মোটের ওপর চন্দ্রদেব এখন মহাজাগতিক বিশ্বের কসমিক সেলিব্রিটি। পেজ থ্রি পুরো কাঁপিয়ে দিয়েছেন। চন্দ্রযানে চেপে মিডিয়ার মেগা প্রজেক্ট এখন চাঁদের বাড়ি অভিযান। paparazziরা এবার সোজা ধাওয়া করেছে টিম নিয়ে। আর কোনো ছাড়ানছেড়েন নেই। চন্দ্রদেব সেখানে বসে বসে ঠিক কী যে করে তা দেখবে, শুনবে আর জানবে বলে। সে পূর্ণিমার আলোয় বসে পা ছড়িয়ে রোমান্টিক কবিতা লেখে না জাল নোট ছাপে? না কী অমাবস্যার অন্ধকারে মেয়েদের ফুঁসলিয়ে প্রেম করে না ড্রাগ পেডলিং করে? চাঁদ বা সোম হয়ত সেখানে বসে illicit সোমরস বানাতে বানাতে মশগুল হয়ে থাকে দ্রাক্ষারসের মদিরায়। সব খোঁজ নেবে ওরা। এমনিতেই অনেক allegations চন্দ্রদেবের বিরুদ্ধে। অনেকগুলো বিয়ে। illegitimate বাচ্চাকাচ্চা। সব মিলিয়ে এই মিডিয়া কাভারেজ আবশ্যক ছিল। সেবার তো জুভেনাইল কোর্টে ছাড় পেয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করেছিল সে। অত্তটুকুনি একটা নাবালক কিশোর। পড়তে এসেছিস গুরুগৃহে আর সেখানে গিয়েই গুরু বৃহস্পতির বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যাকে নিজের রূপে পাগল করে দিলি? গুরুও আবার তাঁর পাঠশালার সবচাইতে মেধাবী ছাত্রটিকে বেশি বকাঝকা করেন নি। বোঝেন সব কিছু। বেস্পতির রূপসী বৌ তারা যে উপোসী ছারপোকা। পাঠের অবকাশে স্ত্রী তারার সঙ্গে তাঁর ছাত্র চন্দ্রের ফষ্টিনষ্টি তিনি যেন দেখেও দেখেন না। তাই বলে সোজা শয়নকক্ষে? তাও ঠিক ছিল। তারাও তো ভালোমন্দ রেঁধে ছেলেটিকে সিডিউস করতেও ছাড়েনি। সব জানেন গুরুদেব। মুশকিল হল তারার পেটে চন্দ্রের ঔরসে সন্তান এসে যাওয়ায়। তিরস্কার করবেন ভেবেও দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের কথায় সে যাত্রায় ক্লিন চিট দিয়েছিলেন বৃহস্পতি নিজেই। গ্রহকুলে লোকলজ্জার ভয়ে। মানেয় মানেয় ওদের অবৈধ সন্তান কে মেনে নেওয়া ছাড়া কীই বা করার ছিল? তারা আর চন্দ্রের পুত্রটি যে আরো মেধাবী, আরো সুদর্শন। মায়া হয় তাঁর বুধকুমার কে দেখলে। নিজে তো সন্তান দিতে পারেন নি। অতএব প্রিয় শিষ্য চন্দ্র যখন সে কাজ সেরেই দিয়েছে সেই বুধ কে প্রতিপালনের দায়িত্ব নিয়েই ফেললেন বেস্পতি। আর চন্দ্র? সে তো সেই অবকাশে শিশুটির দায় এড়িয়ে দিব্য গুরুগৃহ ছেড়ে তখন ছোঁকছোঁক করছে দক্ষের ঘরের আশেপাশে। উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে কারণ দক্ষের সাতাশজন সুন্দরী কন্যা রয়েছে। তার মধ্যে রোহিণীর সঙ্গে একটু বেশিই যেন দহরম মহরম তার।
