উপন্যাসকে অনেক সময় সমাজের খণ্ডচিত্র বলা হয়। সমাজ মানে সম্পর্ক। উপন্যাস যদি সমাজের খণ্ডচিত্র হয় তাহলে সরল ঐকিক নিয়মে ছোটোগল্প সমাজসম্পর্কের খণ্ডাণুর ছবিই ধরে রাখবে। অঙ্কে তো এটাই আসে। অর্থাৎ জীবনের একটা টুকরো, সময়ের একটা টুকরো—‘a slice of life, a slice of time’। পরিসর যত ছোটো হয় (যেমন ছোটোগল্পে, কবিতায়) প্রকাশ তত কঠিন হয়। ছোটো পরিসরে বড়ো ফ্রেমকে আঁটতে গেলে প্রকাশ শুধু কঠিন নয় জটিলও হয়ে পড়ে। এই জটিলতা আসলে শিল্পের জটিলতা, যার গায়ে জীবনের জটিলতার ছায়া এসে পড়ে। ছোটোগল্পকারের তাই সমাজের কাছে দায় অনেক বেশি। অবশ্য এমন মতবাদও চালু আছে যে লেখকের সমাজের প্রতি আবার কীসের দায়? লেখক লেখেন নিজের অনুভূতির কাছে সৎ থাকার জন্য। নিজের আত্মিক মুক্তির জন্য। যদি তাই হয় তবে তো তাঁর দায় নিজের প্রতিই। যার প্রতিই হোক দায় একটা থাকেই। শিল্প একটা আশ্চর্য ফাঁদ, মুক্তি আছে, বন্ধনও আছে। লেখকের লিখতে আসা তাই একদিকে যেমন জীবনের মধুরতম সিদ্ধান্ত, তেমন অন্যদিকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্তও বটে। মধুর এই জন্য যে লিখতে লিখতে লেখক তাঁর অন্তরাত্মার আনন্দ-বেদনা-ঘৃণা-রিরংসার ভার লাঘব করতে পারেন, ভেতরটা হালকা করতে পারেন। কিন্তু মাধুর্যের চেয়ে ঝুঁকি অনেক বেশি। কেননা ওই ফাঁদ, লিখতে লিখতে তৈরি হওয়া এক অচেনা কৃষ্ণগহ্বরের গভীর শীতল অন্ধকার লেখককে তার ভেতরে টেনে নিতে শুরু করে, তাঁর চারপাশকে অনর্থক করে দিয়ে, জীবনের সব সফলতাকে ধুলোবালিকণার শূন্যতায় এনে ফ্যালে। সাহিত্য তখন এক অন্ধকার অভিশপ্ত আর্টে পর্যবসিত হয়।
বিপুল দাস পরিণত লেখক। অন্যস্বরের গদ্যকার। আপাত-শান্ত জীবনযাপনের আত্মার ভিতরে লুকিয়ে থাকা অভিশাপ, জটিলতা ও অন্ধকার বারবার তাঁর লেখার বিষয় হয়ে ফিরে ফিরে এসেছে তাঁর উপন্যাসে, ছোটোগল্পে। অনেক লেখক আছেন যাঁদের ভাষার ভিতরেই এই অভিশাপের লম্বা ছায়া এসে পড়ে। যেমন, জীবনানন্দ দাশ। অনেকে আছেন যাঁদের সৃষ্টির বিষয়ের ভিতর জীবনপ্রণালীর তিমির এসে মেশে। বিপুল দাসের ক্ষেত্রে আমার মনে হয়েছে, ভাষা-বিষয়-আবহে, এই তিনটেতেই জীবনের জটিলতা তিনি সূক্ষ্মভাবে ব্যবহার করতে পারেন। হ্যাঁ, ‘ব্যবহার’ শব্দটা আমি বেশ ভেবেচিন্তেই লিখলাম।
