গায়! তার বদলে অনেকে আশ্রয় নিল হেলিকপ্টার ডেক এর নিচে সেই ফায়ার প্রুফ অ্যাকোমডেশন মডিউলে এবং অপেক্ষা করতে লাগল পরের নির্দেশের – কিন্তু হায়, এর পরে আর কোন নির্দেশ সেই মানুষরা পাননি।

    বাঁচার শেষ চেষ্টায় দু ব্যক্তি আগুন সুরক্ষার যে পোষাক হাতের কাছে ছিল তাই পরে গেল সেই ডিজেল পাম্পিং মেশিনারি রুমের কাছে যেখানে ছিল সেই বিশাল ফায়ার ফাইটিং পাম্প, যারা নীচের সমুদ্র থেকে জল তুলে আগুন নেভাতে সাহায্য করে। প্ল্যাটফর্মে আগুন লাগলে অটোমেটিক্যালি এই পাম্প গুলি চালু হয়ে যাবার কথা। কিন্তু ওই যে আগে লিখেছি, পাইপার আলফায় তখন রাইজার ইনস্টল হচ্ছিল, আর তাই ডাইভার (ডুবুরি) কাজ করছিল। এই ডুবুরিদের সুরক্ষার জন্য, বিশেষ করে যখন তারা জলের নিচে ফায়ার ফাইটিং জল তোলার পাইপের কাছে কাজ করে তখন সেই পাম্পগুলিকে অটোমেটিক মোড থেকে ম্যানুয়াল মোডে করে দেওয়া হয়। কারণ তা না হলে যদি কোন কারণে অটোমেটিক ভাবে ফায়ার ফাইটিং পাম্প চালু হয়ে যায়, তাহলে তার প্রবল সাকশন পাওয়ারে ডুবুরিকে টেনে নেবে জলের তলার থেকে, মানে তার মৃত্যু। সেইদিন পাইপার আলফায় ডুবুরি কাজ করছিল বলে, ফায়ার ওয়াটার পাম্প সব ম্যানুয়াল মোডে সেট করা ছিল।

    আর তাই সেই পাম্প চালু করার জন্য সেই দুজন ডিজেল রুমের দিকে এগিয়ে গেল– তারপরে তাদের আর কোনদিন দেখা যায়নি! তবুও আগুন হয়ত নিভে যেত খানিক করে কারণ পাইপার আলফা তার নিজে দিকের অয়েল আর গ্যাস প্রোডাকশন লাইনগুলো বন্ধ করে দিয়েছিল – মানে দাহ্য পদার্থের সাপ্লাই নেই। কিন্তু সুরক্ষা ব্যবস্থার একটা বিশাল ঘাটতি ছিল এই যে, পাশের দুটি প্ল্যাটফর্ম, মানে টার্টান আর ক্লেমোর যাদের সঙ্গে পাইপলাইনে নেটওয়ার্ক আছে পাইপার আলফা (আগের পর্বের পাইপ-লাইন নেটওয়ার্কের ছবি দ্রষ্টব্য), তারা পাইপার আলফার দিকে সাপ্লাই লাইন বন্ধ করল না! ফলে যা হয় – আউটলেট বন্ধ, কিন্তু আপনি ইনলেট দিয়ে তেল/গ্যাস পাম্প করেই যাচ্ছেন! এই ব্যাকপ্রেশারের ফলে পাইপার আলফায় যেখানে আগুন লেগেছিল তার কাছেই সাপ্লাই লাইন আবার ফাটলো – দাহ্য তেল ছিটকে পড়ল নতুন করে আগুনে!

    এই সময়েই আশে পাশের যত বোট ছিল তারা ছোট ছোট উদ্ধারকারী ডিঙি নামালো উদ্ধারকার্যে

    রাত ১০.২০

    এবার পাইপার আলফা প্ল্যাটফর্মে ঘটল দ্বিতীয় বৃহত্তম বিস্ফোরণ – এর ফলে আগুনের গ্রাসে চলে এল প্রায় পুরো প্ল্যাটফর্মটাই – চারিদিকে লেলিহান আগুনের শিখা। প্ল্যাটফর্মের উপরের হেলিকপ্টার ডেকে ধরে গেল আগুন – ফলে হেলিকপ্টারে করে কাউকে উদ্ধার করার পথ বন্ধ হয়ে গেল। আর ওদিকে অ্যাকোমডেশন ব্লক ধোঁয়ায় ভরে গিয়ে আর সেখানে অপেক্ষা করার মত অবস্থায় রইল না।

