এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • তর্কবিলাস

    পাগলা গণেশ লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৫ জুন ২০২৫ | ১০৮ বার পঠিত
  • আবার বৃষ্টি শুরু হল।

    হালকা ঝিরঝিরে বৃষ্টি, তার সাথে এলোমেলো বাতাস। বৃষ্টির ফোঁটাগুলি যেন মসলিনের একটা পর্দা জানালার বাইরে ঝুলিয়ে দিয়েছিল। বাতাসে সেই পর্দা মাঝে মাঝে ছিঁড়ে গিয়ে আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসছিল। রবিন জনসনের ড্রয়িং রুমের বড় ফরাসি জানালাগুলো জলের নাজুক ফোঁটায় ভরে উঠেছিল। সেগুলোর ওপারে, বাগান যেন সবুজ ও ধূসর রঙের অস্পষ্ট এক স্বপ্নের মতো ঢেকে ছিল।

    আজহার চৌধুরী হলুদাভ গরম আলোর মধ্যে বেজ রঙের নরম সোফায় বসেছিলেন, দুই হাতের আঙুলে দার্জিলিং চায়ের কাপটিকে ধরে তার উষ্ণতাটা নিচ্ছিলেন। তার সামনে, রবিন একটি খোদাই করা সেগুন কাঠের সোফায় বসে স্বচ্ছ কাঁচের গ্লাসে দামী স্কচ হাতে নিয়ে দোলাচ্ছিলেন। গ্লাসের ভেতর বরফগুলো অস্থিরভাবে ঘুরছিল। মাঝখানের নিচু টেবিলে একটা ট্রে, তাতে ভাজা কাজুবাদাম আর চানাচুর রাখা ছিল। আজহারবাবু এখনও সেদিকে হাত বাড়াননি। তার মুখটা একটু চিন্তিত। — রবিনবাবু একবার স্কচে চুমুক দিয়ে কখনও একমুঠো চানাচুর, আবার কখনও দুচারটে বাদাম মুখে দিয়ে চিবাচ্ছিলেন। তার মুখে একটা প্রশান্ত ভাব। যেন তিনি এই পৃথিবীর সমস্ত রহস্য জেনে ফেলেছেন। আর কিছু তাকে চমকিত করতে পারবে না।

    “আচ্ছা বলুন তো, রবিনবাবু,” আজহার উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন —“যদি মানুষ সত্যিই সভ্য হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে এখনও যুদ্ধ হয় কেন? এটা কি পরস্পরবিরোধী ব্যাপার নয়?”

    রবিন ধীরে স্কচে এক চুমুক দিলেন, তারপর চশমার পেছন থেকে একটু কৌতুকের ভাব নিয়ে বললেন, “আহ, আজহার, তুমি কোনোদিন পাল্টাবে না, না? — সদা আদর্শবাদে বিশ্বাসী, সদা আশাবাদী? এখনো মানুষের, মানুষের মানবিকতার উপর ভরসা রাখো। আরে মানুষ যে একটি পনেরশ ঘনসেমি মস্তিষ্কবিশিষ্ট বাঁদর ছাড়া আর কিছু নয়, তা মানতে চাও না কেন?”

    “কিন্তু বুদ্ধিটাই তো আসল। সেটাই কি আমাদের বাঁদরসহ অন্যান্য ইতর প্রাণীদের থেকে আলাদা করে না?” আজহার বললেন।তারপর একটু থেমে,চায় এক চুমুক দিয়ে আবার বললেন, “তাছাড়া মানুষের সংখ্যা বাড়লে, জিনপুল সমৃদ্ধ হয়, বৈচিত্র্য বাড়ে, প্রজাতির বেঁচে থাকার সম্ভাবনা শক্তিশালী হয়। যুদ্ধ তো কোনোভাবেই তার সঙ্গে সমান্তরালে যায় না।”

    “ঠিক। যায় না,” রবিন স্বীকার করলেন, গ্লাসটা টেবিলে রেখে সামনের দিকে একটু ঝুঁকে, “সে তো ঠিক কথা। কিন্তু তাতে সম্পদের ব্যাপারটা তো আছে। এখানে সম্পদ বলতে কিন্তু টাকা-পয়সা, সোনাদানা বা ঘরবাড়ি নয়। আমি বলছি শক্তির কথা।”

    আজহারের ভ্রু কুঁচকে গেল, কপালে ভাঁজটা স্পষ্ট হল।
    — “তোমার কথাটা কিন্তু একদম নিরাশাবাদীর মতো শোনাচ্ছে।”

