১৯১৫ সালে অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের যুগান্তকারী আবিষ্কার সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ বিজ্ঞানী মহলে হইচই ফেলে দেয়। নিউটনের মহাকর্ষ ভাবনা কে জ্যামিতির সাহায্যে ব্যাখ্যা করে আইনস্টাইন, জন্ম দেন একটি সমীকরণের
Gab+Λgab = kTab
সমীকরণের বামদিক টি একটি জ্যামিতিকে বোঝাচ্ছে, আর ডানদিক ভর বা শক্তিকে, তবে সবটাই টেনসর হিসাবে। সহজ কথায় সমীকরণটি বলে দিচ্ছে কিভাবে মহাবিশ্বে অবস্থিত ভর তার চারপাশের স্থান-কালের জ্যামিতিটা কে পালটাবে। মহাকর্ষ আর বল নয় এখন সে শুধুই জ্যামিতি।কিন্তু কেমন হবে সেই জ্যামিতি? যদি স্থানকালে কোনও বস্তু না থাকে তবে স্থানকাল হবে ১নং চিত্রের মতো সমতল, অনেকটা একটা টানটান করে বাধা কাপড়ের ফালির মতো (যদিও কাপড়ের ফালির তল দ্বিমাত্রিক আর স্থানকাল চার-মাত্রিক তবুও বোঝার সুবিধার জন্য এই উপমা দেওয়া হল)। কিন্তু যখনই ওই স্থানকালে বস্তু চলে আসবে (আগের উপমা অনুসারে কাপড়ের ফালির উপর একটা ইটের টুকরো রেখে দেওয়া হল) বস্তুর চারপাশের জ্যামিতিটা পাল্টে যাবে (২নং চিত্র)। এখন ওই ১নং চিত্রে যদি একাধিক বস্তু পরস্পরের থেকে একটা দূরত্ব বজায় রেখে বাধা হীন অবস্থায় সমান্তরাল ভাবে চলতে শুরু করে তবে তাদের চলার পথ (যাকে জ্যামিতির ভাষায় জিওডেসিক বলে) সমান্তরালই থেকে-যাবে কারণ স্থানকাল সমতল এবং আর কোনও বল বা বাধা (বলা ভালো ক্ষেত্র) সেখানে নেই। কিন্তু ভারি বস্তুর উপস্থিতিতে ওই পথ আর সমান্তরাল থাকে না, বেঁকে যায়, কোথাও গিয়ে যেন তারা মিলিত হতে চাইছে।
কিন্তু এই সমস্ত গতি বা বাঁক বোঝার জন্য সমীকরণের কিছু বাস্তব সমাধান চাই, আর বৈচিত্র্যময় মহাবিশ্বে সমীকরণের সমাধান ও বৈচিত্র্য পূর্ণ হবে সেটাই স্বাভাবিক। যে কোনও গাণিতিক সমীকরণের সমাধান করতে হলে কিছু পূর্ব শর্ত রাখতে হয়। বিভিন্ন পূর্ব শর্তে আইনস্টাইনের সমীকরণের নানা সমাধান আসতে শুরু করল। জার্মান গণিতজ্ঞ কার্ল সোয়াজচাইল্ড প্রথম একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান আনলেন। কিন্তু সেই সমাধানে সিঙ্গুলারিটি চলে আসে। সিঙ্গুলারিটি চলে আসায় স্বয়ং আইনস্টাইন ও সমাধানটি নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু কি এই সিঙ্গুলারিটি? কসমোলজির ভাষায় মহাকর্ষীয় সিঙ্গুলারিটি স্থানকালের এমন একটি অবস্থান যেখানে বক্রতার নাগপাশে পরে মহাকর্ষ ক্ষেত্রটি অসীম হয়ে পরে। যেমন একটি গোলাকার ভর যদি ক্রমশ ছোট হতে থাকে তবে তা এক সময় একটি বিন্দুতে পরিণত হবে। এই জাতীয় নিয়ম ভাঙ্গা আইনস্টাইনের পছন্দ হয়নি। সিঙ্গুলারিটি ছাড়া আইনস্টাইন সমীকরণের সমাধান নির্ণয় বিজ্ঞানীদের কাছে এক আকর্ষণীয় বিষয় হয়ে দাড়ায়।