    রাত ১০.২০

    প্রথমে পর্বে লিখেছি এই প্ল্যাটফর্মকে সুরক্ষিত রাখার জন্য এর কাছেই গড়া হয়েছিল পৃথিবীর বৃহত্তম ভাসমান ফায়ারফাইটিং ইঞ্জিন ‘থ্যারস’। সেই থ্যারোসকে আনা হল পাইপার আলফার কাছে, যতটা কাছাকাছি আনা সম্ভব – প্ল্যাটফর্ম থেকে ৩০ মিটার দূরে আনা গেল থ্যারোস-কে। উদ্দেশ্য ছিল এই ৩০ মিটার দূর থেকে উদ্ধারকারী সিঁড়ি বাড়িয়ে দেওয়া হবে – কিন্তু সেখানেই দেখা গেল এক বিশাল ডিজাইন ভুল! মানে থ্যারোস থেকে সেই উদ্ধারকারী সিঁড়ি বাড়াবার পদ্ধতি খুবই খুবই ধীরে – এত আস্তে যে ১০.৫০ এর আগে প্ল্যাটফর্মের কাছে সিঁড়ি পোঁছালোই না!

    রাত ১০.৫০

    তৃতীয় ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে পাইপার আলফা প্ল্যাটফর্মের ভিত্তি কেঁপে উঠল যেন। এই বিস্ফোরণের তীব্রতা এত বেশি ছিল যে একটা পাশের উদ্ধারকারী বোটেও আগুন ধরে মারা গেল উদ্ধারকারীরা। চারিদিকে এমন আগুনের শিখা (প্রায় ৩০০ ফুট উপরে উঠল সেই শিখা) ঘিরে ধরল যে প্ল্যাটফর্মের কাছে যাওয়াই অসম্ভব হয়ে উঠল। এই বিস্ফোরণের পরেই ক্লেমোর ও টার্টান প্ল্যাটফর্ম থেকে তেল ও গ্যাস পাঠানো বন্ধ করা হয়, কিন্তু ততক্ষণে যা ক্ষতি হবার হয়ে গেছে! অ্যাকোমডেশন ব্লকে তখনো যারা বেঁচে ছিল, তারা অনেকে ঝাঁপ দিল জলে বাঁচার তাগিদে।



    আগুনের কবলে পাইপারআলফা


    রাত ১১.২০

    পাইপার আলফা প্ল্যাটফর্ম ক্রমশ টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছিল – তবু যাও বা ছিল তখনো পর্যন্ত সেটুকুও ধ্বংস হয়ে গেল চতুর্থ বিস্ফোরণে। পাইপার আলফা হেলতে শুরু করল এবং কোলাপ্স

    রাত ১২.৪৫

    এই সময়ের মধেই পাইপার আলফার প্রায় সবটাই ধ্বংস। প্ল্যাটফর্মের বেশির ভাগটা, যেখানে ক্রেণ ছিল, লিভিং কোয়ার্টার ছিল, ড্রিলিং এর জায়গা সব মুখ থুবড়ে পড়েছে সমুদ্রের জলে।



    আগুন লাগার পরের দিনের পাইপারআলফা


    তো এই হল মোটামুটি দুর্ঘটনার দিনের পাইপার আলফা প্ল্যাটফর্মের কার্যক্রম। এর প্রতিটা স্টেপ নিয়ে বিস্তারে লেখাই যায়, কিন্তু তাতে লেখা বড় হয়ে যাবে এবং সাধারণভাবে হয়ত বোরিং-ও হয়েউঠবে। তাই যেটুকু বিবরণ থাকলে এই লেখার সঙ্গে রিলেট করা যায়, সেটুকুই আলোচনা করলাম।

    প্রথম যখন পাইপার আলফার ঘটনা শুনি, তখন মনে সর্বপ্রথম যে প্রশ্নটি এসেছিল, এবং আপনি যদি আগের পর্বের লেখাটি মনোযোগ দিয়ে পড়েন তাহলে সেই প্রশ্ন আপনারম নেওআস্তেবাধ্য। আগের পর্বে যে লিখলাম, এই প্ল্যাটফর্মকে সুরক্ষিত রাখার জন্য এর কাছেই গড়া হয়েছিল পৃথিবীর বৃহত্তম ভাসমান ফায়ার ফাইটিং ইঞ্জিন ‘থ্যারস’। থ্যারোস রেডি ছিল, ৩০ মিটার কাছ পর্যন্ত গিয়েছিল সেটাও লিখেছি আগে। উদ্ধারকারী সিঁড়ি না হয় লাগাতে পারে নি সময় মত, কিন্তু তার তো জল কামানের মত ছিল যা দিয়ে ৩০০ ফুট দূর থেকে জল ছোঁড়া যায়। তাহলে সেটা থ্যারোস কাজে লাগায়নি কেন?