সবাই মিলে ছোট থেকে ছেলেপুলে কে প্যাম্পার করলে এমনি হয় বুঝি। সেই কোন শৈশবকালে বিষ্ণুর বরে একবার ইন্দ্রের আসন টলমল করে চন্দ্র পেয়েছিল দেবলোকের অধিকার। ব্যাস মাথাটা ঘুরে গেল পুরো। তড়িঘড়ি রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করে ফেলে এক্কেবারে দেবতার পাসপোর্ট হাতে নিয়ে সে রেডি। এরে কয় দাপট। নয়ত সপ্তাহের শুরু তাকে দিয়ে হয়? বাবা ডাকতেন বিধু, মা ডাকতেন সোম। তা এহেন গুণধর, রূপবান পুত্রের সোজা প্রবেশাধিকার কসমিক বিশ্বের নবগ্রহ নামের এলিট ক্লাবে হবে না তো কী? শুধু কী তাই? নবগ্রহ স্তোত্র থেকে পুজো নেবার অধিকার বাগিয়ে সোজা চন্দ্রমন্দিরে একেবারে ভগবানের আসনে।
আবার বিধাতাপুরুষ যাকে যখন দেন তখন যেন ছপ্পড় ফুঁড়ে দেন। চন্দ্রকেও দিয়েছেন অঢেল রূপ। আমাদের সেই মাধ্যমিকের অত্রিমুনি? মানে সপ্ত ঋষির একজন আর তাঁর স্ত্রী রূপসী অনসূয়া মানে সেই যাকে দেখে রাম-সীতা-লক্ষ্মণের মনে হয়েছিল "মূর্তিমতী করুণা কি শ্রদ্ধা উপস্থিতা" তাঁদের পুত্র এমন হবে নাই বা কেন? আর হ্যান্ডসাম, এলিজিবল ব্যাচেলারের চাহিদা সর্বত্র। তাই কসমিক জগতের মেয়েরা যেন সবাই ফিদা আর গুণমুগ্ধ চাঁদের। সেই ফাঁকে দক্ষের মেয়েদের তো পটিয়ে পাটিয়ে ঘরে তুলেছিলই সে। মেয়েগুলোও তেমনি। সোনারচাঁদের রূপসাগরে ডুব দিয়ে সবাই হাবু আর ডুবু।
বাকি ছাব্বিশজন তো বারবার পতিগৃহ ছেড়ে পিতৃগৃহে আসা যাওয়া করেছেই। দক্ষকে নালিশ করেছে চন্দ্রের নামে। রোহিণী কেন একাই স্বামীসুখ পাবে? আমরা কী বানের জলে ভেসে এসেছি? মরো এবার। দক্ষ শত চেষ্টা করেও হালে পানি পান নি। অবশেষে রণে ভঙ্গ দিয়েছিলেন দক্ষ শ্বশুর। শুধু জামাতা চন্দ্র ভীষণ অবাধ্য হওয়ায় ভয়ানক ক্রোধে দক্ষের অভিশাপে যক্ষ্মা রোগ মুক্তি দেয়নি চন্দ্র কে। তবুও কুছ পরোয়া নেই। ছাব্বিশজন মেয়ের অসহায়তা দেখে দক্ষ অভিশাপও ফিরিয়ে নিয়ে বলেছিলেন "ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমার কথার অন্যথা হবেনা। একপক্ষে চন্দ্র ক্ষয়প্রাপ্ত হবে আর পরের পক্ষে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে আগের রূপ পাবে" মানে শ্যামও রইল, কুলও রইল। আলো রইল, আঁধারও রইল। অভিশাপ দিলাম আবার ফিরিয়েও নিলাম। হিম্মত নেই মেয়েগুলোর বাপের। আর চন্দ্র তখন মুখটিপে হাসছে আর ভাবছে...ঢোঁড়া সাপের আবার বিষ!
