এক
দিনের সূর্য পিছনে ফেলে ওরা নামল মহিডাঙার আলপথে। পিঁপড়ের সারির মতো চলেছে দল বেঁধে। নারীপুরুষ মিলিয়ে পনেরো জন। চলেছে আগেপিছে, পর পর, সাপের মতো এঁকেবেঁকে। মাথায় কলসি, কাঁখে কলসি, হাতে বালতি, ব্যারেল। ছোটো বড়ো মাঝারি। নানান আকার, নানান ঢং। পোড়ামাটি-অ্যালমনিয়ম-প্ল্যাস্টিক। সব পাত্রই জলভরা। হাঁটে দুলে দুলে, নেচে নেচে। জল যেন না চলকায়, তাই ওই দুলুনি ওই নাচুনি।
ঘোর ঘোর বিকেল এখন । আকাশের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত সবাই। আসার পথে হিঙ্গলগঞ্জ বাজারে ট্রেকার উল্টেছে, কচিকাচা বুড়ো জোয়ান সমেত। ওফ কী বীভৎস
দৃশ্য! তাই দেখতে সময় গেল। দেখার জিনিস খুব বেশি মেলে না। কৌতূহল ছিল।
সিনেমা-ভিডিও দেখার মতন।
তাই দেরি হয়েছে। গোটা দলের পায়ে এখন জোর তাড়া, মন ছোটে আগে আগে। হুই দ্যাখো, মুকুন্দপুরের বিশাল শিরীষ গাছের মাথা থেকে বাঘের মতো লাফ দিল একপোঁচ আঁধার। বাইলানির জঙ্গল উজিয়ে, ডাঁসা নদীর বুক বেয়ে কেমন গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসছে। আকাশেও কেমন প্যাঁচগোজের রং। নামবে নাকি! গতকালই ধরন দিয়েছে বৃষ্টি। মাঠে এখন কচি ধানগাছের গোড়ায় জল। আলপথে প্যাচপেচে কাদা। এর উপর আবার বৃষ্টি! শরতের মেঘে বিশ্বাস নেই।
দলটার মধ্যে তাই চলো চলো ভাব। কে আগে যাবে-- তারই দৌড় চলছে যেন। সবার আগে বুড়ো নগেন। হাঁটছে দ্রুত। দুলে দুলে। এবার সে দাঁড়াল। দেখল দল পিছিয়ে পড়েছে। মেয়েগুলো কলকলানি জুড়েছে কখন থেকে। ফাঁকা মাঠে কথার যেন বাধ মানছে না। বিষয় সদ্য দেখা ট্রেকার ওলটানোর ঘটনা। ওদের তাড়া দেওয়া দরকার।
নগেন মুখ খিঁচিয়ে বলে, অর্যা মাগিরা, পাছা মাই পরে দোলাসখন, অ্যাখুন পা চেলকে আয়দিনি--।
মেয়েমহলে হাসির রোল ওঠে। আধবুড়ি ফুচি সর্দারনি মিশিমাখা দাঁত ছড়িয়ে বলে, অর্যা ড্যাকরা, যাচ্ছিস তো আগুতে, পিছকে আমরা পাছা দোলাই আর মাই দোলাই, তুই দেখিস ক্যামনে?
অমনি হো হো হাসির ঝড় বয়ে যায় সকলের চোখেমুখে। হাঁটার গতি কমে যায়। মোক্ষম জবাব পেয়ে নগেন আমতা আমতা করে, ওই নেগে তুদের কিছু বলতি নেই। বেলাবেলি খানপুরের বাঁক না পেরোলি মজা টের পাবিখন—।
বলে নগেন আর দাঁড়ায় না। একাই পা চালায় দ্রুত। ওকে নিয়ে যতই মজা করুক, তাগিদটা বোঝে সবাই। তাই পায়ে টান ধরে, নীরব অথচ জোর তাগিদের বার্তা ছড়িয়ে পড়ে সকলের মধ্যে, চল চল--।
আমিনা তখন নিচু গলায় শান্তিকে বলছিল, বুঢ়ার চোক দেকিচিস! ক্যামুন গিলতি আসে! সবসোমায় ছোঁক ছোঁক।
আমিনা শান্তি সমবয়সি। সবে জামা ছেড়ে শাড়ি ধরেছে। এঁটেসেঁটে বসেছে শরীরে। আর তাতে উদ্ধত যৌবনের সবকিছু ফুটে বেরুচ্ছে।
আমিনার কথা শুনে শান্তি হেসে বলে, তোরে গেলে নাই!
আমিনা অমনি মুখ বাঁকায়, উঁ অত সস্তা! দুবো না চোখি বাঁশপাতা খুঁচকে!
ই, তোর কত সাহস সে তো জানি। বাজারের ওই ছেলেডা য্যাখন তোর হাত থে কলসি নিচ্ছিল, ভয়ে তুই ঝোমরাদার পাছুতে নুকোসনি!
কী করি বলদিনি! ছেলেডা রোজ আমার পাছুতে ঘুর ঘুর করে। চোখ দে গিলতি চায়। একদিন বাজারের পাছ্ গলিতি আমার হাত টেনকে ধরিছিল। বলে কী জানিস, নাইনে তোরে দাঁড়াতি হবে না, এহানে থাকবি, পানি আমি এনকে দুবো।
বাহ্ র্যা, ভালোই তো, রাজি হই যা।
মরণদশা!
হেসে ওঠে দুজনেই। কিন্তু শান্তির বুকে যেন ঈর্ষার মেঘের ঘষটানি লাগে। আমিনা গরিব হোক, হা-ভাতে হোক, দেখতে একেবারে হুরি পরি। কাটা কাটা নাক-মুখ- চোখ। ওর তো গুণমুগ্ধ ভক্ত জুটবেই।
ওদের হাসির মধ্যে শরিফা পিছন থেকে বলে ওঠে, আহ্ মরণ, আ্যাত গুজুর গুজুরকরলি হাঁটবি ক্যামনে! হোঁচট খাব নিকি তুদের জ্বালায়!
