হুড়মুড় করে একটা গল্প শুরু হয়ে গেল। একদম। ‘হুড়মুড়’ শব্দটাই এখানে সবচেয়ে লাগসই, যথাযথ। গরমের গনগনে দুপুরে একটা পেল্লায় উঁচুবাড়ির ছায়ায় ফুটপাথে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে দু-চারজন। হঠাৎ ক্যান্টিলিভারসহ ছাদসুদ্ধ উঁচুবাড়ি তুমুল বিস্ফোরণে মুখ থুবড়ে পড়ল তাদের ঘাড়ে। ঘুম সেই ভাঙল ঠিকই কিন্তু রক্তের অবিরল কল্লোলের ভেতর। ঠিক এভাবেই একটা গল্প শুরু হয়ে গেল।
একটা গল্প শুরু হয়ে গেল। কিন্তু আসলে এটা একটা উপন্যাস শুরু হওয়ার মহড়ামাত্র। একটা গা-গরম করার ফিকির। একটা গল্প শুরু হল, মাঝামাঝি এল, শেষের দিকে চলে গেল কিন্তু এর একটাই ইশারা—একটা উপন্যাস এবার শুরু হবে হবে করছে। উপন্যাসের নাম দেওয়া হবে ‘গোগা’। কারা থাকবে এই উপন্যাসে? ‘অনেকে’। তবে বেশি করে, বার বার থাকবে জেঠিমা, জ্যাঠামশাই আর পিসিমা। তবে বইয়ে এদের নাম থাকবে না। অন্য নাম থাকবে।
ঘটনাগুলোও ঘটবে অন্যরকম ভাবে। কিন্তু উপন্যাসটি শুরু হবার আগে এসব ভেবে মাথা গরম করার দরকার নেই। এখন অন্য কথা। কী কথা? ‘মানে কীভাবে এই উপন্যাস... কীভাবে... কীভাবে... ছোটো কথা... ছোটো ঘটনা... দিনের পর দিন... আস্তে আস্তে... চরিত্রগুলো ... আমিও... যেমন ছিল... থাকবে না... থাকছে না।’ এখন অন্য কথা। এখন তবে আর কী কী কথা? ‘গোগা... একটা নদী... কয়েকটা বাড়ি... কয়েকটা মানুষ... মাঝখানে তিনজন... তিনজন... জেঠিমা অথচ... পিসিমা অথচ... জ্যাঠামশাই অথচ... আলাদা নাম... আলাদা মুখ।’ আর একটা কথা। হয়তো এটাই মূলকথা—‘কার কী নাম হবে জানি না কার কী পদবি হবে জানি না। তবে আমি নায়ক হব। আমার খুব নায়ক হতে ইচ্ছে করে।’ আর তাই গোগার কথা মানে ঠিক জেঠিমা-জ্যাঠামশাই—পিসিমার কথাও নয়। অনেকটা লেখকের নিজের কথা থাকবে। আচ্ছা সে থাকে থাকুক। আপত্তির কিছু নেই, কিন্তু ‘গোগা’ উপন্যাসের পটভূমি কী হবে? গোগা উপন্যাসের পটভূমি গোগা হবে না। কেননা—‘গোগায় যেন ঠিক গোগা নেই।’ গোগার পটভূমিতে গোগার কথা লেখা সম্ভব নয়। গোগার কথা লিখতে হলে, গোগার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। লেখকের ধারণা কলকাতায় বসেই একমাত্র গোগার কথা লেখা সম্ভব। কেননা গোগায় থাকলে গোগার কথা মনে পড়ে না।
একটা গল্প। যা আসলে একটা আশ্চর্য উপন্যাস শুরু হওয়ার (অথবা শুরু না-হওয়ার) ঘোষণামাত্র। ইস্তেহার। প্যামফ্লেট। উপন্যাসের নাম হবে ‘গোগা’। উপন্যাসের বিষয় স্বাভাবিকভাবেই গোগা। গল্পটির নামও গোগা। লেখক অন্যধারার ডাকসাইটে গদ্যকার রমানাথ রায়। সদ্যপ্রয়াত।
