কোলাহলের আড়ালে লুকিয়ে থাকে চাপা কান্না। সংগঠিত প্রতিবাদের দাপটে চোখে পড়েনা নীরব উপেক্ষা। করোনা-সময়ে বাংলার গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে থাকা লোকশিল্পীদের অবস্থা অনেকটা সেরকম। একেই সংগঠিত নয়, তার ওপর নেই সংখ্যার জোর, কাজেই লোকশিল্পীদের কথা শোনার লোকও কম। ঐতিহ্যবাহী যে শিল্প পরম্পরাগুলিকে নিয়ে বাঙালি গর্ব করে করোনার কোপে সত্যি তাদের বেশ দূরাবস্থা। এপ্রিল থেকে জুন ছিল গ্রামীণ শিল্পীদের কাজের মরশুম। কথকতা, সাধুসেবা-ভাগবতপাঠ, ভক্তিগীতি, কীর্তন সহ রাতভোর চলা বহু গ্রামীণ আসরই বাতিল হয়েছে। এবছর সেগুলি আর হওয়ারও কোন সম্ভাবনা নেই। পুজোর মুখে এবার কোপ পড়তে শুরু করেছে শহর ও দেশবিদেশের অনুষ্ঠানের ওপর। ‘নতুন স্বাভাবিকতা’র দাপটে প্রায় সব অনুষ্ঠানই বাতিল। বাউল-ফকির, ছৌ, পটুয়া, নাটুয়া, রাইবেঁশে কোন শিল্পীই ভালো নেই। সারা বছর এই অনুষ্ঠানগুলির দিকেই তাকিয়ে থাকেন বহু লোকশিল্পী।
লোকসংস্কৃতি বিশেষজ্ঞদের হিসেবে ইতিমধ্যেই বাংলার বাউল, ছৌ, রাইবেঁশে এবং গম্ভীরা শিল্পীদের অর্ধেকেরও বেশি অনুষ্ঠান করোনার কারণে বাতিল হয়ে গেছে। ছৌ নাচের শিল্পীদের সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন ছৌ মুখোশ কারিগরেরাও। তাদের প্রায় ৪০ শতাংশ ব্যবসা কমেছে। বাংলার গ্রামীণ হস্তশিল্পীদের ব্যবসার সময় সেপ্টেম্বর থেকে মার্চের মাঝামাঝি। দুর্গাপুজোর থিম নির্ভর মণ্ডপসজ্জা বেশ কয়েক বছর ধরেই বাংলার গ্রামীণ হস্তশিল্পীদের জীবিকার এক বড় অবলম্বন। বিভিন্ন জেলার হাজার হাজার শিল্পী অংশ নেন এই কাজে। এরপর শীতকালীন উৎসব, মেলা, পর্যটকদের আনাগোনার কারণেও তাদের ব্যবসা ভালো হয়। করোনার জন্য এ বছর তাদের ব্যবসা যে মার খাবে তা বুঝতে কোন বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। পিংলার কয়েকজন বিখ্যাত পটুয়া জানালেন, এ বছর এখনও তারা কোন ডাক পাননি। অন্যান্যবার এ সময় বুকিং হয়ে যায়।
আয় নেই তাই অনিশ্চয়তা গ্রাস করেছে তাদের। অনেকে বলবেন, কেন লোকপ্রসার প্রকল্পের সহায়তা আছে, সরকারি রেশন আছে, বাবুদের দেওয়া রিলিফ আছে, সমস্যা কোথায়? সমস্যাটা হল, পেশাগত কাজ বাবদ আয় কখনোই কোন অনুদানের বিকল্প নয়। তার থেকেও বড় কথা হল, এই মানুষগুলি বাঁচেন তাদের শিল্প পরম্পরাকে ঘিরে। সেটাই তাদের আনন্দ, গর্ব এবং জীবন। নিজেদের ভালোবাসার জিনিসটাকে ধরেই তারা জীবিকার রাস্তা গড়তে চান। তা না করতে পারলে হীনমন্যতা আর মানসিক অস্থিরতায় ভোগেন।
আমাদের উন্নয়ন, পরিকল্পনা সবকিছুতেই সংখ্যা একটা বিষয়। কিন্তু যারা দেশ তো বটেই বিদেশের দরবারেও দেশের সাংস্কৃতিক পরম্পরাগুলিকে তুলে ধরছেন; যাদের কাজের সুবাদে ছৌ নাচ ইউনেস্কোর ঐতিহ্যবাহী পরম্পরার আন্তর্জাতিক তালিকায় স্থান পেয়েছে; পটচিত্রের নাম জানেন সারা পৃথিবীর শিল্প রসিকরা; তারা কী আর একটু গুরুত্ব আশা করতে পারেন না? হতাশার অন্ধ গলি থেকে এরা বেরোবেন কীভাবে, এগোবেন কোন পথে সেটাই এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