    রবিনবাবু আবার গ্লাসটা তুলে নিলেন। তাতে একটা চুমুক দিয়ে গ্লাসটা গোল করে ঘোরাতে ঘোরাতে, একটু থেমে বললেন— “তা নিশ্চয় শোনাচ্ছে আজহারবাবু,আপনার বোধ–বুদ্ধি আধুনিক, কিন্তু আপনার প্রবৃত্তি তো সেই সরীসৃপ মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ করে। সে তো এখনো এলাকা বোঝে। তাই না?” এরপর তিনি একটু থামলেন। ডান হাতের তর্জনী ও বুড়ো আঙুলে একটি বাদাম তুলে নিয়ে মুখে দিয়ে, “আচ্ছা বলুন তো, শক্তি কোথা থেকে পাই আমরা?”

    আজহারবাবু যেন একটু বিরক্ত হলেন, “কেন,সূর্য থেকে।”

    রবিন মুচকি হাসলেন, “ঠিক ধরেছেন। প্রতিটি যুদ্ধ, প্রতিটি ভাষণ, প্রতিটি সাম্রাজ্যের উত্থান বা পতন হওয়া — সবই ওই সূর্যালোক চুরি করার জন্য।”

    আজহার বাবু চায়ে সুড়ুৎ করে একটা চুমুক দিয়ে বললেন, “কিন্তু আমরা তো ফসল ফলাই, জ্বালানি আমাদের যা আছে তাতে আগামী ত্রিশ বছর চিন্তা করতে হবে না।তাছাড়া পুলিশ–প্রশাসন, আইন–আদালত আছে।”

    “হ্যাঁ,” রবিন বললেন, “তবে তুমি আবার সরীসৃপ মস্তিষ্ককে ভুলে যাচ্ছো — সে এলাকা বোঝে, প্রবৃত্তি বোঝে। তোমার এই উন্নত মস্তিষ্ক তাকে দমিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখে বটে, কিন্তু সুযোগ পেলেই সে জেগে ওঠে।”

    খুব জোর তর্ক চলছিল, আজহারবাবু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় ওদের বাড়ির সহকারী রমেশ ট্রে হাতে হাজির হল।

    “কাটলেট, সাহেব। ম্যাডাম পাঠিয়েছেন। নটায় ডিনার।”

    রবিন তার হাত থেকে ট্রেটা নিয়ে টেবিলে নামিয়ে রাখলেন। তারপর রমেশের দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে বললেন, “তাকে আমাদের ধন্যবাদ জানাও। আর তাকে বলো, সে যেন তাড়াতাড়ি আসে, আমরা তার অপেক্ষা করছি।”

    রমেশ,"জ্বি সাহেব,” বলে চলে গেল।

    আজহার রমেশ চলে যাওয়ার পর চোখ রাখলেন রবিনের দিকে, “আপনার স্টাফ এখনও আগের মতোই — দক্ষ আর অদৃশ্য।”

    রবিন মুচকি হাসলেন, “একদম। আমি ভাবি, রমেশ যদি ছেড়ে যায় তখন কী হবে।”

    হলওয়েতে একটা বলিষ্ঠ পদধ্বনি শোনা যায় — একটি ছায়াময় শরীর। গাঢ় নীল কুর্তা পরা, প্রশস্ত কাঁধ, টকটকে রং, কোঁকড়া কালো চুল, সবুজ চোখ, কাটা কাটা মুখশ্রী আর প্রায় সাড়ে ছ’ফুট লম্বা, এক কথায় অনবদ্য, এক বছর তিরিশ বয়সের যুবক ঘরে প্রবেশ করল। — এ হল ঋত্বিক, রবিনের ছেলে। সে ঢুকতেই দুজনে তার দিকে তাকালেন। আজহারবাবুর মুখে একটা শ্রদ্ধা,মুগ্ধতার ও সংকোচের ভাব।

    সে রমেশের দিকে তাকিয়ে বলল, “আবার কাটলেট? কাকা, মা’কে বলো কিছু নতুন ট্রাই করতে।”
    তারপর আজহারকে অবলোকন করে বলল, “কাকু, এখনও বাবার লেকচার শুনছ?”

    আজহার হাসলেন,“হ্যাঁ, শেখার চেষ্টা করছি। খুব তাড়াতাড়িই তোমার বাবাকে হারাতে পারব আশা করি।”
    ঋত্বিক হাসল। আজহারবাবু আরও গুটিয়ে গেলেন। তিনি বুকের মধ্যে যেন একটু জ্বালা অনুভব করলেন, তার মুখেও তার ছাপ পড়ল, তার মুখ কালো হয়ে গেল। ঋত্বিকের সামনে এলেই তার এমন হয়। নিজেকে তুলনা না করে পারেন না।

    তিনি নিজেকে একটু সামলে নিলেন,
    — “কাজ কেমন চলছে?”

