"অস্ট্রেলিয়ার এক মরুশহরে শান্ত একটা ক্লাসরুমে আমি বিজ্ঞান পড়াচ্ছিলাম। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে কিছুটা আনমনেই বলে ফেললাম যে, পরের সপ্তাহে তাহলে একটা ভালো রকম সাইক্লোন আসতে চলেছে। বেশিরভাগ ছাত্রই এ কথা শুনে মুখ-টিপে হাসতে শুরু করলো। তাদের মধ্যে একজন তো বলেই ফেলল যে আবহাওয়া দপ্তর বলেছে, নিম্নচাপ সরে যাবে, কোনোরকম সমস্যা না করেই!
কিন্তু ক্লাসের ভিতরই একটা অংশ, স্থানীয় ইন্ডিজিনাস ছাত্ররা কিন্তু আমার কথায় বিস্মিত হল না, বরং উলটে জিজ্ঞাসা করল, যে জ্ঞান ওরা ওদের পূর্বপুরুষের কাছ থেকে অর্জন করেছে, ঠিক সেই একই জ্ঞান অর্থাৎ আবহাওয়া সম্পর্কে এই ভবিষ্যতবাণীর কায়দাটা আমি কীভাবে জানলাম! আমি মৃদু হেসে জানালার বাইরে আঙুল দিয়ে দেখালাম। বাতাস উল্টোদিকে বইছে, মেঘ সরে গেছে দক্ষিণ থেকে উত্তরে, কোরেলা (Corella) পাখিগুলি লোকালয় ছেড়ে চলে গেছে কারিজিনি (Karijini) পাহাড়-শ্রেণীর দিকে। অ্যাবঅরিজিনাল স্টুডেন্টরা খুবই মোহিত হল আমার উত্তরে। অন্যরা নিঃসন্দেহে আমাকে একটা ইডিয়ট সায়েন্স টিচার ভেবেছিল। অন্তত পরের সপ্তাহে বিপুল একটা সাইক্লোন শহরে আছড়ে পড়া পর্যন্ত।
আমার মনে হয় পরিবেশে তাৎক্ষণিক ভাবে উপস্থিত থাকা তথ্যগুলি বিশ্লেষণ করে আমি একটা ঠিকঠাক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পেরেছিলাম। প্রজ্ঞা মানে কখনোই স্যাটেলাইট, আধুনিক ব্যারোমিটার, ইত্যাদি থেকে সংগৃহীত তথ্য কম্পিউটারের সাহায্য নিয়ে ক্যালকুলেশন করে দিনের কোন সময়ে কত মিলিমিটার বৃষ্টি হবে বা বৃষ্টি আদৌ হবেই না, এটা বলা নয়। বরং পর্যবেক্ষণ-জাত তথ্যগুলিকে কাজে লাগিয়ে একটা সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো অনেক বেশী কৃতিত্বের পরিচায়ক। অস্ট্রেলিয়ার অ্যাবঅরিজিনালরা যেরকম পরিবেশের সূক্ষ্ম সংকেতগুলি অনায়াসে পড়ে সেই জ্ঞান তাদের দৈনন্দিন জীবনে কাজে লাগিয়ে আসছেন পঞ্চাশ হাজার বছর ধরে।" (জোয়েল রিড, বিজ্ঞান শিক্ষক)
আমার তো এরকমও মনে হয়, আফ্রিকা থেকে যখন প্রথম অজানার উদ্দেশ্যে আমাদের এইসব আদি-মানবরা তাঁদের জলযানগুলি ভাসাল, সামনে ভয়াল ভয়ংকর অজানা বিপুল জলরাশি, তখনও হয়তো এমন আরও অনেক আশ্চর্য জ্ঞান ওঁদের ছিল যা কালক্রমে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
এখানে আরেকটা উদাহরণ দিই, জ্যারেড ডায়মন্ড (বই: Guns, Germs and Steel), বায়োলজির ফিল্ডওয়ার্ক করেছেন ৩৩ বছর ধরে পাপুয়া নিউগিনির মূলত ফোর উপজাতীয়দের ভিতর।
একদিন জ্যারেড জঙ্গলের ভিতর ফিল্ড-ওয়ার্ক করতে গেছেন, অন্য একটা উপজাতি ওদের খাদ্য-সংগ্রহের পথ অবরোধ করে রেখেছে। খাবার ফুরিয়ে যাওয়ায় জ্যারেড তাঁর টিম নিয়ে মহা-মুশকিলে পড়লেন। এর মধ্যেই জ্যারেডের টিমের এক উপজাতীয় সদস্য কোথাও একটা চলে গিয়ে, কিছু সময় পরে ফিরে এলেন, এক ব্যাগ মাশরুম নিয়ে। যখন এই মাশরুমগুলি অল্প-আঁচে টিমের সদস্যরা (সবাই ফোর উপজাতির) ঝলসে নিতে শুরু করল, জ্যারেড লিখেছেন, খিদের সময় খাবার দেখে খুশি হলেও, ভয়ও করছিল যে এই মাশরুমগুলি বিষাক্ত নয় তো!
