সুউচ্চ বিশাল মঞ্চ থেকে নেতার ভাষণ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে, প্রবল পরাক্রম-শীল সেই নেতা তার ভাষণে যত না মধু ঝড়াচ্ছে, বিষ ছড়াচ্ছে তার বিশ গুণ। অসামান্য নিকৃষ্ট ভাষার প্রয়োগ তার হাতে থাকা মাইক্রোফোনের মধ্যেও বিবমিষা জাগিয়ে তুলছে। নেহাতই নেতার হাতে তাই আছে, না হলে সেও যেন ছিটকে বেরিয়ে যেতে চাইছে। রাজনৈতিক নেতাদের এহেন কদর্য আচরণে আমরা এখন আর বিশেষ আশ্চর্য হই না, ঘৃণা বোধও করি না।ঘৃণায় সিক্ত আমাদের রাজনৈতিক ভাবনা এই জাতীয় কু বাক্যবাণে এতটাই অভ্যস্ত যে এরমধ্যে সে আর নতুন কিছু খুঁজে পায়না। এক লেখিকা মেম সাহেব কে একবার গল্প শুনিয়ে আনন্দ দিতে তার এক পরিচিত যুবক বেশ কিছু রদ্দি গল্প নিয়ে হাজির হয়। লেখিকা সেই গল্পগুলো সবকটি শোনে এবং মাঝে মাঝেই খুব হাসত থাকে। তাকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয় এই গল্পগুলি শুনে আপনি কি আদৌ মজা পাচ্ছিলেন, তখন মৃদু হেসে তিনি বলেন, অবশ্যই কিন্তু সেটা মজা নষ্ট হওয়ার মজা। আমাদের অবস্থা এখন অনেকটা এইরকমই টিভির দৌলতে রাজনৈতিক নেতাদের এই বস্তাপচা বক্তব্য শোনার পরেও আমরা নেহাত মজা নষ্ট হওয়ার মজাতেই মজে রয়েছি।
কিন্তু ভাষার এই বে-লাগাম অত্যাচার কিসের জন্য? এর একটা উত্তর হতে পারে রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষমতার লিপ্সা। Utilitarian আবহে ক্ষমতা তাদের কাছে অনেক বেশি আপন, তাই যে ভাবেই হোক, সেই ক্ষমতার শিখরে যাওয়ার রাস্তা প্রশস্ত করতে যেমন প্রতিশ্রুতির ফল্গুধারা ছোটায়, ঠিক তেমনই, যার কারণে ক্ষমতার শীর্ষ কে স্পর্শ করতে এত কষ্ট করতে হয়, সেই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক বিরোধী দলের প্রতি এক রকমের প্রতিশোধমূলক মনোভাব কাজ করে চলে।আমার লক্ষ্যের পথে যে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, আমার ইচ্ছাপূরণের অন্তরায় যে, সে আমার রাগের কারণ হতে বাধ্য। এই রাগই আমাকে প্রতিশোধ মুখি করে তুলতে চায়। প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলে আমার চলার পথ সুগম, আমার দিকে আঙুল তোলার লোক থাকতো না, অথচ এই পথকে কণ্টক আবৃত করে, আমার প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল আমার সাজানো বাগানে কষ্টের আমদানি করেছে। এই কষ্ট লাঘবের মলম হিসাবে প্রতিশোধ মুখী বাক্যবাণ রাজনৈতিক লোকজন কমবেশি ব্যবহার করে থাকে।
শোধ এবং প্রতিশোধের মধ্যে গঠনগত ফারাক চোখে পড়ার মতো। আমার কাছে থেকে যখন কেউ টাকা ধার নেয়, তখন কোন না কোন সময়ে তাকে সেই টাকা শোধ করতে হয়। এই শোধের মাধ্যমে সে একরকম সাম্য স্থাপনের চেষ্টা করে। টাকা ধার দেওয়ার পর থেকে তা ফেরত পাওয়ার জন্য আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকি। সেই দিক থেকে শোধ এক রকমের নৈতিক সমতা নিয়ে আসে। শোধ করা যেমন কর্তব্য, তেমনি পরিশোধের চিন্তা করাও কোন অন্যায় কাজ নয়।