    শুনতে অবাক লাগলেও এটা ঘটনা যে মানুষের সুরক্ষার জন্যই থ্যারোস দূর থেকে আগুন নেভাতে পারে নি জল নিক্ষেপ করে। আসলে পাইপার আলফা প্ল্যাটফর্মে সেদিন ছিল ২২৮ জন মানুষ – আগুন লাগার পর কে কোথায়, কত জন তখনো প্ল্যাটফর্মে আটকে আছে তা জানা ছিল না থ্যারোস এর আগুন নেভাবার লোকেদের। কিন্তু যেটা জানা ছিল তা হল – যে বেগে জল নিক্ষিপ্ত হবে তার সামনে যদি কোন মানুষ পড়ে, তাহলে সে পুরো উড়ে চলে যাবে যাকে বলে! মানে আগুনের হাত থেকে তখনো যে হয়ত বেঁচে কোন খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু আগুন নেভাবার জল এসে তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিল। এই কারণে থ্যারোস ঠিক কিছু নিক্ষেপ করতে পারে নি আগুন নেভাবার জন্য। অবশ্য অত কম সময়ে যে ভাবে পরপর বিস্ফোরণ হয়েছিল প্ল্যাটফর্মে, তাতে করে থ্যারোস জল নিক্ষেপ করেও যে কিছু করতে পারত তার কোন গ্যার‍্যান্টি ছিল না – তা জানাও যাবে না আর কোনদিন!



    আগুন লাগার কয়েক সপ্তাহ পরে তখনো জ্বলতে থাকে পাইপারআলফা


    ২২৮ জন সেদিন ছিলেন পাইফার প্ল্যাটফর্মে – তার মধ্যে ৬১ জন প্রাণে বেঁচেছিলেন (প্রথম পর্ব দ্রষ্টব্য), অর্থৎ মারা গিয়েছিলেন ১৬৭ জন। কিভাবে এঁরা মারা গিয়েছিলেন তার খতিয়ান নিম্নরূপঃ




    এই দুর্ঘটনায় ক্ষয়-ক্ষতি কেমন হয়েছিল। এখানে একটু বলে নিই, অয়েল ইন্ডাস্ট্রিতে (বা অন্য অনেক ইন্ডাস্ট্রিতে) ক্ষতির পরিমাণ মাপা শুধু অর্থকারী দিক থেকে বিবেচ্য হয় না। মূলত চারটে দিক থেকে ক্ষতির সম্ভাবনা দেখা হয়, মনে রাখা বেশ সোজা PEAR, মানে People, Environment, Asset (মানে সেই প্ল্যাটফর্ম বা ইউনিটের কি ক্ষতি), Reputation। সেই ভাবে ভাগ করে যদি আমরা পাইপার আলফাকে দেখি, তাহলে ১৬৭ জন মারা গেলেন সেটা তো আগেই লিখেছি। অফশোর অয়েল অ্যান্ড গ্যাস ইন্ডাষ্ট্রিতে এর থেকে বেশি মৃত্যু এনেছে এমন দুর্ঘটনা ১৯৮৮ সালের আগে বা পরে আজ পর্যন্ত হয় নি।

    পরিবেশের দিক থেকে দেখতে গেলে ৬৭০ টন মত তেল সমুদ্রের জলে মিশেছিল এই দুর্ঘটনার ফলে। আর তাছাড়া এই ধরণের প্ল্যাটফর্মে নানা ধরণের ক্যেমিক্যাল মজুত থাকে – নানা ধরণের কাজ কর্মের জন্য। এদের মধ্যে বেশির ভাগই টক্সিক – সমুদ্রের জলে মিশলে সামুদ্রিক প্রাণীদের জীবনের ক্ষতি করবে। সবচেয়ে বেশি মজুত ছিল ৫ টনের মত পলি-ক্লোরিনেটেড বাই-ফিনাইল নামক ফ্লুইড। এটাও পুরোটাই ছড়িয়ে পড়েছিল সমুদ্রের জলে।

