‘ছত্রিশ হাজার লাইন কবিতা না লিখে
যদি আমি সমস্ত জীবন ধরে
একটি বীজ মাটিতে পুঁততাম
একটি গাছ জন্মাতে পারতাম...
ছত্রিশ হাজার লাইন কবিতা না লিখে
যদি আমি মাটিকে জানতাম’
(বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)
হোয়াটসঅ্যাপে, ফেসবুকে ইদানীং বারবার ভেসে উঠছে একটি বার্তা যার শিরোনাম ‘খুব দেরি হয়ে যাওয়ার আগে’।
“… পুণে-র ইয়েরাওয়ারা জেলে বন্দি কবি ওয়রওয়রা রাও গুরুতর অসুস্থ। আমাদের এই ‘কবিকে মুক্ত করো’ উদ্যোগকে দ্রুততর করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।… জার্মনির রাইখস্ট্যাগ ট্রায়ালের আদলে সাজানো ভীমা কোরেগাঁও ও প্রধানমন্ত্রী হত্যাচেষ্টা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত একজন বন্দি হিসাবে (বন্দিত্ব অবশ্য তাঁর কাছে নতুন কোনো বিষয় নয়, বর্ষীয়ান এই কবি সেই ১৯৭৩ থেকে গ্রেফতার হয়েছেন, বহু দফায় কারাবন্দি থেকেছেন বহু বছর, যতদিন এদেশের আর কোনো কবিকে থাকতে হয়নি)। তেলুগু সংস্কৃতিতে মৌখিক ভাষ্য বিষয়ে তাঁর পোস্ট ডক্টরাল পেপার, এবং পরবর্তীতে তাঁর থিসিস ‘তেলেঙ্গনা মুক্তিসংগ্রাম ও তেলুগু উপন্যাস: সমাজ ও সাহিত্যের আন্তঃসম্পর্কের একটি পাঠ’-কে সমকালীন মার্কসীয় সাহিত্যচর্চায় মাইলফলক বলে ধরা হয়। সমকালীন বিশ্ব প্রতিরোধ সাহিত্যের সঙ্গে তেলুগু পাঠকদের পরিচয় করিয়ে গেছেন ধারাবাহিক ভাবে, জেলে বসেও অনুবাদ করেছেন কেনিয়ার সাহিত্যিক নগুগি ওয়া থিংগো-র উপন্যাস ডেভিল অন দ্য ক্রস বা জেল ডায়েরি ডিটেইনড। তাঁর নিজের কারাবাসের দিনলিপি সহচরলু ‘ক্যাপটিভ ইমাজিনেশন’ নামে অনূদিত হয়ে আন্তর্জাতিক পাঠকের সম্ভ্রম আকর্ষণ করেছে। ৬৭ থেকে আজ, অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ওয়রওয়রা রাও ক্রমশ থেকে গেছেন বিদ্রোহের ভাষ্যকার। এইসময়ে ‘না’ বলতে পারা কবিদের, শিল্পীদের, চিন্তাকর্মীদের খুব দরকার। তাই, কবিকে মুক্ত করো। মুক্ত করো অন্ধকারের এই দ্বারকে।”
এই আবেদনের নীচে যাঁরা সাক্ষর করেছেন বা যাঁরা করেননি, তাঁদের অনেকেরই একটা অস্বস্তি কাজ করছিল। যে কতটা অধিকারী একজন স্বাক্ষরকারী? তিনি আদৌ কতটা পড়েছেন এই কবিকে? ‘কবি কখনোই সিংহ নয়, শুধু এক স্রোত’। সেই স্রোতের সঙ্গে কতটুকু পরিচিত আমরা? বিচ্ছিন্নভাবে কিছু অনুবাদ হলেও বাংলায় তাঁর কোনো কবিতার বই চোখে পড়েনি। সেই অস্বস্তি দূর হল আলোচ্য বইটিকে পেয়ে। অত্যন্ত দরকারি কাজ করেছেন এঁরা, সম্প্রীতি মনন। সাধারণ পাঠক এর থেকে ভারভারা রাও সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা করতে পারবেন। অনুভব করতে পারবেন কবির শব্দগুলির অন্তর্নিহিত শক্তি, তাঁর প্রতিটি লেখাই যে শ্রমজীবী মানুষের ঘাম রক্ত আর অশ্রু থেকে জন্ম নিয়েছে।
‘আমাকে আরও একবার বলতে শিখতে হবে
মানুষের কমিউনে মানুষের কথা শুনে;
আমাকে শব্দের কাছে বাঁধা পড়তে হবে
তার আদেশ মানতে হবে।
