অবনীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “আর্টের একটা লক্ষণ আড়ম্বরশূন্যতা—সিমপ্লিসিটি। অনাবশ্যক রং-তুলির কলকারখানা, দোয়াত-কলম, বাজনা-বাদ্যি সে মোটেই সয় না।” বাংলার সরাশিল্পের দিকে তাকালে সেকথাটা সবচেয়ে আগে মনে পড়ে। সে যেন নীরবে হেঁটে গিয়ে মনের এক কোণে বসে পড়ে। তাকে কেউ দেখল বা না দেখল, ডাকল বা না ডাকল তাতে তার কিছু যায় আসে না। নিজেকে জাহির করার কোনো দেখনদারি তার নেই। বাংলার লোকশিল্পের সর্বাঙ্গে যে সহজ সুরের শয়তানি রয়েছে সরাশিল্প তার এক চমৎকার উদাহরণ।
তিনপুতুলি সরা—লক্ষী ও জয়া-বিজয়া
দুর্গার সরা
যুগল সরা—রাধা-কৃষ্ণ
দেখার চোখ থাকলেই যে রূপের আড়ালে অরূপকে ধরা যায় তার অসংখ্য নমুনা ছড়িয়ে আছে আমাদের গার্হস্থ্য শিল্পে। আমাদের ঘরের কাজের জিনিস, হাতপাখার ঝালর আর নকশা; থালা-বাটির নকশা; কুঁজো-কলসির গায়ের কারুকার্য; বাঁশ- বেতের ঝাঁপি, সন্দেশের কাঠের ছাঁচ—সবকিছুর গায়ে লেগে থাকে একটা শিল্পের ছোঁয়া। এই ছোঁয়াতেই কেজো জিনিসটার গায়ে বুনে দেওয়া হয় রঙিন ভালোবাসা, সেটা হয়ে ওঠে অন্যরকম। শিল্পবিশেষজ্ঞরা একে বলেছেন, গার্হস্থ্য শিল্প। বাংলার চিত্রিত সরা এই গার্হস্থ্য শিল্পের এক অনন্য ধারাবাহিকতা বহন করে চলেছে।
একটা পুরোনো বাংলা ছড়া মনে পড়ে গেল। “বড়ো সরাটি ভেঙেছে বউ/ছোটো সরাটি আছে/লপর চপর করিস কি লা/হাতের আটকল আছে।” ছড়াই বলে দিচ্ছে সরা ঘর-গেরস্থালির প্রয়োজনে লাগা একটা কাজের জিনিস। পোড়ামাটির এই সামগ্রীটি কখনও হয় কলসির ঢাকনা, কখনও বা তা হয়ে ওঠে ঠাকুরের ভোগের থালা। পিঠেপুলির ছাঁচ থেকে বিয়ের এয়ো সরা সহ বাংলার নানা আচার-অনুষ্ঠানে সরাকে আমরা নানা রূপে অবতীর্ণ হতে দেখি। আচার-অনুষ্ঠানের কাজে সরার ব্যবহার এখনও বেশ চালু। হরপ্পা, মহেন-জো-দারো, কালিবঙ্গান, ময়নামতী সব সভ্যতাতেই ছোটো-বড়ো নানা আকারের সরার দেখা পাচ্ছি আমরা।
রিলিফের সরা—বাংলাদেশ
গণকাসরা
ঢাকাই সরা
চিত্রিত সরায় পৌঁছে আমাদের সেই চেনা সরার চালচলন যেন একেবারে বদলে গেল। আটপৌরে চেহারা ঘুচে গিয়ে তাতে এল এক দেবীয়ানা। রোজকার কাজের জিনিসের বদলে সে হয়ে উঠল নিজেই একটা বিগ্রহ। বাংলার সরাশিল্পীরা তাদের ভাবনা ও কল্পনায় মাটির সরায় আরোপ করলেন এক দেবত্ব। তাদের কাজের সূত্রেই সরায় চেপে লক্ষ্মী, গণেশ, দুর্গা, কালী, গাজি হাজির হলেন ভক্তদের বাড়িতে। সরাশিল্পীদের বিচিত্র ভাবনা, রঙের ঔজ্জ্বল্য, লাগামছাড়া কল্পনা, বিন্যাসের অভিনবত্ব, বাংলার লোকশিল্পে এক নতুন ধারার সূচনা করল। গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না। তাই বাংলার এই লৌকিক পরম্পরাটিকে নিয়ে যতটা আলোচনা হওয়া উচিত ছিল তা হয়নি। এই অসাধারণ শিল্পকর্মকে আমরা একেবারেই গুরুত্ব দিইনি, এমনকি শিল্প বলে স্বীকার করিনি। সংরক্ষণ ও স্বীকৃতির অভাবে হারিয়ে গেছে বহু কাজ। সুরেশ্বরী সরা, গণকা সরা, ফরিদপুরি সরা আজ প্রায় লুপ্ত হতে চলেছে। অযত্নে নষ্ট হয়ে গেছে বহু গুরুত্বপূর্ণ শিল্প নিদর্শন।
