বাঙালির বহুমাত্রিক রসনা-সংস্কৃতি সর্বজনবিদিত। বাংলার রান্নাবান্নার মনস্তত্ত্ব থেকে সমাজতত্ত্ব, খাদ্য-অখাদ্যের পুষ্টি বিচার, স্বাদগন্ধ, পরিবেশন পদ্ধতি নিয়ে ঠাকুরের ভোগঘর থেকে আটপৌরে হেঁশেলঘর, পুরাকাল থেকে আধুনিক যুগ, সাহিত্য থেকে বৈদ্যুতিন মাধ্যম সর্বত্রই যেন দাপিয়ে বেড়ানো এই রন্ধন-সংস্কৃতি। সেই নিয়েই অন্যরকম আলোকপাতের চেষ্টা এই প্রবন্ধে।
প্রাচীন বাংলার প্রধান আহার্যের মধ্যে অবশ্যই ছিল ভাত, মাছ, মাংস, মধু, দুধ এবং সবজি। আমাদের এই বঙ্গ অঞ্চলটি প্রাচীন হিন্দু ও বৌদ্ধ রাজত্বের সময় এবং পরবর্তীতে মুসলিম শাসকদের আমলেও দক্ষিণ এশিয়ার একটি প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক অঞ্চল ছিল। বাঙালি খাবারের বিভিন্নতা এবং বৈচিত্র্য তখনও ছিল এখনকার মতোই ব্যাপক ও বিশাল। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরিবেশিত ও প্রস্তুতকৃত বিভিন্ন ধরনের খাবার ছাড়াও নিজের পরিবার অথবা আত্মীয়স্বজনদের জন্য বিভিন্ন ধরনের রান্না হত সেসময়েও।
পাক রাজেশ্বরে রয়েছে আমাদের ভাজা, সেঁকা এইসব নানাবিধ পদ্ধতির কথা। ভর্জন, তলন, স্বেদন, পচন, ক্কথন, তন্দুর ও পুটপাক এমন সাত রকমের রন্ধনপ্রণালীর কথা রয়েছে সেখানে। ভর্জন বা ভাজা হত ভ্রাস্টে বা পাত্রে। সরাসরি স্নেহপদার্থ বা তেল-ঘিয়ের মধ্যে হত তলন। বাষ্পে রান্না হল স্বেদন। মানে যাকে আমরা বলি ভাপা। আগুনের সরাসরি তাপে হত পুটপাক। সিদ্ধ খাবার রসে সিঞ্চিত হওয়া হল ক্কথন। দ্বারবদ্ধ গরমযন্ত্র বা কন্দুর মধ্যে রান্না হয় তন্দুর বা কন্দুপক্ক। রোদে বা উচ্চতাপে পোড়ানো হল সেঁকা।
এবারে আসি বাঙালি রান্নার কথায় যেগুলি প্রাচীনতম সাহিত্যের দলিলে উল্লেখ রয়েছে।
আনুমানিক অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে চর্যাপদ হল বাংলা লিখিত সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন। মূলত তখন থেকেই বৌদ্ধধর্মের প্রভাব পড়েছিল বাংলার সংস্কৃতিতে। বাঙালির খাদ্যপ্রীতির পরিচয় সেখানেও। বিদগ্ধদজনের লেখায় বারেবারে উঠে এসেছে বাঙালির রন্ধন শৈলীর কিছু কিছু বিবরণ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দ্বাদশ শতকের শ্রীহর্ষ রচিত, নৈষধচরিত, চতুর্দশ শতকের প্রাকৃত পৈঙ্গল এবং বৌদ্ধ সহজিয়া গান চর্যাপদ ইত্যাদি পুথি।
সেসময় মৃগমাংস ছিল অন্যতম আমিষ। ‘অপনা মাংসেঁ হরিণা বৈরী/খনহ ন ছাড়অ ভুসুক অহেরী’ ভুসুকুপাদ রচিত চর্যাপদের এই শ্লোকে হরিণের মাংসের কথা যার অর্থ হল হরিণের মাংস তার জন্য শত্রু অথচ ভুসুক ক্ষণিকের জন্য শিকার ছাড়বে না। কে জানে উত্তরোত্তর হরিণবধের প্রবণতা থেকে মানুষকে ভীতিগ্রস্ত করানোর জন্যই বুঝি এমন লেখা হয়েছিল।
