এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিবিধ

  • যা দেবী সর্বভূতেষু ভ্রান্তি রূপেণ সংস্থিতাঃ ভ্রান্তির ধারণা নাকি ধারণার ভ্রান্তি

    পিনাকী ভট্টাচার্য লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ১৭ অক্টোবর ২০২০ | ২৩৪৭ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • দুর্গাপুজায় চণ্ডীপাঠ চলাকালীন আমরা যে যে রূপে দেবীর স্থিতি কামনা করে থাকি তার একটি রূপ ভ্রান্তি।জীবনে ভ্রান্তির প্রয়োজন আছে, কিন্তু জীবন নিজেই কি একরকমের ভ্রান্তি। আইনস্টাইন এই চণ্ডীসুত্র কিম্বা অদ্বৈত বেদান্তের মায়াবাদ জানতেন কিনা জানা নেই, কিন্তু তার অত্যন্ত প্রিয় বন্ধু মাইকেল বেসোর মৃত্যুর পর তার পরিবার কে লেখা চিঠিতে তিনি লেখেন

    “…Now he has departed from this strange world a little ahead of me. That means nothing. For us believing physicists the distinction between past, present,and future only has the meaning of an illusion, though a persistent one….”

    শুধু আইনস্টাইন নয়, সময় একরকমের ভ্রান্তি এ কথা ইমানুয়েল কান্টও মানতেন।“ক্রিটিক অব পিউর রিজন” এর দি ট্রান্সেনডেন্টাল এস্থেটিকের শেষ ভাগে এক্সপোজিসন অফ স্পেস অ্যান্ড টাইম এর এক জায়গায় তিনি বলছেন,
    (“if you ask is time real? nobody should give a straight answer, they should say it is empirically real and transcendentally unreal…just because I said it is empirically real, one should not think that time is not objective. Time is objective but only with respect to a knowing subject..”)।

    কালের ব্যাখ্যায় কান্ট ঐন্দ্রিক জগত আর আতীন্দ্রিয় জগতের সাপেক্ষে পৃথক ধারণার অবতারণা করেন। বস্তু,জ্ঞান নিরপেক্ষ সময় তার হিসেবে ভ্রান্তি। আমাদের জন্ম, মৃত্যু তখনই হয় যখন “আমরা থাকি না”। তাহলে জন্ম,মৃত্যুও কি একধরণের ভ্রান্তি?
    ভ্রান্তির কারণ মায়াঃ অদ্বৈত-বেদান্ত মতবাদের অন্যতম স্তম্ভ হলো মায়াবাদ অনুসারে ব্রহ্ম মায়ায় আবৃত। সাধারণত দুটি অর্থে ‘মায়া’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। যে শক্তি বিভিন্ন রূপ সৃষ্টি করতে পারে তা যেমন মায়া, তেমনই যে শক্তি সত্যকে আবৃত করে রাখে তাও মায়া। শঙ্করাচার্যের মতে মায়া সৎ ও নয় আবার অসৎ ও নয়। মায়া সৎ নয় তার কারণ বোঝাগেলো কিন্তু অসৎ নয় কেনও?কারণ সে যেহেতু একটা জ্ঞানের জন্ম দিচ্ছে তাই তাকে অসৎ বলা যায়না। মায়া অনির্বচনীয়, কারণ তাকে সৎরূপে, অসৎরূপে অথবা সদসৎরূপে বর্ণনা করা যায় না যদিও সত্ত্ব, রজঃ এবং তমঃ এই তিনটি গুণ দিয়ে মায়া গঠিত। জ্ঞানের উপস্থিতিতে যেহেতু মায়া অবলুপ্ত হয় তাই সে জ্ঞানবিরোধী। মায়া কোনও অভাব কে সুচীত করে না তাই তার মধ্যে ভাবরূপ বর্তমান আবার মায়ার প্রকৃতি সম্পর্কে আমরা নির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে পারি না বলে তাকে যৎকিঞ্চিৎ ও বলা হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন চলে আসে ব্রহ্ম নিত্য তাহলে মায়াও কি নিত্য? জ্ঞানের সংস্পর্শে মায়া লুপ্ত হয়, তাহলে সে তো নিত্য নয়। মায়া নিত্য নয় কিন্তু সে কি অনাদি?শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে মায়া সমন্ধে বলতে গিয়ে বলা হয়েছে -