চিত্রিত সরার সঙ্গে বেশির ভাগ বাঙালির দেখা হয় লক্ষ্মীপুজোর দিনে। ফুল, মালায় ঢাকা সেই সরায় ভক্তির চাপে শিল্পের উৎকর্ষ খোঁজার সুযোগ কম। পুজোর কোলাহলে হারিয়ে গেছে সরাশিল্পীদের নৈপুণ্য। আমরা লক্ষই করিনি শিল্পীদের স্পেসের ব্যবহার, ছবির বিন্যাস, অঙ্কন শৈলী, অলংকরণ ও রঙের ব্যবহার! শুধু লক্ষ্মীকে পাওয়ার লক্ষ্যে আকুল বাঙালি জানতেই চায়নি সরা চিত্রগুলিতে বলা গল্প! কোনো শিল্প-ঐতিহাসিকও তেমনভাবে লক্ষ করলেন না সেসব। তাঁরা বুঝতে চেষ্টা করলেন না অঞ্চলভেদে মৃৎশিল্পীদের গল্পগুলো কীভাবে বদলে যায়, কাজের ধরন হয়ে ওঠে একেবারে আলাদা, কীভাবে স্থানীয় উপকরণ ব্যবহৃত হয় তাদের কাজে। যে-কোনো লোকচিত্রকলায় এটাই স্বাভাবিক। সত্যি বলতে কি, চিত্রিত সরা যে একটা পৃথক অঙ্কন-ঐতিহ্য সেটাই আমরা বুঝতে পারিনি!
লক্ষ্মীসরা দিয়ে শুরু হলেও একে একে সরাচিত্রে এসেছে দুর্গাসরা, কৃষ্ণসরা, গণেশসরা এমনকি গাজিসরাও। গাজিসরা প্রথম দেখেছি, পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলার নয়া গ্রামে। এই গ্রাম যাকে বলে বাংলার পটুয়াদের রাজধানী। সরাশিল্প দেখলেই যে কেউ সাধারণভাবে বুঝবেন তার অঙ্কনশৈলীতে পটচিত্রের প্রভাব স্পষ্ট। অনেকেই জানেন না পিংলার পটুয়ারা পটের পাশাপাশি সরার কাজও করেন। গাজিসরাও আঁকেন তারা। তবে রাখার সমস্যা বলে ইদানীং সরার কাজ কম হয় বলে জানালেন স্বর্ণ চিত্রকর। তবে অর্ডার পেলে লক্ষ্মী, দুর্গা, গণেশ, গাজি সব সরার কাজই তাঁরা করেন। স্বর্ণ জানালেন, পট আঁকার রীতিতেই তাঁরা সরার গায়ে ছবি আঁকেন।
কুমরোটুলির সরা—কলকাতা
সুরেশ্বরী সরা
তাহেরপুরি সরা
বাংলার সরাশিল্পের একটা গুরুত্বপূর্ণ ঠিকানা কুমোরটুলির কাজে অবশ্য পট আঁকার ধরনটা প্রায় নেই বললেই চলে। চালচিত্রের রঙের বিন্যাস, ঔপনিবেশিক অঙ্কন শৈলী, বটতলার ছাপাই ছবির প্রভাব, সব মিলিয়ে কুমোরটুলির সরাচিত্র অন্যান্য অঞ্চল থেকে একটু আলাদা। দেবদেবীর মুখও এখানে বেশি কমনীয়। ঠাকুরদেবতার বসা বা দাঁড়ানোর ভঙ্গি, মাথার মুকুট, পদ্মফুল সবকিছুই এখানে একটু অন্যরকম। কোনো কোনো অঞ্চলের সরাচিত্রে বাঁকুড়ার দশাবতার তাসের প্রভাবও লক্ষ করা যায়। শুধু রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের লৌকিক ঐতিহ্যের প্রভাব নয়, বাংলার সরাচিত্রে ওড়িশার রঘুরাজপুরের পটচিত্রকলা, নেপালের থাংকা পেইনটিং-এর প্রভাবও চোখে পড়ে।
চোখের সামনে পড়ে থাকা জিনিসের প্রতি আমাদের মনোযোগ কম। বাংলার সরার ক্ষেত্রে ঠিক সেই ঘটনাটাই ঘটেছে। দীপঙ্কর পাড়ুই-এর ‘বাংলার সরা’ গ্রন্থটি লুপ্তপ্রায় এই ঐতিহ্যটির দিকে মানুষের দৃষ্টি ফেরানোর একটা প্রয়াস। ক্ষেত্রসমীক্ষার মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গার সরাশিল্পের ঐতিহ্যের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি। বিভিন্ন জায়গার লোকশিল্পের ঐতিহ্যগত পরম্পরাগুলিকে সংরক্ষণের লক্ষ্যে সারা পৃথিবী জুড়ে যে কর্মকাণ্ড চলছে, এই বইটি সেই প্রচেষ্টাকে আরও জোরদার করবে। শিল্পীদের কাছে গিয়ে তাদের কাজ খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করেছেন তিনি। তাই বইটি কলাসমালোচকের নিছক গবেষণার গণ্ডি পেরিয়ে হয়ে উঠেছে একটি অর্থবহ পর্যবেক্ষণ। অঞ্চল-সংস্কৃতি ও লোকশিল্প চর্চায় এক প্রয়োজনীয় সংযোজন। লোকশিল্প বা পরম্পরা স্বাভাবিকভাবে স্থান বা