আগের তিন কিস্তিতে ভাতের পাতে সুক্তো, শাক, চচ্চড়ি সাবড়িয়ে ঢুকেছি যাকে বলে মেইন কোর্সে। আমিষ মেইন কোর্স। আর তা বলতেই মাছে-ভাতে বাঙালি নামটির কথা মাথায় আসে সবচেয়ে আগে। মাছ বাঙালির পাতে বলা যায় ‘কনস্ট্যান্ট’, কিন্তু বাঙালির মাংস ভোজনের ঘটাও কম নয়।
চণ্ডীমঙ্গলে পাই অনাড়ম্বর ভাববর্ণনার গুণে নিরলংকার ভাষায় লহনা খুল্লনার বিবাদের মধ্যে দিয়ে বহুবিবাহ পীড়িত বাঙালির গার্হস্থ্য জীবনের খুঁটিনাটি।
‘খুল্লনা বসিলা ছেলী খুইয়া অজাসালে
মানের পাতে লহনার খুদের অন্ন রাঁধে
লহনার বাক্যে রামা সহিতে না পারে
ছাগল লইয়া চল কানন ভিতরে।’
এরপরে কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তাঁর পদ্যে একাধিকবার খাদ্য প্রসঙ্গ এনেছেন। সেখানেই দেখি মাংসের উল্লেখ।
‘তিন গোটা শর ছিল একগোটা বাঁশ।
হাটে হাটে ফুল্লরা পশরা দিত মাস।।’
অথবা
‘তবে সুশাসিত হবে গুজরাট ধরা।
পুনরপি হাটে মাংস বেচিবে ফুল্লরা।।’
কিংবা
‘ঘরেতে নাহিকো পোত্দার
প্রভাতে তোমার খুড়া, গিয়াছে খাতক পাড়া
কালি দিব মাংসের উধার।।’
তাঁর ভোজন বর্ণনায় আরও পাই এমন অপূর্ব কাব্যিক স্ফুরণ। সেখানে ভোজনসামগ্রীর অপরিমিতি শুধু নয় লেগে আছে ব্যাধ কালকেতুর ভোজন প্রকৃতির আদিমতা ও প্রান্তিক জনজীবনে খাদ্যের অনুষঙ্গ।
‘চারি হাঁড়ি মহাবীর খায় খুদ জাউ
ছয় হাণ্ডি মুসুরী সুপ মিশ্যা তথি লাউ’
লাউ মেশানো মুসুরির ডালের স্যুপের কথাও এল। এ যেন আধুনিক কালে আমাদের হেঁশেলে লাউ দিয়ে ডালের অনুরূপ। সেই ট্র্যাডিশন এখনও চলছে। মঙ্গলকাব্যের মুসুরির স্যুপ বা বিদেশের স্যুপ কিংবা সুরুয়া তো আমাদের ডালের মতোই। চামচ দিয়ে তুলে বাটি থেকে খাওয়া যায়।
এখানে কালকেতুর ভোজন প্রকৃতিও ব্যক্ত করতে ছাড়েননি কবি।
‘শয়ন কুৎসিত বীরের ভোজন বিটকাল
ছোটগ্রাস তোলে যেন তে আঁটিয়া তাল।’
সেই কালকেতুর মুখে আবারও মাংস বেচার কথা অর্থাৎ সে যুগে মাংস খাওয়ার এবং বেচার ব্যাপারটা চলত অত্যন্ত রমরমিয়ে।
‘মাংস বেচি ছিনু ভালো, এবে যে পরাণ গেল, বিবাদ সাধিল কাত্যায়নী।’
আবার কবিকঙ্কণ চণ্ডীর সুবৃহৎ সমভূমির মধ্যে ফুল্লরা ও খুল্লনা বারেবারে নড়েচড়ে ফিরে আসে। আর সেখানে রন্ধন প্রসঙ্গ এসে পড়ে বলাই বাহুল্য।
প্রাক্বিবাহ পর্বে ফুল্লরার পিতা সঞ্জয়কেতুর মুখে বর্ণিত হয়ে কন্যার গুণাবলি। বিয়ের পরে সে কালকেতুর যোগ্য স্ত্রী বা ‘হাঁড়ির মুখের সরা’র মতো অবিচ্ছেদ্য রূপে আবির্ভূত হয়।
‘এই কন্যা রূপে গুণে নামেতে ফুল্লরা।
কিনিতে বেচিতে ভাল জানয়ে পসরা।।
রন্ধন করিতে ভাল এ কন্যা জানে।
যত বন্ধু আইসে তারা কন্যাকে বাখ্যানে।।’
নিদারুণ দারিদ্র্যেও সে রান্না করে চলে সুঘরনির মতো।
এরপরেই কবি ঈশ্বর গুপ্তকে মনে পড়ে। বাঙালির খাবারদাবার নিয়ে তাঁর একাধিক কবিতার মধ্যে মাছ-সর্বস্বতা লক্ষণীয়।
‘ভাত-মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙালী সকল
ধানে ভরা ভূমি তাই মাছ ভরা জল।’
সাহেবদের আরাধ্য তপসে মাছকে তোল্লাই দিয়ে লিখলেন
‘এমত অমৃত ফল ফলিয়াছে জলে, সাহেবরা সুখে তাই ম্যাঙ্গো ফিস্ বলে।’
তপসে মাছে রূপে গুণে মুগ্ধ গুপ্ত কবি আরও লিখলেন সেযুগে,
‘কনককান্তি কমনীয় কায়, গালভরা গোপদাড়ি—তপস্বীর প্রায়।’
আর সত্যিই তো তপস্বী বা তাপসের মতো চেহারার কারণেই এর নাম তপসে।
যে-কোনো মূল্যে এই মাছের কদর করলেন সাহেবরা। সাহেবসুবোর খিদে মিটল, কবির লেখায় প্রাণ জুড়োল। বাজারে তপসে দুর্মূল্য হল।
‘ব্যয় হেতু না হয় কাতর
খানায় আনায় কত করি সমাদর
ডিস ভরে কিস লয় মিসি বাবা যত
পিস করে মুখে দিয়ে কিস খায় কত।
তাদের পবিত্র পেটে তুমি কর বাস
এই কয় মাস আর নাহি খায় মাস।’
এখানে তাদের মানে অবশ্য ‘সাহেবদের’, আর দ্বিতীয় ‘মাস’-টি মাংস!