বিজ্ঞানের অত্যন্ত আলোচিত বিষয় কৃষ্ণগহ্বরের গঠনের সাথে জুড়ে আছে এই সিঙ্গুলারিটি। কৃষ্ণগহ্বর একটি নক্ষত্রের শেষ অবস্থা। সারা জীবন নক্ষত্রের মধ্যে থাকা জ্বালানি একধরণের চাপ সৃষ্টি করে চলে যা ঐ নক্ষত্রেরই অভিকর্ষজ বলের বিরুদ্ধে কাজ করে নক্ষত্রটি কে সুস্থির রাখে। কিন্তু জ্বালানি একসময় শেষ হয়, তখন নক্ষত্রটি নিজের অভিকর্ষজ বলের প্রভাবে চুপসিয়ে যেতে যেতে একটি বিন্দুতে চলে আসে যাকে আমরা বলি সিঙ্গুলারিটি। একটি বিন্দুতে সমস্ত ভর চলে আসায় সেই স্থানের জ্যামিতিক বক্রতা অসীম হয়ে যায় (৩নং চিত্র)। একটি বিন্দুতে সমস্ত ভর চলে এলে তার ঘনত্ব অস্বাভাবিক বেড়ে যায়, তাই স্থানকালের স্বাভাবিক আইন কানুন সেখানে ভেঙে পড়ে এই সিঙ্গুলারিটি কে ঘিরে থাকে একটি অঞ্চল যার শেষ প্রান্তটির নাম ইভেন্ট হরাইজেন, বলা ভালো এখান থেকেই কৃষ্ণগহ্বরের এলাকা শুরুইভেন্ট হরাইজেন কে টপকে একবার কৃষ্ণগহ্বরে ঢুকে পরলে আর বেড়িয়ে আসা সম্ভব নয়। এমন কি আলোও সেখান থেকে বেড়িয়ে আসতে পারে না, তাই তো সে কৃষ্ণগহ্বর। এই বছরের নোবেল প্রাইজ এই গঠন পদ্ধতিকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু এর সাথে “রায়চৌধুরী” সমীকরণের যোগ কোথায়? ইভেন্ট হরাইজেন গঠনের বিষয়ে “রায়চৌধুরী” সমীকরণের কোনও ভূমিকা নেই আছে ঐ সিঙ্গুলারিটিতে।
১৯৫০ এর শুরুর থেকেই অমল কুমার রায়চৌধুরী আইনস্টাইনের সমীকরণের বিভিন্ন সমাধান নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। তার গবেষণার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল কিন্তু আইনস্টাইনের সমীকরণের একটি সিঙ্গুলারিটি মুক্ত সমাধান নির্ণয় করা। তার চিন্তায় মহাবিশ্বের জ্যামিতি সময় নির্ভর। আইনস্টাইনের সমীকরণ সমাধানের জন্য তিনি পূর্ব শর্ত হিসাবে কখনই মহাবিশ্ব কে সমসত্ব (চিত্র ৪) বা সমসারক মনে করেননি, বরং দেখতে চেয়েছেন ঘূর্ণন (spin) এবং অসমসারক (shear) এবং ঐ Λ র সাহায্যে সিঙ্গুলারিটি কে এড়ানো যায় কিনা। সেই সময় তার দুটি পেপার “Arbitrary Concentrations of Matter and the Schwarzschild Singularity” এবং “Condensations in Expanding Cosmologic Models” American Physical Society (APS) তে প্রকাশিত হয়। কিন্তু যে কাজের জন্য তিনি প্রসিদ্ধ সেই