এই মহাবিশ্বে, পরমাণু থেকে শুরু করে বৃহৎ নক্ষত্র পর্যন্ত সবকিছুতেই যা সবচেয়ে বেশি ‘চোখে পড়ে’ তা হল শূন্যতা বা নাথিংনেস। তা সে একটা নক্ষত্র থেকে আরেকটা নক্ষত্রই হোক, বা প্রতিবেশী দুটি গ্যালাক্সির মধ্যেকার অসীম দূরত্বই হোক, আবার পরমাণুর ভিতরকার কণাগুলির আন্তঃ-দূরত্বই হোক। দেখা যাবে দুটি গ্যালাক্সির আয়তনের তুলনায় মাঝখানে যে ফাঁকা অংশ, তা আরও অকল্পনীয় বিরাট, গ্যালাক্সি দুটির কল্পনাতীত আয়তনের তুলনাতেও। আমাদের ছায়াপথের সবচেয়ে নিকটবর্তী যে ছায়াপথ, সেই অ্যান্ড্রোমিডা প্রতি সেকেন্ড আমাদের দিক ধেয়ে আসছে ১১০ কিমি গতিবেগে। বা মিনিটে ৬৬০০ কিমি গতিবেগে। এই তীব্র বেগে ধেয়ে আসা অ্যান্ড্রোমিডা কত সময় নেবে আমাদের এই ছায়াপথের উপর হুড়মুড় করে এসে পড়তে? তা নিয়ে ভাববার আগে, দেখা যাক আমার থেকে আপনার দূরত্ব কত। রাফলি ৯১০০ কিমি ( এ শহর থেকে কলকাতার দূরত্ব)। ধরা যাক একজন মানুষের আয়ু ১০০ বছর। আরও ধরা যাক মিল্কিওয়ে থেকে অ্যান্ড্রোমিডার দূরত্বও এই ৯১০০ কিমি। তাহলে পরবর্তী ১০০ বছরে অ্যান্ড্রোমিডা এই ৯১০০ কিমি-এর ভিতর মাত্র ২ সেমি দূরত্ব অতিক্রম করবে, ওই অত বেগে (১১০ কিমি/ সেকেন্ড) ধেয়ে আসবার পরও। তাহলে প্রশ্ন এই যে এই ‘৯১০০ কিমি’ দূরত্ব অতিক্রান্ত হবে কতদিনে? তার জন্য প্রয়োজন ৪.৫ বিলিয়ন ইয়ার্স। তবে অ্যান্ড্রোমিডা আমাদের ছায়াপথের ঘাড়ে এসে পড়লেও, আমাদের হয়ত তেমন অসুবিধে হবে না, কেননা ততদিনে পৃথিবীতে আর প্রাণের অনুকূল পরিবেশ নেই। জল তো থাকবেই না, এমনকি পাহাড়-পর্বত-শিলাখণ্ড ততদিনে সব গলে যাবে উত্তাপে! যেমনটি হয়েছে শুক্রগ্রহে।
আবার আমাদের বা সূর্যের নিকটতম নক্ষত্রটি হল প্রক্সিমা সেন্টরাই। তার দূরত্ব কত? ৪.২ আলোকবর্ষ। সূর্য বা প্রক্সিমা সেন্টরাই-এর বিশাল আয়তনের তুলনাতেও এ এক দুর্লঙ্ঘ দূরত্ব, ৪০,২০৮,০০০,০০০,০০০ কিলোমিটার। এই প্রায় ৪০ লক্ষ কোটি কিলোমিটারের ভিতর আর দ্বিতীয় কোনো নক্ষত্র নেই। এ তো গেল দুটি মহাজাগতিক বস্তুপিণ্ডের মধ্যেকার দূরত্বের কথা। অন্যদিকে যে কোনো পদার্থের ভিতরও ৯৯.৯৯৯৯৯৯৯৯% খালি স্থান। অর্থাৎ যা কিছু এক্সিস্ট করে, তা ক্ষুদ্র কোনো আণুবীক্ষণিক প্রাণই হোক বা মহাকাশের বুকে অতিকায় কোনো নক্ষত্র হোক, সবকিছুরই বিল্ডিং ব্লক হল পরমাণু, কিন্তু এই পরমাণুর ভিতর আবার অধিকাংশ স্থানই আবার ফাঁকা। অর্থাৎ পরমাণুর ভিতর ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন এই মৌল কণিকাগুলি সবমিলিয়ে পরমাণুর ভিতর যতটা স্থান অধিকার করে রাখে তা পরমাণুটির মোট আয়তনের তুলনায়, মাত্র ০০.০০০০০০০০১ শতাংশ। এটি ঠিক কতটা অযৌক্তিক তা অনুধাবন করবার জন্য, ধরা যাক পরমাণুর নিউক্লিয়াসটি একটা ফোনের হোম স্ক্রিন বাটনটির সাইজ, ১ সেমি ব্যাসের। তাহলে পরমাণুটির ব্যাস কত হবে? ১ কিমি! অর্থাৎ সবদিক বাঁচিয়ে বলাই যায় যে পরমাণুটির ভিতর যে কোনও বিন্দু থেকে যে কোনো দিকে ভোররাতেই ৫০০ মিটারের মতো মর্নিংওয়াক করে আসাই যায়, কোথাও হোঁচট না খেয়ে।
