দুরন্ত ঘূর্ণির এই লেগেছে পাক / এই দুনিয়া ঘোরে বন-বন-বন-বন / ছন্দে ছন্দে কত রঙ বদলায় … রঙ বদলায় । এই হলও আমাদের চারপাশের চলমান বিশ্ব, ক্রমাগত নানা পরিবর্তন হয়ে চলেছে। কখনো তা গতির মাধ্যমে ধরা দিচ্ছে, কখনো প্রত্যক্ষ করছি ছন্দে ছন্দে রঙের পরিবর্তন, আবার কখনো শব্দের আসা যাওয়া কানে বাজছে। রাত দিন কে, দিন রাতকে অনুসরণ করছে। আমরা যে সমস্ত পরিবর্তন বুঝি বা দেখি তার “গতিরও” রকম ফের আছে। কিছু পরিবর্তন আমরা চকিতে দেখতে পাই যেহেতু তা খুব দ্রুত ঘটে, আবার কিছু পরিবর্তন মন্থর, মনে রেখে চিনতে হয় পরিবর্তনকে। নরেন্দ্র নাথ মিত্রের চা গল্পের নায়ক শুভেন্দু প্রেমিকার হাতের আট বছর আগের চায়ের স্বাদ এখন পায়না, কারন এক প্রকার স্মৃতি তার মধ্যে রয়ে গেছে যা দুটি পরিস্থিতি কে আলাদা করতে পারছে। আমেরিকান দার্শনিক উইলিয়াম জেমস এর কথায় আমরা যতই আমাদের মনকে খালি করার চেষ্টা করিনা কেন প্রতিনিয়ত আমাদের মন কিছু না কিছু দিয়ে ভর্তি হয়েই চলেছে, এ প্রক্রিয়া চলতে থাকে, একে বাদ দেওয়া যায় না। এই প্রক্রিয়া এবং তার ছন্দই আমাদের মধ্যে সময় এর অর্থে ধরা দেয়। শুধু চা গল্পের নায়ক শুভেন্দু নয়, আমরা সবাই এই জাতীয় পরিবর্তনের সাক্ষী। সবাই মনে করতে পারি কি ঘটনা ঘটেছে, যাকে আমরা বলি অতীত।আর এই যে “আমি” যে আমি আমাকে কে চিনতে পারছি সে হল বর্তমান, আর যে সময়ের মুখাপেক্ষী হয়ে আমি বসে থাকি সে হল ভবিষ্যৎ, এটা আমাদের প্রচলিত ধারনা।
সময় নিয়ে প্রথম আলো
পাশ্চাত্যের দর্শন নাকি শুরু হয় বিস্ময় দিয়ে। বহির্জগৎ এর বৈচিত্র তাদের আকৃষ্ট করেছে, আর তাই হয়তো নানাসময় নানাভাবে স্থানকাল কে বুঝতে চেয়েছেন তারা। স্থান ও কাল নিয়ে সক্রেতিস পূর্ব দার্শনিকদের মধ্যে জেনো এবং হেরিক্লিতাসের ভাবনার একটা সাধারণ উপসংহার ছিল এইরকম যে সময় এবং স্থানের মাধ্যমে যে গতির ধারনা গড়ে ওঠে সেটা একটি বিভ্রম ছাড়া আর কিছু না। হেরিক্লিতাসের কাজ কর্ম বই এর আকারে না থাকলেও তার বিভিন্ন উক্তি আমরা পাই অন্যের লেখা বইতে, এবং সেখান থেকেই তার দর্শন জানা জায়। তার অনেক কথার মধ্যে যেটি আত্যন্ত বিখ্যাত সেটি ছিল “তুমি এক নদীতে দুবার পা ডোবাতে পারবে না”, অর্থাৎ তিনি বলতে চাইছেন জগতে পরিবর্তনই একমাত্র স্থায়ী বাকি সব অস্থায়ী। এই যে সময়ের সাথে পরিবর্তনের ফলে শচীন কর্তার গানের মতো “তুমি আর নেই সে তুমি”র ছোঁয়া পাচ্ছি তা কিন্তু একধরনের কালিক দূরত্বর ধারনারই আভাস। যদিও এটা ঠিক যে কালিক দূরত্বের সম্পূর্ণ ধারণা আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদেই পরবর্তীতে পাওয়া যায়।