কয়েক বছর আগে বিপুলের ‘সরমার সন্ততি’ আমাকে মুগ্ধ করেছিল। তাঁর সাম্প্রতিক গল্পের সংকলন ‘নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু’ (প্রকাশকাল-আগস্ট ২০১৯) বেরিয়েছে ‘ঋতবাক’ প্রকাশনী থেকে। পঁচিশটি গল্পের একটি একশো ছিয়াত্তর পাতার সংকলন। জানি না সবগুলি গল্প সাম্প্রতিক সময়ে লেখা কি না, তবে প্রথমেই বলি এক গল্পসমগ্র ছাড়া একটি বইয়ের দু-মলাটের ভিতরে এতগুলি গল্প অনেকসময় পাঠককে ক্লান্ত করতে পারে। এই বইটি করেছে বলছি না, তবে সম্ভাবনা থেকে যায়। কারণটা সহজ—একজন লেখক, বিশেষত বিপুল দাসের মতো সিরিয়াস লেখক তো কমবেশি একটিই সিগনেচার বহন করেন, তাই পুনরাবৃত্তির একটি সম্ভাবনা তো অবশ্যই থেকে যায়। তবে কিনা একটার পর একটা গল্প যদি একটার পর একটা কুয়াশামদির স্তর পেরিয়ে অস্পষ্ট রহস্যময় স্বপ্নের ভিতর পাঠকের হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে পারে তাহলে অবশ্য অন্য কথা।
‘নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু’ গল্পটিতে অবশ্য সেই অস্পষ্ট রহস্যময় কুয়াশা নেই। গল্পগুলি, গল্পের বিষয়-আশয় অনেকটাই বাস্তবের দিকে ঝুঁকে আছে। এই লেখকের ভাষায় তো একটা জাদু আছে, যা মাঝে মাঝে বিদ্যুৎচমকের মতো কালো আকাশে খেলে যায়। যেমন, ‘সর্পকথা’ গল্পটি। মামার বাড়িতে সিঁড়িঘরের নীচের ভাঁড়ারে বইপত্র ঘাঁটতে গিয়ে টর্চের আলোয় বিষধর সাপটিকে দেখতে পায় কিশোর বলাই। সাপটিকে দেখতে পাওয়ার আগের মুহূর্তে সে একটা সন্দেহজনক বুনো গন্ধ পেয়েছিল। মামিকে খুব ভয় পায় বলাই। কিন্তু মামি এখন ঘুমোচ্ছে। সাপটাকে লাঠি দিয়ে মেরে বাইরে ফেলতে যাওয়ার মুখে মামার সঙ্গে দেখা। গল্প এমনই সাদামাটা। গল্প প্রায় কিছুই নেই। কিন্তু গোটা গল্পের ভিতর রক্তাক্ত হাহাকারের মতো ছড়িয়ে থাকে মামার ছেলে বঙ্কুর তিনচাকার সাইকেলটার প্রতি বলাইয়ের অবদমিত তীব্র বাসনা, চোরাটান। গল্পের শেষে মামার অনুমতি সাপেক্ষে পুরোনো সাইকেলটা উঠোন জুড়ে খুব করে চালায় বলাই। এই দৃশ্যে এসে গল্পটির উত্তরণ ঘটে। মুহূর্ত অনন্ত হয়ে যায়।
‘জীবনের সহজপাঠ’ গল্পের জীবনের পুরো নাম জীবন দত্ত। ভবঘুরে, ছিটগ্রস্ত, ভদ্রসমাজের অপাঙ্ক্তেয় জীবনের জীবনযাপন ‘দুমুখো কুকুরের’ রহস্যের মতোই হেঁয়ালিময়। ভোকাট্টা ঘুড়ির মতো জীবন তার। তবু বটতলায় বাসের জন্য অপেক্ষা করা তার দিদি ফুলুকে নিয়ে আড়ালে-আবডালে হাসিমশকরা হয় একথা সে জানে, কিন্তু তাকে দেখে মনে হয় এসব সে মোটেও গায়ে মাখে না। সুতির শাড়ি আর ‘সিমপিল’ পোশাকের বদলে ফুলুর গায়ে একদিন ঝলমলে সালোয়ার কামিজ ওঠে, সবার চোখ টাটায়। একদিন খবর হয়ে যায় লাল ওড়না গলায় পেঁচিয়ে ফুলু সুইসাইড করেছে। জীবনকে খবরটা দেয় মুদির দোকানি নারীলোলুপ হরি সাউ। জীবন নদীপাড়ের ছাতিমতলায় দাঁড়িয়ে শান্তভাবে খবরটা শোনে। পরের দৃশ্যেই জীবন নদীতট বরাবর দৌড়নোর প্রস্তুতি নেয়। তার পায়ের কাছে পাথরে-থেঁতলে-যাওয়া মাথা নিয়ে হরি সাউয়ের লাশ পড়ে থাকে। জীবনের প্রতি মায়া, টান আর প্রতিহিংসা, প্রতিশোধের মিশ্র অবস্থান ফুটে উঠেছে এই গল্পটিতে।