যাক এইসব অকল্পনীয় সংখ্যার (.০০০০০০০১) কথা, আমরা বরং খালি চোখে চশমা ছাড়াই যে সব জিনিস দেখতে পাই, তাদের কথা ভাবি। ধরা যাক এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং। ৪৪৩ মিটার উঁচু, ১০২ তলা এবং ৩৬৫০০০ টন পদার্থ। এখন যদি কোনো ম্যাজিক করে এই ৩৬৫০০০ টন পদার্থ যে অণু-পরমাণুগুলি দিয়ে তৈরি সেগুলি থেকে সব শূন্যস্থান, বেলুনের হাওয়া বের করে দেবার মতো নিষ্কাশিত করা যায়, কী পড়ে থাকবে? ৩৬৫০০০ টন ওজনের এক দানা চালের সাইজের ‘এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং’। হ্যাঁ এক-দানা চালের সাইজ।
মানুষের শরীর প্রায় ৭ অক্টালিয়ন (৭-এর পর ২৭টা শূন্য) অণু দিয়ে তৈরি। এই অণুগুলিও একইরকম ফাঁপা। হয়তো তাই আমরা প্রায়ই শুনি, অনেকেই বলে থাকেন, ‘আজকাল খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগে’। আমার প্রায়ই মনে হয় এ আসলে ‘আত্মোপলব্ধি’ বা ‘ট্রু-সেলফ’-এর ধারণা। জোকস অ্যাপার্ট, আবার কল্পনা করা যাক যে, এই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের শরীরের প্রতিটি কোষে যে সব অণু-পরমাণু দিয়ে তৈরি, সে সবের ভিতর যে ‘শূন্য স্থান’ আছে তা সব বের করে দেওয়া হল। এটা করা হলে দেখা যাবে, পৃথিবীর পুরো জনসংখ্যা তখন একটা আপেলের ভিতর ফিট করে যাচ্ছে! অর্থাৎ একটা আপেলে ৭.৫ বিলিয়ন মানুষ। শুধু একটাই শর্ত, মানুষের শরীর যে পরমাণুগুলি দিয়ে তৈরি, তার প্রতিটি ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন ইত্যাদি ভরযুক্ত সব কণাগুলিকে কোনো ফাঁকহীনভাবে একসঙ্গে এক জায়গায় জড়ো করতে হবে।
এবারে আবার আমরা একটা ছবির দিকে তাকাব। দূর থেকে তোলা, আমাদের সবার গ্রুপ ফটো। আমাদের এ ছবিটার নাম ‘ফ্যাকাসে নীল বিন্দু’। আমাদের এই পৃথিবী নামক গ্রহটির ছবি। ছবিটি তোলা হয়েছিল ১৪-ই ফেব্রুয়ারি ১৯৯০, ভয়েজার ১ মহাকাশ যান থেকে, যখন এই মহাকাশ-যানটি পৃথিবী থেকে ছিল প্রায় ৬ বিলিয়ন কিলোমিটার দূরে। এই ছবিটিতে পৃথিবীর সাইজ, ১ পিক্সেলের থেকেও কম। আমি জানি আমাদের অনেকের ফোনেই ক্যামেরা আছে ২০ থেকে ৪০ মেগাপিক্সেলের ক্যামেরা। ১ মেগাপিক্সেল = ১মিলিয়ন পিক্সেল। তাহলে এই মাপের ক’টা ‘পৃথিবী’-র ছবি তোলা যায় আমদের মোবাইল ফোনের ক্যামেরায়, আমি সেই ক্যালকুলেশনে আর গেলাম না।
তো এই ছবিতে বিশাল মহাশূন্যের প্রেক্ষাপটে, এক ফালি সূর্যরশ্মির ভিতর আমাদের পৃথিবী একটা দুর্বোধ্য ধুলোর কণার মতো ভাসছে!
ছবিটিকে উদ্দেশ্য করে মহানুভব জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সাগান কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানমঞ্চে ১৯৯৪ সালের ১৩ অক্টোবর তার ভাষণে যা বলেছিলেন, আমি তার ভাবানুবাদ নীচে তুলে দিচ্ছি। শ্রেষ্ঠ কবিতার মতো আধ্যাত্মিক এই স্পিচ। তাই এই বক্তব্যটির পরে আমি আর একটা শব্দও লিখব না। লেখা যায় না!