জেনোর কাল সম্পর্কিত চিন্তা পাওয়া যায় এরিস্টটলের ফিজিক্স বইতে উল্লেখিত চারটি প্যারাডক্সের মধ্যে।প্যারাডক্সগুলির মধ্যে বিখ্যাতটি গ্রীক বীর একিলিস এবং কচ্ছপের মধ্যবর্তী দৌড় সংক্রান্ত বিভ্রান্তির হলেও এখানে তীর বিষয়ক প্যারাডক্সটি ভাবার মতো। কি আছে সেখানে? ধরা যাক, একটা তীর ছোড়া হলো, এটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সামনে এগিয়ে যাবে। এখন কোনো নির্দিষ্ট একটি সময়ে যদি আমরা শুধুমাত্র ঐ মুহুর্তের অবস্থাতে বস্তুর গতি চিন্তা করি, তাহলে আমাদের কাছে মনে হবে তীরটি স্থির আছে, বা শূন্যে ভাসমান অবস্থায় আছে। অর্থাৎ সোজা কথায় আমরা তীরটির একটা স্থির দশা দেখবো। এটা সমস্ত মুহুর্তের জন্যই সত্যি। জেনোর প্রশ্নটা ছিলো , যেকোনো নির্দিষ্ট মুহূর্তে যদি তীরটিকে স্থির দেখায়, এবং সময় যেহেতু এরকম তাৎক্ষণিক মুহূর্তেরই সমষ্টি, তাহলে আমরা বলতে পারি, প্রত্যেক তাৎক্ষণিক মুহূর্তেই তীরটি স্থির থাকবে, অর্থাৎ এটি যেখানে ছিলো সেখানেই থাকবার কথা। তাহলে এটির প্রকৃত দশা হবার কথা গতিহীন, অর্থাৎ আমরা বস্তুর গতি বলতে যেটা বুঝি, সেটা আসলে ভ্রান্তি বা মায়া। এই প্যারাডক্স গুলো কোনও নির্দিষ্ট তত্ব খাড়া না করলেও মানুষ কে চিন্তার রসদ দিয়ে গেছে। বিজ্ঞানে যেমন নিউটন আর আইনস্টাইন দুই ভিন্নধারার পুরধা তেমনি সময়ের দর্শনে দুই প্রান পুরুষ হলেন জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট এবং জন ম্যাকট্যাগার্ট। তাই এই দুজনের তত্ব কে আগে একটু দেখে নিয়ে বাকিদের বিষয়ে আবার কথা হবে।
কান্টঃ দর্শনের নতুন মোড়
১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত “ক্রিটিক অব পিউর রিজন”এর মাধ্যমে দর্শন জগতকে নতুন করে চিন্তার রসদ জুগিয়ে ছিলেন যিনি, তিনিই কিন্তু ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে “ইউনিভার্সাল ন্যাচারাল হিস্ট্রি অ্যান্ড থিওরি অব হেভেন্স” বইতে সৌরজগতে নতুন গ্রহের কথা উল্লেখ করেছিলেন, যদিও মহাকাশে ইউরেনাসের (ওই নতুন গ্রহ) অস্তিত্ব এর ১২৫ বছর পর প্রমাণিত হয়। এই হলেন জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট। সময় বিষয়ে কান্টের ভাবনায় আসার আগে কুশাগ্র বুদ্ধি ও অসাধারণ সজ্ঞার মিশেল এই জার্মান দার্শনিকের দর্শন ভাবনার তিনটি ধাপ কে একটু দেখে নেই। প্রথম ধাপে কান্ট ছিলেন লাইবনিজ এবং ভলফ এর চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত, বুদ্ধিবাদকেই তিনি দর্শন ভাবনায় শ্রেয় মনে করতেন, যতদিন না হিউমের “Essays and Enquiries” বইটি তার ঘুম ভাঙায়। তার কথায় “Hume awoke me from my dogmatic slumbers”। হিউমের অভিজ্ঞতাবাদ তাকে আকৃষ্ট করে, কিন্তু সাথে সাথে তিনি এটাও বোঝেন, যে এর দ্বারা অনেক সমস্যারই সমাধান সম্ভব নয়, এটা ছিল দ্বিতীয় ধাপ। তৃতীয় ধাপ শুরু ১৭৭০ সালে, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার ফাঁকে নিজের মৌলিক চিন্তাকে কাজে লাগিয়ে সমস্যা গুলির সমাধান করতে চান। জন্ম নেয় “সবিচারবাদ”(Critical Philosophy)। তার বিখ্যাত বই গুলি -যার মধ্যে অন্যতম “ক্রিটিক অব পিউর রিজন” -এই সময়েই তিনি লেখেন।