আমিনা আর শান্তি সঙ্গে সঙ্গে চুপ। পা চালায় দ্রুত। শরিফার যা মুখ, এখনই হয়তো সাত-সতেরো লাগান ভাঙান শুরু হয়ে যাবে। কাক-কাঁকুড় জ্ঞান ওর কোনও কালেও ছিল না। ভয় বিশেষ করে আমিনার। বাজারের ছেলেটার ব্যাপার যদি দেখে থাকে, তবে তো কথাই নেই, যা পেট আলগা, হয়তো বাপকে লাগিয়ে দেবে। আর বাপও রগচটা, দেবে হয়তো লতিফ মাঝির সঙ্গে নিকে বসিয়ে।
দ্রুত পায়ে শান্তিকে ছাড়িয়ে যায় আমিনা। পিছনে শরিফা তখন গলা তুলে হাঁকছিল, অর্যা মাগি মিনসের দল, হাঁটায় ঢিল দিলি হবে! মরবার শখ হইছে নাই!
ওর পিছনেই হাঁটছে জীবন ঢালি। তার হাতে ব্যারেল। সে প্রায় ধমকে ওঠে, আহ মিতে বউ, তোমার মুখদোষ আর কিছুতি গ্যালো না। যাচ্ছে তো সবাই, কেউ তো দেঁড়কে নেই।
শরিফা মুখ না ফিরিয়ে জবাব দেয় সাপটে, এই হচ্ছে তোমার স্বভাব মিতে। জ্ঞান মারার মওকা পেলি আর ছাড়বা না। ওই নেগে বলি তুমি এসো না, আমার মিতেনিরে
পাঠাও।
আরে বাবা পাঠাতিই তো চাই। সে শালি জল আনতি গে পা মচকাবে কে জানত!
কতবার বলি হাসপাতাল নে ঝাও। সেরকে যাবে। কথাই শোনবা না।
হাসপাতাল কি এহানে! তা নে ঝাব পয়সা কোথা!
সোজা কথা। সরল। অকপট। বাকি সবাই মাথা নেড়ে সায় দেয়, এমনকি শরিফাও।
দুই
চলার গতি বাড়ে। সেই সঙ্গে বাড়ে কোমরের দুলুনি। ওই দুলুনি জল বাঁচানোর জন্য। জল, খাবার জল। এই সোঁদরবনের গাঁ গেরামে বড়ো মহার্ঘ এই জল। কেউ একফোঁটা খরচ করে না অকারণে। করতে নেই। কেননা জল এখানে মাথা কুটলেও মিলবে না কোথাও। কেমন মজা বোঝো! মজাটি নিয়ে শরিফা আর ওর মিতেনি জীবন ঢালির বউ নেকি এক সময় খুব হাসাহাসি করত। জলের দেশের মেয়ে ওরা। জলের অভাব ব্যাপারটা মাথায় ঢোকে না কিছুতেই। মুখে বলেও, ধুস তাই আবার হয় নিকি! ভাত নি, কাপড় নি সে তো বুঝি, তা বলে পানি নি!
শরিফার স্বামী ময়জুদ্দি হেসে বলে, হয় হয়। এটাই তো মজা র্যা। সোঁদরবনে পানি আছে, তবে লোনা, খাবার পানি খুব কম।
হ্যাঁ, দেখেছে শরিফা, উলার চকে আট-আটটা টিউকল বসল। পানি উঠল বালি গোলা। খাওয়া দূরে থাক, মুখে দিলে ওয়াক থুঃ। পুকুরের পানি! সে তো তিন-চার মাস। খেলে পেটে ঘা হয়। বলে আর্সেনিক। তবে পানি কোথায়! হুই ডাঁসা নদী পার হও। ভবানীপুরে ডিপ টিউকল করেছে পঞ্চায়েত। সেখান থে পানি নে এসো। কিন্তু যাবে কীভাবে? বড়ো বাধা যে নদী। ছোটো-বড়ো নাও যা আছে, সব মাছ মারতে যায় বাদায়, চালানি যায় হাসনাবাদে। দু-একখানা নাও যা আছে, সেখানে ফ্যালো কড়ি মাখো তেল। কলসি-বালতি পিছু এক টাকা, নগদা-নগদি। টাকা দাও আর পানি নাও। কার আছে পয়সা! উলার চকের মানুষের চাষবাসের উপর জীবন। ছ-মাস কাজ, বাকি সময় জোন খাটো, নাও চালাও নয়তো বিশপুরের হাটে মাল বও। না হলে উঞ্ছবৃত্তি করে চালাও। তাই পানি নিয়ে চলে টানাপোড়েন। কখনও মারপিট, মেয়ে হলে ইজ্জতের উপর হামলা। অনন্ত ঢালির বউ আয়না এক কাণ্ড ঘটিয়েছে। সে শরীরের রং ঢং দেখিয়ে মাঝিদের বশ করে পানি আনত। কিন্তু রসিক মাঝি সেয়ানা খুব, সুযোগ বুঝে একদিন হামলে পড়ল ওর উপর। আর আয়নাও তেমনি৷ ইজ্জত বাঁচাতে দিল হালের বাড়ি কষিয়ে। এক ঘায়ে কাত রসিক। আয়না এখন জেলে। ওর রুগ্ন ছেলেটা মা মা বলে উলার চকের আকাশ বাতাস ভারী করে চলেছে।