শব্দের সাথে যে বিশ্বাসঘাতকতা করে
তার কোন উত্তরাধিকার থাকে না।
শব্দকে দুর্বল করতে পারে না কোন শক্তি।
কালের গনগনে ফার্নেসে
ভীম বেগে নেমে আসা হাতুড়ির আঘাতে আঘাতে
এখনই আমার ভাষা নির্মাণের সময়।’
(শব্দ)
আমরা যদি একেবারে প্রথম থেকে এই কবিকে লক্ষ করি তো দেখব কীভাবে তিনি নিজেকে তৈরি করেছেন। ১৯৬৮ সালে তাঁর প্রথম কবিতার বই বেরোচ্ছে, যদিও কবিতা লিখছেন তিনি সতেরো বছর বয়স থেকেই। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ক্যাম্প ফায়ার’ যখন প্রকাশিত হয়, তার আগেই নকশালবাড়ি আন্দোলনের জন্ম হয়েছে। দূর থেকেই এই আন্দোলনের আগুনের তিনি আঁচ নিয়েছেন। যদিও তেলুগু সাহিত্যে একটা ধাক্কা দেওয়ার প্রয়োজন তিনি এরও আগে অনুভব করেন। তৈরি করেন সাহিত্য বান্ধব নামে অরাজনৈতিক সংগঠন যার মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হয় ‘সৃজনা’। সেটা ১৯৬৬ সাল। এর পর জন্ম হয় ‘বিরসম’ অর্থাৎ বিপ্লবী লেখক সংঘের। সৃজনাও রাজনৈতিক চরিত্র পায়।
১৯৬৮ সালের ক্যাম্প ফায়ার থেকে ২০১৪ সালে ফিল্ড অব সিডস—এই ৪৬ বছরে ভারভারা রাওয়ের কবিতার ভরকেন্দ্র কিন্তু রয়ে গেছে বিপ্লব এবং বিপ্লব। বিপ্লবের থেকে বড়ো স্বপ্ন আর কিছু নেই, বিপ্লবের থেকে বড়ো রোমান্সও আর কিছু হয় না, সেই হিসেবে তিনি একজন স্বপ্নচারী, একজন রোম্যান্টিক কবি। সেই রোমান্টিকতা তাঁর গোড়ার দিকের কবিতাতে বেশি স্পষ্ট।
‘বইতে দাও ঝোড়ো হাওয়া
জ্বলে উঠুক আগুনের ফুলকি
ঘুমিয়ে থাকা বিপ্লবের লাল সূর্যকে
জাগতে দাও’
(রক্তে রাঙা একটি স্বপ্ন, উরে গিম্পু, ১৯৭৪, অনুবাদ— কাঞ্চনকুমার)
সেই স্বপ্ন এক কারাগার থেকে আর-এক কারাগারে ঘুরতে ঘুরতে হয়তো খানিক ফিকে, পায়রা উড়তে দেখে তাই তাঁর মনে হয় এরা তত স্বাধীনতার নয়, যতটা শান্তির প্রতীক।
‘স্বপ্নের পায়রারা
আমার মনের গহন থেকে উঠে এসে
আলতো বসে আমার চোখের পাতায়
ভয়ার্ত হয়তো
হয়তো সতর্ক
পাছে ধরা পড়ে আমার খোলা চোখের ফাঁদে’
কবির কণ্ঠস্বরে কি খানিক ক্লান্তি? আসলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক শান্ত সমাহিত তাঁর স্বর। তবে ভাষা বা আঙ্গিক নিয়ে সেভাবে কোনো পরীক্ষানিরীক্ষা চোখে পড়ে না। দীর্ঘ একাকীত্ব তাঁকে অন্তর্মুখী করেছে, শিখিয়েছে যে-কোনো বিপ্লবের জন্ম আসলে হয় নিজের ভেতরে। বাইরের চাঁদ তাঁর আর চোখে পড়ে না, তিনি দেখতে পান নিজের কবিতার জ্যোৎস্না আর নিজের রক্তে মিশিয়ে দেন দু-এক ফোঁটা কবিতাকে।
তবে নারী সম্পর্কে তাঁর ধারণা এই সময়ে রাজনৈতিক ভাবে সঠিক কি না তা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। এই সংকলনে থাকা ‘সতী’ বা ‘নারী’ কবিতা দুটিতে যদিও তিনি নারীকে বলেছেন ‘ক্রান্তির পথে এসো/ নারীপণ্যতন্ত্র থেকে দূরে’ কিন্তু অন্যত্র পড়া একটি কবিতায় (মেরিট) দেখি মিনিস্কার্ট জিনস পরা মেয়েদের রাস্তা রোকো নিয়ে কটাক্ষ।
সব বিপ্লব কি তাহলে বাইরেই হবে?