তুলনায় ‘ভাঙা রূপকথা’ গল্পটি বেশ অন্যরকম। সুখী, অভ্যস্ত, পরিপূর্ণ জীবন প্রিয়া আর তার সফল কার্ডিওলজিস্ট স্বামী অনিকেতের। ঐশ্বর্যে সমান সমান না হলেও সম্পর্কে ও প্রেমের ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ জীবন প্রিয়ার বন্ধু ও তার স্বামী অর্জুনেরও। দাম্পত্যপ্রেম, সচ্ছলতা, বৈভব কোনো কিছুরই অভাব নেই তাদের। তবু এই সম্পূর্ণতার ফাঁকফোকর দিয়ে গভীর রাতে বা ভোররাতের হঠাৎ ঘুমভাঙা নির্জনে মনে হয় কার সঙ্গে যেন দেখা হওয়ার কথা ছিল। ছায়ার মতো একটা কষ্ট হয়, অনিকেত আর বীথি, দুজনেরই। তারা বোঝে, একে অপরের জন্য হয়তো এই কষ্ট, হয়তো নয়। নিছক পরকীয়া প্রেম নয়, প্রেমের আলো-আবছায়া উপস্থিতি-অনুপস্থিতির গল্প ‘ভাঙা রূপকথা’।
এমনই আর-একটি পরকীয়া প্রেমের কাহিনি ‘জাগরণপালা’। দিব্যেন্দু জানে তার স্ত্রী বীথির সঙ্গে বাপের বাড়ির গ্রাম আলতাডাঙায় অলোকদা নামক এক যুবকের শারীরিক সম্পর্ক আছে। এটা সে শুনেছে। অথচ ঘটনাপরম্পরা ও যুক্তি বলছে বীথি নয়, অলকের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে বীথির মায়ের সঙ্গে। একরাতে আলতাডাঙা থেকে ফেরার পথে বাস মিস করে দিব্যেন্দু। পেট্রল পাম্পের পাশে ধাবার খাটিয়ায় একটি ভাড়া করা মেয়ের উপর যৌন আক্রোশ ফলায় সে। বীথির পরকীয়ার প্রতিশোধ নেয়। কিন্তু দেখা যায় আসলে গণিকাটির মাকে উন্মাদের মতো খুঁজছে সে।
পুস্তক আলোচনার নাম করে গল্পগুলো ধারাবাহিক বলে যাওয়া কোনো কাজের কথা নয়। এই বইটি পড়তে পড়তে একটাই কষ্ট বারবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে—কোথায় গেল বিপুল দাসের সেই ক্ষুরধার ভাষা, একই সঙ্গে মায়াবী ও ধারালো, কোথায় গেল তাঁর লেখার সেই বেদনাবিদ্ধ মজার ঝলকানি! অনেকসময় গল্পের চরিত্রগুলি, চরিত্রের মুখে সংলাপগুলিকে কষ্টকল্পিত বলে মনে হয়। অনেকসময় গল্পের কাহিনিকে বেশ গোলাকার মনে হয়, অনেকসময় আবার কাহিনি চূড়ান্ত পরিণতি পেতে পেতে হঠাৎ থমকে গিয়ে ছত্রখান হয়ে যায়। বিপুল দাসের মতো গদ্যকার এইসব বিষয় নিয়ে আরও শক্তি প্রদর্শন করতে পারবেন বলে আশা ছিল।
বইটির প্রচ্ছদ ছিমছাম।