নিউটন ও লাইবনিজের সীমাবদ্ধতা
ক্রিটিক অব পিউর রিজনে কান্ট কালের স্বরূপ নিয়ে আলোচনা করেছেন। কান্টের আগে কাল সম্পর্কিত দুটি মত প্রচলিত ছিল, একটি নিউটনের মতবাদ অন্যটি লাইবনিজের। নিউটনের চিন্তায় সময় বা কাল বাস্তব বস্তু, এবং তা অনন্ত(এমন কি স্থানও)। কিন্তু মুশকিল হলো কোনও বস্তুকে বাস্তব হতে হলে তাকে কালে অবস্থান করতে হয়। তাহলে কালকেও তো বাস্তব হওয়ার জন্য কালে অবস্থান করতে হবে। কিন্তু কাল আবার কিভাবে কালে অবস্থান করে?অন্যদিকে স্থান কাল অনন্ত হলে ঈশ্বরও স্থান কালাতীত নয়। এটা মানা সম্ভব কি?ঈশ্বরকে তো অতীন্দ্রিয় হতেই হবে। ফলত এই মত মানা সম্ভব ছিলনা।
অন্য দিকে লাইবনিজের রিলেশনিজম বলছে স্থান আসলে চারপাশের বস্তুর মধ্যে সম্পর্কের একটি ক্ষেত্র, আর বস্তুগুলো যে ঘটনা ঘটায় তার মধ্যের সম্পর্কের একটি ক্ষেত্র হল সময়। লাইবনিজের মতে যেহেতু সময় বস্তু নয়, বস্তুর মধ্যেকার সম্পর্ক, তাই এর উৎস “অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণা”। কিন্তু এখানেও এক সমস্যা। অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণা কে স্বীকার করার অর্থ “পূর্বতঃসিদ্ধি”(priori) কে অস্বীকার করা। পূর্বতঃসিদ্ধি কথাটি ঠিক কি বোঝায়? সহজে বলতে গেলে কোনো বিষয় সম্পর্কে কোনো বিবৃতিকে পূর্বতঃসিদ্ধি বলার অর্থ,বিবৃতিটির অর্থ বুঝতে কোনও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয় না, ভাষাটিই যথেষ্ট। যেমন ৩+৪ = ৭, এই লেখাটির সত্যতা অভিজ্ঞতা নিরপেক্ষ। তাই এটি পূর্বতঃসিদ্ধি। স্থান ও কাল সম্পর্কে বলতে গিয়ে পূর্বতঃসিদ্ধি কে অস্বীকার করার অর্থ ইউক্লিডের জ্যামিতিকেও প্রশ্ন চিহ্নের মুখে ফেলে দেওয়া, কারন এই জ্যামিতি দাড়িয়ে আছে অনেক “পূর্বতঃসিদ্ধি”র উপর।
কান্টের অতীন্দ্রিয় সময়
এই জাতীয় সমস্যা কে পাশকাটাতে কান্ট এই দুই মতকেই বাদ দিলেন। এখানে বলে রাখা ভালো যে “ক্রিটিক অব পিউর রিজন” কান্টের মহান সৃষ্টি হলেও তা মোটেও সহজ নয়।