গল্পে শুনেছি, নচিকেতাকে যখন ‘ধন-রতন’ অফার করলেন যম, নচিকেতা চাইলেন ‘জ্ঞান’! অন্যদিকে ছোটো থেকে বড়ো হতে গিয়ে, ‘ছেলে-ভোলানো’ ছড়ায় শুনলাম, লেখাপড়া (যা-কিনা আমাদের সময়ে অন্তত ‘জ্ঞান’-এর প্রাথমিক উৎস) করে যে, গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ে ওঠা (ভাড়ার ভেবে বসবেন না যেন), তার পক্ষেই সম্ভব হয় কেবল! তাহলে তো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে নচিকেতার সময় থেকেই ব্যাপারটা খানিক দুয়ে দুয়ে চার হয়ে আছে! সরাসরি টাকাকড়ি না-নিয়ে, নচি হালকা ঘুরপথে ঘটিয়েছিলেন ব্যাপারটা! যাতে করে পরবর্তীকালে যারা আমরা ‘আম-আদমি’, যমের দেখা প্রায়শ পেয়েও, কোনো অফার-টফার পাই না কোনোকালেই, ‘জ্ঞান’-কে ‘ধন’ করে তোলার প্রসেস-পটু হয়ে উঠতে পারি গোড়া থেকেই!
গল্পের কত যে পরত, সত্য সন্ধানে মত্ত মানুষের তা কী আর এক জীবনে বুঝে ওঠা হয় কখনও! নচিকেতার রসিকতায় পাছে কোনো ঘ্যাম-সিরিয়াস পাঠক দেশ-কাল-পাত্রের নিত্য অথবা সত্য বিচারে ব্রতী হয়ে ওঠেন, তাই আগেভাগে গরুকে গাছে তুলে রাখা জরুরি। বলে রাখা জরুরি, এ-লেখায় সামান্যও দায় এবং দায়িত্ব নেই সত্য রক্ষার। সে আপনি পাঠক, আপনিই ভালো জানবেন গল্প আসলে কী, গুজব কারে কয়, প্রকৃষ্ট প্রবন্ধ (আজকের ভাষায় ‘পেপার’) হয়ে ওঠার প্রাথমিক শর্তাবলী, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি জানি লিখলে কথা রবে, কোথাও-না-কোথাও, কালির কলঙ্কে অন্তত, তাই লিখি।
আমি লিখি, আপনি লেখেন, তুমি লেখো, সে লেখে, তিনি লেখেন। সর্বনামের লিঙ্গভেদ নেই, তবে বচনভেদ আছে। তাই আমরা লিখি, আপনারা লেখেন, তোমরা লেখো, তারা লেখে, তাঁরা লেখেন — সবাই লেখে। একইভাবে আমি থেকে সবাই, পড়িও। হালফিলের বাস্তবতা এটাই যে আমরা সবাই লিখি-পড়ি। এই বাস্তবতার বাইরে যেখানে তবুও আছে, রয়ে গেছে খানিক খানিক বিপরীত বাস্তব, লিখিয়ে-পড়িয়ে কিছু করে দেখানোর উদ্যমভুক্ত হতে তারও হয়তো দেরি তেমন নেই আর। থাকবেই বা কেন! আজও যে আছে, সেটাই তো কম লজ্জার কিছু নয়! সবার আগে সকলের জন্য চাই— ‘শিক্ষা’, অর্থাৎ, অক্ষরের অধিকার! কেননা স্বাক্ষরতা ক্রমশ আনে জ্ঞান — জ্ঞান আনে সক্ষমতা — সক্ষমতা আনে উন্নয়ন — আর উন্নয়ন আনে সভ্যতা! এবং যেহেতু যত মত, ততই পথ, আর সব পথ এসে শেষে সেই আমড়াতলার মোড়েই মেলে, বিকল্পের কথা বাড়িয়ে লাভ আছে কি কোনো?
গল্প গরু গাছে পাছে আরও গুলিয়ে ওঠে সবকিছু, মোদ্দাকথাটা এবার পেরে ফেলা যাক তবে। সাড়ে সাতেরোশো থেকে পৌনে তিন হাজার শব্দসীমায় আদতে এ-লেখা তার পাঠককে পা টিপে পড়িয়ে এবং বুঝিয়ে ফেলতে চাইছে রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায় নামের এক বাংলা গদ্যকারের সাহিত্যে-সাধন তত্ত্ব! কেন এ-হেন চাওয়া, আর ও তত্ত্ব (তা-ও অন্যের ব্যাখ্যায়) পড়ে প্লাস বুঝে কার কী হবে, সে অবশ্য বাড়তি প্রশ্ন। এমনটাই হয় বলে হচ্ছে এবং হবেও। একেই বলে সাহিত্য-সমালোচনা। অথবা আরও একধাপ এগিয়ে — সমালোচনা-সাহিত্য!