চিরকাল অফলাইন হয়ে থাকা দেশের গ্রামীন শিল্পীদের অনলাইন অনুষ্ঠানের সাফল্য এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে, দেখাচ্ছে এগোনোর রাস্তা। শুধু ভারতে নয়, এ ঘটনা ঘটছে সারা বিশ্বে। সারা পৃথিবীর লোকশিল্পীদের ৬১শতাংশই অসংগঠিত শিল্পের অংশ। এদের প্রায় ৪০শতাংশ মহিলা। করোনা এদের সবারই জীবন ও জীবিকায় ধাক্কা দিয়েছে। তথ্য বলছে এদের অনেকেই অনলাইন অনুষ্ঠান ও হস্তশিল্প সামগ্রীর অনলাইন বাণিজ্যের মাধ্যমে বেঁচে থাকার রাস্তা দেখতে পেয়েছেন। বিশেষ করে অনলাইন অনুষ্ঠানে বাংলা ও রাজস্থানের হস্তশিল্পীদের সাফল্য হয়ে উঠেছে এই দুঃসময়ে তাদের বাঁচার সিলভারলাইন।
কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক। কোভিড ও আমফান বিধ্বস্ত সুন্দরবন সংলগ্ন উত্তর ২৪পরগনার হিঙ্গলগঞ্জে ৬৮জন ভাটিয়ালি শিল্পীর বাস। এদের মধ্যে আছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী সৌরভ মণি সহ বিষ্ণুপদ সরকার, রফিকুল ইসলাম প্রমুখ। এই লকডাউনের সময়েই সৌরভ অনলাইন অনুষ্ঠান করেছেন, সেই অনুষ্ঠান দেখেছেন ৪৫০০ মানুষ। এই সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে অন্যান্য ভাটিয়ালি শিল্পীরাও অনলাইন অনুষ্ঠানের দিকে ঝুঁকেছেন। তার জন্য নিয়মিত রিহার্সাল দিচ্ছেন তারা। গত ২৯শে মার্চ থেকে মে’র মাঝামাঝি অবধি পাওয়া একটা হিসেব থেকে দেখা যাচ্ছে বাংলার ৪৮জন লোকশিল্পী ২৭টি অনলাইন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। গ্রামবাংলার লোকশিল্পীদের জীবনে এ এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। প্রযুক্তি ও শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা নদীয়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, বাঁকুড়ার লোকশিল্পীরা এমন অনুষ্ঠান এর আগে কখনও করেননি। প্রথম অনুষ্ঠান কিন্তু প্রতিক্রিয়া ও ফলাফল শুনলে চমকে যাবেন। সারা বিশ্বের প্রায় ১ লাখ ১০হাজার মানুষ তাদের অনুষ্ঠান দেখেছেন। লাভ সাইন, লাইকস, কমেন্টস এ ভেসে গেছেন তারা। এদের অনেকে আগে বিদেশে অনুষ্ঠান করেছেন। কিন্তু অনলাইন অনুষ্ঠান এই প্রথম। অনেককেই প্রথমে এ কাজে রাজি করানো যায়নি। এখন তাদেরই উৎসাহ সবচেয়ে বেশি।
গরিব গ্রামীণ শিল্পীদের এটা একটা বড় সাফল্য। এই সাফল্যকে মোটেই কোন বিক্ষিপ্ত ঘটনা বলা যাবে না। একই রাস্তায় হেঁটে সাফল্য পেয়েছেন রাজস্থানের লাঙ্গা ও মাঙ্গানিয়ার সম্প্রদায়ের শিল্পীরা। করোনার সময়েই রাজস্থানের মরু অঞ্চলের ১১৭জন শিল্পী ৩১টা অনলাইন অনুষ্ঠান করেছেন। মজার ব্যাপার হল অনুষ্ঠানের সময় এরা অনেকেই বুঝতে পারেন নি ব্যাপারটা কী হচ্ছে? কোন দর্শক নেই, হাততালি নেই তাহলে কারা শুনছেন তাদের গান? অনলাইনে অনুষ্ঠান দেখে তো তাদের চক্ষু চড়কগাছ! পৃথিবীর নানা প্রান্তের ১ লাখ ২৪ হাজার দর্শক তাদের গান শুনেছেন একথা জেনে বিস্মিত হয়েছেন তারা। অনলাইনে যে এত মানুষ গানবাজনা শোনেন, তা নিয়ে নিজেদের মতামত জানান, শো বুক করেন এসব অভিজ্ঞতাই তো তাদের ছিল না। এই অভিজ্ঞতা তাদের অনলাইন সম্পর্কে উৎসাহী করে তুলেছে।