সঙ্গত কারনেই বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং তার বিখ্যাত বই “ A Brief History of Time” এ কান্টের কাজ কে মহান বলার সঙ্গে অতি দুর্বোধ্য বলতেও পিছপা হননি। “ক্রিটিক অব পিউর রিজন” এর দি ট্রান্সেনডেন্টাল এস্থেটিকের শেষ ভাগে এক্সপোজিসন অফ স্পেস অ্যান্ড টাইম এর এক জায়গায় তিনি বলছেন, যদি জিজ্ঞাসা করা হয় সময় কি বাস্তব? কেউই এর সরল উত্তর দেবেনা, বরং তারা বলবে এটি অনুভূতিগতভাবে বাস্তব এবং অতীন্দ্রিয়ভাবে অবাস্তব ... যেহেতু আমি বলেছি যে এটি অনুভূতিগতভাবে বাস্তব, তাই কেউ ভাবেন না যে সময় বস্তুনিষ্ঠ নয়, সময় বস্তুনিষ্ঠ তবে কেবল মাত্র একটি বস্তুকে জানার সাপেক্ষে ” (“if you ask is time real? nobody should give a straight answer, they should say it is empirically real and transcendentally unreal…just because I said it is empirically real, one should not think that time is not objective. Time is objective but only with respect to a knowing subject..”)। কালের ব্যাখ্যায় কান্ট ঐন্দ্রিক জগত আর আতীন্দ্রিয় জগতের সাপেক্ষে পৃথক ধারণার অবতারণা করেন। এটাই কাল সম্পর্কে কান্টের মূল কথা। তার ভাবনায় স্থান বা সময় কেউই কোনও "অভিজ্ঞতার ধারণা" নয়, বরং এটি একটি বিশুদ্ধ অন্তর্দৃষ্টি। কিন্তু “বিশুদ্ধ” বলতে এখানে কি বোঝানো হচ্ছে? অল্প কথায় বলতে গেলে যার মধ্যে এমন কিছু নেই যা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে পেতে হবে তাই “বিশুদ্ধ”। ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে কোনও জ্ঞান এলে তা অবশ্যই কোনও "অভিজ্ঞতার ধারণা", ফলত তাকে বিশুদ্ধ বলা যায় না।
এখন স্থান ও কাল কথাটা একসাথে উচ্চারণ একসাথে হলেও এদের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। একাধিক বস্তু “এক মুহূর্তে” পাশাপাশি থাকতে পারে। এই যেমন একই সময় বহু লোক মিছিলে পাশাপাশি হাঁটে। কিন্তু একটি স্থানে সময়ের রেখায় পাশাপাশির (simultaneous) কোনও স্থান নেই, সেখানে সবই আগে পরে (successive)। পাশাপাশি(simultaneous) ঘটনা ঘটলে তাদের স্থান আলাদা হতে বাধ্য কারন কাল একরকম একমাত্রা বিশিষ্ট। এই ক্ষেত্রে একটা মনে হতে পারে , এই যে আমরা পরপর সমস্ত ঘটনা দেখি এর থেকেই তো কালের ধারনা আসে বা বলা ভাল এই অভিজ্ঞতাই আমাদের কালের ধারনা দেয়। সহজ কথায় এটা মনে হলেও কান্টের ব্যখ্যা ছিল ভিন্ন। তার মতে জ্ঞান রূপে কালের ধারণা আগে থেকেই আছে। তাই সে পূর্বতঃসিদ্ধ। এই পূর্বতঃসিদ্ধ অন্তর্নিহিত বোধের রূপ, সংশ্লেষের দ্বারা বাহ্যিক জ্ঞানের রূপ হয়। তাই সময় সমস্ত উপস্থিতির একটা প্রাথমিক অবস্থা আর সমস্ত উপস্থিতির একটি প্রাকৃতিক শর্ত। কান্টের কথায় সমস্ত বাহ্যিক অন্তর্দৃষ্টিগুলির খাঁটি রূপ হিসাবে দেশ বা স্থান কেবলমাত্র বাইরের স্বীকৃতিতে সীমাবদ্ধ। তাই যখন আমরা আমাদের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ অবস্থা গুলি সময়ের সাপেক্ষে অনুভব করি, তখনই বাইরের জগৎ কে স্থান এবং সময় উভয়ের সাপেক্ষে বুঝতে পারি।