কোনো শিল্পীর সঙ্গে আনতাবড়ি একটা আন্দোলনের নাম জুতে দেওয়া সমীচীন নয় জানি। কিন্তু রমানাথ রায় ঘোষিতভাবে শাস্ত্রবিরোধী গদ্যকার শুধু নন, শাস্ত্রবিরোধিতার নেতৃত্বও দিয়েছেন বুক চিতিয়ে। বাংলা গদ্যসাহিত্যের ছাঁচে-ঢালা বাজারকাটতি ধ্যানধারণাকে, গল্পের বস্তাপচা বিষয়, আঙ্গিক, কাঠামো, শব্দব্যবহার, বাক্যরীতি, গূঢ়তত্ত্ব অথবা তত্ত্বের ভণ্ডামিকে, মূল্যবোধের ছেলেখেলাকে খোলা ময়দানে চ্যালেঞ্জ করেছেন। শাস্ত্রবিরোধী মুভমেন্টের সৈনিক হিসেবে বিশ্বাস করেছেন—‘সময় হয়েছে যা কিছু পুরনো তাকে বর্জন করবার। সময় হয়েছে যা কিছু নতুন তার জন্য তৈরি হবার। আলমারি থেকে সব বই নামিয়ে ফেলো। আমাদের জন্য এবার একে একে তাকগুলি খালি করে দাও।’ [সম্পাদকীয় অংশ, ‘এই দশক’। প্রথম বর্ষ, প্রথম সংকলন] বিশ্বাস করেছেন ধর্ম দর্শন সমাজ ইতিহাস ভূগোল অর্থনীতি বিজ্ঞান রাজনীতি তত্ত্ব শৃঙ্খলা মূল্যবোধ বিশ্বাসঅবিশ্বাস প্রেমঅপ্রেম পাপপুণ্য এসব লেখকের সাবজেক্ট নয়। এসবে তিনি আর পাঁচটা ছাপোষা প্যাঁচপয়জারহীন সাধারণ লোকের মতোই সমান অশিক্ষিত। তাঁর একটাই কাজ, তাঁর নিজের অন্তরাত্মার জটিল রহস্যময় অনুভূতিকে শব্দে প্রকাশ করা। ব্যাস। আর কিছু নয়। ‘শাস্ত্র বিরোধিতা কেন ও প্রকৃত বাস্তব’-এ রমানাথ সরাসরি বলছেন, ‘এখন আর ক এসে খ-এর কথা বলবে না। খ এখন নিজেই নিজের কথা বলবে।’ বলছেন লেখায় কাহিনি থাকবে না, নাটক থাকবে না, কৃত্রিমতা থাকবে না। কেননা জীবনে কাহিনি থাকে না, ঘনঘটা থাকে না। শুধু তাই নয় ‘গল্পে এখন যারা কাহিনী খুঁজবে তাদের গুলি করা হবে।’ ‘বিয়ে করা বা মাথা ধরা ছাড়া কী ঘটে জীবনে’—রমানাথ প্রশ্ন তুলছেন।
এবার ‘গোগা’য় ফিরি। গোগা তাহলে কাহিনি নয়, গোলগল্প নয়। হবে কী করে? ‘গোগা’ লেখা হচ্ছে ১৩৭৬ নাগাদ, বেরোচ্ছে ওবছর ‘এই দশক’ পত্রিকার একাদশ সংকলনে, মাঘ মাসে। আর ঠিক আগের বছর ষষ্ঠ সংকলনে অর্থাৎ ১৩৭৫-এ ‘কথা’ গল্পটিতে লেখক ঘোষণা করে দিচ্ছেন ‘না আর গল্প নয় গল্প বলতে পারব না আমি কথা বলতে পারি কথা বলব।’ নিঠুর হাতে আখ্যান ভেঙে দিচ্ছেন রমানাথ। কিন্তু ‘গোগা’র ইশারা তো লেখক শুরুতেই দিচ্ছেন। বিষয় থাকবে। কী হবে বিষয়? ‘গোগা কী গোগা কোথায় গোগার আয়তন গোগার লোকসংখ্যা গোগার জলবায়ু গোগার কৃষিজ সম্পদ গোগার প্রাকৃতিক দৃশ্য গোগার রাস্তাঘাট গোগার লোকাচার গোগার সংস্কৃতি গোগার খেলাধুলো গোগার মেয়েরা গোগার ছেলেরা...’ খটকা লাগে। খুবই খটকা লাগে। কিন্তু পরমুহূর্তেই রমানাথ জানিয়ে দেন ‘গোগার কথা কাউকে বলিনি... কাউকে বলা যায় না।’ তাঁর নাকি ইচ্ছে ছিল সবাইকে গোগায় নিয়ে যাবেন গোগা দেখাবেন। কিন্তু কাউকে নিয়ে যাওয়া হ’ল না।
