
বিকিনির জায়গায় এসেছে ট্রিকিনি। দুটি বস্ত্রখণ্ডের সাঁতার পোশাকের সঙ্গে একপিস ডিজাইনার মুখোশ যুক্ত হয়ে নাম হয়েছে ট্রিকিনি। সাজপোশাক আর ফ্যাশনের পৃথিবীতে ডিজিটাল দাপটে আমরা বেশ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম। করোনাকালে তা এক নতুন চেহারা নিয়েছে। নতুন ফ্যাশনের হালহদিশ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে গোটা র্যাম্প ঢুকে পড়েছে অনলাইনে। ফিজিক্যাল স্পেসের সঙ্গে ডিজিটাল টেকনোলজি মিশে ফ্যাশনের দুনিয়ায় এসে গেছে এক নতুন পরিভাষা, যার নাম ফিজিটাল। অতিমারি, মহামারি, মন্বন্তর, আর্থিক দুরবস্থা মানুষের পোশাক-আশাকের ওপর যে ছাপ ফেলে সেকথা আমাদের ইতিহাস বলছে। করোনার দিনে মৃত্যু ও সংক্রমণের বিভীষিকার মধ্যেও তার লক্ষণগুলি বেশ ফুটে উঠছে।
সত্যিই বড়ো বিচিত্র জীব মানুষ! সবকিছুকেই সে নিজের রঙে, নিজের ঢঙে সাজিয়ে নিতে চায়। মনখারাপের দিনেও সুরুচি ও শিল্পকলা তার সঙ্গ ছাড়ে না। মানুষের সাজপোশাক বলুন বা ফ্যাশন, সবকিছুর মধ্যেই তা জেগে ওঠে। বিহারের মধুবনী শিল্পীরা এখন বাঁচার তাগিদেই তৈরি করছেন মাস্ক। আর সেই মাস্কের গায়ে তারা এঁকে দিচ্ছেন মধুবনী চিত্রকলার মোটিফ। একই ঘটনা ঘটছে পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলার নয়াগ্রামে। সেখানকার পটুয়ারা করোনা মাস্কের গায়ে ফুটিয়ে তুলছেন পটচিত্রের ছোটো ছোটো ছবি। শুধু আমাদের দেশে নয়, এ ঘটনা ঘটছে পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও। পেরু ও চিনের লোকশিল্পীরাও মাস্কের গায়ে আঁকছেন তাদের ঐতিহ্যবাহী চিত্রকলা। কাপড়ের টুকরোয় মুখ ঢাকা পড়লেও শিল্প ঢাকা পড়বে না, মানুষের এই প্রবণতাই জীবনের সঙ্গে শিল্পকে জুড়ে দেয়। এই প্রবণতার হাত ধরে ভবিষ্যতে গ্লাভস কিংবা পিপিই স্যুট এর গায়ে ফ্যাশনের ছোঁয়া লাগলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
ওয়ার্ডরোবে লেগে থাকে সময়ের দাগ। এ ঘটনা যে বারবার ঘটে চলে ফ্যাশনের ইতিহাস তার সাক্ষী। ১৯৩০-এর দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন বা আর্থিক মন্দার সময়ে দামি ওভারকোটকে সরিয়ে চালু হয়ে গিয়েছিল সস্তার ট্রেঞ্চ কোট। ফ্রক আর স্কার্ট-এর কাটছাঁটেও পড়েছিল ব্যয়সঙ্কোচের ছাপ। শোনা যায়, মাথায় পরচুলা পরা চালু হয়েছিল যৌনরোগ, বিশেষ করে সিফিলিসের সংক্রমণে চুল পড়ে যাওয়া মানুষের টাক ঢাকতে। টাক ঢাকতে এল উইগ। ফ্রান্সের সম্রাট ত্রয়োদশ লুই-এর আমলে মাথায় রিবন শোভিত উইগ পরা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৬১৯ সালে বুবনিক প্লেগ থেকে বাঁচতে চালু হয়ে গেল ধনেশ পাখির মতো লম্বা ঠোঁটওয়ালা মাস্ক। নিশ্বাস নেওয়ার সময় সংক্রমণ ঠেকাতে ঠোঁটের ফাঁপা জায়গাটায় ঠাসা থাকতো নানারকম শিকড়বাকড়। মুখোশের চোখের জায়গাটায় বসানো থাকতো চশমার কাঁচ। আর সঙ্গে ছিল চামড়ার লম্বা কোট আর হ্যাট। প্লেগকে তো মানুষ নিশ্চয় ভয় করত। পুরোনোদিনের বইতে প্লেগ আটকানোর পোশাক পরা মানুষের সেই ছবি দেখলে গোয়েন্দাকাহিনিতে পড়া খুনির ছবি দেখার মতো ভয় করে। রোগ ঠেকাতে মাস্ক মোটেই নতুন কিছু নয়। গোয়েন্দাগল্পে জাঁকিয়ে বসার বহু আগে রোগ ঠেকাতে মাস্ক ব্যবহার করতেন সাধারণ মানুষ। ১৯১৮-র জাপানি ফ্লু-র সময়ে জাপানে মাস্ক ব্যবহার বেশ চালু ছিল। পরবর্তী সময়ে তা হয়ে দাঁড়াল এক লাভজনক ব্যাবসা। পশ্চিমের ‘লং ড্রেসেস উইথ হাই ওয়েস্ট’, সেও তো টিবিতে বিধ্বস্ত শরীরের ভগ্নদশা ঢাকার প্রয়াস।
শুধু অতীতে নয়, এই ঘটনা ঘটছে এইসময়েও। কোভিড সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে আমাদের পোশাক শিল্প ও ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে এর প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। ভারতে এই শিল্পের ৮০ শতাংশ বাজারই খুচরো। সেই বাজারের একটা বড়ো অংশ এখন অতিমারির ধাক্কায় বন্ধ। কিছু কিছু দোকানপাট খুলতে শুরু করলেও ব্যাবসার অবস্থা স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে। বহু ব্যবসায়ী তাদের দোকানের ঝাঁপ চিরতরে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবেন। যেসব দোকান খোলা, তাতে যে খুব ভিড় হচ্ছে এমন নয়। শুরুতেই ফ্যাশনের ফিজিটাল হয়ে ওঠার যে কথা বলেছি তা একটা মরিয়া প্রচেষ্টা। মানুষ ঘরবন্দি, আয় কমেছে, বেড়েছে আর্থিক অনিশ্চয়তা। তার থেকে বড়ো কথা বাইরে বেরোলে আছে সংক্রমণের বিপদ। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ধাক্কায় সব অনুষ্ঠানই হচ্ছে নম নম করে। ফ্যাশন বলুন বা সাজপোশাক, দেখানোর জায়গাও কম। তবুও মানুষের ভাবনা থেমে নেই। এই কোয়ারেন্টিন কালে আসছে সময় আর পরিস্থিতির উপযোগী পোশাকের নতুন ডিজাইন।
কারণ মানুষ চরিত্রগতভাবে বৈচিত্র্যবিলাসী, বাঁধা গণ্ডি থেকে বেরোতে চায় সে। বাধ্যতামূলকভাবে ঘরে থাকতে হচ্ছে বলে সে এখন ঘরের পোশাকে আনতে চাইছে বৈচিত্র। বস্ত্রশিল্প বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, এই সময়ে আমাদের দেশে লাউঞ্জওয়্যার মানে ঘরে পরার পোশাকের বিক্রি বেড়েছে ৭০ শতাংশ। বিক্রি বেড়েছে অ্যাক্টিভওয়্যারের। জগিং, ট্রেকিং, খেলাধুলার পোশাকের ব্যাপারে চলছে নতুন ভাবনাচিন্তা। ঘরের পোশাক হয়ে উঠছে আরও ছিমছাম, আরও কেতাদুরস্ত। কখনও বা একঘেয়েমি মুক্ত হওয়ার বাসনায় আরও রঙিন। এও তো এক নতুন স্বাভাবিকতা।
সুনীশ দেব | 182.66.***.*** | ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০৮:৫১97163আমাদের যাপনরীতিতে দুঃসময় কিছু বাধ্যতামূলক পরিবর্তনের ভগীরথ । কিভাবে অনিচ্ছুক জীবন তা সহনীয় করে রঞ্জনলিপিতে সে ইতিহাস বর্ণময় তার পুঙ্খানুপুঙ্খতায় । লেখাটি মনোরম এবং সময়ের দলিল । শুভেচ্ছা অনিঃশেষ ।
enkisad | 178.165.***.*** | ২৭ নভেম্বর ২০২১ ২১:১৭501482
derenusio | 178.165.***.*** | ২৯ নভেম্বর ২০২১ ০২:৩১501517