    পিউপিল আর এনভায়রেনমেন্ট তো হল, তা অ্যাসেট ড্যামেজ হয়েছিল কত টাকার? এর মধ্যেও একটা হালকা খেলা আছে – এই হিসেবে অনেক সময় মিলিয়ে ফেলা হয় হার্ডকোর অ্যাসেট ড্যামেজ, মানে ধরুন পাইপার আলফা প্ল্যাটফর্মটা পুনরায় খাড়া করতে কত টাকা লাগবে। আবার তার সঙ্গে যুক্ত হয় এই যে প্রোডাকশন বন্ধ হয়ে গেল তার খরচটা! আগে লিখেছি পাইপার আলফা দিনে ৫ মিলিয়ন ডলারের তেল তুলত। যদি একবছর বন্ধ থাকে তাহলে কতক্ষতি প্রোডাকশনে? ৩৬৫*৫ = ১৮২৫ মিলিয়ন ডলার কি? না, হিসেব অত সোজা নয়। কারণ আপনি মাটির নীচে থেকে তেল না তুললে সেই তেল তো আর পালাচ্ছে না! আজ তুলতে পারলেন না, ঠিক আছে, কাল তুলবেন! তাই এমন প্রোডাকশন ইমপ্যাক্টে যুক্ত হয় জটিল ফাইনান্স ক্যালকুলেশেন – আর এই প্রোডাকশনকে উপাধি দেওয়া হয় “ডিফারড প্রোডাকশন”। পাইফার আলফা তো নিজে একা নয়, সে ছিল একটা নেটওয়ার্ক-এর অংশ। পাইপার আলফা, টার্টান, ক্লেমোর ইত্যাদি ছয়টি প্ল্যাটফর্ম মিলিয়ে প্রোডাকশন ডিফারড হয়েছিল ৩.২ বিলিয়ন ব্যারেল অয়েল। ১৯৮৮ সালের প্রতি ব্যারেল তেলের দাম গড়ে ১৫ ডলার ধরলে এই ডিফারড প্রোডাকশনের অর্থকারী মূল্য ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার সেই সময় মূল্যে! বুঝতে পারছেন কি কেস?

    আর পাইপার আলফায় সরাসরি ক্ষতির পরিমাপ ছিল এমন (মিলয়ন ডলারে)




    মানে ওই ডিফারড প্রোডাকশন বাদ দিয়ে অক্সিডেন্টাল পেট্রোলিয়ামে পকেট থেকে বের করতে হয়েছিল ১.১৬৫ বিলিয়ন ডলার পাইপার আলফার দুর্ঘটনার জন্য! অক্সিডেন্টাল পেট্রোলিয়াম অনেক বড় কোম্পানি বলে ১.২ বিলিয়ন ম্যানেজ করে ফেলেছিল, কিন্তু বুঝতেই পারছেন ছোট কোম্পানিতে এমন বড় দুর্ঘটনা হলে সেই কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে যেত! শুধু তুলনার জন্য বলে রাখা যাক, ওই যে ডিপওয়াটার হরাইজন সিনেমার কথা বলেছিলাম, তার জন্য বি পি পেট্রোলিয়াম কোম্পানির খরচা হয়েছিল প্রায় ২৭ বিলিয়ন ডলার! এবং বি পি প্রায় দেউলিয়া হতে হতে খাদের কিনারা থেকে ফিরে এসেছিল!

    পাইপার আলফার মত দুর্ঘটনা অয়েল ইন্ডাস্ট্রিতে আগে হয়নি বলে, এর মত বিস্তারে তদন্তও আগে হয়নি অয়েল ইন্ডাস্ট্রির ইতিহাসে! অবশ্য এমন নয় যে অন্য ইন্ডাস্ট্রিতে দুর্ঘটনা ঘটে মানুষ আগে মারা যায় নি – আমাদের দেশের ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনা সেই তালিকায় একদম উপরের দিকে থাকবে। নীচে দেখে নেওয়া যাক কেমন দুর্ঘটনার ইতিহাস আছে।



    প্রসেস-সেফটি সম্পর্কিত কিছু নির্বাচিত দুর্ঘটনার তালিকা


    ১৯৮৮ সালের নভেম্বর মাসে লর্ড কালিন এর নেতৃত্বে এক পাবলিক এনকোয়্যারি-র সূচনা হয়। সেই সব তদন্তের ডিটেলসে আর ঢুকবো না। তদন্তে দেখা গিয়েছিল সেই দিন পাইপার আলফা প্ল্যাটফর্মে নীচের সুরক্ষা বিষয়ক খামতিগুলি

    ওয়ার্ক পারমিট সিস্টেমের গলতি

    প্ল্যাটফর্মের লে-আউট

    সিদ্ধান্ত নিতে অযথা বিলম্ব

    প্ল্যাটফর্ম এভাকিউয়েশন পদ্ধতি

    ফায়ার প্রোটেকশন পদ্ধতি

    সংযোগ ব্যবস্থা


    এই তদন্তে অক্সিডেন্টাল পেট্রোলিয়াম কোম্পানিকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় ‘পর্যাপ্ত সুরক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষণ এর ব্যবস্থা না রাখার” জন্য – কিন্তু কোন ক্রিমিন্যাল চার্জ আনা হয় নি ওই কোম্পানির বিরুদ্ধে। এই সব ঘটনার কয়েক বছর পরেই অক্সিডেন্টাল কোম্পানি নর্থ-সী তেল তোলার জায়গা থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে অন্য জায়গায় চলে যায়।