ভাতের কথা দিয়েই শুরু হোক এবার। জানা যায়, প্রায় ৫০০০ বছর পূর্বে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে ধান আমদানি হত। আর নদীমাতৃক বাংলার ভৌগোলিক কারণেই হোক কিংবা আদিবাসী-কৌম সমাজের উত্তরাধিকারের ফলেই কৃষিপ্রধান বাংলার প্রধান খাদ্য হয়ে ওঠে ভাত। এমন সব খোঁজ রয়েছে ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীর ‘প্রাকৃত পৈঙ্গল’ গ্রন্থে। বহু গুণীজনের লেখায় উঠে এসেছে এই তথ্য।
পিঙ্গলের দ্বারা রচিত এই গ্রন্থটি ছন্দে বর্ণিত। আনুমানিক চতুর্দশ শতাব্দীতে বারাণসী ধামে এই প্রাকৃত পৈঙ্গলের সংকলন হয়। সংস্কৃতে রচিত কিন্তু প্রাকৃত ছন্দে লেখা সর্বজনবিদিত এই পদটি। মূলত রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদ হলেও বাঙালির সুস্বাদু জীবনযাপনের চিত্রটিও নিম্নোক্ত পদটিতে অতি সুমধুর ভাবে বর্ণিত—
ওগ্গর ভত্তা, রম্ভঅ পত্তা।
গাইক ঘিত্তা দুগ্ধ সজুত্তা।
মইলি মচ্ছা, নালিচ গচ্ছা।
দিজ্জই কন্তা, খাঅ পুণ্যবন্তা।।
কলাপাতায় বেড়ে দেওয়া হয়েছে ওগরা ভাত (ফ্যানভাত)। সঙ্গে গাওয়া ঘি, সুস্বাদু দুধ, মৌরলা মাছ, নালতে (পাট) শাক। এসব রান্না করে স্ত্রী পরিবেশন করছেন তাঁর কান্ত (স্বামী)-কে এবং এই খাদ্যের মালিক সেই স্বামী সত্যই পুণ্যবান।
আমিষগন্ধী এ আয়োজন রাজসিক বা তামসিক কোনোটাই নয়, আবার পুরোপুরি সাত্ত্বিকও নয়। কিন্তু সেকালের পক্ষে এ আয়োজন অতি সামান্যই। বাঙালি জীবনের আন্তরিক ছায়াপাত হয়েছে বলে চিত্রটি ঘরোয়া হলেও বড়োই শুচিস্নিগ্ধ।
প্রাচীন সাহিত্যে পাকবিদ্যার উল্লেখ আছে। ভারতীয় সংস্কৃতির চৌষট্টিকলার মধ্যে অন্যতম হল রন্ধনকলা। গৃহদেবতার নৈবেদ্য বা অতিথি সত্কারের জন্য সুসজ্জিত খাদ্য পরিবেশনাও এর মধ্যেই পড়ে। সেই কোন্ যুগে গৃহস্বামীর উদ্দেশ্যে তাঁর ঘরনির নিবেদিত অতি সাদামাটা খাদ্যও পরিবেশনার গুণে মহার্ঘ হয়ে উঠেছিল চর্যাপদে।
ইংরেজ আমলে আঠারোবার দুর্ভিক্ষে শামিল হয়েও ভেতো বাঙালি ভাতকে বর্জন করতে পারেনি। চর্যাপদের আমল থেকেই ভাতের সঙ্গে যে তাদের নাড়ির সম্পর্ক।
শ্রীহর্ষের নৈষধচরিতে নল-দময়ন্তীর বিয়ের ভোজে গরম ধোঁয়া ওঠা অভগ্ন, ফুরফুরে সাদা ভাতের উল্লেখ রয়েছে।
“পরিবেশিত অন্ন হইতে ধুম উঠিতেছে, তাহার প্রতিটি কণা অভগ্ন, একটি হইতে আরেকটি বিচ্ছিন্ন! সে অন্ন সুসিদ্ধ, সুস্বাদু আর শুভ্রবর্ণ, সরু ও সৌরভময়!’’