    “সেই একই, ক্লান্তিকর। দিনগুলো পুনরাবৃত্ত হচ্ছে। জাতিসংঘের রিপোর্ট আছে আগামী সপ্তাহে। আমি ইরান যাচ্ছি পরশু। কাকু, আমায় একটা সাধারণ কাজ জোগাড় করে দিতে পারেন? আর ভালো লাগছে না।”

    — “কী বলো হে? বাংলার গর্ব তুমি—,” আজহারের গলায় একটা অনিচ্ছার ভাব।

    — “সেইজন্যই তো পালাতে পারছি না কাকু, এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছি। গর্বের বোঝাটা যে বড্ড ভারী।”

    ওদের কথা চলছে, এমন সময় সদর দরজায় কলিংবেল বাজে। রমেশ একটু পরে গিয়ে দরজাটা খুলে দেয়।

    “কাকু, কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি বলুন তো? বৃষ্টিতে ভিজে গেছি একেবারে, ছাতাটাও নিয়ে যাইনি।”

    রমেশ বিনয়ী হয়ে বলে, “আমি একটু ম্যাডামকে সাহায্য করছিলাম, দিদিমণি।”

    হলওয়েতে লঘু পদশব্দ শোনা গেল। ঘরে প্রবেশ করল রবিনবাবুর কন্যা, সোহিনী। বছর পঁচিশ বয়স, অসম্ভব সুন্দরী ও মেধাবী।

    সে ঘরে প্রবেশ করতেই আজহারবাবুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সোহিনী এসে রবিনবাবুর সামনে দাঁড়ালেন, কপট রাগ করে বললেন,
    “বাবা, তুমি আবার এই ছাই-পাঁশগুলো খাচ্ছ? তোমার না হাই ব্লাডপ্রেসার?”
    তারপর আজহারবাবুর দিকে ফিরে বললেন,
    “কেমন আছেন আজহারবাবু?”

    — “ভালো। তোমার কী খবর? পড়াশোনা কেমন চলছে?”

    — “ভালোই, মুখস্থ করা আর উগরে দেওয়া।” বলে মুখটা ব্যাজার করল।

    আজহারবাবু অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন,
    “হা হা, যা বলেছ। কলোনিয়াল কেরানি পড়ানো শিক্ষাব্যবস্থা।”

    সোহিনী ঘুরে দাঁড়াল,“বাবা, আমি ভিজে গিয়েছি পুরো, কাপড়টা ছেড়ে আসছি।”

    — “যাও।”

    একটু পরে সোহিনী এসে বলল,“বাবা, মা বলছে,চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
    তার পরনে এখন হালকা নীল রঙের ছাপা কুর্তা, তার সাথে একটা ডেনিম পালাজো।

    আজহারবাবু মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকালেন।

    রবিন হাত তুলে তাকে ডাকল,
    “বসো,সবে আজহার আজকে আমার পিছনে পড়েছে আবার।”

    “কী টপিক?” সোহিনী আবার জিজ্ঞেস করলেন।

    “যুদ্ধ, বিবর্তন, মানবজাতির শেষ,” রবিনবাবু বললেন।

    “অভ্যাস ম্যাডাম, অভ্যাস।” আজহার যোগ করেন।

    সোহিনীর দৃষ্টি জানালার দিকে —
    “তুমি যখনই আসো, বর্ষা শুরু হয়?”

    আজহার তার দিকে তাকিয়ে বললেন,
    “আমিই সাথে আনি হয়তো।”

    সোহিনী চুপ করে জানালার ওপারে চেয়ে থাকে।

    রবিন বলেন,“কী ভাবছ, সোহিনী? আমরা কি ধ্বংসের পথেই যাচ্ছি? নাকি আজহারবাবুর কথামতো মানুষ হয়ে যাব?”

    সোহিনী কাঁধ তুললেন,“দুটোই করি। তবে সমানভাবে নয়।”

    এমন সময় ঋত্বিক আবার ঘরে ঢুকল, তার হাতে চায়ের ট্রে।

    “তুমি সব সময় ধাঁধায় কথা বলো, সোহিনী। আমাদের মতো গড়পড়তা মানুষ কি তা বুঝতে পারে?” — বললেন আজহারবাবু।

    “না আজহারবাবু, আমি শুধু গৌরচন্দ্রিকা করি। মানুষ খুব অমনোযোগী, কিনা? সরাসরি নীরস তথ্য পরিবেশন করলে মানুষ বীতশ্রদ্ধ হয়ে যায়।”সোহিনী খানিকটা বাদাম তুলে মুখে দিল।

    “আপনার কথায় অমনোযোগী কে হয়, ম্যাডাম? কার এত দুর্ভাগ্য!” — বলে আজহারবাবু হাসলেন।

    “তাহলে, আজকের টপিক কী?” বলে ঋত্বিক আজহারবাবুর পাশে সোফায় বসল।

    হলওয়েতে আবার ধ্বনিত কণ্ঠ শোনা যায় — মার্জিত, স্নেহের সাথে হালকা রাগ মিশিয়ে,
    “রমেশ, তুমি কী যে করো না!”