কাজটি অর্থাৎ “Relativistic Cosmology” ১৯৫৫ সালে ফিজিক্যাল রিভিউ তে প্রকাশিত হয়। এই পেপারেই আমরা তার বিখ্যাত সমীকরণ যা কিনা “রায়চৌধুরী” সমীকরণ নামে খ্যাত, তার হদিশ পাই। একটি মজার এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলও এই “রায়চৌধুরী” সমীকরণ কিন্তু আসলে একটি জ্যামিতিক সমীকরণ। আপেক্ষিকতাবাদে এই সমীকরণ প্রয়োগ করা হয়েছে কারণ প্রফেসর রায়চৌধুরীর গবেষণার মূল লক্ষ্য ছিল কসমোলজি। কসমোলজি বাদ দিলেও এই সমীকরণের তাৎপর্য এতোটুকু কমে না। তিনি টেনসর জ্যামিতির সাহায্যে spin (চিত্র ৬) এবং shear (চিত্র ৫) এর সংজ্ঞা স্থির করেন। ১৯৫৫ তে তার এই গবেষণা যখন প্রকাশিত হয়, ঠিক সেই সময়েই Heckmann এবং Schucking তাদের গবেষণা পত্রেও আইনস্টাইনের সমীকরণের সমাধানেকরেন তার সাথে “রায়চৌধুরী” সমীকরণের মিল দেখা যায়। এরপর বহু গবেষণা পত্রে “রায়চৌধুরী” সমীকরণের উল্লেখ থাকলেও স্টিফেন হকিং এবং রজার পেনরোজের “singularity theorems” এর উপর রজার পেনরোজের “Gravitational collapse and space-time singularities”, স্টিফেন হকিং এর “Occurrence of Singularities in Open Universes” এবং “Singularities in the Universe” এই গবেষণা পত্র প্রকাশিত হওয়ার পরই “রায়চৌধুরী” সমীকরণ প্রচারের আলো পায়। যদিও রজার পেনরোজের “Gravitational collapse and space-time singularities” গবেষণা পত্রে “রায়চৌধুরী” সমীকরণের উল্লেখ আমরা পাইনা। এর একটা কারণ প্রফেসর রায়চৌধুরী তার সমীকরণটি করেছিলেন ভর যুক্ত পদার্থের জন্য, কিন্তু প্রফেসর পেনরোজ তার গবেষণা পত্রটি করেছিলেন ভরহীন বস্তুর কথা মাথায় রেখে যেমন ফোটন। সে যাই হোক গবেষণা পত্রে প্রফেসর পেনরোজ কিন্তু মোটের উপর “রায়চৌধুরী” সমীকরণ কেই অনুসরণ করেছিলেন। পরে অবশ্য অন্য গবেষণা পত্রে তিনি “রায়চৌধুরী” সমীকরণের উল্লেখ করেন।
কিন্তু কি আছে এই সমীকরণে? অত্যন্ত জটিল এই গাণিতিক সমীকরণ কে সহজ ভাষায় বলতে গেলে যে জিওডেসিকের কথা আগে বলা হয়েছিল বলা যায় এই সমীকরণ সেই জিওডেসিক গুলির কাছে আসা, দূরে যাওয়ার (৭ নং চিত্র) জ্যামিতিটা তুলে ধরে। টেকনিকালি বলতে গেলে জিওডেসিক গুলো কনভার্জ করছে কি না সেটা নির্ণয় করার জন্য “রায়চৌধুরী” সমীকরণ প্রয়োজন, আর এই জিওডেসিক গুলো ফোকাস হলেই চলে আসবে সিঙ্গুলারিটির কথা। রায়চৌধুরী সমীকরণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল ও রয়েছে। আমরা জানি যে, এই মহাবিশ্বের শুরু হয়েছে বিগ ব্যাং নামক এক মহাবিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে। বিগ ব্যাং এক ধরণের সিঙ্গুলারিটি নির্দেশ করে। চতুর্মাত্রিক জগতে রায়চৌধুরী সমীকরণ থেকে এটা দেখানো যায় যে, আমাদের মহাবিশ্বে যে কোন দুটি বস্তুকণার চলার পথ ধরে সময়ে পেছন দিকে যেতে থাকলে সেগুলো একটা জায়গায় গিয়ে জড়ো হতে চাইছে, ফোকাস হতে চাইছে, সেটাই বিগ ব্যাং। অমল রায়চৌধুরীই প্রথম ধারণা দেন যে, সিঙ্গুলারিটি এড়িয়ে যাওয়া আমাদের জন্য সম্ভব নয়, যা পরে স্টিফেন হকিং এবং রজার পেনরোজের কাজের ভিত্তি হয়ে দেখা দেয়।
এই পর্যন্ত বলে লেখাটি শেষ করলে সমীকরণের স্রষ্টার প্রতি পূর্ণ মর্যাদা বা সম্মান প্রদর্শন হয় না। তাই লেখা শেষ করবো “রায়চৌধুরী” সমীকরণোত্তর একটি ঘটনা বলে। সময় টা ১৯৯১-৯২ সালে ফিজিক্যাল রিভিউ ডি তে E Ruiz এবং J M M Senovilla র “General class of inhomogeneous perfect-fluid solutions” শীর্ষক একটি গবেষণা পত্র প্রকাশিত হয়, যা দেখায় আইনস্টাইন সমীকরণের সিঙ্গুলারিটি মুক্ত সমীকরণ সম্ভব। এই গবেষণা পত্র সেই সময় বিশ্বে হইচই ফেলে দেয়। সত্তরোর্ধ প্রফেসর রায়চৌধুরী ১৯৯৭ সালে একটি একক প্রকাশনায় দেখান যে এই ধরণের সমাধান কোনও বাস্তব পরিস্থিতি কে বর্ণনা করে না, কারণ Senovilla র কাজ আসলে এক বস্তু শূন্য মহাবিশ্ব কে নির্দেশ করছে যা সম্ভব নয়। প্রায় ৭৫ বছর বয়সে কোনও ছাত্রছাত্রীর সাহায্য ছাড়া নিজে হাতে সমস্ত হিসেব কষে আরেকবার সিঙ্গুলারিটি কে রক্ষা করে তিনি বুঝিয়ে দিলেন জিনিয়াসের কাছে বয়স একটা সংখ্যা মাত্র।
খাসা! খটমট বিষয় খুব সহজ করে লেখা।
আবার পড়ব।
বেশ বেশ ☘️
চিত্রগুলি কোথাও দেখতে পেলাম না কেন?
সুশান্ত
কোনও টেকনিকাল প্রবলেম হচ্ছে মনে হয়
আমার মনঃপুত হয় নি। আরো বিস্তৃত আলোচনার দরকার
বেশী টোকনিকাল হলে তো মুশকিল
বেশী টেকনিকাল হলে তো মুশকিল
বেশী টোকনিকাল হলে তো মুশকিল
বেশী টোকনিকাল হলে তো মুশকিল
মুস্কিল কেন হবে? হয়তো আকারে আপনার লেখা বড় হবে। কিন্তু আপনার লেখা সকলকে আকৃষ্ট করবে।
অতি জটিল একটি বিষয়কে যদ্দূর সম্ভব সহজভবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ধন্যবাদ লেখককে।
আমি চিকিৎসক। ৪৫ বছর আগে ফিজিক্সকে ভালোবেসেছিলাম, কেমিস্ট্রিও।
তবে লেখাটি একটু বেশি সংক্ষিপ্ত। আরেকটু আলোচনার প্রয়োজন ছিল। বিশেষ করে হকিং এবং পেনরোজের কাজের প্রেক্ষিতে। তাহলে এর গুরুত্ব আরও বাড়তো। প্রসঙ্গত, নারলিকার তো খুব ভালো আলোচনা করেছেন। সে সূত্রও কাজে আসতে পারতো।
বেশ আবার লিখবো।