একটি ভাল কাজের প্রতিদানে আর একটি ভালো কাজ করার তাগিদের মধ্যে যেমন কোন বিরোধাভাস নেই, তেমনই একটি ভালো রাজনৈতিক বক্তব্যের মাধ্যমে, ভালো কথার মাধ্যমে, বিরোধী রাজনৈতিক মত কিংবা অভিযোগগুলি খণ্ডন করা এক রকমের রাজ’নৈতিক’ কর্তব্যের মধ্যে পরে। কিন্তু প্রতিশোধ কথাটির মধ্যে জন্মগত ভাবেই লুকিয়ে থাকে ‘যে কাজ করা উচিত নয়’ তার সুবাস। প্রতিদানের মতন কোন স্পৃহা যদি প্রতিশোধে জাগ্রত হয়, খারাপ কথা বলার পৃষ্ঠে যদি আরেকটি খারাপ কথা বলার ইচ্ছা মনে চলে আসে, তবে অবশ্যই তারমধ্যে বিরোধাভাস থেকে যায়। এই ধরনের কথা বলার পিছনে এক ধরনের যুক্তি দেওয়া হয় যা শুনলে মনে হয় যেন বক্তা নিজে কথা বা প্রতিশোধের রসনায় ঠিক সিক্ত নয়, কেবলমাত্র বিপরীত দিক থেকে তার গায়ে গরল এসে পড়ায় তার এই রূপ ধারণ। আমরা অনেককেই বলতে শুনি ‘আমি এ ধরনের খারাপ কথা বলি না নেহাত ও বলল তাই তার জবাবে…’ অর্থাৎ আমি আমার কথাটি কে খারাপ বলেই জানি এবং আমি এটাও জানি যে এইরকম খারাপ কথা যখন আমার দিকে এসেছিল আমি আহত, ব্যথিত হয়েছিলাম। আমার প্রতি আমি যে আচরণ প্রত্যাশা করি না, আমার ও সেই আচরণ অন্যের প্রতি করা উচিত নয়, যদিও প্রবৃত্তি আমায় এর বিপরীতেই নিয়ে যেতে চাইবে।
ন তৎ পরস্য সংদধ্যাৎ প্রতিকূলং যদাত্মন:।
এষ সংক্ষেপতো ধর্ম: কামাদন্য: প্রবর্ততে।।
মহাভারত অনুশাসন পর্ব ১১৩/ ৮
কিন্তু এরপরেও এই জাতীয় প্রতিশোধমূলক কাজ, ভাষা কুকথা চলতেই থাকে। আমরা প্রতিশোধের খেলায় মত্ত হয়ে , এক রকমের শোধের আঙ্গিকেই সমতা প্রতিষ্ঠা করতে চাই। আমার দেয় টাকা ফেরত পেলে যে ধরণের সমতা প্রতিষ্ঠা হয়, তাতে দাতা ও গ্রহীতা দুজনেই একই জায়গায় চলে আসে। দানের ফলে যে বৈষম্য তৈরি হয়েছিল পরিশোধ সেই বৈষম্যকে মিটিয়ে দুজনকে পূর্ববর্তী অবস্থানে প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু আমার দিকে ধেয়ে আসা কুকথার তীরের বিপরীতে আমি যখন কুকথার কামান দাগি, তখন দুজনেই আহত হই। পূর্ব অবস্থান থেকে নিচের একটি অবস্থানে পতিত হই। কার আঘাত কতটা, এটা মাপার কোন সহজ উপায় না থাকলেও মনে মনে আমরা এই ভেবেই আনন্দ পাই যে (নিচে হলেও), এক ধরনের সমতা বিধান আমি করতে পেরেছি, হতেই পারে তার জন্য দুজনেই দুজনের প্রকৃত অবস্থান থেকে বিচ্যুত হয়েছি।
নেতারা তাদের ইচ্ছাপূরণ করার জন্য আমাদের দিকে যে ভাষণ ছুঁড়ে থাকে তা কি আমাদের কতোটা সমৃদ্ধ করে জানিনা, তবে ভাষণের বিশেষ বিশেষ অংশে দর্শকদের দিক থেকে যে করতালির ধ্বনি শোনা যায় তা কিন্তু অনেক প্রশ্ন তুলে দেয়। নেতার মুখদিয়ে কুকথার শ্রোত নির্গত হলে দর্শক কখনোই সংঘবদ্ধভাবে প্রতিবাদ করে না। বলে না আপনার ভাষা সংযত করুন, আমরা সকলেই সহনাগরিক বরং কুকথার তীব্রতা যত পারে বারে করতালি উচ্চমার্গে চলে যেতে থাকে। দর্শকের দিক থেকে বিচার করলে দর্শক এই আচরণ পিছনে কিছু কারণ থেকে যায়। দর্শক, শ্রোতা ,আমরা হলাম ছাপোষা মানুষ। রাজা হওয়ার বা রাজা বধ করার সরাসরি কোন ক্ষমতা আমাদের মধ্যে থাকে না কিন্তু তাই বলে এক রকমের চাপা ইচ্ছা যে তুষের আগুনের মতন জ্বলতে থাকে না একথা বলা যায় না। যে নেতা কে আমি আমার প্রতিভূ রূপে দেখতে চাই, তার ক্ষমতায়নের মাধ্যমে আমি ছদ্মবেশে একরকম রাজার আসনে বসে পড়ি। যাকে বধ করা আমার সাধ্যের বাইরে নেতার মুখের কথা দিয়ে আমি তাকে বধ করে ঐ সিংহাসনে বসে পরার এক তুরীয় আনন্দ লাভ করে থাকি। কিন্তু এর জন্যে কুকথা কে আশ্রয় করি কেন?