    মীরা, রবিনের স্ত্রী — লম্বা, ছিপছিপে গড়ন। মাঝবয়সী, কিন্তু যৌবনের সব লাবণ্য এখনো শরীর থেকে অন্তর্হিত হয়নি। সৌন্দর্যে একটা স্নিগ্ধতা আছে।

    তিনি এসে রবিনবাবুর পাশে বসে বললেন,“সেটাই কারণে তুমি টেলিভিশন পছন্দ কর না। শুধু কবিতা আর মোটা মোটা বইগুলো নিয়ে পড়ে থাকো।”

    তারপর তিনি আজহারের দিকে তাকিয়ে বললেন,“আজহার-দা, ও আবার আপনার কাছে মানুষের অপদার্থতা প্রমাণ করার চেষ্টা করছে?”

    — “না, ঠিক তা নয়।” আজহার হেসে বললেন, “তবে তার প্রভাব আছে।”
    তারপর ঋত্বিকের দিকে তাকিয়ে বললেন,"তোমার বাবার মানুষের সভ্য হওয়া নিয়ে খুব একটা সদর্থক ধারণা নেই।তিনি বলেন,মানুষ শুধু একটা বুদ্ধিমান বাঁদর।"

    -"আমি যদিও অতটা একপেশে ভাবি না,তবে আমার মনে হয় মানুষ স্বার্থান্ধ।"
    সোহিনী একটু ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল,"না দাদা,তুই একটু বেশিই যেন বলে ফেলছিস।"
    ঋত্বিক একটু হেসে বলল,"কেন?মানুষ কি স্বার্থপর নয়?"
    -"স্বার্থপর ঠিকই।কিন্তু স্বার্থ ছাড়া কি কিচ্ছু করে না?"
    -"না,করে না।তুই হয়তো ভাববি আমি জেদ করছি,কিন্তু ভেবে দেখ,তুই যেগুলোকে স্বার্থহীন কাজ বলছিস,সেগুলোও স্বার্থ দ্বারাই পরিচালিত।"
    আজহার বাবু বেশ একটু আহত হলেন যেন,বললেন,"এটা ঠিক আমার বোধগম্য হল না।তুমিও এবার তোমার বাবার মতোই একপেশে কথা বলছ।"

    ঋত্বিক একটু থামল,মনে মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিল হয়তো।তারপর বলল,"যেসব কাজকে আপনারা নিঃস্বার্থ বলেন,যেমন এই দাতব্য সংস্থাগুলোর কাজ,বা ধর্মীয় মিশন,এদের যে সদস্য এরা বিশ্বাস করে ভালো কাজ করলে এরা মৃত্যুর পর স্বর্গ পাবে।আবার যারা নাস্তিক,তারা নিজের বিবেকের কাছে জবাবদিহি করতে চায়,তার চোখে চোখ রাখতে চায়।"
    আজহার বাবু একটু ভ্রুকুঞ্চিত করলেন,"তা ঠিক।তোমার বক্তব্য আমার আর তোমার বাবার মতের মাঝখানে বাবু হয়ে বসে পড়েছে।"

    ঘরের মধ্যে একটা হাসির রোল উঠল।হাসি থামলে ঋত্বিক বলল,"হয়তো তাই।তবে একটা ব্যাপার কী জানেন কাকু,আমরা সবাই একটা করে চশমা পরি।আর দুনিয়াটাকে সেই চশমার মধ্য দিয়েই দেখি,তাই আমাদের চোখে পৃথিবী সেভাবেই ধরা দেয়।"
    -"একদমই তাই।আসলে পৃথিবীতে সত্য বা মিথ্যা বলে কিছু নেই।যা কিছু আছে আমাদের মনে।আর সত্য সবার কাছে একইরকমভাবে ধরা দেয় না।যারা যেমন দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক তেমন ভাবেই ধরা দেয়।"
    -"আপনি একদম আমার মনের কথা বলেছেন আজহার বাবু।"

    এমন সময় রবিন বাবু একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,"তোমরা যে আমাকে একেবারে বাদই দিয়ে দিলে হে?"