বাঙালির এই সর্বজনীন মৎস্য বিলাসিতা দেখে বলতে ইচ্ছে করে এ যুগে বাংলায় অন্নদামঙ্গল রচিত হলে দেবীর কাছে ঈশ্বরী পাটনি নিশ্চয়ই চেয়ে বসতেন এই বর “আমার সন্তান যেন থাকে মাছে ভাতে”!
মাছের পাশাপাশি হরিণ, গোরু, খাসি আর পাখির মাংসের রেওয়াজ তো ছিলই। বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গলেই রয়েছে।
‘মাংসতে দিবার জন্য ভাজে নারিকেল,
ছাল খসাইয়া রান্ধে বুইড়া খাসীর তেল’
ভারতচন্দ্র তার অন্নদামঙ্গল-এ ভবানন্দ মজুমদারের স্ত্রী পদ্মমুখীর ব্রাহ্মণ ভোজনের নিমিত্তে রান্নার বিবরণে রয়েছে মাছের পাশাপাশি কচ্ছপের ডিমের কথাও।
‘নিরামিষ তেইশ রাঁধিলা অনায়াসে
আরম্ভিলা বিবিধ রন্ধন মৎস্য মাসে।
কাতলা ভেটুক কই কাল ভাজা কে
শিক-পোড়া ঝুরি কাঁঠালের বীজে ঝোল।
ঝাল ঝোল ভাজা রান্ধে চিতল ফলুই
কই মাগুরের ঝোল ভিন্ন ভাজে কই।
ময়া সোনা খড়কীর ঝোল ভাজা সার
চিঙ্গড়ির ঝোল ভাজা অমৃতের তার।
কণ্ঠা দিয়া রান্ধে কই কাতলার মুড়া
তিত দিয়া পচা মাছ রান্ধিলেক গুড়া।
আম দিয়া ষোল মাসে ঝোল চড়চড়ি
আড়ি রান্ধে আদারসে দিয়া ফুলবড়ি।
রুই কাতলার তৈলে রান্ধে তৈল শাক
মাছের ডিমের বড়া মৃতে দেয় ডাক।
বাচার করিল ঝোল খয়রার ভাজা
অমৃত অধিক বলে অমৃতের রাজা
সুমাছ বাছের বাছ আর মাস যত
ঝাল ঝোল চড়চড়ি ভাজা কৈল কত।
বড়া কিছু সিদ্ধ কিছু কাছিমের ডিম
গঙ্গাফল তার নাম অমৃত অসীম।’
বেহুলার বিয়েতে হরিণের মাংস ও কাউঠা বা ছোটো কচ্ছপের মাংস দিয়ে বিবিধ ব্যাঞ্জনের কথা রয়েছে।
আবার রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র যে সামোসার কথা বললেন তা যে দেখি সেকচি অর্থাৎ বেকড সিঙ্গারার মতো!
‘কচি ছাগ মৃগ মাংসে ঝালঝোল রসা
কালিয়া দোলমা বাগা সেকচী সামসা।’
সেকালে বেজি, শজারুর মাংস রান্নার বর্ণনাও পাওয়া যায়। এ ছাড়া, কাঁকড়া, শামুক, হাঁস, শুকর খেত সকলেই। মুসলমানদের শুকর এবং সনাতন হিন্দুদের গোরুর মাংস নিষিদ্ধ ছিল। বৌদ্ধ ধর্মানুসারে আবার জীবহত্যা মহাপাপ। তাই তারা ছিল নিরামিষভোজী। সেই ট্র্যাডিশন বুঝি বাংলার জৈনরা এখনও বয়ে চলেছে।
বাঙালির রান্নাঘরে দোলমা, কাবাব, কোরমা, কালিয়া এসেছে সুলতানি আমলে। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে দেবী নিজহাতে সঘৃত পলান্ন বা পল (মাংস) মিশ্রিত অন্ন রাঁধেন। এই পলান্নই এখনকার বিরিয়ানির অনুরূপ।
এ ছাড়াও দেবী রাঁধেন ‘অন্নমাংস সিকভাজা কাবাব করিয়া’ অর্থাৎ বাঙালির পোলাও মাংস আর সিককাবাব সেই ভারতচন্দ্রের আমল থেকেই জনপ্রিয়। সেসময় মুসলমানরা মোরগের মাংস খেতেন। ধীরে ধীরে তা হিন্দু বাঙালির সংসারের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে গেল।