    লর্ড কালিন কমিটির রিপোর্টের দ্বিতীয় ভাগে তখন নর্থ-সী তে তেল তোলার যে সুরক্ষা পদ্ধতি ছিল তাতে ১০৬ টি পরিবর্তন আনার সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে ৩৭ টি সুপারিশ ছিল ইক্যুইমেন্ট কিভাবে অপারেট করতে হবে সেই বিষয়ক, ৩২ টি সুপারিশ প্ল্যাটফর্মে যারা কাজ করে সেই ব্যক্তিদের সুরক্ষা বিষয়ক, ২৫ টি সুপারিশ প্ল্যাটফর্মের ডিজাইন বিষয়ক, এবং ১২ টি এমারজেন্সী সার্ভিস বিষয়ক। এগুলো কার্যকরী এবং বাস্তবায়িত করার ৫৭ টি সুপারিশের দায়িত্বে রেগুলেটার, ৪০ টির দায়িত্বে অপারেটর নিজে, ৮ টির দায়িত্ব সামগ্রিক ভাবে অয়েল অ্যান্ড গ্যাস ইন্ডাষ্ট্রি, আর ১ টার দায়িত্বে জাহাজ সংস্থা যারা এই কোম্পানির হয়ে কাজ করে।

    লক্ষণীয় বিষয় ছিল এই যে এই ১০৬ টি সুপারিশের প্রতিটি অয়েল অ্যান্ড গ্যাস ইন্ডাষ্ট্রি বিনা বিরোধিতায় মেনে নেয় এবং সেগুলো নিজেদের কোম্পানিতে চালু করে বাধ্যতামূলক ভাবে। এই সব সুপারিশ নিয়ে ১৯৯২ সালে প্রণিত হয় “অফসোর ইনস্টলেশন সেফটি কেস রেগুলেশন” – এটা মূলত ইউ কে এবং নর্থ-সি এর জন্য প্রযোজ্য হলেও, এই সুপারিশগুলির উপকারিতা দেখে সারা বিশ্বের সব জায়গার অয়েল অ্যান্ড গ্যাস ইন্ডাষ্ট্রিতে এর ব্যবহার শুরু হয় ব্যাপক ভাবে। এই নতুন সেফটি কেস-এর মূল পার্থক্য আগেকার থেকে এই যে, এখন এটা ‘এভিডেন্স বেসড’ হতে হবে, আগেকার মত ‘প্রেসক্রিপটিভ’ অ্যাপ্রোচ নয়। এই প্রেসক্রিপটিভ অ্যাপ্রোচে অনুমান করে নেওয়া হয় যে এই এই মেনে চললে এই এই সব ঠিক থাকবে, আদৌ ঠিক আছে কিনা তার প্রমাণের প্রয়োজনীয়তা ছিল না তেমন। লর্ড কালিনের রিপোর্টে পরিষ্কার বলা হয়

    “A Safety Case is astructured argument, supported by a body of evidence, thatprovides a compelling, comprehensible and valid case that asystem is safe for a given application in a given environment.”

    আজও যখন আমরা অফশোর প্ল্যাটফর্ম বা পাইপলাইন ডিজাইন করি, তখনও সেই কালিন রিপোর্টের সুপারিশগুলি মেনে চলতে হয়। তবে আজকাল আর আলাদা করে মনে রাখতে হয় না সুপারিশের ধরন, কারণ সেগুলো এখনকার ইন্ডাস্ট্রি স্ট্যান্ডার্ডে প্রোথিত হয়ে গেছে চিরস্থায়ী ভাবে।

    পাইপার আলফা দুর্ঘটনায় মৃত ১৬৭ জন আর ফিরে আসবেন না – কিন্তু তাঁদের মৃত্যুর কারণ থেকে শিক্ষা নিয়ে বিগত তিরিশ বছরে বেঁচেছে আরো অনেক অফশোরে কর্মরত মানুষের প্রাণ।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
    পর্ব – ১ | পর্ব –২
  • আলোচনা | ১০ জুন ২০২১ | ২৯৭৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Amit | 203.***.*** | ১১ জুন ২০২১ ০৯:৪৪494835
  • গোগ্রাসে পড়ে ফেললাম। দারুন হয়েছে পুরো লেখাটা সুকি। জাস্ট অসাধারন। প্রসেস সেফটি র সবকটা পিলার খুব ভালোভাবে টেকনিক্যালি কভার হয়েছে , কিন্তু লেখাটা র এতো সুন্দর ফ্লো যে সবার ভালো লাগবে। সে এই ফিল্ড এর লোক আদৌ না হলেও। সেটা একটা বিশাল এচিভমেন্ট। 