চতুর্দশ শতকেই ‘চর্যাপদে’র ঢেন্ডন পাদের বৌদ্ধ গানের পদে দেখি সেসময় হাঁড়িতে ভাতের ব্যবহার—
‘টালত মোর ঘর নাহই পড়বেষী
হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী’
যার অর্থ হল বাড়িতে ভাতের জোগাড় নেই অথচ নিত্য প্রতিবেশীর আনাগোনা যা বাংলার অন্যতম চিরাচরিত প্রথা। প্রবাদেই আছে, আপনে খেতে পায় না শঙ্করাকে ডাকে। আবার মনসামঙ্গলের সনকার হাঁড়ি ভাতে উপচে পড়ে। ভাতের কোনো অভাব নেই সেখানে। ‘যেই মাত্র হাড়িতে মেনকা দিবল হাত/ হাড়িতে পাইল উত্তম ব্যঞ্জন ভাত।’ সেই আমল থেকেই বাঙালির স্টেপল ফুড যে ভাত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সাদা ভাত ছাড়া মধ্যযুগে তিনরকমের ভাত, পরমান্ন (পায়েস), খেচরান্ন (খিচুড়ি) এবং পলান্ন (পোলাও) রান্নার প্রচলন ছিল। চণ্ডীমঙ্গলে খুল্লনার রন্ধনশৈলী ও কুটুম্বিতার পরিচয় দিতে রয়েছে ‘দধিপিঠা খান সভে মধুর পায়স’। চৈতন্যচরিতামৃতে রয়েছে ‘সঘৃত পায়স’। অন্নদামঙ্গলে দেবী অন্নপূর্ণা শিবের জন্য নিজেই রাঁধেন সঘৃত পলান্ন ও শিকপোড়া। ‘অন্নমাংস সিক ভাজা কাবাব করিয়া’।
ভাতের পরেই আসে বাঙালির রান্নায় শাকসবজি বা তা দিয়ে ব্যঞ্জনের কথা। ভাতের স্বাদকে পরিপূর্ণ করতে ভাতের সঙ্গে জায়গা করে নিয়েছিল পঞ্চব্যাঞ্জন। সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘জলে ডাঙ্গায়’ বইতে আছে বাঙালির পঞ্চরসে ভোজন সমাপনের কথা। ‘আমরা তেতো, নোনা, ঝাল, টক, মিষ্টি—এই পাঁচ রস দিয়ে ভোজন সমাপন করি’ অর্থাৎ আমাদের পঞ্চব্যঞ্জন সেই হরেদরে পঞ্চ রসের সমাহার বটে এবং বিদেশি মেন্যুর ফাইভ কোর্স মিলও। বাঙালির এ এক প্রাচীন ট্র্যাডিশনও। বাঙালির সব ধরনের আনন্দানুষ্ঠানের নিমন্ত্রণের মেন্যুতে শাকভাজার স্থান শুক্তোর পরেই। কারণ শাক নাকি শুভ। নববর্ষেরই হোক কিংবা ঠাকুরের ভোগে, আইবুড়ো ভাত, উপনয়ন কিংবা সাধভক্ষণ অথবা অন্নপ্রাশনে শাকভাজা দিয়ে শুরুয়াত নতুন কিছু নয়। মধ্যাহ্নভোজে ভাতের সঙ্গে আর নৈশভোজে লুচির সঙ্গে বাঙালির শাকভাজা বিনে গীত নাই। আবার দীপাবলির আগের দিন ভূত চতুর্দশীতে চোদ্দোশাক খাওয়ার রীতি অনেককাল আগের।
ভরা অমাবস্যার অন্ধকার দূর করতে চোদ্দ প্রদীপ জ্বালানোর সঙ্গে চোদ্দোটি শাক ভেজে খাওয়ার নিয়ম। এটি প্রধানত স্বাস্থ্যরক্ষার্থে। ঋতু পরিবর্তনের কারণে হঠাৎ হিম পড়ায় যাতে ঠান্ডা না লেগে যায়। এই চোদ্দো রকমের শাকগুলি হল ওল, কেঁউ, বেতো, সর্ষে, কালকাসুন্দে, নিম, জয়ন্তী, শাঞ্চে, হিলঞ্চ, পলতা, শৌলফ, গুলঞ্চ, ভাঁটপাতা এবং সুসনি। আয়ুর্বেদ এবং কবিরাজি শাস্ত্রে এই শাকগুলি ভেষজ গুণসম্পন্ন। শাকরান্নার কথা বাংলা সাহিত্যের ছত্রে ছত্রে রয়েছে।
আর তাই বুঝি মধ্যযুগে কবিকঙ্কন মুকুন্দরামের ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে ভাতের সঙ্গে অনুপান রূপে নানা রকমের শাক এসে জুটল বাঙালির পাতে। আমাদের নদীমাতৃক দুই বাংলার গ্রামেগঞ্জে শাক জন্মানোর প্রবণতাই হোক কিংবা সবুজ শাকের ভেষজ এবং আয়ুর্বেদিক গুণই হোক শাক বাঙালির রসনায় আজও সমানভাবে আদর পায়।