অতএব উলার চকের গরিব-গুরবো মানুষের পানি চাই। জল চাই। বিকল্প পথ খোঁজে সবাই। হাঁ পানি কোথা জল বলে বুক চাপড়ায়। তা গেল বছর যেন আল্লা মুখ তুলে চাইলেন। হিঙ্গলগঞ্জ বাজারে ডিপ টিউকল বসল। ঘটা করে উদ্বোধন হয়েছিল। মন্ত্রী, অফিসার এসেছিল, কত বক্তৃতা, কত প্রতিশ্রতি! আর আশেপাশে সাত গাঁয়ের মানুষ দেখেছিল উপচে পড়া পানির বন্যা। আহ্, কষ্ট বোধহয় ঘুচল। হিঙ্গলগঞ্জ হাঁটা পথে যাওয়া যাবে। উলার চক থেকে পাঁচ মাইল। যেতে আসতে দশ মাইল। মাঠ ভাঙলে মাইল দেড়েক কমে। এ পথে অন্তত নদী নেই, খাল নেই। অতএব পারাপারের ব্যাপার নেই। তবে মুশকিল আছে। একখানা মাত্র ডিপ টিউকল। আর সাতটা গাঁয়ের লোক সেখানে হামলে পড়েছে। সকাল সন্ধে চিঁড়ে চ্যাপটা ভিড়। কলসি-বালতির লাইন সাপের মতো এঁকেবেঁকে মাইল ছাড়িয়ে যায়। ভোর ভোর সেখানে ছোটো। কোমরে চিঁড়ে-মুড়ি-পান্তা বেঁধে চলে যাও। লাইন দাও। লাইনে খাওয়া, বসা, বিশ্রাম। লাইন এগোয় শামুকের গতিতে। দিনের সূর্য উঠে আবার পড়তে থাকে, তখন হয়তো মেলে পানি। এ নিয়ে ঝুট ঝামেলাও কম নেই। কল যাতে খারাপ না হয়, হুড়োহুড়ি না হয়, তার জন্য ব্যবস্থা আছে। সকাল থেকে পানি দেওয়া শুরু। একটার সময় বন্ধ, আবার তিনটে থেকে সাঁজবেলা পর্যন্ত পানি মিলবে, তুমি দূর থেকে এলে কি দু-দিন পানি পাওনি, কোনও রেয়াত নেই। লাইনে দাঁড়াও, পানি পাবে। দেখাশোনার জন্য পাহারাদার আছে। ষন্ডা-গুন্ডা মুশকো জোয়ান সব। কী তাদের চেহারা! কী হাঁকডাক! ভয়ে পিলে চমকায়। লাঠি নিয়ে যখন তেড়ে আসে, তখন বুঝি কাপড়ে চোপড়ে হয়। তবে ওরাও বশ হয়। ওষুধ আছে। এ কথা জানে শরিফা, জানত নেকিও। বুকের আঁচল একটু সরাও। সামান্য অং ঢং করো। একটু ধরতে দাও। পানি তোমার কাঁখে হেঁটে আসবে।
তবু কি ঝামেলা নেই? আছে। এই তো আজই, মাঠখুলি গাঁয়ের লোকেরা ত্যাঁদড়ামি করছিল। ওরা এসেছে সাতজন। কলসি-বালতি-ব্যারেল মিলিয়ে পাত্র নিয়ে এসেছে উনিশটা। তা হবে কেন? বলে তর্ক জুড়ে দেয় বাকি সবাই। একজন এক পাত্র জল পাবে। এটাই তো নিয়ম।
মাঠখুলির লোকেরা পাল্টা তর্ক জোড়ে, আঙগা গাঁয়ের লোক আসতি পারেনিকো, কাজেকম্মে আছে। তা বলে ওরা জল পাবে না— এ কেনদারা কথা!
না, পাবে না। নিয়ম সবার নেগে এক। বলে কল-পাহারাদার লাঠি নিয়ে হেঁকে তাড়িয়ে দেয়।
মাঠখুলির মেয়েমদ্দরা চেঁচামেচি জুড়ে দেয়। হাত ঘষটায়, দাঁত খিঁচোয়। কেউ কেউ কাতর প্রার্থনা করে, কান্নাকাটিও জুড়ে দেয়। কোনও কিছুতেই পাহারাদারের হৃদয় গলে না। লাঠি তুলে কঠিন গলায় হেঁকে ওঠে, ভাগ শালা--।
মাঠখুলির লোকেরা চলে যায় শাপ-শাপান্ত করতে করতে। সুযোগ পেলে দেখে নেওয়ার হুমকি দিতে দিতে।
তাই, বড়ো মহার্ঘ এই পানি। শরিফা আদরের হাত বোলায় কলসির গায়ে। সেই কোন ভোরে বেরিয়েছে। শুকতারা তখনও আকাশে জ্বলজ্বল। প্রায় চার মাইল পথ ঠেঙিয়ে এসে দেখে ওদের আগে প্রায় শ-পাঁচেক হাঁড়ি-বালতি-কলসি-ব্যারেলের লাইন পড়ে গেছে। ওরা কাছেপিঠে থাকে, আগেভাগে আসতে পারে। তা বলে দূরের মানুষের সুবিধে-অসুবিধে দ্যাকপে না, এ কেনদারা নিয়ম! কথাটা শরিফা বলেছিল কল-পাহারাদার সান্টু, লতিফকে। ওরা হেসে বলেছিল, হবে না কেন, কিন্তু এমনি এমনি হবে! বলে চোখ মটকায়।
শরিফাও পাল্টা দেয়, বড্ড নোলা তোমাদের, এত দিচ্ছি হচ্ছে না!
লতিফ, সান্টু হেসে বলে, ওইটুকুতে হয়! বলে চোখ ইশারা করে শান্তি আমিনাকে দেখায়।
ফুঁসে ওঠে শরিফা, ওরে মরণ, ওরে ড্যাকরা, আমার মাই খেয়ে হচ্ছে না, আবার কচি মেয়ার খেতি চাস!