    ১৬৭ জন না হলেও ইন্ডিয়াতে ও বেশ বড়ো কয়েকটা এক্সিডেন্ট হয়েছে রিফাইনারি বা পেট্রোকেমিক্যাল কমপ্লেক্স এ। আইপিসিল নাগোথানে তে ১৯৯০ (প্রায় ৬০-৭০ জন। আসল ফিগার জানা যায়নি)। HPCL ভিজাগ এ ১৯৯৭ (৬০ জন। এক ই কেস)। ২০০৫ ONGC ২২ জন ইত্যাদি। এগুলোর একটাও ডিটেল্ড ইনভেস্টিগেশন ফাইন্ডিংস বা রুট কস নেট আর্কাইভ এ খুঁজে পাওয়া যায়না। 


    ১৯৯৭ এর HPCL এর LPG এক্সপ্লোশন টা আমার নিজের চোখের সামনে দেখা। এক্সপ্লোশন এর পরে যে ৮০-৮৫ জন প্লান্ট থেকে কোনোমতে বেঁচে বেরোতে পেরেছিলো , তার মধ্যে আমি নিজে একজন। অবশ্য নাহলে আজকে  আর এসব  আটভাট  লিখবো কি করে ? 


    পরে বাইরে র দেশে কাজ করতে এসে একটা বেসিক তফাৎ বুঝতে পারলাম। আসলে ইন্ডিয়াতে লোকের প্রাণের কোনো দাম নেই। ডেথ টোল মানে জাস্ট একটা নাম্বার। দ্যাট্স অল। ইন্ডিয়ায় কোনো ইনসিডেন্ট হলে তার ইনভেস্টিগেশন-এর আসল অবজেক্টিভ থাকে ম্যানেজমেন্ট কে গার্ড করা, ইনসিডেন্ট থেকে শিক্ষা নিয়ে সিস্টেম শোধরানো নয়। ৯৭ - HPCL এক্সপ্লোশন এ গাদা গুচ্ছের সিস্টেম ফেলিওর ছিল। ক্রিটিকাল অ্যালার্ম রিপেয়ার ফল্ট , ফলটি পিএ সিস্টেম  থেকে ভুলভাল LPG বুলেটস ড্রেন ভালভ ডিসাইন - ইত্যাদি ইত্যাদি। অন্য কোনো দেশ হলে টপ লেভেলের কয়েকটার জেল হতো ক্রিমিনাল নেগলিজেন্স এর জন্যে। আর ওখানে যেটা হয়েছিল - প্লান্ট GM র দিল্লি HQ তে ট্রান্সফার। তার তিন বছর পর তিনি HPCL এ ৬০ বছরে রিটায়ার করে দিব্যি রিলায়েন্স এর জামনগর রিফাইনারি তে ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়ে  চলে  গেলেন। আর কিচ্ছুনা। ওখানে সব যেমন চলছিল , তেমনি চলতে থাকলো আরো ৬ বছর (মানে আমি ছাড়া অবধি)  বা আরো বেশি। 


    বাইরের বেশির ভাগ দেশে যা দেখেছি : প্রতিটা ছোট ছোট নিয়ার মিস ইনসিডেন্ট কে খুব গুরুত্ব দিয়ে ইনভেস্টিগেট করা হয়  আর করেক্টিভ স্টেপস নেওয়া হয়। যেহেতু আসিডেন্ট হলে প্রচুর ইন্সুরেন্স  বা লিগ্যাল লিয়াবিলিটি র চাপ থাকে তাই পার্সোনাল সেফটি টাকে সব্সময় গুরুত্ব দেওয়া হয় আইদার ফর ডিসাইন অর অপারেশন। এই কারণে ওভারঅল সেফটি র প্রতি এটিচুইড টা অনেক বেটার। যে কারণেই হোক। এছাড়াও ইনভেস্টিগেশন মানে কাউকে স্কেপগোট করা নয় , সিস্টেম ফল্ট টাকে ঠিকঠাক ইডেন্টিফাই করা। তাই ইনভেস্টিগেশন এপ্রোচ ইন জেনারেল সিস্টেম ওরিয়েন্টেড। পার্সন ওরিয়েণ্টেড নয়। এটাও একটা বিরাট তফাৎ ইন্ডিয়ার থেকে।


    কোনো ঘটনা ঘটে গেলে বাকি সব ইন্ডাস্ট্রির সাথেও  ওপেনলি লেসন্স লার্ন্ট শেয়ার করা হয় যাতে বাকিরা সিস্টেম শোধরাতে পারে কিছু ঘটার আগে। এসব রিপোর্ট গুলো ওপেন নেট আর্কাইভ গুলোতে সহজে পাওয়াও যায়। লুকোনোর ব্যাপার নেই। ইউটুবেই গুচ্ছের CSB রিপোর্টস আছে। 