এই বইয়ের খুব চমৎকার একটা ভূমিকা লিখে দিয়েছেন সব্যসাচী দেব। অনুবাদক তালিকাটিও আকর্ষণীয়। যেমন আছেন শঙ্খ ঘোষ, সুদীপ বসু, বীতশোক ভট্টাচার্য, অশোক চট্টোপাধ্যায়, তেমনি কাঞ্চন কুমার, আশা সেন, সুজিৎ ঘোষ, অলকানন্দা এবং প্রতীক। বীতশোক ভট্টাচার্যের নাম দেখে বোঝা যায়, অনূদিত কবিতাগুলি সবই সাম্প্রতিক নয়। একটা বড়ো সময়কালের অনুবাদ নেওয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রতিটি অনূদিত কবিতার মূল কবিতার উৎস, বইটির প্রকাশকাল এবং অনুবাদের সময়কাল এগুলি থাকা জরুরি ছিল। তাহলে আমরা আরও ভালোভাবে বুঝতে পারতাম কবি ভারভারার বিকাশের গতিপথ। প্রকাশক অমিত দাশগুপ্ত এবং দীপক মিত্র ‘প্রকাশকের কথায়’ জানিয়েছেন ‘জলার্ক কবিতায় জানু-জুন ২০০২ প্রকাশিত কিছু কবিতা, অন্যান্য পত্রিকায় প্রকাশিত কয়েকটি কবিতা এবং সাম্প্রতিক সময়ে অশোক চট্টোপাধ্যায়ের অনূদিত কবিতাগুলি নিয়ে এই সংকলন।’ কোন্ কোন্ পত্রিকায় কবে এই অনুবাদগুলি বেরিয়েছে জানতে পারলে বাংলায় ভারভারা চর্চার ইতিহাস বুঝতে সুবিধে হত।
পেছনের প্রচ্ছদে একটি দুষ্প্রাপ্য ছবি আছে। পুলক চন্দের তোলা এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে কলেজ স্ট্রিটের ‘কথাশিল্প’-তে বসে আসেন ভারভারা রাও, ১৯৮৫ সাল। কৌতূহল জাগে, সেইসময় কি তাঁর কবিতার কোনো অনুবাদ করেননি কেউ? করার সম্ভাবনাই বেশি। সেই অনুবাদগুলো পেলে সংকলনটির ব্যাপ্তি আরও বাড়ত নিঃসন্দেহে। আর একটা প্রশ্ন—ভারভারা না ওয়রওয়রা? কোন্টা ঠিক বানান?
এই লেখাটি যখন প্রস্তুত হচ্ছে তখনও জেলে পচছেন কবি। যাঁর কবিতার বিস্ফোরককে ভয় পায় রাষ্ট্রশক্তি। খুঁজে বেড়ায় তাঁর শক্তির উৎস ঠিক কোথায়।
‘কবিতা হল সেই সত্য
যা ফাঁস করা যায় না—
রাষ্ট্রের লাগামহীন মানুষের মতো
সুধাহীন জীবনের মতো।
আমার পকেট হাতড়ে
বইখাতা তছনছ করে
কাবার্ড তন্ন তন্ন করে
তোমরা পাবে আমাদের হৃদয়ের
গহিন ঘর, দুর্লভ ফুলের মতো।
কোনদিন টেরও পাবে না
আমার এই বিপজ্জনক বেঁচে থাকাই
আমার কবিতার গোপনতম শক্তি’
(এই আলোড়িত বেদনার্ত ভাষা, রাগে দপদপ করা শব্দ)
এইরকম এক সময়ে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তোলার বদলে সত্যিকারের কাজের কাজ করলেন সম্প্রীতি মনন। তাঁদের কৃতজ্ঞতা জানাই।
অপূর্ব বিশ্লেষণ।যে কবির কন্ঠে প্রতিবাদ নেই তিনি কবি নন।কবি ঝরণা।ড্যামে আটকে পড়া নদী নন।বিশিষ্ট কবি শ্রদ্ধেয় তৃষ্ণাদির বিশ্লেষণে সেই সত্যিটা উঠে এসেছে।
কবি ভারভাড়া রাও আমাদের সময়ে একটা জ্বলন্ত শিখা ।..যার আলোয় আমরা পথ খুঁজে নিতে পারি এই অন্ধকার ময় ক্ষনে ।...ইচ্ছে রইলো বই টা কিনবার ।..লাল সালাম !!!
ভালো লাগলো। ভারাভারা রাও নিজেই এক সাহিত্য আন্দোলন। কবিকে শ্রদ্ধা
সত্যিই তাই। শব্দকে দুর্বল করতে পারে না কোন শক্তি।
কবি, কবির কবিতা এবং তার অবাধ বিচরণ মানবিক সকল মানুষ কে সংঘবদ্ধ করে তুলবে এটাই সত্য। কবি নিজেই আজ যেন মহামিছিল, গণ জাগরণে।
আপনার বিশ্লেষণে, কবিকে যেন খুব কাছ থেকে দেখতে পেলাম।
যে কলম রক্তে উদ্দীপনা তৈরি করে,তাকে লাল সেলাম।এই নষ্ট সময়ে কবি আলোর দিশা। বই টা সংগ্রহে রাখার ইচ্ছা রইলো।