সব লোকশিল্প ও সংস্কৃতিরই একটা আন্তর্জাতিক চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে দিয়েই একটি দেশ আরেকটি দেশের সংস্কৃতির শিকড়ে পৌঁছতে পারে। স্থানীয় মানুষও পৌঁছতে পারে তাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির উৎসে। একারণে অনলাইন অনুষ্ঠানকে জনপ্রিয় করার জন্য ঐতিহ্যবাহী শিল্প ও পরম্পরা নিয়ে কাজ করে চলা আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনেস্কোও উৎসাহ দেয়। তাদের মতে, কোভিডের সময়ে অনলাইন অনুষ্ঠানগুলি মানুষের পারস্পরিক বন্ধনকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে পারে।
ইউনেস্কো তো বটেই পশ্চিমবঙ্গ সহ দেশের বিভিন্ন লোকশিল্প ও সংস্কৃতির বিশেষজ্ঞরাও অনলাইন অনুষ্ঠানের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। তাদের মতে, এতে শিল্পীরা সারা পৃথিবীর দর্শক ও শ্রোতাদের কাছে পৌঁছতে পারবেন। অনলাইনে অনুষ্ঠান করার রীতিনীতিগুলি সম্পর্কে অভিজ্ঞ হয়ে উঠলে তাদের আয়ও বাড়বে। দর্শক-শ্রোতা ও ক্রেতাদের নতুন বাজার ধরতে পারবেন তারা। তবে শুধু আবেগের বন্যায় ভেসে যাওয়া নয়, গানবাজনার পাশাপাশি এবিষয়ে তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণও দিতে হবে। অনলাইন প্রেজেন্স বজায় রাখা এবং অনুষ্ঠানের নিয়মকানুন সম্পর্কে তাদের প্রাথমিক শিক্ষারও প্রয়োজন রয়েছে। তবে শিল্পীদের যা উৎসাহ দেখছি তাতে মনে হচ্ছে স্বাভাবিক বোধবুদ্ধি ব্যবহার করে এসব ব্যাপারে দক্ষ হয়ে উঠতে তাদের খুব বেশি সময় লাগবে না। একেবারে প্রাথমিক স্তরে এ সংক্রান্ত কিছু কাজকর্ম ও কর্মশালা ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে শুরু হয়েছে।
মারি, মন্বন্তর, মড়ক, মহামারি, অতিমারি লোকশিল্পীরা কম দেখেননি। সেসব অতিক্রম করেই তাদের পথ চলা। ঝুমুর গান, ভাওয়াইয়া গান, কবি গান, পটচিত্র, মঙ্গলকাব্য, লোকশিল্পে আমাদের ফেলে আসা দুঃসময়ের বর্ণনা এখনও জীবন্ত হয়ে আছে। শীতলা মঙ্গল কাব্যে শুনি কলেরা ও বসন্তের দেবী মা শীতলাকে তুষ্ট করার গান। আবার ‘চল মিনি আসাম যাবো দেশে বড় দুখ রে’ গানে শুনি, মন্বন্তরের দুঃসময়ের বর্ণনা। সেসব এখন ইতিহাসে ঢুকে গেছে। করোনাও নিশ্চয় জায়গা পাবে একালের লোকশিল্পীদের রেখা-লেখা-গানে। আবার কোন রমেশ শীল, চিত্তপ্রসাদ, সোমনাথ হোড়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সুনীল জানা’দের মত মানুষেরা লেখায়-রেখায়-কবিতা-গান-ছবিতে ফুটিয়ে তুলবেন এই দুঃসময়ের বর্ণনা। জানাবেন, কীভাবে অনলাইন হয়ে উঠেছিল লোকশিল্পীদের এগোনোর রাস্তা, বেঁচে থাকার সিলভারলাইন।