চৌকো বাক্সবাড়িতে সায়া, লুঙ্গি, ছোটো প্যান্ট সব গায়ে গায়েই আছে। গামলায় একসাথে জড়ো হচ্ছে। বালতিতে বা মেশিনে জড়াজড়ি ডুবছে, ভাসছে, উঠছে। মেলা হচ্ছে পাশাপাশি। তাদের কখনও যুগলবোধ। কখনও একাকীত্ব। ‘তারে তে দুটো জামা/তারে তে একা শাড়ি...’
পুরানো বাড়ির পেয়ারা, জাম্বুরা, জামরুল ঘেরা উঠোনে লম্বা তার টাঙানো। কাপড়-জামা শুকোচ্ছে। সকালের রোদে শার্ট, পাঞ্জাবি, তহবনদের একপ্রস্থ ওয়ার্মিং সারা। বিকেল গড়িয়ে এলে তারে ঝোলে বেলায় গা ধোওয়া শাড়ি-সায়া। সায়াটা মাঝখানে কেন? মাথায় ঠেকছে যে! “কে ঝোলায় মাঝ রাস্তায় এই সব জঞ্জাল? গায়ে লাগছে! সায়া-টায়া কি খুব ভালো জিনিস?” বিরক্তিতে এবং ঘেন্নায় কোঁচকানো মুখ ছোটো কাকুর। বিড়বিড় করছেন।
সায়া কী এমন খারাপ বুঝতে পারি না। মাসিকের ন্যাকড়া তো নয়! সে ন্যাকড়া, মা-মাসিরা লুকিয়ে রোদ না পড়া ছাতা ধরা দেয়ালে এমন ভাবে মেলতেন, ভয়ার্ত গুটিয়ে থাকা অন্ত্যজ যেন! পুতুল, দীপা, বুড়িরা সেই দাস্য ভাব ঘুচিয়ে, কেচে মাড়-নীল দিয়ে কেমন খটখটে রোদে শুকোয় কানি-কাপড়। ন্যাপকিন আসার আগের কিসসা।
রাত্রিকালে ছোটো কাকু, বড়ো জেঠুদের বারমুডা ট্র্যাঙ্গেলের অভিযান প্রিয়তা থাকলেও, সকাল সফেদ। সায়া বস্ত্রটি তার চেয়েও বেশি জড়িয়ে ট্র্যাঙ্গেল রহস্যে। সে জলজ কাব্য এমন অপ্রতিরোধ্য। ত্যাগ করা দায়। কিন্তু প্রভাত কালে সর্বসমুক্ষে তাঁকে স্বীকার করবে কে! সে অপরিহার্য। তাই বলে ভেড়ুয়া হই নাকি! ঘেন্না। ঘেন্না। ঘেন্না। ছড়াই।
সায়া একটি উদাহরণ মাত্র। শাস্ত্রে, পুরাণে, একদিন-প্রতিদিনের জীবনে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারী নানা ভাবে দমিত। নারীকে দাপে রাখার, তার মনোবল ভেঙে দুমড়ে দেবার শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার পিতৃতান্ত্রিক সমাজ সৃষ্ট ভাষার রাজনীতি।
যা কিছু প্রিয় অঙ্গ নারীর। যৌন আকর্ষণ যে অঙ্গে, তাকে ঘিরে ভয়-ঘৃণা-হিংসা স্প্রে করো। যৌবনবতী কন্যা। সুস্তনী। আয় ডলে দি। প্রবল নিতম্ব। তন্ কি তাম্বুরা। আয় বাজিয়ে দি। ভ্যাঁপু। গাঁড় মারি।
আর ও ছুঁড়ি কলকল কথা বলে খুব। খুব চুলবুলি। আয় ফলনায় সিগ্রেট গুঁজে ইংরেজি রেকর্ড বাজিয়ে নাচাই। ‘লুক্কুসে রাজভোগ রেখে চুষে চুষে খেতে দিয়েছিল বলে সুবীরদা শেফালীকে একটা বাড়ি করে দিয়েছিল...’ এ সবই পুরুষের বিজয়গাথা। ফলনা, লুক্কুস—মেয়েদের নীচু স্থান। মেয়েদের এমন বিজয়গাথা নেই। পেটিকোট থেকে প্যান্টি... সময় এগিয়েছে। সায়া-পেটিকোটে ঘেন্না। প্যান্টি ঝরঝরে। কিন্তু উল্লাস কই? প্রতিশোধস্পৃহা অবদমনের। নিপীড়নের প্রতিশোধ। তা ঠিক স্ফূর্তি বা উল্লাস নয়। ভাষার রাজনীতিতে, অদৃশ্যমানতা একটা নারীকেন্দ্রিক শক্তিশালী শব্দ। নারীর জীবন গণ্ডিবদ্ধ ছিল, তাই তার অভিজ্ঞতা, লোকায়ত জ্ঞান, নতুন চিন্তা, আবিষ্কার, যৌনতা, বিশ্ব জ্ঞানভাণ্ডারে স্থান পায়নি। সময় পালটাচ্ছে। নারীর এই অদৃশ্যমানতা সর্বপ্রেক্ষিতে আলোচিত হোক নানা ব্যাখ্যায়, নানা মাত্রায়।