জ্যারেড ওঁদের কাছে বিষয়টা বলতে শুরু করলেন, "এমনকি বিখ্যাত মাশরুম বিশেষজ্ঞরাও অনেক সময় মাশরুম চিনতে ভুল করে! তাই প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে এই মাশরুম খাওয়াটা কী ঠিক হবে?" এ কথা শুনে ফোর উপজাতীয় সদস্যরা রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে পড়ল। জ্যারেড কী বলছে, তার মাথামুণ্ডু কিছুই তাঁরা বুঝতে পারল না। ওদেরই একজন তখন জ্যারেডকে বুঝিয়ে বলল, এমনকি ওদের মধ্যে যারা খুব অল্পবয়সী, নাবালক, ২৯টা প্রধান খাবার-যোগ্য মাশরুমের নাম, জঙ্গলের কোথায় পাওয়া যায় সে সব কিছুই তাদেরও নখদর্পণে। এই যে মাশরুম ওরা খাবে বলে ঠিক করেছে, এগুলি টান্টি (Tanti) নামের একটা গাছের গায়ে হয়। এগুলি খাওয়া শুধু নিরাপদ নয়, খুবই সুস্বাদুও বটে। অর্থাৎ ওঁরা এই মাশরুমগুলি ও অন্যান্য খাবার-যোগ্য জঙ্গুলে মাশরুমগুলিকে হাতের তালুর মতো চেনে এবং জানে। এই উপজাতীয় মানুষগুলি যখনই নতুন কোনো জায়গায় যায়, সেখানকার স্থানীয় মানুষের কাছে প্রথমেই ওঁরা জিজ্ঞেস করে নেয় ওখানকার গাছগাছড়া সম্পর্কে। কোনো প্রয়োজনীয় গাছের সন্ধান পেলেই, ওঁরা তার নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে আসে ওদের ডেরায়। এভাবেই শয়ে শয়ে নতুন নতুন গাছ বা পাখ-পাখালির সম্পর্কে এমন অনেক তথ্য ও জ্ঞান জ্যারেড অর্জন করেছিলেন এই উপাজাতীয় মানুষগুলির সঙ্গে থেকে, যা তিনি কখনোই সারা পৃথিবীর সব প্রাণীবিদ্যা বা উদ্ভিদবিদ্যার বইগুলি পড়ে ফেললেও জানতে পারতেন না। সুতরাং আমাদের পূর্বপুরুষ এবং নারীরা বোকা তো ছিলেনই না, বরং ডায়েট্রি নলেজ বা পরিবেশ পড়ার সূক্ষ্ম কারিকুরিতে তাঁরা আমাদের থেকে অনেক বেশী স্মার্ট ছিলেন। এই কথাগুলি লিখলাম এই জন্য নয় যে যারা সোশ্যাল মিডিয়ায় সারাক্ষণ তর্ক করছে, কেউ কিছু বললেই তার বিপরীতমুখী কিছু একটা বলে পৃথিবী জয় করে নিচ্ছে, তাদের প্রতি আমি কোনো কারণে বিরক্ত হয়েছি। বরং নিজের অক্ষমতাগুলি সম্পর্কে যত দিন যাচ্ছে ততই যে আরও সচেতন হচ্ছি, সে কথা জানাতেই এ লেখা।
আমার বাবার সঙ্গে আমার বয়সের ডিফারেন্স ছিল ৩০ বছর। মৃত মানুষের তো আর বয়স বাড়ে না! এভাবেই আমাদের বয়সের পার্থক্য এখন কমে আসছে। যাইহোক আমার মনে পড়ে, আমার বয়সে আমার বাবা কতটা প্রাজ্ঞ ও বিচক্ষণ ছিলেন। কাল্পনিক ভাবে ধরা যাক আমাকে এবং আমার সমবয়সী বাবাকে দুটি আইডেন্টিক্যাল জন-মানবহীন দ্বীপে আলাদা আলাদা ভাবে রেখে আসা হল। এখন ওই নির্দিষ্ট দ্বীপটিতে টিকে থাকার সম্ভাবনা ও রিস্ক অ্যাসেস করতে আমার যদি ২ দিন লাগে, আমার বাবার হয়ত সময় লাগবে ২ ঘণ্টা। এবং আলটিমেটলি টিকে থাকার এই প্রতিযোগিতা উনিই জয়ী হবেন বিরাট ব্যবধানে। আমার মনে হয় এটা শুধু আমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, দু একটি ব্যতিক্রম ছাড়া আমাদের প্রজন্মের প্রায় সবার ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। দু'পাতা সাহিত্য ও এটা-সেটা পড়ে, তর্কে জয়ী হবার কায়দা ছাড়া আর কীই-বা শিখেছি আমরা?
আমার বাবা নোকিয়া ৫০০-এর একটা হ্যান্ডসেট ব্যাবহার করতেন। যদিও ২০১১ সালে বাবা মারা গেছেন, কিন্তু স্মার্ট ফোন ব্যাবহার করবার মতো স্মার্টনেস তখনও ওঁর হয়নি।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।