এখন মনে হতে পারে কোনও অভিজ্ঞতা ছাড়া কি ভাবে পূর্বতঃসিদ্ধ সংশ্লেসক জ্ঞান পাওয়া যায়? এই আলোচনায় আসার আগে দেখা উচিৎ পূর্বতঃসিদ্ধ সংশ্লেসক কাকে বলে? আমরা আগেই বলেছি “৩+৪=৭, এই লেখাটির সত্যতা অভিজ্ঞতা নিরপেক্ষ তাই এটি পূর্বতঃসিদ্ধ”। কিন্তু এখানে “৩+৪” শুধু এইটুকুর মধ্যে ৭ এর ধারণা কোথাও নেই। দর্শনের ভাষায় বিধেয়পদের ধারনা উদ্দেশ্যপদে নেই। এটা হলেই বাক্যটি সংশ্লেষক, না হলে বিশ্লেষক। কান্টের আগে দার্শনিকদের মত ছিলো, বাক্য বিশ্লেষক হলে তা অবশ্যই পূর্বতঃসিদ্ধ আর সংশ্লেষক হলে তা পরতঃসাধ্য। কান্টের আপত্তি এখানেই। যুক্তির সাহায্যে কান্ট দেখান যে, আমাদের জ্ঞানশক্তিতে স্থান ও কাল দুটি পূর্বতঃসিদ্ধ আকার আছে বলেই পূর্বতঃসিদ্ধ সংশ্লেষক জ্ঞান আমরা লাভ করি। স্থান ও কাল কে বাদ দিয়ে কিছুই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হতে পারে না। স্থান ও কাল ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে বস্তুকে জানার শর্ত, কিন্তু অতীন্দ্রিয় জগতে এরা অবাস্তব।
স্ববিরোধীতা পিছু ছাড়ল না
কালের এই রূপের কথা বলতে গিয়ে কান্ট এক এন্টিনমি উপস্থিত করেন। সহজ কথায় অ্যান্টিনোমি হ'ল একটি প্যারাডক্স যা সঠিক যুক্তি ব্যবহার করে একটি অসম্ভব সিদ্ধান্তে চলে আসে। যেমন আমি যদি লিখি “ এই বাক্যটি মিথ্যা” বা “চরম সত্য বলে কিছু হয় না” তাহলে প্রশ্ন আসবে আমি কি কিছু ভুল লিখলাম? উত্তর অবশ্যই না, কিন্তু বাক্য গুলো একধরনের হতবুদ্ধিকর পরিস্থিতির মধ্যে এনে ফেলেছে। ক্রিটিক অফ পিওর রিজিন এ কান্ট চার রকমের অ্যান্টিনোমির প্রস্তাব করেছেন, যদিও এখানে প্রথম প্রস্তাবটিই প্রাসঙ্গিক।কি আছে সেই প্রস্তাবে? থিসিস হিসেবে বলা হচ্ছে মহাবিশ্বের এবং সময় দুইয়েরই একটা সূচনা আছে এবং মহাবিশ্ব সসীম।বেশ,তাহলে মানতে হয় মহাবিশ্বর সূচনার আগে সময় ছিলনা। সময় না থাকলে মহাবিশ্ব গঠনের পক্ষে কোনও কারন থাকেনা। কিন্তু কারন ছাড়া তো কিছুই হতে পারেনা, তা হলে মহাবিশ্বের সূচনা কি করে হলো? আন্যদিকে এর অ্যান্টিথিসিস বলছে মহাবিশ্বের এবং সময়ের কোনও সূচনা নেই, মহাবিশ্ব অসীম। যদি তাই হয় তাহলে তো যে কোনও মুহূর্তের পিছনে অনন্ত মুহূর্ত আছে। কিন্তু সংজ্ঞা বলছে, অনন্ত "ক্রমাগত সংশ্লেষ" দ্বারা সম্পূর্ণ করা যায় না। তাই সূচনাহীন মহাবিশ্বও সম্ভব নয়। স্থান ও কালকে জ্ঞানের আকার ছাড়া বস্তু বা বস্তুধর্ম মনে করলে এই জাতীয় স্ববিরোধীতা চলে আসে।
এই সমস্ত ব্যাখ্যার ফলে কান্ট একটি বিষয়কে তুলে ধরতে সমর্থ হন যে কালের সংস্পর্শে না আসা বস্তুর স্বরূপই হলও বস্তুর প্রকৃত রূপ।আমরা যা দেখি তা স্থান ও কালের চশমাদিয়ে দেখা একটা উদ্ভূত(derived)রূপ মাত্র।ফলে বস্তুর স্বরূপ আমাদের কাছে অজ্ঞাত। একই সাথে ঈশ্বরকেও অতিন্দ্রীয় স্থানে বসাতে আর কোনও আসুবিধা থাকল না। ফলে অধিবিদ্যক এবং ধর্মতত্ত্ব উভয়েই রক্ষা পেলো।