ভাষার আগাপাশতলা পালটেছে সায়া থেকে প্যান্টির উত্তরণ পর্বে। দেখার, দেখবার, দেখাবার ধরন পালটেছে। গত শতকে ব্রা খোলামেলা দড়িতে দোল খেলে কী অস্বস্তি, কী অস্বস্তি! যাও, যাও, ওপরে ব্লাউজ মেলো। অন্তর্বাস ওভাবে মেলতে নেই। সে অবস্থা পালটালো চোলি কাট্ ইনন্। টপলেস জলচল। ভাষাও দুরমুশ হয়ে গেছে। নতুন তরফের মেয়েরা তোড়ে ব্যবহার করছে খিস্তি, স্ল্যাং। তারা বিষয় নয়, বিষয়ী হতে চায়। কবিতায়, গদ্যে সাহসী, প্রতিবাদী। সিনেমা, নাটকেও চলে এসেছে আড়ভাঙা ডায়লগ। তাদেরকে ঠেকাতে কখনও ঐতিহ্যের বৈদিক পাঠ। কখনও নানা রকম আইনি গেরোর সহজপাঠ। আইনের পাড়াতুতো পাঠ—লোকাল কমিটি। খাপ পঞ্চায়েত। কর্পোরেট পৃথিবীর থাবার তলায় সব অর্থেই বিরাট সংখ্যক জনগোষ্ঠী দলিত। নারী। যে-কোনো বর্ণের নারীও তো দলিত। পায়ের নীচে থাকাই তার ভবিতব্য। প্রতিষ্ঠানে, রাজনীতিতে দূরস্থান, পরিবারে, সমাজে তার মাথা তোলা বারণ। ‘বেটি মোড়ল/মিনস্যা গাঁড়োইল’। মানে, মেয়ে সংসারের মোড়ল হলে, পুরুষ হয় গাধা। ছড়ায়, প্রবাদে, ধর্মগ্রন্থে, সাহিত্যে—মেয়েদের মোড়লিতে নানা ভাবে বাধা বিরোধিতা। এ বাধা ভাঙা সহজ নয়।
৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবসে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নারীরা বলবেন। আন্তর্জাতিক। প্রাদেশিক। নাগরিক। আঞ্চলিক। গ্রামীণ। নিম্নবর্গ। কণ্ঠে কতটা ছাড়! কতটা আটকাট! উক্ষীবীক্ষি। আটকাট কথাগুলো বলার জন্য। রাগ। দুঃখ। হতাশা। অভাব-টভাব। কেন্দ্রের। রাজ্যের। সংসারের। প্রভুর। মালিকের। ভাতারের। সব ঠিকঠাক বলতে পারবে কি? ভাষা-টাষা ঠিক থাকবে তো? এডিট হয়ে যাবে হয়তো। কিন্তু নিজেদের ঠিকঠাক কথা স্ল্যাং ছাড়া বলা যায় না যে! বলা যাবে না কেন!। হইচই চ্যানেলে অবাধ স্ল্যাং। লিপস্টিক মাখা ঠোঁটে, রাখঢাকহীন ইংরেজি ফাক্। সে সব তো অডিয়ো-ভিডিয়ো টিউব চ্যানেলে থেকে যাচ্ছে। আজ অন্য কথা হোক।
আজ। পুকুর পাড়ে বাসন ভিজিয়ে, জলে পা ডুবিয়ে, তুলে আনি প্রাণীদের সেই গত শতাব্দীর নমকিন্ পরচর্চাগুলো।
কেন? ভাটি বয়সের ভীমরতি?
হ্যাঁ রতি, নারী-পুরুষ সকলেরই ভীম। আগুন আর মাটিতে যাওয়ার আগে অবধি।
তো থাক। হারিয়ে যাওয়ার আগে। ভুলে যাওয়ার আগে। বয়স্থা মেয়েদের চাকা চাকা তীব্র ছাতিমগন্ধ আলাপগুলো থাক।
আলো-আঁধারি কৈশোরে কত যে মায়া গাছ। মায়া মাছ। মায়া নদী। তার পাশাপাশি তুমুল। চুটকি। ছিলকা। নিষিদ্ধতার আমোদ। ‘নড়ে ঘণ্টা পড়ে না’। ‘আদেকলার হলে ব্যাটা নাড়ি কাটতে চাট কাটা’। দুটি বহুল প্রচলিত বুলি। ছুটিদি ‘নড়ে ঘণ্টা...’ টা উইথ অ্যাকশন, হাত নাড়িয়ে, ঘণ্টা দোলার অ্যাকশন দেখিয়ে বলত। নাড়ি কাটতে গিয়ে চাট, নুঙ্কু কেটে গেলে বাঁচে? এই সব কার্যকারণ বেরসিকতা শুনে খুবই রেগে যেত ছুটিদি। তো ছুটিদির বিয়ে হল। বিয়ে দেখতে কী ভালো, কী ভালো! সেখানে, সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ক্রিয়াটি কী?