    ছোট ছোট ইনসিডেন্ট নেগলেক্ট আর অকুমুলেট করে করেই তারপর একটা বড়ো এক্সিডেন্ট ঘটে। সেফটি পিরামিড এর ছবিটা তূলে দিলাম। তাই শুরুতেই বিপদের গোড়া কেটে দিলে শান্তি। 



    এতো করেও যে সব ইনসিডেন্ট আটকানো যায় তা নয় কিন্তু বেসিক এপ্রোচ টা এটাই অন্য দেশে। অবশ্যই সব দেশ সমান নয়। 


    কিন্তু ইনডিয়াতে বেসিক সেফটি এটিচিউড টাই একেবারে প্যাথেটিক রকমের কম (আমার নিজের যেটুকু দেখা)।  ৯৭ ভাইজাগ এক্সপ্লোশন হবার জাস্ট ৭  দিন পরে সব স্টাফ রিফাইনারি তে ঢুকেছে ড্যামেজ এসেস করতে। সেখানে একটা ম্যানেজার তার জুনিয়রকে বলছে একটা অলমোস্ট কোলাপ্সড হয়ে যাওয়া ট্যাঙ্কের মাথায় উঠে দেখতে কতটা ফুয়েল রিকভার করা যাবে হিসেব করতে। সে ওরকম ল্যাডার এর হাল দেখে আপত্তি করায় (সরকারি কোম্পানী বলেই আপত্তি করতে পেরেছিলো অবশ্য) , ম্যানেজার নিজেই ওপরে উঠে দেখতে গেছে। আর ৬-৮ ফুট উঠতেই সে ল্যাডার ভেঙে পড়ে পা মচকে গেলো। আরো একটু ওপরে গেলে প্রাণটাই যেত আর কি। এগুলো সুইসাইড বা স্তুপিডিটি না হলে আর কি বলা যায় ? 


    তাই মনে হয় ইন্ডিয়াতে বাইক চালাতে গেলে  হেলমেট পরার জন্যেও পুলিশকে জোর করতে হয়। লোকের নিজের কাছে নিজের মাথা বা প্রাণের কোনো দাম নেই। যত দায় শুধু পুলিশ বা সরকারের। জোরাজুরি করায় ভাইজাগে আমার এক কলিগ বলেছিলো বটে - হেলমেট পড়ে কি হবে। জীবনে এতো জ্বালা যন্ত্রনা , মরলেই হাড় জুড়োয়।  তারপর থেকে আমি আর কাউকে হেলমেট পড়তে বলিনা। 


    :) 

  • b | 14.139.***.*** | ১১ জুন ২০২১ ০৯:৫৯494836
  • "সে এই ফিল্ড এর লোক আদৌ না হলেও। সেটা একটা বিশাল এচিভমেন্ট। "


    একদম। 

  • Ranjan Roy | ১১ জুন ২০২১ ১১:৫৭494842
  • দারুণ লেখা সুকি! টুপি খুললাম। আপনার কথামত সিনেমাটা আগেই দেখে নেওয়ায় লেখার অনেকটা বুঝতে পারছি।


     সেই সঙ্গে অমিতকেও ধন্যবাদ। আমাদের দেশের সেফটি সমস্যা এবং বিশেষ করে  সিস্টেম শোধরানোর বদলে ব্যক্তিকেন্দ্রিক অ্যাপ্রোচকে হাইলাইটা করার জন্যে।


     ভোপাল গ্যাসকান্ডের সময় আমার স্ত্রী এবং শিশুকন্যারা ওখানেই ছিলেন। চারদিন পর আমি গিয়ে পৌঁছই। তখন আমাদের টেলিফোন ছিলনা। 


    ঘুরে ঘুরে যা দেখেছি তা আর কহতব্য নয়।


     কোলকাতা থেকে  আসা ডাক্তারদের টিমে ডঃ পুণ্যব্রত গুণ ছিলেন, যিনি গুরুর পাতায় লেখেন।

  • সুকি | 49.207.***.*** | ১২ জুন ২০২১ ০৮:২৯494867
  • অমিতাভদা, বি, রঞ্জনদা - আপনাদের ধন্যবাদ 


    অমিতাভদা, তোমার ভালো লেগেছে জেনে খুশী হলাম।  এবং একই সাথে আশ্বস্ত, কারণ তুমি এই ফিল্ডের অভিজ্ঞ ব্যাক্তি। তুমি ভারতে সেফটি কালচার নিয়ে যা লিখেছো সবই জির্জলা সত্যি! আমাদের দেশে কোরাপশন এত ডিপ রুটেট যে শুধু টাকা পয়সা মেরে দেওয়া নয়, তার এফেক্ট মানুষের সুরক্ষাতেও এসে পরে ইনডাইরেক্টলি।  শুধু আমাদের উইশ ফুল থিঙ্কিং দিয়ে এই সব বিষয়ে বিশাল কোন চেঞ্জ আনা যাবে না, সরকারকে আইন করে পুরো টাইটের উপর রাখতে হবে কোম্পানীদের ।