    ‘অজামেকাং লোহিতশুক্লকৃষ্ণাং বহ্বীঃ প্রজাঃ সৃজমানাং সরূপাঃ’।

    অর্থাৎ, মায়াপ্রকৃতি নিজের মতোই অনেক জীব সৃষ্টি করে। তারা কেউ বা লাল, কেউ বা সাদা আবার কেউ কালো। অজা কথার অর্থ হলো যার জন্ম নেই অর্থাৎ মায়া অনাদি। জন্ম নেই কিন্তু শেষ আছে।

    ভ্রান্তির কারণ স্বপ্নঃ

    মায়া আমাদের এক রকমের স্বপ্নের মধ্যে রাখে। স্বপ্ন আমরা দেখি, তারপর তা ভেঙেও যায়, জ্ঞানের আগমনে মায়া লুপ্ত হয়, একরকমের বিপরীত কার্য-কারণ সম্পর্ক।কার্য আগে(স্বপ্ন দেখা) কারণ পরে(ঘুম ভাঙ্গা)। মায়া এবং স্বপ্নর মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে।কান্টের মতে স্থান কালের মাধ্যমে কোনও বাহ্য অভিজ্ঞতা না হলে অন্তর অভিজ্ঞতা হতে পারেনা।তাই জানায় যদি ভ্রান্তি থেকে যায় তবে স্বপ্নে তাকে ঠিকঠাক করে নেওয়া যায়না।ভারতীয় দর্শনে এই ভ্রান্তির আলোচনা কে বলা হয় “খ্যাতিবাদ”। স্বপ্ন আসলে অসৎখ্যাতির উদাহরণ, স্বপ্নের কথা বলা মানে যাচাই না করে, কোনও অভিজ্ঞতার সমর্থন ছাড়াই কিছু কে প্রতিপন্ন করা। ভিগেন্সটাইনের সুযোগ্য ছাত্র নরম্যান ম্যালকমের মতে স্বপ্ন-জ্ঞান বলে কিছু নেই।কেনও? কারণ যদি আমরা স্বপ্ন দেখি তবে আমরা অবশ্যই ঘুমিয়ে আছি। কিন্তু আমরা যদি ঘুমিয়ে থাকি, তবে আমরা চিন্তা বা বিচার করতে পারি না, আর চিন্তা বা বিচার না করলে কোনও জ্ঞান, সঠিক বা ভ্রান্ত কোনটাই হতে পারে না, সে হয়ে ওঠে অনির্বচনীয়।

    আমাদের যদি প্রশ্নকরা হয় তুমি কি জেগে আছো? আমরা কখনই এর উত্তরে না বলতে পারিনা, ঠিক যেমন তুমি কি ঘুমিয়ে আছো? এর উত্তরে আমরা কখনই হ্যা বলিনা। উত্তরের এই সীমাবদ্ধতা আমাদের কাছে একটি প্রশ্ন নিয়ে আসে, কি কারণে আমরা চেষ্টা করলেও অন্য উত্তর দিতে পারিনা?এর একটা কারণ আমরা উত্তরটা এম্ন এক জগতে খুঁজছি যেখানে তার উত্তর নেই। যেমন গণিতে বাস্তব সংখ্যা রেখায় কাল্পনিক রাশিকে খুঁজলে উত্তর পাবোনা, উত্তর পেতেহলে আমাদের আর্গ্যান্ড ক্ষেত্রে(arganed diagram)যেতে হয়।শুধুমাত্র বাস্তব জগতে উত্তর খুজতে গেলে জন্মের আগে্র ও পরের জানার অসম্পূর্ণতা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যেন কোনও ফাঁদ (trapping mechanism) আমাদের গতিকে রুদ্ধ করেছে।এই পর্বের আলোচনা শেষ করবো দেকার্তের “মেডিটেশন” এর কয়েকটি লাইন দিয়ে ভ্রান্তি হিসাবে স্বপ্নের ভুমিকাকে পরিষ্কার ভাবে বর্ণনা করেছে।