"...এই এইখানে, এই-ই আমাদের বসত। আমরা। এখানেই সবাই, যাদের আমরা ভালোবেসেছি, যতজনকে আমরা চিনি, যাদের যাদের কথা আমরা শুনেছি, পড়েছি, জেনেছি, তাদের সবাই এখানেই তাদের জীবন কাটিয়েছে, মরে গেছে, আবার কেউ কেউ আমাদের মতো বেঁচে আছে।
আমাদের প্রত্যেকের সারা জীবনের যত আনন্দ, দুঃখ-কষ্ট, হাজার হাজার আত্মবিশ্বাসী ধর্ম, রাজনৈতিক মতাদর্শ আর অর্থনৈতিক মতবাদ, যত শিকারি আর লুণ্ঠনকারী, যত সাহসী আর কাপুরুষ, সভ্যতার নির্মাতা ও ধ্বংসকারী, যত নৃপতি ও শাসক আর প্রজা, যত প্রেমিক-প্রেমিকা, যত পিতা-মাতা-শিশু, স্বপ্নে বিভোর কিশোর, তরুণ, বৃদ্ধ, পরিব্রাজক, আবিষ্কারক, যত নীতিবান শিক্ষক, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, যত সুপারস্টার, মানব ইতিহাসের সকল দয়ালু সন্ত আর পাপী, সবাই তাদের জীবন অতিবাহিত করেছে আলোয় ভেসে থাকা ধুলোর ঐ ছোট্টো কণাটিতে।
অসীম অনতিক্রম্য এই মহাবিশ্বে, খুব ছোট্ট একটা নাট্যমঞ্চ আমাদের এই পৃথিবী। স্রেফ একটা বিন্দু। অথচ তারই একটি অংশের দখল নেবার জন্য, 'অধিকার' কায়েম করবার জন্য দিগ্বিজয়ী বীর সম্রাট আর সেনাপতিদের দল কী সীমাহীন হিংস্রতা দিয়ে, কত রক্তের নদী বইয়ে দিয়েছে! নিজেকে মহান প্রমাণ করবার আশায়, এইসব বিজয়ে গৌরবান্বিত হয়ে ওঠার নেশায়, রক্তের ফোয়ারা ছুটিয়েছে! কী বিকট বীভৎস এই জিঘাংসা! আমাদের স্বাজাত্যাভিমান, আমাদের কাল্পনিক অহমিকা, এই অকূল ব্রহ্মাণ্ডে আমি বা আমরাই শ্রেষ্ঠ বা আমাদের অবস্থান সুবিধাজনক, এই বিভ্রম কী ভয়াবহরকম প্রশ্নবিদ্ধ হয় এই ঝাপসা ফ্যাকাসে নীল আলোর বিন্দুটির দিকে তাকিয়ে!
আমাদের মানবিক মূর্খতাকে সংজ্ঞায়িত করবার জন্য আমাদের ক্ষুদ্র পৃথিবী নামক বাসস্থানটির, এই দূরবর্তী চিত্রের দিকে তাকানোর চেয়ে ভালো কোনও উপায় নেই।
আমাদের বাসস্থান গ্রহটি মহাজাগতিক অন্ধকারের জানালা দিয়ে একটি ম্লান আলোর রেখার ভিতর একাকী একটি ধূলিকণা, বিন্দুবৎ।
এই সুবিশাল অন্ধকারে আমাদেরকে রক্ষা করতে অন্য কোথাও থেকে সাহায্য আসবে এমন কোনো ইঙ্গিতও নেই।
আমাদের সীমিত জ্ঞানে পৃথিবীই একমাত্র গ্রহ যা এখন পর্যন্ত জীবনকে আশ্রয় দান করতে পারে, তাকে লালন করতে পারে। অন্তত নিকট ভবিষ্যতেও আর কোথাও নেই, যেখানে আমাদের প্রজাতি ও তাবৎ প্রাণীকুল চলে যেতে পারে, বসত গড়তে পারে। পৃথিবীর বাইরে ভ্রমণ? সম্ভব। স্বয়ংসম্পূর্ণ বাস্তুতন্ত্র? এখনও নয়। পছন্দ হোক বা না-ই হোক, এই মুহূর্তে পৃথিবীই আমাদের একমাত্র আশ্রয়।
বলা হয়ে থাকে জ্যোতির্বিজ্ঞান আমাদের বিনয়ী করে তোলে, চরিত্র গঠনে সাহায্য করে। মানুষের অহমিকাকে ধূলিসাৎ করে দেবার জন্য দূর থেকে তোলা ছোট্টো পৃথিবীর এই ছবিটার চেয়ে ভালো উদাহরণ আর হয় না। আমার মতে, এই ছবিটা মনে করিয়ে দেয়, পরস্পরের প্রতি আরেকটু সহানুভূতিশীল হওয়া কতটা জরুরি। কতটা জরুরি এই ছোট্টো নীল বিন্দুটার প্রতি যত্নশীল হওয়া, আমাদের একমাত্র বসতটাকে, সংরক্ষণ করা, উপভোগ করা।"