‘নটে রাঙা তোলে শাক পালঙ্গ নলিতা
তিক্ত ফল তাঁর শাক কলতা পলতা
সাঁজতা বনতা বন পুঁই ভদ্র পলা
নটুয়া বেথুয়া তোলে ফীরে ক্ষেতে ক্ষেতে
মহুরী শুলকা ধন্যা ক্ষীর পাই বেটে।’
মনসামঙ্গলে দেখি লখিন্দর পেটে সনকার সাধভক্ষণের রান্নায় রয়েছে এমনটি।
তেঁতুল চলার অগ্নি জ্বলে ধুপধুপ
নারিকেল কোরা দিয়া রাঁধে মুগের স্যুপ।
ধীরে ধীরে জ্বলে অগ্নি একমত জ্বাল
কড়ির বেগেতে রান্ধে কলাইয়ের ডাল।
ঝিঙ্গা পোলাকারী রান্ধে কাঁঠালের বীচি
নারিকেল কোরা দিয়া রান্ধে বটবটি।
আনিয়া বাথুয়াশাক করিল লেচাফেচা
লাড়িয়া ছাড়িয়া রান্ধে দিয়া আদা ছেঁচা।
এমনকি শাকতোলার বর্ণনাতেও রয়েছে বিবিধ রকমের শাকের নাম। কুমড়োর ডগা, পুঁইশাক, লাউয়ের ডগা, পলতা, সোনাকচু, পানিকচু, তেলাকুচো, গিমেশাক, ওকরা, থানকুনি, ঘিয়া লতা এসব শাকের নাম।
মানিক রামের ধর্মমঙ্গলেও পাই শাকান্ন রন্ধনপ্রণালীর উল্লেখ—‘শুসুনির শাক এনে সম্বরিয়ে তৈলে’। গ্রামগঞ্জের শুলপো শাক থেকে ঘি দিয়ে নালিতা বা পাটশাক হোক কিংবা আমাদের পরিচিত পালং, নটেই হোক। ভৌগোলিক কারণেই হোক কিংবা আদিবাসী-কৌম সমাজের উত্তরাধিকারের ফলেই হোক কৃষিপ্রধান সবুজ বাংলার দরিদ্র অন্ত্যজ মানুষের প্রধান খাদ্যই ছিল শাক-ভাত। তবে তরিজুত করে রাঁধতে পারলে শাক কিন্তু মনোহরা। মুলো শাক কিংবা কলমি সবাই সেখানে এক ছাদের নীচে জব্দ তেলের মধ্যে সন্তলনের বৈচিত্র্যময় কারিগরিতে।
ভালো লাগলো, প্রাচীন সাহিত্যের পাতে চিরদিনের শাকভাত ।সুন্দর পরিচ্ছন্ন ছবি ।
দারুণ সুন্দর লেখাটা!
প্রশংসা করে শেষ করা যাবেনা।
ধন্যবাদ।
লেখাটা বেড়ে। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
ভাল লাগল লেখাটা। শুধু একটা প্রশ্ন, ‘প্রাকৃত পৈঙ্গল’এর মোঅলি মচ্ছা মইলি মচ্ছা নিয়ে। এই মাছটা কি সত্যিই মৌরলা মাছ? সুকুমার সেন নিজেই খুব সংশয় ছিলেন। প্রথমদিকে তিনি এই মাছকে মৌরলা বলেই উল্লেখ করেছিলেন। শরদিন্দুর ‘গৌড়মল্লার’এ তাই মাছটি মৌরলা। কিন্তু পরে সুকুমার সেন মত বদলেছিলেন। তিনি জানান, এটা ময়না মাছও হতে পারে। সেই বিখ্যাত ছড়া, ‘দাদাভাই চালভাজা খাই ময়না মাছের মুড়ো’, তাঁকে প্রভাবিত করে। বাংলায় মাছের এত বৈশিষ্ট্য আর অঞ্চল ভেদে একই মাছের অন্য নাম এত বছর পরে সঠিক মৎস্য শিকারে বাধা হবেই। আর ছোট মাছের জনপ্রিয়তা অঞ্চল ভেদে ভিন্ন। দক্ষিণবঙ্গে পুঁটি, খলসে, মৌরলা, ডানকোনা যথেষ্ট ছিল। এখন শেষের তিনটি কমতির দিকে। আবার উত্তরবঙ্গে বরোলি, রায়কর, রিঠা, পাথরঠোকা সুস্বাদু। খুব মুশকিল।
সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে ওরাইজা স্যাটিভার দক্ষিণ পূর্বএশিয়া থেকে আগমনের আগেই এদেশের নিজস্ব ধান ওরাইজা নিভারার চাষ শুরু হয়েছিলো। কাজেই ধান আমাদের একেবারে নিজস্ব স্টেপল ফুড।