    রঞ্জনদা, হ্যাঁ, ভোপাল দুর্ঘটনা আমি নিজে না দেখলেও যা শুনেছি বা পড়েছি তাতে গা-শিউরে ওঠে যাকে বলে। 

  • ,@2c | 2402:3a80:116a:dde6::176e:***:*** | ১৩ জুন ২০২১ ১৫:২৩494918
  • গোগ্রাসে গিললাম লেখাটা....গোয়েন্দা গল্পের মতো টানটান উত্তেজনা.... একটুও বোরিং হয়নি,আপনি এইরকমভাবে ডিটেইলস এ লিখবেন....

  • dc | 122.164.***.*** | ১৩ জুন ২০২১ ১৫:৪৪494919
  • দারুন লাগলো লেখাটা। আর অমিতবাবুর অ্যানালিসিসও অসাধারন। ডিপওয়াটার হরাইজন দেখেছি। সুকান্তবাবুর সাথে একমত, সিনেমাটা টেকনিকালি অসাধারন ছিলো। তবে একটা কথা, লার্জ সিস্টেম নিয়ে এতোরকম এতোরকম স্টাডি হয়, মোড অফ ফেলিওর নিয়ে কতো কতো অংক কষা হয়, কিন্তু তারপরেও ফেল করে। 

  • সুকি | 49.207.***.*** | ১৪ জুন ২০২১ ০৯:৪০494931
  • ,@2c ধন্যবাদ 


    dc, আপনি ঠিকই বলেছেন, ফেলিওর তো হচ্ছেই। কিন্তু ব্যাপারটা এমন - যেগুলো সব লিখেছি সেগুলো না করলে ফেলিওর আরো বেশী হত। পুরোপুরি এলিমিনেট করা কোনদিনই সম্ভব হবে না হয়ত - কারণ বিষয় এত জটিল আর এতো কিছু ইন্টারেকশন থাকে যে কহতব্য নয়। যতটা কম করা যায় আর কি - এছাড়া লিগ্যাল রিকোয়ারমেন্ট আছে অনেক কিছু, যেগুলো এই লেখায় টাচ করি নি। 

  • Amit | 203.***.*** | ১৪ জুন ২০২১ ১০:০৪494933
  • একদম ঠিক সুকি। তারপর প্লান্ট রিভ্যাম্প বা ডিবটলনেক বা মডিফাই করতে গেলে ফেলিওর রিস্ক আরো অনেক বেড়ে যায় ইন্টারঅ্যাকশন কমপ্লেক্সিটি অনেকগুন বাড়ার জন্যে। যেমন তুমি দেখালে পাইপার আলফা অয়েল থেকে গ্যাস প্লাটফর্মে কনভার্ট হয়েছিল। আরো একটা মেজর ফ্যাক্টর হলো যে এডভান্সড প্রসেস কন্ট্রোল মডেল এপ্লিকেশন করে করে সবসময় প্ল্যান্টকে সবসময়  ম্যাক্সিমাম ডিজাইন বা অপারেটিং লিমিট এ পুশ করা। ১০০-% টাইম প্রসেস লিমিট ম্যাক্সিমাইজ করতে গেলে ফাটিগ ফেলিওর এর চান্স ও বেড়ে যায়। 


    বলতে বাজে লাগে। কিন্তু গত কয়েক বছরে ওয়ার্ল্ডওয়াইড আরো একটা বাজে ট্রেন্ড হলো খরচ কমাতে বড়ো প্রজেক্ট গুলো সব মডিউল বিল্ট করা। চীন বা ইন্ডিয়া বা ফিলিপিন্স এ মডিউল বানিয়ে জাহাজে করে প্রজেক্ট সাইট এ নিয়ে আসছে। এদের সবার প্রিজারভেশন কোয়ালিটি বেশ খারাপ। তার ওপর প্রজেক্ট কনস্ট্রাকশন ডিলে হলে সেগুলো পড়ে থেকে থেকে আরো বেশি খারাপ হয়ে যায়।  মাইক্রোবিয়াল করোসন টাইপ ফেলিওর মেকানিসম প্রেডিক্ট করা এখনও অনেকটাই উনসার্টেন। তুমি এগুলো আরো ভালো করে জানবে।  

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে প্রতিক্রিয়া দিন