গুরুচণ্ডালির পাতায় মাঝে মাঝে নানারকম অসামান্য তত্ত্ব(!!) চোখে পড়ে। এইরকম এটি অসামান্য তত্ত্বের মূল বক্তব্য- বাংলাভাষার সঙ্গে সংস্কৃত ভাষার কোনো যোগাযোগ নেই; মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য আরবি-ফারসি ভাষায় পরিপূর্ণ ছিল। পরবর্তীকালে বিদ্যাসাগর-বঙ্কিম জোর করে বাংলা ভাষায় তৎসম শব্দ ঢুকিয়ে বাংলা সাহিত্যের চূড়ান্ত ক্ষতি করেছে! বিদ্যাসাগর-বঙ্কিম যে হিন্দুত্ববাদী ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দালাল ছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই!এই অসামান্য তত্ত্ব ও তার প্রবক্তাদের উদ্দেশ্যে প্রথমেই বলতে হয়, এইরকম নির্লজ্জ মিথ্যাচার খুব কমই শোনা যায়। অবশ্যই মধ্যযুগে (চতুর্দশ-অষ্টাদশ শতক) অনেক আরবি-ফারসি শব্দ বাংলা ভাষায় গৃহীত হয়েছে, এই অন্তর্ভুক্তি বাংলাভাষাকে আরো সমৃদ্ধ করেছে! কিন্ত যে দাবী করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ছাড়া আর কিছু নয়!
বাংলাভাষার উৎস ও ক্রমবিকাশ নিয়ে বহুল গবেষণা হয়েছে, ঐ গবেষণার উপর সামান্য পড়াশোনা করলেই এই তত্ত্বের অসারতা প্রমাণিত হয়! আগ্রহী পাঠক এই বইগুলো পড়ে নেবেন, তাহলে নিজেই বুঝতে পারবেন।
আমি এখানে কোনো বিস্তৃত আলোচনায় যাচ্ছি না।
আমি শুধু মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের বেশ কিছু উদাহরণ পাঠকের সামনে তুলে ধরব। ঐ উদাহরণই পাঠকের সামনে এ অসামান্য তত্ত্বের সারবত্তা(!!) প্রকাশ করবে, আর বেশী কিছু লিখতে হবেনা!
-------------------------
"রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।
প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।।
হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে।
পরাণ পীরিতি লাগি স্থির নাহি বান্ধে।।"
"রূপের পাথারে আঁখি ডুবিয়া রহিল।
যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেল।।"
(জ্ঞানদাস, ষোড়শ শতক)
"নন্দনন্দন চন্দচন্দন
গন্ধনিন্দিত অঙ্গ।
জলদসুন্দর কম্বুকন্ধর
নিন্দি সিন্ধুর ভঙ্গ।।"
"মন্দিরে বাহির কঠিন কপাট।
চলইতে শঙ্কিল পঙ্কিল বাট।।
তঁহি অতি দর দর বাদল দোল।
বারি কি বারই নীল নিচোল।।"
(গোবিন্দদাস, ষোড়শ-সপ্তদশ শতক)
"নিরঞ্জন-সৃষ্টি নর অমূল্য রতন।
ত্রিভুবনে নাহি কেহ তাহার সমান।।
নর বিনে চিন নাহি কিতাব কোরাণ।
নর সে পরম দেব তন্ত্র-মন্ত্র-জ্ঞান।।
নর সে পরমদেব নর সে ঈশ্বর।
নর বিনে ভেদ নাই ঠাকুর কিঙ্কর।।"
(দৌলত কাজী, সপ্তদশ শতক)
"এক কায়া এক ছায়া নাহিক দোসর।
এক তন এক মন আছে একেশ্বর।।
ত্রিজগত এক কায়া এক করতার।
এক প্রভু সেবে জপে সব জীবধর।।"
"প্রেমানন্দ সিংহাসন প্রেমরস বৃন্দাবন
প্রেমানন্দ অমৃতলহর।
প্রেমানন্দ তরুমূল প্রেমানন্দ ফলফুল
প্রেমানন্দ রস মধুকর।।"
(আলীরাজা, সপ্তদশ শতক)
"ভিখারীর ভার্যা হইয়া ভূষণের সাধ।
কেন অকিঞ্চন সনে কর বিসম্বাদ।
বাপ বটে বড়োলোক বল গিয়া তারে।
জঞ্জাল ঘুচুক যাহ জনকের ঘরে।।"
(রামেশ্বর, শিবায়ন কাব্য , অষ্টাদশ শতক)
"ভূতনাথ ভূতসাথ দক্ষযজ্ঞ নাশিছে।
যক্ষরক্ষ লক্ষ লক্ষ অট্ট অট্ট হাসিছে।।"
"অতি বড় বৃদ্ধ পতি সিদ্ধিতে নিপুণ।
কোনো গুণ নাই তার কপালে আগুন।।
কুকথায় পঞ্চমুখ কণ্ঠভরা বিষ।
কেবল আমার সঙ্গে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ।।"
(ভারতচন্দ্র, অষ্টাদশ শতক)
"সে কি এমনি মেয়ের মেয়ে।
যাঁর নাম জপিয়ে মহেশ বাঁচেন হলাহল খেয়ে।
সৃষ্টিস্থিতি লয় করে মা কটাক্ষে হেরিয়ে।
সে যে অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড রাখে উদরে পুরিয়ে।।"
"মা কতো নাচো গো রণে।
নিরুপম বেশ বিগলিত কেশ,
বিবসনা হরহৃদে কতো নাচো গো রণে।।"
"শঙ্কর পদতলে, মগনা রিপুদলে, বিগলিত কুন্তলজাল।
বিমল বিধুবর, শ্রীমুখ সুন্দর, তনুরুচিবিজিত তরুণ তমাল।।"
(রামপ্রসাদ, অষ্টাদশ শতক)
আর উদ্ধৃতি দেওয়া নিষ্প্রয়োজন! আগ্রহী পাঠক মূলগ্রন্থগুলি পড়ে নেবেন। তবে এবার সিদ্ধান্তের দায়িত্ব পাঠকের!