বিশেষজ্ঞদের মতে এর পিছনে রয়েছে এক রকমের অসহায়তা এবং অজ্ঞানতা। প্রকৃত রাজনৈতিক ভাষণ চিন্তা, মত, কোন কিছুরই খুব দ্রুত নিষ্পত্তি করতে পারে না। আমরা যদি কোন দেশের মানুষের রাজনৈতিক চিন্তার বিবর্তন দেখি, তবে দেখব সেই বিবর্তন কখনোই রাতারাতি হয়নি। বিবর্তন কখন হবে, কিভাবে হব্ বা আদৌ হবে কিনা হলেও তার কোনও সুফল সে পাবে কিনা, এই বিষয় নিয়ে সাধারণ মানুষের কোন নির্দিষ্ট ধারনা থাকে না। নিজেদের মতামত, মতবাদ আদর্শ (হতেই পারে সে আদর্শে কখনোই পৌঁছানো সম্ভব নয়) ক্রমাগত লোকের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ একটি মন্থর গতির প্রক্রিয়া। একটি বড় লরি রাস্তার মোড়ে বাঁক নিতে সময় নেয়, অথচ একজন সাইকেল আরোহী সেই বাঁক অতি সহজে বাঁক নিতে পারে। ঠিক একইভাবে অনেককে নিয়ে কোন মতবাদ গড়ে তুলতে গেলে যে সময়ে লাগে, তার চেয়ে কোন নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে কোন সংস্থা বা কার্যপ্রণালীর উপর বিশ্বাস না রেখে, কেবল ব্যক্তিগত মুন্সিয়ানার উপরে ভরসা করে বৈতরণী পার করতে গিয়ে এক রকমের অনৈতিক কাজ আমরা করে থাকি। উত্তেজক ভাষণ এই কাজ করে। বক্তা হিসাবে নেতা যা বলতে চায়, আর শ্রোতা হিসেবে আমরা যা শুনতে চাই, এই দুইয়ের মধ্যে এক রকমের যোগাযোগ, দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে পরে। মনমতো ফল চটজলদি পেতে হলে নিয়মনিষ্ঠার চেয়েও প্রবৃত্তি নির্ভর হওয়া সহজ পথের হদিশ দেয়।
কুকথার মধ্যে এক রকমের উত্তেজক ভাব থাকে, কিন্তু তার থেকেও উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি তার সহজিয়া ভাব।যা সহজ তা মনে থাকেও অনায়াসে। কিন্তু মনে থাকলেই তো আর সে কথা বলতে হবে এমন কোনও কথা নেই। কুকথা বা গালাগালি মুখে আসার একটি অন্যতম কারণ ‘sensory metaphor’। কুকথার সাহায্যে আমরা এমন কিছু শব্দ তুলে আনতে সক্ষম হই, যার বাস্তবে অস্তিত্ব নেই, কিন্তু প্রতিশোধ নিতে চাওয়া এক মনের সাপেক্ষে সে বিদ্যমান। একজন মানুষকে দেখে যদি আমি তাকে ‘বরাহনন্দন’ এই শব্দে আখ্যায়িত করি, তা কখনই কোনও বাস্তব পরিস্থিতির কথা বলে না, অথচ তাকে নীচ দেখানোর এর চেয়ে ‘সহজ’ পদ্ধতি আর কিইবা হতে পারে। কোনও মানুষের কাছে একই সঙ্গে কিছু কেতাবি শব্দ আর কিছু কুকথার তালিকা এক সঙ্গে দিলে, পরীক্ষায় দেখা গেছে মানুষের মধ্যে কিছু সময় পরেও ঐ কুকথা গুলি শতকরা হিসেবে বেশী মনে থেকে যায়।
প্রতিশোধের ক্রোধে মানুষের চিন্তা লোপ পায়, বিচক্ষণতা উবে যায়, তাই বাদ বিচার না করে হাতের সামনে সহজে যে শব্দবন্ধ পরে থাকে তা দিয়েই বিপক্ষকে প্রবল আঘাত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। মহাভারতে দ্রৌপদীর নিজের অপমানের প্রতিশোধ যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, কিংবা কয়েক দশক আগে, কোন এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব প্রধান সরকাারি অফিসে তার অপমানের প্রতিশোধ স্বরূপ সেই অফিসেই নিজের প্রবেশের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করে যে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন, সেই প্রতিশধের ‘ট্রাডিশন আজও চলিতেছে’। প্রতিশোধের আগুনে মানুষ অপরকে পোড়াতে গিয়ে নিজেও পুড়ে যায়। সহজ কথা সহজলভ্য বলে তাকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করার সময় আমরাও অত্যন্ত বিচক্ষণ দ্রৌপদীর মতন বলে ফেলি “অন্ধের ছেলে অন্ধই হবে”।ফল কুরুক্ষেত্র।
ভারী বলিষ্ঠ বক্তব্য. ভাল লাগল