দারুণ লাগল পড়ে। আমার পরবর্তী লেখার ক্ষেত্রে কাজে আসবে। বাকি পর্ব গুলো পাওয়ার অপেক্ষায় আছি।
কিছু বানান পরিবর্তন করলে ভাল হয়। যেমন- কারণ (কারন নয়) , স্ববিরোধিতা (স্ববিরোধীতা নয়) । এই আর কি।
বাহ, সঙ্গরোধের দিনগুলোতে ভিন্ন স্বাদের লেখা পড়তে ভালো লাগছে।
পিনাকীদার গুরুতর সময় ভাবনা কলেজ জীবনের দর্শণের ক্লাসে নিয়ে যাচ্ছে আবার।
অনেকদিন পর হিউম, কান্ট স্পর্শ হলো। উড়ুক
আমার বিনীত প্রশ্নঃ
১ আ প্রায়োরি ট্রুথ বা পূর্বতঃসিদ্ধ জ্ঞান একটি নির্দিষ্ট স্থান এবং কালবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আমার জন্যে অভিজ্ঞতা -পূর্ব জ্ঞান হতে পারে , কিন্তু অন্য একটি স্থানবিন্দু বা কালবিন্দুতে অবস্থিত ব্যক্তির জন্যে তা অভিজ্ঞতার বিষয় হতে পারে ।
ধরুন, আমি আগে মদের ব্যাপারে কিছু জানতাম না, ঘটনাচক্রে খেয়ে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বুঝলাম ওটা কি জিনিস। সেটা আমি ছেলেকে বলে দিলাম । তাহলে তার কাছে মদের গুণাগুণ আ প্রায়োরি হল, আমার কাছে হলনা। বলতে চাইছি এটা সাপেক্ষ ব্যাপার, কোন চরম অপরিবর্তনীয় গুণ নয় । ভুল বকলে নির্দ্বিধায় ধরিয়ে দেবেন।
২ কান্ট অবজেক্টিভ ট্রুথ (থিং ইন ইটসেলফ) এবং সেইসঙ্গে ঈশ্বরকেও "আননোয়েবল" বা সঠিক ভাবে জানা সম্ভব নয় বলে অধিবিদ্যা এবং বস্তুবাদ দুটোরই মানরক্ষার বদলেএকটু চিমটি কেটে দিলেন না ?
শ্রদ্ধেয় রঞ্জন বাবু,
আপনার প্রশ্ন দুটি ভুল নয়। আমরা যখন জ্যামিতি করতাম স্কুলে তখন অক্সিয়াম বা স্বতঃসিদ্ধর সাথে পরিচিত হই। এটাও সেই রকমই । আর দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর এর জন্য আপনাকে আর একটু অপেক্ষা করতে হবে। বিজ্ঞানে ও এই "আননোয়েবল" বা অ্যাটেম্পোরালের মজাটা আছে।
অনেক ধন্যবাদ, পিনাকী,
আগ্রহের সঙ্গে পড়ছি আপনার লেখা। কঠিন বিষয় এমন ভাবে লিখছেন যে কোন তারিফই কম নয় ।
অনুরোধ, আমাকে "শ্রদ্ধেয়" না বোলে প্লীজ রঞ্জন বা রঞ্জনদা বলুন, আড্ডা দিতে স্বচ্ছন্দ বোধ করব।
লেখাটা বেশ ইন্টারেস্টিং। তবে একটা জায়গায় ভাষান্তরে গোলমাল হয়েছে মনে হয়।
'but only with respect to a knowing subject' এর ভাষান্তর 'কেবল মাত্র একটি জ্ঞাত বস্তুর সাপেক্ষে' নয়।
জ্ঞাত বস্তুু মানে known object।
knowing subject মানে জানতে চাওয়ার ক্রিয়াটা সংঘটিত হচ্ছে যে সক্রিয় কর্তার দ্বারা, সেই বিষয়ী।
তুলনা নেই। জট ছড়িয়ে সহজ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন দর্শনের কঠিন ও জটিল বিষয়টি। অনেক ধন্যবাদ, চলতে থাকুক।