    "..I ought to set aside all the doubts of these past days as hyperbolical and ridiculous, particularly that very common uncertainty respecting sleep, which I could not distinguish from the waking state; for at present I find a very notable difference between the two, in as much as our memory can never connect our dreams one with the other, or with the whole course of our lives, as it unites events which happen to us while we are awake. And, as a matter of fact, if someone, while I was awake, quite suddenly appeared to me and disappeared as fast as do the images which I see in sleep, so that I could not know from whence the form came nor whither it went, it would not be without reason that I should deem it a spectre or a phantom formed by my brain (and similar to those which I form in sleep), rather than a real man."

    ভ্রান্তির কারণ ভুল ধারনাঃ

    যারা বর্তমান বাদে আর সবকিছু কেই অবাস্তব বলে মান্যতা দেন সেই বর্তমানবাদীদের কাছে কোয়ান্টাম তত্ত্ব নিজেদের সঠিক প্রমাণের এক অন্যতম হাতিয়ার। তাদের কথায় “জন্ম হয়েছিল” বা “মৃত্যু হবে” দুটোই সমান অবাস্তব। এর মধ্যে তাদের চোখে কোনও ভ্রান্তি নেই। তারা তাদের সমর্থনে যে ঘটনা গুলোর কথা উল্লেখ করে থাকেন, তার মধ্যে অন্যতম তরঙ্গ অপেক্ষকের বিনাশ (collapse of the wave function)।

    তরঙ্গরূপী ইলেকট্রন যখন ইলেকট্রন বন্দুক থেকে নির্গত হয়ে কোনও পর্দায় আঘাত করতে যায়, তখন জন্মক্ষণ বলে দিতে পারেনা পর্দার কোথায় সে আঘাত করবে, বরং এটা বলা যায় পর্দার বিভিন্ন জায়গায় ইলেকট্রনটির আঘাত করার সম্ভাবনা কতো। বর্তমানবাদীদের কথায় যেহেতু বর্তমানই একমাত্র বাস্তব তাই পর্দায় আঘাত করা মাত্র বাকি সকল অংশে আঘাতের সম্ভবনা শূন্য হয়ে যায়।কিন্তু এখানেই ভ্রান্তি। গাণিতিক সম্ভবনা একরকমের বিমূর্ত ভাবনা,সে কখনও স্থানকালের সাথে পরিবর্তিত হতে পারে না। যেমন মুদ্রা সে থাকুক বা না থাকুক, তাকে উপরেই ছুড়ি বা হাতেই রাখি হেড পড়ার সম্ভাবনা ১/২। যে তরঙ্গের বিনাশের কথা বর্তমানবাদীরা বলছেন সেটিও কোনও কিন্তু একটি গানিতিক অপেক্ষক, যা বিমূর্ত। সঙ্গত কারণে তার বিনাশ হয় না।কারণ probability আর possibility এক বিষয় কে বোঝায় না।

    চেনা না চেনার ভ্রান্তি আমাদের আমাদের মধ্যে থেকে যায়।যখন সেই ভ্রান্তি দূর হয় তখন কে সি ভট্টাচার্যের কথায়- পূর্বক্ত অভিজ্ঞতাটি আমাদের ভাবায় “এ ভুল আমি কি ভাবে করতে পারি?সত্যিই ওটা কি আমিই ছিলাম?” -এ যেন ভ্রান্তির দিক পরিবর্তন ভ্রান্তি চিহ্নিতকরণেও ভ্রান্তি?।সময়ের হাত ধরে পিছিয়ে গিয়ে ভ্রান্তির পুনঃমূল্যায়ন।তবেই না দর্শনের জন্ম!
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ১৭ অক্টোবর ২০২০ | ২৩৪৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে প্রতিক্রিয়া দিন