অতএব প্লটভিত্তিক ন্যারেটিভ রচনার আশাস্বপনের কবর খোঁড়া হয়ে গেল একেবারে গোড়াতেই। এবার গল্পকথকের কথা শোনার (পড়ার) পালা। তাঁর জন্ম হয়েছিল গোগায়। তবে তাঁর মা অবশ্য এটা মানেন না। তবে তিনি মায়ের কথা বিশ্বাসও করেন না। তিনি বইতে লিখবেন গোগাতেই তাঁর জন্মভিটে। কিন্তু কখন? শীতের সন্ধেবেলা? না হেমন্তের সন্ধেবেলা? কোন্টা ভালো? দুটোই ভালো। তবে শীতকালেই হবে। শীতকাল তাঁর এত পছন্দের! জন্মের সময় থেকে তাঁর সুখের শুরু। না না তাঁর দুঃখের শুরু। গোগায় কি মা-বাবা ছিলেন? না কোনোদিন ছিলেন না। থাকলেও বইতে লিখবেন না। লিখলে মিথ্যে হবে হয়তো। তা ‘হোক মিথ্যে লিখব।’
পদে পদে অনিশ্চয়তা, জটিলতা, পরস্পরবিরোধিতা, দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ছিন্নভিন্ন জীর্ণ হয়ে যাওয়া, এই ‘গোগা’ রচনাটির মর্মমূলকে রক্তাক্ত করেছে। পদে পদে বিশ্বাসভঙ্গ, সংশয় আর সন্দেহ। শাস্ত্রবিরোধীদের মতে এটাই আধুনিক সাহিত্যের মূল ট্রেইট। কেননা আধুনিক মানুষ সংশয়দীর্ণ দ্বিধাজর্জর অবিশ্বাসী। শাস্ত্রবিরোধীদের আলোচনায় ফ্রানজ্ কাফকার কথা উঠে আসে। কাফকা একবার লিখেছিলেন—বালজাক একটা ছড়ি নিয়ে ঘুরতেন, তাতে খোদাই করা ছিল—যা কিছু বাধা আসে আমি সব চুরমার করি। এ প্রসঙ্গ উত্থাপন করে কাফকা আসলে নিজের কথা বলছেন। তাঁর ক্ষেত্রে উলটোটা ঘটে—প্রতিটি বাধাই তাঁকে চুরমার করে দেয়।
একটা লেখা লিখতে লিখতে লেখক যে প্রতি মুহূর্তে কতটা চূর্ণবিচূর্ণ হচ্ছেন, কতটা তছনছ হয়ে যাচ্ছেন তা গোগা পড়তে পড়তে টের পাওয়া যায়। গা ছমছম করে ওঠে। অন্তরাত্মা হিম হয়ে যায়। ওপরসা বাইরের পৃথিবীর কথা একটানা বলে গেলেও, তার বাড়ি, পাঁচিল, দেয়াল, রান্নাঘর, ঘরের চাল, আলো রোদ, দুপুর, বিকেল, নারকেল গাছ, বিলিতি ফুলগাছ, পিসিমা, জেঠিমা, টেবিল, ডেস্ক, নদী, বাতাস, ধুলো ও রাত্রির কথা বলে গেলেও, লেখার যত গভীরে ঢোকা যায় তত বোঝা যায় তা আত্মজিজ্ঞাসার কামড়ে কামড়ে ক্ষতবিক্ষত, সংশয়সংকোচে রক্তাক্ত, লেখকের অন্তর্গত অন্ধকারে অন্ধকারে ধুন্ধুমার, অনুভূতির বেদনায় ছিঁড়ে ফালা ফালা, নেগেশানে নেগেশানে জেরবার। উপন্যাস রচনার এত এলাহি আয়োজন, ঘনঘটা অথচ লেখক বিলকুল জানেন ‘এই ভাবেই উপন্যাস... এই ভাবেই... যেন কিছু ঘটে না ঘটার নেই অথচ এই সব নিয়ে একটু একটু করে আস্তে আস্তে অনেক কথা... সে সব অনেক কথা... মাঝে মাঝে পরিচ্ছেদ থাকতে পারে...।’