ওই কুসুমডিঙা। কুসুমডিঙাই তো বলে—সেই যে কনের পেছনে বর দাঁড়িয়ে, অগ্নিতে খই নিরঞ্জন। সেই প্রথম বরকনের সমস্ত শরীর পরশের শিহরণ!
সে সব সামান্য ইঙ্গিতে — হাসি পাঞ্চ করে বোঝানো যায়। আর ফুলশয্যা?
ফুলশয্যার দগদগে কাহিনিটি আমি শুনেছি চাকুরি ক্ষেত্রে। সিনিয়র স্টাফ ইরাদি, অন্য বন্ধু মঞ্জু, গীতার দিকে তাকিয়ে হেসে হেসেই বলেন, “বিয়ে তো হল বুড়ো বয়সে, তিরিশ পেরিয়ে... রসকষ শুকিয়ে কাঠ... তো ভরসা সেই বোরোলীন..”
ঘরে আমরা আছি—চোখ নামিয়ে, বইয়ে মুখ গুঁজি। বোরোলীন শুকনো শরীর ভেজায়—ক্রিম হবে যৌনলীলার আনন্দ—এইসব জ্ঞানগম্যি। শিউলির বিয়ের কথা চলছে। লম্বা ফিগার, সুশ্রী। বুক-টুক কম। স্কুলের জামাইবাবুদের প্রিয় শালি। তারা হেসে হেসে সমাধান দেয়—“ভেবো না। ও দাদাবাবু মালিশ করে ঠিক করে দেবে।”
মঞ্জুদির একটা চুটকি—‘প্রথম পোয়াতি চুষতে/দ্বিতীয় পোয়াতি চুদতে...’ প্রথম গর্ভধারণে স্তনস্ফীতি—ডলতে মজা। দ্বিতীয় পোয়াতির যোনি সড়োগড়ো — সংগমে মজা।
মীনু কেন ওই সমীরবাবুকে অত পাত্তা দেয়? “বর ছেড়েছে। চোদন খাবে কোথায়। সমীর চোদন দেয় যে—” শান্তশিষ্ট অধ্যাপিকার মুখে এই ভাষ্য শুনে খারাপই লেগেছিল। ওই গালাগালটা শুনিনি তখনও। পরে, দেখি এ তো জলচল।
পুব বাংলার খোলা মুখ। শুনেছি বিচি শয়তান বা বিচি পাকা ছেলে। রান্না ভালো না হলে বাবা বলতেন—‘বালের রান্না’। এই বালের রান্না একনাগাড়ে শুনেছি ছোড়দির মুখে। কিডনি ফেইলিওর। বাড়ি, হাসপাতাল চলছে। নানারকম খাবার খেতে চাইছে। ঝাল-মশলা খাওয়া বারণ। দিলেও খাবার ক্ষমতা নেই। থুঃ থুঃ করে খাবার ফেলে বলছে—“কী আনিস্ এ সব বাল-ছাল, গু-গোবর। একটু খারমান পাতা বাটা আর ট্যাংরার ঝাল আনতে পারে না আমার বুড়া মরদ। তোরা পারিস্ না। আনবি না এসব বালের রান্না...”
শেরবাদিয়া হাওয়া কী একটা টক-ঝাল ছিলকা শুনিয়ে গেল ছোড়দির কানে:
“মাছ খাবা ট্যাংরা
ভাতার লিব্যা চ্যাংড়া।”
সেই ছিলকা শুনে চিরঘুমের আগে কেমন চনমনে হয়ে উঠছে ছোড়দির মুখ। ট্যাংরা মাছ আর চ্যাংড়া পাবার হাউশে কেমন কামরাঙা মুখ। অগ্নিশিখা খানিক আনত। নারীর দীপ্তিময় কামনার কাছে। “ও জীবন রে—জীবন, ছাড়িয়া না যাস মোরে...”
প্রাসঙ্গিক লেখা কিন্তু কিছুটা চলার পর কেমন জানি হারিয়ে গেল , কিছু শব্দ উল্ল্যেখ ই যেন মুখ্য হয়ে গেল আসল বক্তব্য হারিয়ে গেল ..
গাঁড়োইল কথাটি বোধকরি সংস্কৃত শব্দ গড্ডল হতে উদ্ভূত। গড্ডল শব্দের অর্থ ভেড়া, গাধা নয়।
এই লেখাটা কি অন্য কোনও বড় লেখা বা বই থেকে তোলা? কেমন আধ খামচা করে তোলা হয়েছে।
খুবই বিক্ষিপ্ত ও দুর্বল লেখা, নারীর নিষ্পেষণ মানেই চোষন আর চোদন?
"ও জীবন রে" মোটেই ভাওয়াইয়া গান নয়, বরং ভাওয়াইয়া সুরে দেহতত্ত্বের গান।
প্রাসঙ্গিক লেখা। হাল্কা কথায় গভীর চলন। পাঠক কে বিটুইন দ্য লাইনস পড়তে হবে তবেই এই লেখার মর্মার্থ বোঝা যাবে।
সপাট তৃপ্তিদির মতই। দুরন্ত লেখা