অঞ্চল-নির্ভর। কোনো শিল্পের বৃদ্ধি বা অবলুপ্তি আঞ্চলিক ইতিহাসেরই অঙ্গ। একটি শিল্পের নির্মাণ প্রক্রিয়ার ডকুমেন্টেশনও এই আলোচনার অংশ। পরম্পরাটিকে ভবিষ্যতে বাঁচিয়ে রাখার কাজে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। শুধুই আবেগে ডুবে না গিয়ে এই প্রসেস ডকুমেন্টেশনের কাজটি দীপঙ্কর নিষ্ঠা সহকারে করেছেন। লোকশিল্পের আলোচনায় অনিবার্যভাবে ঢুকে পড়ে আঞ্চলিক ইতিহাস। আবার লোকশিল্প হয়ে ওঠে আঞ্চলিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। একটা শিল্পকর্মের সৃষ্টি ও বিকাশের আয়নায় দেখে নেওয়া যায় স্থানীয় সংস্কৃতি ও অর্থনীতির চেহারাকে। ‘বাংলার সরা’ গ্রন্থটি একটি বিস্মৃতপ্রায় লোকশিল্পের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি শিল্পধারাটির আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যগুলিকেও ধরেছে। বইটির অঙ্গসজ্জা ও উপস্থাপনা লেখকের প্রচেষ্টার সঙ্গী হয়েছে।
বাংলার একেবারে নিজস্ব এই লৌকিক পরম্পরাটি আজ সংরক্ষণের অভাবে বিপন্ন। শিল্পীপরিবারের নতুন প্রজন্ম এ পেশায় আসছেন না। পুরোনো শিল্পীদের অনেকেই ছেড়ে দিচ্ছেন কাজ, নতুনরাও এই কাজে কোনো আগ্রহ বোধ করছেন না। সুরেশ্বরী সরা বা ফরিদপুরি সরার কথা শুনলে অনেক নবীন শিল্পী অবাক হয়ে তাকান। তৈরি করা তো দূরের কথা, অনেকে এগুলি চোখেও দেখেননি। অনেক দেরি হয়ে গেছে, আর বেশি দেরি করলে যা আছে সেটুকুও বিলুপ্ত হবে। বাংলার লৌকিক পরম্পরাগুলি বাঁচিয়ে রাখার জন্য ইতিমধ্যেই সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নানা প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। পট, ছৌ মুখোশ, ডোকরা, নতুনগ্রামের কাঠের পুতুল, পাঁচমুড়ার পোড়ামাটির কাজ বাংলার বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ লোকশিল্প এই প্রচেষ্টার আওতায় এসেছে। ঐতিহ্যকে সংরক্ষণের পাশাপাশি তাকে ঘিরে যাতে এর সঙ্গে জড়িত শিল্পীরা জীবিকা করতে পারেন তা নিশ্চিত করাই এর লক্ষ্য। বাংলার সরাশিল্পকেও এর আওতায় আনা গেলে ভালো হয়। কলকাতা, উত্তর চব্বিশ পরগনা, নদীয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, মালদা, কোচবিহার মিলিয়ে বাংলার সরাশিল্পীদের সংখ্যা কিন্তু খুব কম নয়। পুরোনো শিল্পধারা বাঁচিয়ে রাখার পাশাপাশি তাকে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার উপযোগী করে তুলতে না পারলে এই প্রচেষ্টা গতি পাবে না। সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে সরার বিষয়ে বৈচিত্র্য আনতে না পারলে বিক্রি বাড়বে না। যোগেন চৌধুরী, কে জি সুব্রহ্মণ্যনের মতো বাংলার অগ্রণী শিল্পীদের চিত্রিত সরা নিয়ে আরও ভাবনাচিন্তার অবকাশ আছে।
সরায় চেপে লক্ষ্মী এসে প্রবেশ করেন গৃহস্থের বাড়িতে। জীবনভর সরার গায়ে তার ছবি এঁকেও লক্ষ্মী সরাশিল্পীদের অধরা থেকে গেছে। অপরিচয়ের অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে সুকুমার পাল, দিলীপ পালের মতো শিল্পীরা সরাকে আঁকড়ে ধরে লক্ষ্মীলাভের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের মৃৎশিল্প যে মৃত শিল্প নয়, সেই পরীক্ষা দিয়ে চলেছেন তাঁরা।