বলা যেত অনেক কথা। কিন্তু বাধা যে পানি। এ দিগরে সব মিলবে, টাকা চাইলে টাকাও, কিন্তু পানি! মাথা কুটে মরলেও কেউ একফোঁটা পানি ধার দেবে না। স্রেফ নেই বলে দেবে। শরিফাও কি পারবে! এই যে প্রাণের মিতেনি নেকি পা মচকাল, কলসি ভেঙে সব জল মাটিতে। এত করে বলল, আমারে আদ্দেক জল দে শরি--। শরিফা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল। ইচ্ছে থাকলেও দিতে পারেনি। আজকের পানি কাল পর্যন্ত চালাতে হবে। আবার পরশু ভোর না হতেই ছুট। ছোটাই যেন জীবন হয়ে গেছে।
তাই শরিফা বোঝে আমিনা শান্তিকে বেশিদিন লোভের হাত থেকে বাঁচানো যাবে না। ওরা নিজেরাই চাইবে না। কষ্ট যখন ঘাড়ের উপর নিশ্বাস ফেলবে, তখন সতীপনা
বাপ-বাপ বলে ঘুচে যাবে। নিজের জীবনেই দেখছে শরিফা । ময়জুদ্দি যখন খাটত-খুটত, তখন কত ভাব-ভালোবাসা, কত আদর! সেই মানুষটা গাছ থেকে পড়ে মাজা ভাঙল, ভাব-ভালোবাসা সব উবে গেল কোথায়! এবার যত হম্বিতম্বি শরিফার উপর, যা শালি ভাত লে আয়, পানি লে আয়। যেখান থে পারিস লে আয়, য্যামনভাবে পারিস লে আয়--।
এখন শরিফা বাইরে বেরোলে, আনকা লোক গায়ে ঢলে পড়লেও ময়জুদ্দির কোনও
ভাবান্তর নেই। খিদের সময় ভাত পানি পেলেই হল। সেটা কীভাবে এল, কেমনভাবে
জোগাড় হল, কোনও প্রশ্ন নেই, কৌতূহল নেই। শরিফা এক-এক সময়ে ভাবে পঙ্গু
মানুষটার সঙ্গে থেকে লাভ নেই। তার রূপ আছে, যৌবন এখনও অটুট। ছেলেপুলেও
আসেনি পেটে। বাপ মা কতবার বলেছে, ছেড়ে দে শরি, চল আবার নিকেয় বসবি।
প্রাণে ধরে পারেনি শরিফা। মানুষটার শরীর গেছে, মেজাজও খিটখিটে, কিন্তু এই
মানুষটার শরীর, শরীরের গন্ধ সবই তো চেনা। এখনও কত আদর ওর হাতে। মাঝে মাঝে শরিফাকে জড়িয়ে ধরে, বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে হাউ হাউ করে কাঁদে, আমার নেগে তোর জেবনডা নষ্ট হল র্যা শরি।
শরিফা কলসিটাকে কাঁখ বদল করল। মনে হল ময়জুদ্দির উড়োপুড়ো মাথাটা এক বুক থেকে সরে আর এক বুকে আশ্রয় নিল। কাঁদছে যেন হুড়হুড়িয়ে। শরিফার চোখেও নদী বইছে। আকাশ, মাঠ, দূরের গাছপালা যেন নাগরদোলার মতো দোল খাচ্ছে।
পাশ থেকে জীবন বলে উঠল, ও মিতেবউ সাঁঝবেলায় চোখির জল ফ্যালাও ক্যানে? ওতে অমঙ্গল হয় জানো না!
সঙ্গে সঙ্গে ঝেঁঝে ওঠে শরিফা, চোখির মাথা খেইছ নিকি! পানি নে যাচ্ছি, তা
চোখিমুখি কী লাগবে! রাজভোগ!
বলে সে হনহনিয়ে এগিয়ে যায়। হেসে ফেলে জীবন।
তিন
জীবন হাসছে বটে, একই অবস্থা ওরও। শুধু চোখে জল নেই এই যা। ওর জমি নেই একফোঁটা। জনমভর শুধু খাটুনি। কখনও চাষ কাজে, কখনও ভ্যান-রিকশা নিয়ে মাল চালানির কাজে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে একদিন অন্তর জল আনা। এ কাজটা করত বউ নেকি। ধান ভানত, মুড়ি ভাজত। আবার জলও আনত। শরিফার দেশের মেয়ে, সেই সুবাদে মিতেনি। রং ঢং তারও কম নেই। শরিফা আর নেকি-- দুজনে মিলে জল আনতে যায়। পাড়ার লোকদের তারাই জোগাড় করে। দূরের গাঁ-ঘরের মেয়েদের পথেঘাটে নানা বিপদ। কেউ পিছনে লাগে, কেউ আবার জল লুঠতে আসে। এই তো গেল মাসে মুকুন্দকাটির খালপাড়ে জল লুঠ হয়েছে। আঁধারকালে লাঠিসোটা নিয়ে তেড়ে এসেছিল বাইলানির লোকেদের উপর। কেড়ে নিয়েছে জলের পাত্রগুলো। একা মানে বিপদ, তাই পুরুষদের সঙ্গে থাকা, একসঙ্গে যাওয়া আসা। তাও নেকি পারল না জল বাঁচাতে। খানপুরের বাঁকে বিশাল হাবড়। জলেকাদায় মাখামাখি। সেখানেই পা হড়কে পড়ল। পা মচকে এখন দাওয়ায় শুয়ে কাতরায়। জীবনের এখন মাথা খারাপ দশা। নুন ভাতের জোগাড় করবে, নেকির চিকিৎসা করবে, না জল আনবে! এক-এক সময় রাগ সামলাতে না পেরে নেকিকেই দু-চার ঘা কষিয়ে দেয়। মার খেয়েও নেকি কাঁদে না। হাসে। দু-হাত বাড়িয়ে বলে, আহা রাগ হইছে বাবুর! এসো গো রাগ মিটকে দেই। বলে সে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এসে জীবনের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। রাগ হলেও প্রাণে ধরে আর নেকিকে ঠেলে ফেলতে পারে না জীবন। রাগ-দুঃখ-অভিমান সব যেন জল হয়ে, কাদা হয়ে বেরিয়ে যায়।