#
ব্যাপার হল গিয়ে রাঘবের সাহিত্যে কী আছে আমি তার কতটুকুই বা জানি! অথবা নিজেকে যদি এমনভাবে বোঝাই যে, আমিই একমাত্র জানি যে রাঘবের সাহিত্যে কী আছে, তারপরও রাঘবের সাহিত্যে যা আছে, তা কিন্তু রাঘবের সাহিত্যেই থেকে যাবে। এ-কথা যে শুধু রাঘবের সাহিত্যের ক্ষেত্রে বলা যায়, তেমন তো নয়। সাহিত্য হোক-না-হোক, যে-কোনো লেখারই তো এটুকুই সম্পর্ক সত্যের সঙ্গে। অক্ষরের মৃতশরীরে অমর হয়ে আছে যে কথাবৃত্তান্ত, পাঠক গিয়ে তাকে কাঠি না-করলে, তার আর সাধ্য কোথায় যে নিজেই জেগে ওঠে! এখন কেউ যদি ভেবে বসেন, এ-লেখার কাজ তাই পাঠককে পটিয়ে হাতে একটা কাঠি তুলে দেওয়া কোনো মতে, রাঘবের সাহিত্যশরীরে তা প্রয়োগ করার জন্য, ভুল করবেন। ও জিনিস পড়া বা না-পড়া আপনার ব্যাপার। আর ও-নিয়ে বুলি কপচানোর কাজ আমার না।
তবে?
মাতৃগর্ভ উৎস ধরে নিলে গন্তব্য মৃত্যুর নিরুদ্দেশলোক, অন্তর্বর্তী যা কিছু তার মধ্যেই থেকে যায় রচনাবৃত্তি, জৈব জীবনকে একটা-না-একটা অর্থ, তাৎপর্য, ব্যঞ্জনামণ্ডিত করে তোলার আকুতি ও প্রয়াস। নগ্ন স্বাধীনতা তার প্রায় জন্ম জড়ুল। দণ্ডিত হয়েও তাই প্রবল উৎসাহে জড়িয়ে পড়ে অন্তহীন সওয়ালে। যন্ত্রণাভিষিক্ত, বৈরি পরিবেশের সঙ্গে নিয়ত সংঘর্ষে লিপ্ত। অত্যাশ্চর্য সব ঘটনা তাকে ঘিরেই, শিকলের শব্দ যেন তার-ই অস্তিত্বের সংবর্ধনা-বাদ্য। কিছুতেই যে মৃত্যুকে দাসখত লিখে দেবে না, এমন মানুষ দাস হয় কী করে!
— “লিখনদাসের কথা”, ‘দলদাস’
সওয়াল-জবাব-সওয়ালেরা অন্তহীন আবর্তে জড়িয়ে যেতে যেতে, অনিঃশেষ পথের যাত্রী হয়ে উঠলে, জানি না কেন, ক্রমশ বেড়ে ওঠে হামসফরের খোঁজ! বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে একলা চলতে চলতেও হয়তো তাই লিখে রাখতে হয় একলা চলার বয়ান! আয়না অথবা ছায়ার মতো সেই লিখনই তখন হয়ে ওঠে একলা পথের সহযাত্রী, ভাবনা-দোসর! আর ঠিক সেখানেই কি নিজের অজান্তে সংঘটিত হয় কোনো ‘আত্ম’-ঘাতের আয়োজন? নিজের প্রশ্ন, ভাবনাজাল, চিন্তারেখাই হয়ে ওঠে পিছুটান এগিয়ে চলার পথে?
কী হবে এমন হয় যদি, হয়েই চলে নিরন্তর, তাসের ঘরের মতো ভেঙে পরে একের-পর-এক চিন্তা-কাঠামো হঠাৎ! ভাবনার ভিত যায় কেঁপে! যে লিখন ছায়াসঙ্গীর মতো এতটা পথ একসঙ্গে এল, সে-ই যদি হয়ে ওঠে আমার বর্তমান চিন্তার, অবস্থানের, এমনকি আগামী চলনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী, একাকী ভুলের একমাত্র সাক্ষী! কীভাবে এড়াব তাকে?