"যাই বলুন আপনি শ্বশুরবাবা, রোহিণীই আমার শুক্লপক্ষ আর বাকী ছাব্বিশজন কেষ্টপক্ষ"
জ্যোতিষশাস্ত্রে লগ্নে চাঁদ থাকলেই বুঝি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয় লগনচাঁদা রা। চাঁদেরও তেমনি। তাই চন্দ্র থামতে শেখেনি। তার ঠিকুজির জোরে যক্ষ্মা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে আবারো সে আগের রূপে স্বমহিমায় বলীয়ান।
শুনেছি মেয়েরা হয় পুরুষের হেড টার্নার। তাই বলে একজন পুরুষও মেয়েদের মাথা ঘুরিয়ে দেবে? ঠিক তাই।
তার রূপের ঘনঘটায় নয় নয় করে ন'জন দেবতার বউয়েরা প্রেমে পড়েছে চন্দ্রের! নারায়ণের স্ত্রী লক্ষ্মীও এঁদের দলে।
মেয়েদের জিগ্যেস করলেই বলে, সে কিনা কুরু ও পাণ্ডব দুই বংশেরই আদিপুরুষ। তার নামেই তো চন্দ্রবংশ। সে কী যে সে লোক! তাকে নিয়ে সর্বকালীন আদিখ্যেতা তো হবেই। গোলেবাকুলির গপ্পো হলেও চাঁদ স্বয়ং বিশ্বাস করে যে অমৃতমন্থনের অমৃত আসলে চাঁদেরই আলো। অমৃতের আধার তো আসলে চাঁদই। যার নাম অমৃতকুম্ভ। আর মোহময়ী সেই জ্যোত্স্নাই তো সবকিছুর মূলে। যতই লোকে বলুক ক্ষীরসাগরের ভালো ভালো সবকিছুই আসলে অমৃত বা এলিক্সির অফ লাইফ। নাহ! দেব ও দানবের অমৃত মন্থনের দ্বিতীয় দফায় প্রথম উঠেছিল চাঁদ। সেই চাঁদকে মাথায় তুললেন যে স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেব। বাসুকি সাক্ষী এসবের। চন্দ্রশেখর হলেন মহাদেব আর চাঁদকে লাই দিয়ে মাথার জটায় তুলেই হল যত বিপত্তি। আবারো প্যাম্পারড হল সে।
চন্দ্র ওরফে চাঁদ হয়ে গেল সেলেব। এক ধর্মে তার কমা বাড়ায় পূর্ণিমায় সত্যনারায়ণ পুজো হবে। অন্য ধর্মে দ্বিতীয়ার চাঁদ দেখে কেউ রোজা রেখে ঈদ পালন করবে। মাসের পনেরোদিনে পনেরোটা তিথি! অমুক চতুর্থী, তমুক একাদশী। কেউ আবার ধ্বজায় বয়ে বেড়াবে। তার বাড়া কমায় নদীতে জোয়ারভাটা খেলবে। মানুষের শরীর রসস্থ হবে। তার হ্রাস বৃদ্ধিতে মনের অসুখ থেকে বাতের ব্যথা বাড়বে কমবে। এই একজন লুনার মাফিয়ার জন্য এতকিছু। সে একাই একশো।
আজ সেখানে আদ্যোপান্ত ল্যাবরেটরি সাজিয়ে বসেছে মিডিয়া। মানে প্রজ্ঞান অ্যান্ড কোম্পানি। সেখানে এখন কোয়ালিটেটিভ অ্যানালিসিস চলছে সর্বক্ষণ। সল্টের কালার, ওডার, নেচার, টেক্সচার, সলিউবিলিটি সব মাপতে ব্যস্ত তারা সদলবলে।
দশটি সাদা ঘোড়ায় টানা সুসজ্জিত রথে চড়ে রোজ সে জমিদারি স্টাইলে সেজেগুজে সান্ধ্যভ্রমণে বের হয় যে। আর সেই ফাঁকে একটু একটু করে ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানীদের ডেটাবেস থইথই করতে থাকে। কত রসদ চাঁদের সে জমিদারিতে। কত অজানা রসায়ন সেখানে।