ওই যে হাসু, হাসিনা চলেছে কাঁখে কলসি নিয়ে, মুখ ভার, চোখে পানি। মাঝে মাঝেই ফুঁপিয়ে উঠছে সে। সাতদিন আগে ওর চার বছরের রুগ্ন ছেলে রূপুকে মাটি দিয়েছে। মরার আগে তেষ্টার পানিও পায়নি। পানি ছিল না। ঘটিবাটি সব শূন্য। সারা বাড়ি হাঁটকে পাটকেও মেলেনি। মরণকালে গালে পানি দিতে হয়— এটা বোধহয় আল্লা ওর কপালে লেখেনি। ওর বাপ না পেরে ছুটে গিয়ে ডাঁসা নদীর নোনা পানি এনে মুখে দিয়েছিল। হাসিনা এখন হাঁটছে আর ইনিয়ে কাঁদছে, ও রূপু র্যা, আমি তুমারে পানি খাবাতি পারলুম না বাপ। ও আল্লা আমারে তুলকে ন্যাও গো, রূপুর কাছে পেঠকে দ্যাও গো--।
ওই যে মরি, মরিয়ম, বছর আটেক বয়েসের কচি মেয়ে। দবিরের ভাইয়ের বেটি, ওর মা জ্বরের তাড়সে বিছানায়। বাধ্য হয়ে কচি মেয়েটা আজ পথে নেমেছে। ঠিকমতো হাঁটতে পারছে না জলের ছোটো কলসি নিয়ে। পড়ছে চলকে চলকে।
পিছন থেকে ঝোমরা বলে, ও মরি, জল বাড়ির তক্ যাবে তো র্যা!
ওদের পিছনে বিউটি, মতি, তুলসী, মাধব। সকলেই হেসে ওঠে। সবার পিছনে শঙ্কর। সে হাসতে পারছে না। হাসি আসছে না কেন? শঙ্কর নিজের বুকে হাত বোলায়। নাহ্, কোথাও তো হাসির মতো কোনও ব্যাপার নেই। নেই কেন? ও কি পাথর হয়ে গেল! চলছে ফিরছে খাচ্ছে পান করছে-- সবই তো মানুষের মতো। তবে রাগ দুঃখ হাসি কান্না আসে না কেন? এসব না থাকলে মানুষ কীসে!
শঙ্করের চোখ ছুটে যাচ্ছ মরিয়মের দিকে। ঠিক ওই বয়েসের মেয়ে ছিল ওর। রাইমণির যে কী হল, কী ভূতে ধরল, দুম করে বলে বসল, থাকব না তোমার ঘরে। ভাত নি, জল নি-- নাথি মারি অ্যামন ধারা সংসারে। বলে মাঠের ধারে বটগাছে ঝুলে পড়ল মেয়েকে নিয়ে। শঙ্কর সেই থেকে অনুভূতিহীন। চলতে হয়, চলছে। বুড়ো বাপ মা আছে, তাদের জল দরকার, আনছে। তারপর মাঠের ধারে বটগাছের তলায় শুয়ে থাকছে চুপচাপ। ওর যেন বারবার মনে হচ্ছে রাইমণি যে-কোনও সময় গাছ থেকে নেমে আসবে। মেয়েকে ওর কোলে তুলে দিয়ে মুখ ঝামটা দেবে, পারি না বাপু, ন্যাওদিনি, মেয়ার ঝামালি সামলাও।
হাঁটতে হাঁটতে চোখ তুলল শঙ্কর। সূর্য পুরোপুরি নিভে গেছে। ঘোর আঁধারের পোঁচ লেগেছে মাঠের শরীরে। বাইলানির জঙ্গল যেন থাবা উচিয়ে গর্জন করছে। ওই তো খানপুরের বাঁক। এবার তো সাবধান হতে হয়। লোকে বলে খানপুরের বাঁকে ভূতের বাসা। ওরা বেকায়দায় পেলে ঠেলে ফেলে দেয় হাবড়ের মধ্যে। জীবনের বউ-এর পা মচকেছে, সে তো ওইসব ভূতের কাণ্ড। শঙ্কর তবু নির্বিকার। হাঁটছে দুলে দুলে, নেচে নেচে। সামনে নগেন বুড়ো একবার হাঁক দিল, বাঁক আইছে গ, সাবধান-সাবধান--।
আর তখনই কাদেরের চোখে পড়ল, খানপুরের বাঁকের মুখে একটা বাচ্চা ছেলে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। একা। দেখেই ওর হাত পা হিম হয়ে গেল।
ছেলেটাকে দেখেছিল হাসুও। দেখেই সে দিকবিদিক জ্ঞানহারা হয়ে চিৎকার দেয়, ও রূপু, রূপু র্যা, ওহানে দেঁড়কে আচিস ক্যানে বাপ?
হাসু এগিয়ে যাচ্ছিল, তখনই ফুচি সর্দারনি ওর পথরোধ করে দাঁড়ায়, তুই পাগল হলি নাই! কুতকে রূপু! ও কি তোর রূপু, দ্যাখ ভালো কর্যে!
হাসু তবু মানে না, কেঁদে বলে, হ্যাঁ, ওই রূপু--।
শরিফা বলে, তুই কি চোখির মাথা খেইচিস নিকি! সব ভুলকে গেচিস মা! আয়-আয়দিনি।
না, আমি ঝাব না। আমার রূপুরে নে ঝাব। বলে সে চিৎকার ছাড়ে, ও রূপু, আয়
বাপ--।
ছেলেটা পা পা এগিয়ে আসছিল, কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, আমারে পানি দে—পানি খাব।
মবিন পিছন থেকে চিৎকার করে ওঠে, খপরদার, আর যেও না, ও শালো জিন, ধরকে নেবে।
হাসু তবু শোনে না। পাগলের মতো ছুটে চলে। সঙ্গে সঙ্গে গোটা দল টের পায় খানপুরের বাঁক বেয়ে, বাইলানির জঙ্গল ভেদ করে একরাশ ছায়া ওদের দিকে এগিয়ে আসছে। শব্দহীন পায়ে ওদের ঘিরছে, ঘিরে ফেলছে। ঘোর অন্ধকার চারদিকে। একটু পরে সেই অন্ধকার মুখ ব্যাদান করল। গমগম আওয়াজ উঠল, জল দে, পানি দে--।
চার
যেন এইমাত্র একটা যুদ্ধ হয়ে গেল। মহিডাঙার আদিগন্ত বিস্তৃত মাঠ, ঘোর ঘোর আঁধার, ওপাশে বাইলানির জঙ্গল, এপাশে থই থই ডাঁসা নদী-- এ যেন যুদ্ধেরই পটভূমি। আর সৈন্যসামন্ত ওই পড়ে আছে মাঠের বুকে, আলের ধারে, শীর্ণ খালপাড়ে। মাঠে ধান, খালে জলকাদা, তারই গায়ে কেউ কেতরে, কেউ শুয়ে, কেউ বসে, কেউ উপুড় হয়ে। বাতাসে শো শোঁ। বৃষ্টি ফোঁটা পড়ছে টুপিয়ে টুপিয়ে। ওদের চোখ মুখ শরীরে জলের স্পর্শ। জলের অভাব মিটিয়ে দিচ্ছে যেন। কেন না জল, মহার্ঘ জল আর ওদের হাতে নেই। সব বেদখল। খানপুরের বাঁকে অন্ধকারে অন্ধকার হয়ে যারা এসেছিল, ঘিরে ধরেছিল ওদের, তাদের মুখ ঢাকা ছিল গামছায়, কাপড়ে কিংবা শাড়িতে। তাদের হাতে ছিল লাঠি, বাঁশ, দা, সড়কি। অস্ত্র তুলে একটাই কথা ছিল সকলের মুখে, জল দে, পানি দে—।
প্রথম ঘা খেয়েছিল নগেন। লাঠির বাড়ি পিঠে পড়তেই ‘ও বাবা গো’ বলে টাল খেয়ে পড়ার আগেই মাথার কলসি কে যেন লুফে নিল। অন্ধকারে রীতিমতো যুদ্ধই হয়ে গেল। তবে গোটা যুদ্ধটা হল এক-তরফা। ওরা তৈরি ছিল। বনবন লাঠি সড়কি ঘুরিয়ে কাত করে ফেলে সবাইকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কলসি-বালতি-ব্যারেল সব বেদখল। জল পড়তে দিল না। তার আগেই চলে গেল ওদের হাতে। মুহূর্তেই শরীরগুলো মিশে গেল অন্ধকারে। খানপুরের বাঁক পেরিয়ে বাইলানির জঙ্গলে উধাও। পায়ের ধুপধাপ আওয়াজ ছিল, তাও মিলিয়ে গেল বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দে।
আর কোনও শব্দ নেই। কোনও চিৎকার চেঁচামেচি কান্নাকাটি-- তাও না। কেউ কাঁদবে না, স্থির প্রতিজ্ঞা যেন সকলের চোখেমুখে। মুহূর্তেই ওরা যেন সর্বস্বান্ত, জল- পানি হারা, ঘটনা এত দ্রুত ঘটেছে যে, ওরা বোবা মেরে গেছে।
বুড়ো নগেন এতক্ষণে ধাতস্থ হয়। হাত মুঠো করে, দাত খিঁচিয়ে বলে, শালোদের যেদি একবার উলার চক পানে নাই, দেখ্যে নুবো কত্ত বড়ো লুটেরা ওরা!
ওর পাশে ফুচি সর্দারনি মাথা চেপে বসে আছে। সেটা যত না আঘাতে, তার চেয়েও বেশি লঙ্জায়। একটা বাচ্চা মেয়ে কিনা সটান ওর পাছায় লাথি মারল! ঘুরে দাঁড়াবার আগেই কলসি নিয়ে হাওয়া। ফুচি রাগ আর অভিমানে বলে ওঠে, তোমার কেরদানি জানা আছে বুড়া। পারো শুধু মেয়ামানষের পাছুতে খিটকি মারতি। এতগুনা লোক এল, মাগি মিনসে মিলে সব আঙগা জল কেড়কে নেলে, পারলে ঠেকাতি!
আলধারে বসে আছে কাদের। ওর কপাল চুঁইয়ে এখনও রক্ত ঝরছে। সেই অবস্থায়
নগেনকে বলে, চিনবা কী কর্যে, উয়াদের মুক দেখিছ?
ঝোমরা সর্দার এতক্ষণে উঠে বসে। পায়ে সে জোর চোট পেয়েছে। ও একজনের পা চেপে ধরেছিল, আমার জল কেড়কে নিওনি বাপ, আমার কচিডার খুব অসুখ। জল না পেলি মরকে যাবে বাপ।
কথা শোনেনি ওরা। সাঁই জোরে লাঠির বাড়ি বসিয়ে দেয় পায়ে। ঝোমরা ব্যথা যন্ত্রণা ভুলে চিৎকার করে ওঠে, শালোদের চিন্যাছি--।
মবিন সামনে এসে বলে, চিন্যাছিস! কারা?
ওরা সেই মাঠখুলির দল। আজ ওরা জল পায়নি, তাই আঙগা জল লুটকে নেলে।
মবিন দাঁতে দাঁত ঘষটায়। চোখে জ্বলে আগুন, বুকটাও গন গন করছে। এতক্ষণে
বোঝে আজ ও একটা মহা অন্যায় করেছে। ওদের একজনের পা ধরেছিল তাক করে। চিনেছিল ভাই বেরাদর বলে। ফিসফিসিয়ে বলেছিল হেই বাপ, আল্লার বান্দা আমি, আমারে ছেড়কে দ্যাও।
অন্ধকার থেকে সড়কি উঠে এসেছিল ওর সামনে, সেই সঙ্গে বাঘের মতো গর্জন,
ঠ্যাক্যায় পড়লি সব ব্যাটা আল্লার বান্দা। মার শালোরে--।
আঘাতটা যত না শরীরে, তার থেকেও বেশি লেগেছে মবিনের মনে। নিজেকেই ছি-ছিক্কার করতে ইচ্ছে হচ্ছে। ইস, কী বলে ওদের পা ধরতে গিয়েছিল! লুঠেরার কি জাতধর্ম থাকে!
শান্তি আমিনা তখনও ঠক ঠক করে কাঁপছিল। ওরা বাধা দেয়নি। জল চাওয়ার আগেই কলসি বাড়িয়ে দিয়েছিল। তা সত্ত্বেও ওদের কালো কালো হাতগুলো শান্তি আমিনার বুক পাছা ভালো করে মুচড়ে দিয়ে গেছে। আহ্ লঙ্জা! শিহরণ ওঠে শরীরের রোমকূপ বেয়ে। আর সেই লজ্জা ঢাকতে ওরা পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে। সরতে থাকে আরও অন্ধকারে ।
চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে মতি, বিউটি তুলসী। সকলেই যেন নিঃস্ব। হাত পা ছড়িয়ে বিন বিন করে কাঁদছে। শুধু মরিয়মের চোখেমুখে কোনও ভাষা নেই। ঘটনার আকস্মিকতায় সে যেন বোবা মেরে গেছে।
খালপাড়ে তখন শরিফার কপালে ভিজে গামছা চেপে ধরছিল জীবন। এদিকের যা কিছু যুদ্ধ, প্রতিরোধ, সে তো শরিফাই করেছিল। ওই তো মুখ ধরেছিল প্রথম, ওরে ও ড্যাকরা, পানি খাবি! মুতকে খা। তুদের মায়ের মুত খা, বাপের মুত খা--। বেশি বলতে হয়নি, তার আগেই লাঠি ওর মুখ বন্ধ করে দেয়।
জীবন বলে, ক্যানে মুখ ধরো মিতে বউ!
শরিফা কেঁদে ফেলে, ও মিতে আমি কেমনে ঘর ঝাব! তুমার মিতে আজ কী খাবে
বলোদিনি?
মবিন বলে, সব তো হল, অ্যাখুন কী করবি?
এতক্ষণে সবাই চুপ। সত্যিই তো, যুদ্ধ শেষ হয়েছে, ওদের সর্বস্ব গেছে, এবার কী! ফুচি সর্দারনি বুক চাপড়ে কেঁদে ওঠে, ও বাপ, ঘরকে আজ একফোঁটা জল নি, কী করব হেই বাপ!
নগেন আগের মতো দাঁত খিঁচোয়, কী করব, আমরাও লুটব। আঙগা জল লুটেছে,
আমরা ছেড়কে দুবো!
কথাটা রাগে বলা। কিন্তু সেটাই যেন হতচকিত করে দেয় সবাইকে। সত্যি, এভাবে
ওরা কোথায় ফিরবে! কী হবে গিয়ে! সমস্যা সকলেরই আছে। কেউ কি বুঝবে ওদের
জল লুঠ হয়েছে!
মবিন দাঁতে দাত ঘষটে সায় দেয়, হাঁ, ঠিক বলেছ খুড়া। আঙগা য্যাখন গেছে, আমরা ক্যানে ছেড়কে দুবো! আসো দিনি মহিডাঙার সাঁকোর ধারে যাই।
সেহানে কী হবে, হেই মবিন? জিজ্ঞেস করে কাদের ।
মবিন বলে, খানপুরের দলডা আসবে। ওরা তো আঙগা পরে ছিল। শিগগির পা চেলকে এসোদিনি।
পারবি!
পারতিই হবে।
ঝোমরা তখন পায়ের ব্যথা ভুলে সটান উঠে দাঁড়ায়। নিজের বুকে কিল বসিয়ে বলে, পারব না মানে! দ্যাখ না সব কটারে আজ শুইয়ে দুবো। চল শালো, মহিডাঙার সাঁকোর বাঁশ খুলকে দাঁড়াই।
সবাই সায় দেয়। দলটার মধ্যে আবার তাগিদ দেখা দেয়। নগেন যথারীতি সবার
আগে। মুখ খিঁচিয়ে বলে, পা চেলকে আয়দিনি, ওরা এসি পড়বে।
শান্তি আমিনা দাঁতে দাঁত ঘষটায়। ওরা যেন সেই শত্রু, যারা ওদের ইজ্জতের অপমান করেছে, ওদের কিছুতেই ছাড়া হবে না। ফিসফিসিয়ে ওরা পরস্পরকে বলে, চল--।
শরিফাকে টেনে তোলে জীবন। বলে, পারবে মিতে বউ?