কিন্তু একটা লেখার ভেতর এত টালমাটাল কীসের? এত অপচ্ছায়া? এত বিপন্নতার কালশিটে? বুঝতে হবে শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলনের বীজ বোনা হয়েছিল ছয়ের দশকের একেবারে গোড়াতেই। এই আন্দোলনের মুখপত্র ছিল ‘এই দশক’ পত্রিকা। শাস্ত্রবিরোধী পরীক্ষানিরীক্ষা প্রথম শুরু হয় ‘বিদিশা’ পত্রিকাটিকে ঘিরে, যেটি পাঁচটি সংখ্যা পেরোবার পর বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৬২-এর এপ্রিল নাগাদ বেরোয় ‘এই দশক’ নামের একটা বুলেটিন, রমানাথ রায়ের সম্পাদনায়। ১৯৬৪-তে বন্ধ হয়ে যায়। কমবেশি দুবছরে বেরোয় মোট নটি সংখ্যা। তার আবার দু-বছরের মাথায় ১৯৬৬-র মার্চে ‘এই দশক’ পুরোদস্তুর ‘পত্রিকা’ হিসেবে বেরোতে শুরু করে। এই অন্যধারার গল্পপত্রিকাটি নিয়মিত অনিয়মিতভাবে চব্বিশটি সংখ্যার মুখ দেখতে পায়। শেষতম সংখ্যাটির জন্মসাল ১৯৮১। পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে ‘গোগা’ এই পত্রিকায় প্রকাশ পায় ১৯৭০ সালে, আমাদের এই এপারের বাংলাদেশের সারা গা জুড়ে যখন দাউদাউ আগুনের পোড়া ক্ষত। খুব সংক্ষেপে বলা যায় ৪৭-এর স্বাধীনতার পরবর্তী দেড় দু-দশকের মধ্যেই মানুষের তুমুল মোহভঙ্গ, পার্টিশনের মর্মান্তিক কাটাদাগ ও দীর্ঘমেয়াদি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হানাদারি, নিরালম্ব শরণার্থীদের হাহাকার এবং সর্বোপরি ৫৯-এর ভয়াবহ খাদ্যসংকট প্রচলিত ব্যবস্থার ওপর রাগ ও ঘৃণা জাগানোর পক্ষে যথেষ্ট ছিল। আর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ছয়ের দশকের রাজনৈতিক পালাবদল। ৬৪ ও ৬৭-তে দু-দুবার কমিউনিস্ট পার্টির ভাগ হওয়া, মধ্যপন্থী ও উগ্রপন্থী বামপন্থার স্পষ্ট মেরুকরণ ও সর্বোপরি নকশাল আন্দোলনের তুঙ্গস্পর্শী তোলপাড়। সময়ের এই ক্যানভাসে ফেলে দেখলে অবশ্য ওই সর্বাঙ্গীণ বিপন্নতা সন্দেহ ও অনিশ্চয়তাকে ধরতে সহজ হয়।
তবে কিনা এত বোঝাবুঝি ধরাধরি ব্যাখ্যা কাঙলাপনা ও কার্যকারণবাদকে শাস্ত্রবিরোধীরাই ঘৃণা করতেন। ‘সাহিত্য থেকে সেকেলে কার্যকারণবাদকে ছুঁড়ে ফেলে দাও’—এ স্লোগান তো তাদের ‘দশবিধি’-র ন-নম্বরে লেখা ছিলই। বরং ‘গোগা’য় ফেরা যাক। গোগা তবে কী? ‘টিনের ঘর পুব দিকে মুখ পিছনে গোয়ালঘর বাড়ির সামনে সদর দরজার সামনে চণ্ডীমণ্ডপ, টিনের চাল, ইটের দেয়াল, সামনে বাচড়া মাঝখানে একটা নারকেলগাছ... বাড়ির সামনে রায়বাড়ি সামনে চৌধুরীদের... আর নন্দদের বাড়ি... হু হু হাওয়া দিত। নদীতে জোয়ার আসত। অনেক ওপরে জল উঠত। আমি অনেকদিন পাড়ে দাঁড়িয়ে থেকেছি।’ এসব পড়ে ধারণা হবে গোগা তাহলে একটা দেশগাঁ, লেখকের বাপ-দাদুর জন্মভিটে। আবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি লেখেন ‘বাংলাদেশের ম্যাপে গোগার নাম নেই। থাকলে আমার কাজটা সহজ হত’। এ গল্পে দুটো সাংকেতিক চরিত্র রয়েছে ‘বি’ আর ‘মি’। ‘মি’ গোগায় যেতে চাইত। মাঝে মাঝে ‘বি’ও বলে উঠত গোগায় যাব। কিন্তু ‘আমি কাউকে গোগায় নিয়ে যেতে পারিনি।’ তাহলে গোগা কী কোনো দেশ নয়? আবার একইসঙ্গে রমানাথ বলেন ‘মানে গোগা মানে আমি।’ গল্পের শুরু সম্বন্ধে লেখকের মত ‘সে আমার শুরু।’ লিখছেন ‘আমি নায়ক হব। আমি থাকব মাঝখানে। ‘আমি’ নিয়ে লিখব। খারাপ হবে?’ খারাপ হয়তো হবে না কিন্তু তাহলে মনে হবে যে ‘গোগা’ মানে গল্পকথক নিজে। গোগা তাঁর অস্তিত্বের শীতজার্নাল। ‘উপন্যাসে আমার কথা... মানে গোগার কথা লিখব।’ লিখুন, তবে তা লিখলে তো গোগার তবু একটা কংক্রিট আদল পাওয়া যায়। কিন্তু আবার কখনও হঠাৎ তিনি বলে ওঠেন ‘পাশে মা থাকলে বলত সব মিথ্যে। গোগা বলে কিছু নেই।’ তবে কী মা’র কথাই সত্যি? গোগা একটা নিছকই ‘কিছু না’। একটা নিঃসীম শূন্যতা। তাই নিয়েই কল্পনার দরকষাকষি, শিল্পশৈলীর নকড়াছকড়া। আবার গল্পের কোথাও তিনি বলেন ‘যখন আর কথা নেই শব্দ নেই তখন গোগার কথা। এখন কোন কথা নেই। কথা শেষ।’ তখন ধন্দ জাগে গোগা কি তবে শব্দের নির্বাসনমাত্র, নীরবতার কালো রক্ত? আবার যখন তিনি বলেন গোগার কথা লিখতে গেলে গোগার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, তখন আবার এই ধন্দ জাগে যে গোগা কি তাঁর অল্টারইগো অথবা ‘অপর’? কে জানে? কেউ জানে না। মানবমনের এই তালগোলপাকানো জটিল রহস্যময় অনুভবই রমানাথের সর্বস্বের ওপর বারবার ছায়া ফেলে গেছে।
শুরুতে একবার শুধু বলেছিলাম রমানাথ রায় সদ্যপ্রয়াত। আর এগোইনি। এগোতে হাত কাঁপে। মিথ্যে বলতে চোখের পাতা কাঁপে। লেখক তো লোলা। চটুল বারসিঙ্গার লোলা। প্রকাশ্য বারে যে পাবলিকের সিটি ও হাততালির মুখে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করে ‘আজ গান গাইতে আসিনি।... আজ এই শেষবারের মতো আপনাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি।... আজ শেষবারের মতো আপনারা আমার এই দেহ দেখে নিন।’ তারপর তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে রাস্তায় বেরিয়ে রাস্তা ক্রস করে হঠাৎ একটা ট্যাক্সি ধরে। তারপর চলে যায়। রমানাথের ‘লোলা বিয়ার খায়’-এর কথক ভাবে লোলা কোথায় গেল? বোধহয় ট্যাক্সি চড়ে আত্মহত্যা করতে গেছে। ভাঙা বুকে নিরাশ হয়ে হোটেলের দোতলায় ফিরে এসে দেখে পিয়ানো একোর্ডিয়ান বঙ্গ ম্যারাকাসে ঝলমল ঝলমল করছে রাত্রিবার। একজন দুলে দুলে চিৎকার করে গান গাইছে। দূরের একটা টেবিলে এক বোতল বিয়ার নিয়ে লোলা বসে আছে।
লোলা বলে—‘আজ আমাদের শেষ দেখা।
— হয়তো
— আজ আমার শেষ বিয়ার খাওয়া।
— হয়তো।’
লোলারা মরণজয়ী। বার সিঙ্গার-রা মৃত্যুঞ্জয়। লেখকরাও তাই। কথা দেয়, ভাঙে, আবার কথা দেয়। কিন্তু দিব্যি বেঁচে থাকে। আমরা অহেতুক গানস্যালুটের তোড়জোড় করি!
সুদীপ বসুর এই লেখাটি পড়তে পড়তে রমানাথ রায়ের রামরতন সরণি গল্পের কথা মনে আসে-