এই যে জড়িয়ে যাওয়া অথবা এড়িয়ে চলার বাস্তবতা, যা কম-বেশি প্রায় সকল সচেতন লেখকেরই সংকট, রাঘবেরও হয়তো বা লিখনের ‘জন্ম জড়ুল’! জীবনের প্রতিটা অলগলির গল্প যখনই স্মৃতিকথনের নিশ্চিন্ত আশ্রয় ছেড়ে, নিতে চায় আত্ম-অনুসন্ধানের এলোমেলো সংরূপ, ‘আত্ম’-কে অনবরত আঘাত করার মাধ্যমেই তখন যেন জন্ম নেয় শব্দ, একের পর এক। আহত, আঘাতপ্রাপ্ত সেই আত্মন — যে তখন নিজেকেও জানে না আর — আদৌ কি প্রস্তাব করে উঠতে পারে কোনো জ্ঞানের অস্তিত্ব বিন্দু? সেই মুক্ত ‘আমি’ তো তখন শুধু পাত্রই নয়, পেরিয়েছে দেশ-কালের সীমানাও!
অথচ যাকে বলছি লিখন, স্ব-ভাবে কেবলই তো বাঁধা পড়তে চাওয়া তার! শব্দ জমে জমে হয়ে উঠতে চায় পাথুরে প্রমাণ — জ্ঞানপ্রস্তর! জ্ঞানের প্রাচীর! এই যে যুগ্ম-বৈপরীত্য, লিখন আর আত্মনের সহাবস্থানে এই যে দুই বিপরীত প্রবণতা, তারই কোনো সমঝোতায়, অথবা অসমীকরণে কি জন্ম নেয় সাহিত্য? জ্ঞানের সঙ্গে কি নিত্য বৈরিতার সম্পর্ক তার? শৃঙ্খলের সম্বন্ধ? যাকে ছিন্ন করার বাসনায়, অস্বীকার করতে করতে, অজানার দিকে এগিয়ে যেতে চাওয়া শুধু?
#
মগজে কলোনি। গোটা চিন্তাকাঠামোয় যদি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে প্রবাহিত হয়ে চলে ঔপনিবেশিক ঘুণ, হাজার একটা বয়ানও কি তখন পরিগণিত হবে-না, আদতে একই উচ্চারণের বিভিন্ন প্রতিধ্বনিরূপে শুধু! যদি তা-ও হয়, তাতেও কি উদাসীন-ঔদ্ধত্যে আদৌ উপেক্ষা করে ওঠা সম্ভব একের হাজার হয়ে ওঠার কঠোর বাস্তবতা? ক্রমপরিবর্তনশীল চিন্তা-প্রবণতা, কখনও সাময়িক, কখনও-বা সামগ্রিকভাবেই যদি বিভ্রান্তির অভিযোগ আরোপে খারিজ করতে চায় অতীত বাস্তবতা, বাতিল করতে চায় বহুচর্চিত ইতিহাসের বয়ান — অন্তহীনের অভিজ্ঞান, অনিঃশেষের আশ্বাসও তবে তো ঘাঁটি গড়তে শুরু করে সেখানে। কেন্দ্রের বিপরীতে যেতে চেয়ে প্রবল প্রত্যয়ে যখন প্রান্তের পথে পা বাড়ালাম, ভাবিওনি পেরোতে হবে ঠিক কতটা পথ! যখনই ভেবেছি প্রান্তে এসে পৌঁছেছি ঠিক, দেখি কেন্দ্রও সরে এসেছে আমারই পিছু পিছু চুপিসারে! এভাবেই যখন গেছে কেন্দ্র-প্রান্তের জানাটাই আদতে গুলিয়ে, পেয়েছি পথ চলার অনায়াস আনন্দ!
জানার সঙ্গে, জ্ঞানের সঙ্গে আনন্দের যে বোঝাপড়া, ইতিহাসের সঙ্গে সাহিত্যেরও খানিক তাই। জানায় আনন্দ আছে, কিন্তু কোনো বিশেষ জানায় থিতু হয়ে থাকলে, আনন্দে ক্রমশ টান পড়তে শুরু করে। ইতিহাস কোনো এক ঘটনাকে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টি থেকে জানতে, বুঝতে বা ভাবতে চায় ঠিকই, কিন্তু ক্রমশ ওই জানা-বোঝাতেই থিতু হয়ে যাওয়া ব্যতিরেকে, তার আর উপায় থাকে না কোনো। ঔপনিবেশিক নির্মাণের নিকৃষ্ট সব ষড়যন্ত্র থেকে তার নিস্তার প্রায় নেই বললেই চলে। এ-কথা সেই কবেই বুঝেছিলেন বঙ্কিম। বুঝেছেন আধুনিক কালের আরও গুটিকয় ব্যক্তিত্ব। বুঝেছেন রাঘবও। সাহিত্যের পথে তাই নিরন্তর আনন্দের অনুসন্ধান তাঁর, শেকল পরা ইতিহাসের পিছুটান সম্বল করেই।
জমা করা স্মৃতি র পাহাড় সরিয়ে কেনো কেও কেও কলম তুলে নেন ..., এ লেখা ভাবায়।