    আজহার বাবু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন,"না,না,কি যে বলেন! বাদ কেন দেব?"
    ঋত্বিকও হেসে বলল,"বাবা,তুমিও না!তোমাকে কী কথা বলতে মানা করেছি? তুমিই তো চুপ বসেছিলে।"
    সোহিনী বাবার দিকে কপট রাগের ভঙ্গিতে তাকিয়ে বলল,"বাবা তুমি লোককে অপদস্থ করতে খুব ভালো পারো।"

    রবীনবাবু হেসে বললেন,"আরে না,আমি এমনি মজা করছিলাম।"

    বাইরে জানালায় এখন হঠাৎ ঝলমলে আলো — বৃষ্টি থামছে। বাগান এক মুহূর্তের জন্য স্বর্ণাভ আভায় ভরে গেল।

    এমন সময় আজহার সোহিনীর দিকে তাকালেন। নিঃশব্দে সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস চাপার চেষ্টা করলেন। — কিন্তু মুখের উপর অদৃশ্য সংলাপ ভেসে ওঠে — দুঃখ, আকাঙ্ক্ষা, নৈঃশব্দ আর অদ্ভুত একটা আবেগের ছায়া।

    রবিন তার ছেলে ঋত্বিকের দিকে তাকালেন —
    “ঋত্বিক, তুই কাল বলছিলি না, সেই ইসরায়েলি কর্নেলের কথা?”

    ঋত্বিক হেসে বলল,
    “না না, তেমন কিছু না। তিনি একটু আবেগে ভেসে গিয়েছিলেন আর কি।”

    — “তুই বিনয়ী হচ্ছিস। গোটা হল তোর জন্য হাততালি দিয়েছিল।”

    ঋত্বিক একটু সংকুচিত হয়ে বলল,"ও বেচারি বলতে বলতে বেশি বলে ফেলেছিল।নিজেরা গণহত্যা করে,এখন কাঁদুনি গাইছে।এখন ভুলে গেছে।"

    আজহারের মন এখানে ছিল না, সে একমনে কিছু ভাবছিল, তা দেখে ওরা আর কিছু বলল না।

    ঋত্বিক উঠে পড়ে বলল,“বাবা, আজহার কাকু, এবার আমাকে ক্ষমা করতে হবে। কাল যাওয়ার জন্য ব্যাগ গোছগাছ করতে হবে।”
    বলে সে ধীর পায়ে হলওয়ের দিকে চলে গেল।

    একটু পর সোহিনী নীরবে উঠে চলে গেল। মীরা চুপচাপ তার পেছনে পেছনে গেল, যাওয়ার পথে একবার আজহারের দিকে তাকাল।

    রবিন আজহারের দিকে ঝুঁকে বললেন —
    “কী হলো তোমার?”

    আজহার সাড়া দিলেন না।

    “আমাকে বলতে পারো তুমি,” বলে রবিন একটু থামলেন, তারপর বললেন, “কী, বলবে?”

    মেঘ ফিরে এল। রুম আবার অন্ধকার হয়ে গেল।

    একটি তীব্র বজ্রধ্বনি শোনা গেল বাইরে। রবিন একটু কেঁপে উঠলেন। গিয়ে জানালায় পর্দা টেনে দিয়ে এসে বসলেন।

    রমেশ ঢুকে আজহারের দিকে তাকিয়ে বলল —
    “আজহারবাবু, ড্রাইভার জিজ্ঞেস করছে, গাড়ি বের করবে কি?”

    আজহার বিষাদ মিশ্রিত গলায় বললেন,
    “না, এখন না — বৃষ্টি থামলে যাব।”

    রবিন নিজের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে চশমাটা খুললেন,
    — “বৃষ্টি হয়তো থামবে না।”

    ঘরে একটা অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য বিরাজ করতে লাগল।

    বাইরে থেকে ঝিঁঝিঁর একটানা আওয়াজ ভেসে আসছে। এমন সময় ইলেকট্রিসিটি চলে যাওয়াতে ঘরটা আবছা অন্ধকারে ভরে গেল।

    পরিশেষে আজহার মুখ খুললেন,
    “আমাকে বাড়ি যেতে হবে।”

    রবিন জানালার দিকে তাকিয়ে বললেন,
    “ঝড় থেমে গেছে, আর একটু অপেক্ষা করলে বোধহয় বৃষ্টি থেমে যাবে। তবে তুমি খেয়ে যেও। মীরা তোমার জন্য অনেক যত্ন করে রান্না করেছে।”

    আজহার চুপচাপ বসে রইল।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন