এরপর আসি বাঙালির জলখাবার বা ‘টিফিনে’। পাউরুটি আমাদের দেশে বিদেশি প্রাতরাশ হিসেবেই সুপরিচিত। তবে স্বদেশি আন্দোলনের যে সময়টায় বিদেশি দ্রব্য বর্জনের রমরমা ঠিক তখনি শুরু হয়েছিল বাংলার বেকারি কালচার। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের শিষ্য শরত্চন্দ্র ঘোষ ‘আর্য বেকারি অ্যান্ড কনফেকশানারি’ খুলে বাঙালির হাতে তুলে দেন দেশীয় পাউরুটি। একখানি বই লিখেছিলেন তিনি ‘পাশ্চাত্য পাকপ্রণালী ও বেকারি দর্পণ’। এই দেশীয় বেকারির পাউরুটি অচিরেই জনপ্রিয় হয়েছিল এমনকি বিদেশিদের কাছেও। ‘পাকরাজেশ্বর’ বা ‘ব্যঞ্জনরত্নাকর’-এ জলখাবার নিয়ে পৃথক অধ্যায় না থাকলেও রুটি, পরোটা, লুচি, নিমকির বিশদে উল্লেখ আছে। ‘পাকরাজেশ্বর’-এ ফিরঙ্গিরোটিই পাউরুটি।
ব্রিটিশ শাসনামলেও ভাতের উপরই জোর দিয়েছে বাঙালি। তবে লুচি-পরোটা ছিল বিলাসিতা। বিংশ শতকে রুটি খাওয়ায় পুরোদস্তুর অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। গ্রামবাংলায় তিনবেলাই ভাত কিন্তু শহুরে মানুষের এত সময় কোথায়? তাই তারা রুটি-পাউরুটিকেই বেছে নিয়েছিল।
কবিকঙ্কণ ‘চণ্ডীমঙ্গল’-এ ফলাহারের উল্লেখ করেছেন। এই ফলার বা ফলাহার কিন্তু আমাদের জলখাবারের অন্যতম অঙ্গ এখনও।
“যদি ভালো পাই মহিষা দই চিনি ফেলি কিছু মিশায়ে খই
পাকা চাঁপাকলা করিয়া জড়ো খাইতে মনের সাধ বড়ো”
আবার
“স্নান করি দুর্ব্বলা, খায় দধি
খণ্ডকলা চিঁড়া দই দেয় ভারিজনে”
এই ফলারের কথায় মনে পড়ে চৈতন্যদেবের আমলে ভাণ্ড ভরা চিঁড়েমুড়কি দধি ফলাহারের কথা। তাই বুঝি ‘চৈতন্যচরিতামৃত’-এ বৈষ্ণব সেবায় এই ফলাহারের ছড়াছড়ি। সাধুসেবায় ভাণ্ডারাতেও উত্কৃষ্ট সব অনুপান সহযোগে ফলার নিবেদনে তাঁদের খুশি করার কথা, মুড়ির উল্লেখ রয়েছে। সেখানে মুড়ির নাম ‘সান্দি তণ্ডুল ভাজা’। মানিক গাঙ্গুলি তাঁর ‘ধর্মমঙ্গল’-এ মুড়কিকে রেখেছেন মিষ্টান্নের তালিকায়।
এরপর সংস্কৃত শব্দ রোটিকা থেকে রুটির প্রসঙ্গও এসেছে ‘শ্রী চৈতন্যচরিতামৃত’-এ।
১৮৩১ সালের ‘পাকরাজেশ্বর’ বা ১৮৫৮-র ‘ব্যঞ্জনরত্নাকর’ এর মতো রান্না বিষয়ক গ্রন্থে রয়েছে দধিরোটিকা, সূক্ষ্ম রোটিকা, বেসনিরোটিকা বা দুগ্ধরোটিকার কথা। ফিরঙ্গরোটি বা পাউরুটির প্রসঙ্গ এসেছে সেখানে। আবার প্রিয়রোটিকা থেকে এসেছে বাঙালির আদরের পরোটা। আটার বিশেষ রুটি যা ঘিয়ে ভাজলে পরতে পরতে খুলে যায়। মুসলমান বাবুর্চিদের হাতে বানানো হলেও বাংলায় সুলতান আমলের প্রভাবে যা বাঙালির তেকোনা পরোটায় উন্নীত হয়।
এবার আসি বাঙালির প্রিয় জলখাবার লুচি প্রসঙ্গে।
বাঙালির প্রিয়রোটিকা বা পরোটা কিংবা পুরিকা বা কচুরি এই দুই আদি অনাদি জলখাবারের পূর্বসূরি হল বঙ্গহেঁশেলের অন্যতম জ্বলজ্বলে নক্ষত্র লুচি। মানিক গাঙ্গুলির ‘ধর্মমঙ্গল’ থেকে আরম্ভ করে ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের ‘অন্নদামঙ্গল’-এও লুচির উল্লেখ রয়েছে। ‘জীবনস্মৃতি’-তে সেই কবে পড়েছিলাম ভৃত্যরাজকতন্ত্রে ঠাকুরবাড়ির জলখাবারের জন্য কাঠের বারকোশে রাখা স্তূপীকৃত লুচির কথা। রবিঠাকুর ভীরু বাঙালিদের ব্যঙ্গ করতে গিয়ে ‘মানসী’ কাব্যগ্রন্থের ‘ধর্মপ্রচার’ কবিতায় উল্লেখ করেছেন লুচিপ্রীতি।
‘‘সাহেব মেরেছি! বঙ্গবাসীর
কলঙ্ক গেছে ঘুচি।
মেজবউ কোথা! ডেকে দাও তারে—
কোথা চোকা, কোথা লুচি!
না পাইলে কি জানি কী করে বসি!’’
ঈশ্বরগুপ্তের ‘হেমন্তে বিবিধ খাদ্য’ কবিতাতেও স্থান পেয়েছে বাঙালির প্রিয় লুচি।
‘‘দেবতার প্রিয় খাদ্য সকলের আগে।
ময়দার কাছে কিছুই না লাগে।।
দুধে গমে ঘিয়ে ভাজা যার নাম লুচি।
ছেলেবুড়ো সকলেরই ভোজনান্তে রুচি।’’
আর রসরাজ অমৃতলালের কথায় রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের গলায় ‘লুচি মাহাত্ম্য’ এই টপ্পা অঙ্গের গানটি কে না শুনেছে?
‘‘ওগো লুচি তোমার মান্য ত্রিভুবনে
তুমি অরুচির রুচি মুখমিষ্টি শুচি
আবার খাইয়ে ধন্য জীবনে
লুচি তোমার মান্য ত্রিভুবনে’’
যদি একান্তই না শুনে থাকেন, শুনে নিন এক্ষুনি এখানে!
কচুরির বাঙালিয়ানা সর্বজনবিদিত। কারণ উত্তর থেকে দক্ষিণ, পুব থেকে পশ্চিম কলকাতার অলিগলিতে এখনও থিকথিক করছে কচুরির পুরানো দোকান। সুশ্রুতের ভেষজ শাস্ত্রের পুঁথিতে রয়েছে কচুরির সংস্কৃত নাম পুরিকার কথা। মাষকলাই বেটে নুন, আটা আর হিং মিশিয়ে ময়দার লেচিতে পুর দিয়ে বেলে তেলে ভেজে নাকি মুখরোচক পুরিকা বানাতে হত।
মনে পড়ে? রসরাজ অমৃতলালের সেই ‘লুচি মাহাত্ম্য’র গানের কথায় লুচির সমগোত্রীয় বাদবাকি খাবারের কথা?
‘‘তব কন্যার নাম কচুরি সুন্দরী
খাস্তা বলে আবার সর্বদা আদুরি
তব সহোদর ভাই রুটি ও পরোটা
আর ডালপুরি ব্যাটা সে যে তোমার জ্যাঠা’’
আর সেইসঙ্গে এসেছিল বাঙালির প্রিয় শিঙাড়া। সেটিতেও মোগল প্রভাব। সংবোসাগ > সাম্বুসাক > সাম্বোসা > সামোসা বা শিঙাড়া। সাম্বুসাক, সাম্বোসা বা সামোসায় মাংসের কিমার পুর ভরা থাকত। ষোড়শ শতকে পোর্তুগিজরা ভারতের মাটিতে পা রাখার পর ‘আলু’ নামের চমৎকার এক সস্তার সবজি যেই প্রবেশ করে তখনই বুঝি শিঙাড়ার পুরেও আলু প্রবেশ করে। আপামর বাঙালির দরবারে তা আলুর পুর দিয়েই সস্তায় জনপ্রিয় হল।
মধুরেণসমাপয়েৎ হবে পিঠেপুলির কথায়। তার আগে চাই পঞ্চরসের দুই অন্যতম রস অম্ল বা টক/রেলিশ/চাটনি/অম্বল আর বাকি থাকে মিষ্ট রসের কথা। নয়তো বাঙালির পঞ্চব্যঞ্জন অসমাপ্ত থেকে যায়। শুভকাজের ভোজ কিংবা দেবতার ভোগ চাটনি ছাড়া অসম্পূর্ণ থেকে যায়। গোটাষষ্ঠীর সজনেফুল ছড়ানো টোপা কুলের অম্বল অথবা রান্নাপুজোর চালতার টক কিংবা দীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজোয় রাঙালু, বড়ি, মুলোর তেঁতুল টক আর নিদেন লেবুপাতা দেওয়া ঠাম্মার চটজলদি হাত অম্বল মনে পড়লেই নোলা সকসক করে ওঠে আমাদের। কথাতেই বলে, “নুন চুপচুপে নেবুর রস, ত্যাঁদড়া ভাতার মাগের বশ”!
বাঙালির শেষপাতে এই প্রবল টক প্রীতির কারণেই বুঝি মুখেমুখে একসময় ফিরত এই প্রবাদটি।
ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’-এ ভবানন্দ মজুমদারের স্ত্রী পদ্মমুখী দেবী অন্নদার পুজোয় ব্রাহ্মণ ভোজনের আয়োজনে রাঁধছেন... “অম্বল রাঁধিয়া রামা আরম্ভিলা পিঠা।।”
অর্থাৎ টকের পরেই আসে মিঠা।
বাঙালির হেঁশেলের ঝুলকালিতে টমেটো থেকে আমড়া, করমচা থেকে আনারস, ছড়া তেঁতুল থেকে আলুবখরা, কাঁচা আম থেকে পেঁপের চাটনি যুগে যুগে বিবর্তিত হয়ে জন্ম নিয়েছে নতুন ভাবে, নতুন রাঁধুনির হাতের জাদুতে। একসময় বেগুন, ঢ্যাঁড়শ, আলু বা ডুমুরের টকও হত। আর চল ছিল এই অম্বলে চুনোচানা মাছ ভেজে ফেলে দেওয়ার। চিত্রা দেবের ঠাকুরবাড়ির রান্নাতে রয়েছে কচি তেঁতুলের স্ফটিক জলের কথা।
এবার মিষ্টিমুখের পালা।
মধ্যযুগে ধর্মপূজায় মদ্যমাংসের সঙ্গে পিঠেও নিবেদন করা হত। মধ্যযুগের বাংলা মঙ্গলকাব্যে নানাপ্রকার পিঠে ও পিঠে গড়ার বিচিত্র সব উপাখ্যানের উল্লেখ আছে।
বিজয় গুপ্তের ‘পদ্মপুরাণ’-এ সনকার ছয় পুত্রবধূকে নিরামিষ-আমিষ রান্নার পর নানাপ্রকার পিঠে তৈরি করতে দেখা যায়।
“মিষ্টান্ন অনেক রাঁন্ধে নানাবিধ রস
দুইতিন প্রকারের পিষ্টক পায়স।
দুগ্ধে পিঠা ভালো মতো রান্ধে ততক্ষণ
রন্ধন করিয়া হইল হরষিত মন”
কবিকঙ্কণের চণ্ডীতে রয়েছে দধি, চিনি, ক্ষীর, রাবড়ি, মন্ডা, ছানার উল্লেখ। দুর্ব্বলা হাট থেকে এইসব উপকরণ কিনে আনে পিঠে বানানোর জন্য।
“নির্ম্মাণ করিতে পিঠা, বিশা দরে কিনে আটা, খণ্ড কিনে বিশা সাত আট”
একই সময়ে চণ্ডীদাসের পদে আছে শ্রীকৃষ্ণের জন্মের পরে নন্দের মিঠাই বিতরণের উল্লেখ। ‘চৈতন্যচরিতামৃত’-এ শচীমাতা পুত্রকে খেতে দেন প্যাঁড়া, সরপূপী, অমৃতখণ্ড, কর্পূরীপিঠা, পদ্মচিনি প্রভৃতি মিষ্টান্ন।
জয়ানন্দের ‘চৈতন্যমঙ্গল’-এও রয়েছে পিঠেপুলির জয়াজয়াকার। নিমাইয়ের সঙ্গে লক্ষ্মীদেবীর বিবাহের পরে নববধূ প্রথমদিন রান্নাঘরে ঢুকেছেন শাশুড়িমাতার সঙ্গে। রন্ধনপটীয়সী লক্ষ্মীদেবী সেদিন রাঁধলেন এরূপ।
“পঞ্চাশ ব্যঞ্জন অন্ন রাঁধিল কৌতুকে
পিষ্টক পায়স অন্ন রান্ধিল একে একে।”
কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাস গ্রহণের শেষে শ্রীচৈতন্য ঈশ্বর প্রেমে বিহ্বল অবস্থায় তিনদিন অনাহারে ছিলেন। পরে তিনি গঙ্গা পেরিয়ে শান্তিপুরে অদ্বৈত ভবনে এসে উপবাস ভঙ্গের সময় প্রভুর জন্য ভক্তরা যে নানাবিধ নিরামিষ ব্যঞ্জন প্রস্তুত করেছিলেন তার মধ্যে পিঠে ছিল প্রধান—“মুদগ বড়া, মাস বড়া কলা বড়া মিষ্ট/ ক্ষীর পুলি নারিকেল পুলি পিঠা ইষ্ট।”
আবার ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে কালকেতুর বউ ফুল্লরার কাছে পিঠেপুলির আবদারের কথাও ছিল —
“মনে করি সাধ খাইতে মিঠা
ক্ষীর নারকেল তিলের পিঠা।”
পঞ্চদশ শতকের শেষ ভাগে বিজয় গুপ্তের ‘মনসামঙ্গল’-এ বণিকসুন্দরীর রন্ধনযজ্ঞেও নানা প্রকার পিঠের উল্লেখ ছিল।
“মিষ্টান্ন অনেক রান্ধে নানাবিধ রস
দুই তিন প্রকারের পিষ্টক পায়স
দুগ্ধে পিঠা ভালো মতো রান্ধে ততক্ষণ
রন্ধন করিয়া হৈল হরষিত মন।”
১৫৭৫-এ দ্বিজ বংশীদাসের ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যে সনকার রান্না করা সুস্বাদু পদের মধ্যেও পিঠে ছিল।
“কত যত ব্যঞ্জন যে নাহি লেখা জোখা
পরমান্ন পিষ্টক যে রান্ধিছে সনকা
ঘৃত পোয়া চন্দ্রকাইট আর দুগ্ধপুলি
আইল বড়া ভাজিলেক ঘৃতের মিশালি।
জাতি পুলি ক্ষীর পুলি চিতলোটি আর
মনোহরা রান্ধিলেক অনেক প্রকার।”
অষ্টাদশ শতকে ঘনরাম রচিত ‘ধর্মমঙ্গল’-এ বারবনিতাদের রন্ধন-পারদর্শিতার উল্লেখে রয়েছে তাঁদের হাতে প্রস্তুত পিঠেপুলির বর্ণনা—
‘‘উড়ি চেলে গুঁড়ি কুটি সাজাইল পিঠা
ক্ষীর খণ্ড ছানা ননী পুর দিয়া মিঠা।”
আমাদের ঘটিবাড়ির মুগসামালীর কথা পাই ষোড়শ শতাব্দীর কবি কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর লেখায় চণ্ডীদেবীর আশির্বাদধন্য খুলনা তার স্বামীর তৃপ্তির উদ্দেশ্যে দেবী সর্বমঙ্গলাকে যা যা নিবেদন করেছিলেন তার মধ্যেও। “কলা বড়া মুগ সাউলি ক্ষীরমোন্না ক্ষীরপুলি/ নানা পিঠা রান্ধে অবশেষে।”
আবহমান কাল ধরে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী খাদ্য তালিকায় পিঠের উল্লেখ এপার, ওপার দুই বাংলারই লোকজ ও নান্দনিক সংস্কৃতিরই বহিঃপ্রকাশ। কৃত্তিবাসের ‘রামায়ণ’-এ বাঙালির খাদ্য তালিকায় ‘দধি পরে পরমান্ন পিষ্টকাদি যত’ আছে তেমনি মহাভারতে নল-দময়ন্তীর বিবাহভোজের বিবরণেও ‘সুমিষ্ট পিষ্টক এবং দই’-এর কথা রয়েছে। ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’য় যুক্ত একমাত্র রূপকথা ‘কাজলরেখা’-য় পিঠা হয়ে ওঠে অমৃত সমান। যেমন—
“নানা জাতি পিঠা করে গন্ধে আমোদিত
চন্দ্রপুলি করে কন্যা চন্দ্রে আকিরিত
চই চপরি পোয়া সুরস রসাল
তা দিয়া সাজাইল কন্যা সুবর্ণের থাল
ক্ষীর পুলি করে কন্যা ক্ষীরেতে ভরিয়া
রসাল করিল তায় চিনির ভাজ দিয়া।”
বাঙ্গালির অন্তঃপুরের বিবিধ খাদ্যদ্রব্য অন্তপ্রাণ কবি ঈশ্বর গুপ্তর কবিতা লালনে পিঠেও স্থান পেয়েছিল একসময়।
“আলু তিন গুড় ক্ষীর নারিকেল আর।
গড়িতেছে-পিঠেপুলি, অশেষ প্রকার॥
বাড়ি বাড়ি নেমন্ত্রণ, কুটুম্বের মেলা।
হায় হায় দেশাচার ধন্য তোর খেলা॥”
মুসলমানদের মধ্যে বিয়ের অনুষ্ঠানেও পিঠে তৈরির রেওয়াজ প্রচলিত রয়েছে। তবে “পান পানি পিঠা, এই তিনই শীতে মিঠা”—এই প্রচলিত প্রবচনেই প্রমাণ করে পিঠার ব্যাপারে শীতকালই শ্রেষ্ঠ খেজুর গুড়ের কারণে।
এমনকি ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’র ‘কাজলরেখা’ থেকে ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র ‘কাঁকণমালা, কাঞ্চনমালা’ গল্পে রয়েছে ‘পিট-কুড়ুলির ব্রত’-র কথা, রাজ্যে পিঠা বিলানোর অনুষ্ঠান। ‘চৈতন্যচরিতামৃত’-এ উল্লিখিত ‘ছেনাপোড়া’ আজকের বাংলার দোকানেও মিষ্টি হিসেবে বিক্রি হয়।
বিভিন্ন সময়ে বঙ্গদেশ মুসলিম নবাব ও সুলতানদের অধীনে শাসিত হওয়ার কারণে বাংলার খাদ্যেও সেই প্রভাব দেখা যায়। মোগলদের শাসন আমলে স্বাভাবিকভাবেই মোগল সংস্কৃতি এবং সাহিত্যের পাশাপাশি রন্ধণপ্রণালী এবং খাদ্যাভাসের প্রভাব এ অঞ্চলে বসবাসরত বাঙালিদের উপর পড়ে। তাই বুঝি বর্তমান সময়ের মতো বাখরখানি, পরোটা, কাবাব, হালুয়া, বিরিয়ানি ইত্যাদি বিভিন্ন মোগলাই খাবার ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে দুই বঙ্গেই।
চা এবং পাউরুটি বা কেক, পুডিং এর প্রভাব হল মূলত খ্রিস্টান এবং ইউরোপীয় আগমন তথা বিদেশি খাদ্যাভাসের সুস্পষ্ট প্রভাব যা এখনও বাঙালির অন্যতম ফাস্ট ফুড।
দশ ঘাটের জল খেতে খেতে আমরা বাঙালি আজ এই পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছি। নানা সংস্কৃতি এসে মিশেছে এই বাংলার পাড়ে। পারস্য, পোর্তুগিজ, ইউরোপীয়, চিনা, দিশি কত ঘাটের রান্নার স্রোত এসে মিলেছে বাঙালির হেঁশেলে, স্বাদকোরকে। খাওয়াদাওয়ার বৈচিত্র্য তাই বঙ্গ-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
সবশেষে বাঙালির খাওয়াদাওয়ার পর মুখশুদ্ধির প্রচলন বহুকালের। চর্যাপদে পান ও কর্পূরের উল্লেখ আছে। মুকুন্দরামের ‘চণ্ডীমঙ্গল’-এ গুয়া পানের কথা ছাড়াও পান, সুপারি, হরীতকী ইত্যাদি মুখশুদ্ধির কথাও আছে।
চমৎকার! রসনা ভরানো লেখা। এক জায়গায় বিস্তৃত ও বিস্তারিত সময়কে ধরা কৃতিত্বে।।
একটি আপত্তি থাকলো। সুশ্রুতের ভেষজ শাস্ত্র বলে কিছু নেই। তাছাড়াও আমার সুশ্রুত পাঠে পূরিকার উল্লেখ পাইনি। পূরিকার উল্লেখ রয়েছে মহাভারতে।