শরিফা মুখ ঝামটা দেয়, পারব না মানে! ড্যাকরাদের আজ চোকি সরষে ফুল দেইখ্যে ছাড়ব। চলোদিনি, বেশি প্যাচাল পেড়ো না।
দলটা আবার ফিরতি পথে মহিডাঙার খালপাড়ে পৌঁছয়। হাঁটে গুটিগুটি, প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে। বাঁশের নড়বড়ে সাঁকো থেকে বাঁশ খুলে নেয় একটা একটা করে। দাঁতে দাঁতে ঘষটানি। চোখে আগুন। বাঘের মতো ওত পেতে থাকে। শুরু হয় আর এক যুদ্ধের প্রস্তুতি।
শুধু হাসু তখনও খানপুরের বাঁকে বসে। আকুল চোখে খুঁজছে ওর রূপুকে। এই তো ছিল এখানে, কোথায় গেল ছেলেটা! হাসু গুনগুন করে বলে, ও রূপু, ও বাপ কমনে গেলি! পানি চেলি, পানি খাবি নে?
আর শঙ্কর তখন খালপাড়ে শিরীষ গাছের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে রাইমণি গাছ থেকে যেন নেমে এল সরসরিয়ে। মেয়েটাকে ওর কোলে দিয়ে বলল, কী গো জল দোবা না! তেষ্টায় যে ছাতি ফেটকে গ্যালো। কী গো জল দাও--জল--!
( অনুষ্টুপে পূর্বপ্রকাশিত)
ব্যাপক গল্প !
আপনি কি মহাযুদ্ধের পটভূমি গল্পসংকলনের লেখক? যদি তাই হয় আপনার গল্প আমি বহুদিন ধরে মুগ্ধতার সঙ্গে পড়ি। বসিরহাট অঞ্চলকে চিনতে শেখা যায় আপনার লেখাগুলো পড়লে। প্রসঙ্গত আপনি সুন্দরবনের পটভূমিতে বাঘাচাঁদ সিরিজ লিখবেন বলেছিলেন আপনারই একটা অন্য লেখায়। জানি না সেটা বেরিয়েছে কী না। ওটার জন্য আগ্রহে বসে আছি।
আর যদি আপনি অন্য অনিল ঘোষ হন তাতেও অসুবিধে নেই। এই গল্পটা দারুণ লাগল।
শাক্যজিৎ, আমি সেই অনিল ঘোষ। আমরা বোধহয় পরস্পরকে চিনি। বাঘাচাঁদ সিরিজ শেষ হয়েছে, তবে বই করার সুযোগ ঘটেনি এখনও। জানি না আদৌ হবে কিনা।
ভেতর শুদ্ধ নাড়িয়ে দিল এই গল্প। অসাধারণ!
হবে বাঘচাঁদ সিরিজ।
অনেকদিন পর একটা সুন্দর গল্প পড়লাম। দারুন পরিনত লেখা।
অনিলদা,আমি আপনাকে চিনি লেখার সূত্রে। সামনাসামনি আলাপ হয়নি কখনো। আপনার গল্প থেকে ভাষা গঠন ও নির্মাণ এগুলো শিখি। কীভাবে লিখতে হয় শিখি। বসিরহাট অঞ্চলটিকে পড়তে পারি। আমার কাছে আপনি এই সময়ের এক ইম্পরট্যান্ট লেখক। আমার মনে আছে আমি পাশাপাশি দুটো বই পড়ে খুব ইন্সপায়ারড হয়েছিলাম। আপনার বইটা আর ট্যাঁকের মাঠে মাধবী অপেরা--নীহারুল ইসলামের। আখ্যান নির্মাণ কেমনভাবে হয় জানছিলাম। এরকম কিছু কিছু বই আমার কাছে মূল্যবান হয়ে থাকে। অমর মিত্রর মাঠ ভাঙে কালপুরুষ বা আনসারউদ্দিন বা মুর্শিদ এ এম। আপনার গল্পগুলোও তাদের মধ্যেই থাকবে।
বাঘচাঁদ কোথাও পড়তে পাওয়া যাবে কি? মানে কোথাও কি বেরিয়েছিল? তাহলে সংগ্রহ করতাম।
দাদা অসাধারণ একটি লেখা পড়লাম, দীর্ঘ ১০বছর কাটানো এই প্রতিবেশী গ্রামগুলির সাথে আমি ভীষণভাবেই পরিচিত।লেখাটি পড়ে এক আত্মিক টান অনুভূত হচ্ছে। ভালো থাকুন আরও লেখা ছবি হয়ে উঠুক আপনার কলমে।
অসাধারণ লেখা। প্রান্তিক মানুষের কথা, তাদের উচ্চারণে বলা সহজ কথা নয়। ধন্যবাদ আপনাকে।
অসাধারণ লাগল
ভালো লাগলো।
শুধু মহাযুদ্ধের পটভূমি নয়,সুন্দরবনের প্রান্তিক মানুষের জীবনযুদ্ধের অনুপম আলেখ্য হিসাবে গল্পটি মর্মস্পর্শী। এভাবেই আপনার কলমের যুদ্ধ জারি থাকুক।
'মহিডাঙার খালপাড়ে পৌঁছয়। হাঁটে গুটিগুটি, প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে। বাঁশের নড়বড়ে সাঁকো থেকে বাঁশ খুলে নেয় একটা একটা করে। দাঁতে দাঁতে ঘষটানি।' - শেষ দিকের এই বর্ণনা অন্তহীন এক মহাযুদ্ধ বা বিপ্লবের দিক নির্দেশ করে। এই লেখা পড়ে আমরা শিহরিত হই , আর করুণা হয় আমরা যারা খুব অল্পতেই আপোষকামী।
খুব ভালো লেখা, সত্যের ।মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়.