(লেখকের কৈফিয়ৎ - লেখাটা বাংলায়। কিন্তু যথেষ্ট সংখ্যক উদ্ধৃতি আছে ইংরেজিতে। মেকলে সাহেবের ভূত ঘাড়ে চেপে আছে বোধ করি! পাঠকদের কাছে এজন্য দুঃখপ্রকাশ করা আর মার্জনা চাওয়া ছাড়া অতিরিক্ত কিই বা করতে পারি আমি?)
শুরুর কথা
২৯ জুলাই, ২০২০, ভারতীয় সংসদে – করোনা-সংকটে যখন সবাই ব্যতিব্যস্ত - কোনরকম আলোচনা এবং বিতর্ক ছাড়া দুটি কক্ষেই পাস হয়ে গেলো নতুন শিক্ষানীতি ২০২০ (NEP 2020)। এরকম অস্বাভাবিক, অভূতপূর্ব একটা আবহে যেখানে লক্ষাধিক মানুষ মারা যাচ্ছে অসহায়ভাবে, জিডিপির সংকোচন ঘটেছে ২৩%-এর ওপরে, কর্মহীন মানুষের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, “স্থানান্তরী” শ্রমিকদের বেঁচে থাকার এবং অস্তিত্ব ধারণের পরিসর ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে, প্রতিটি প্রয়োজনীয় জিনিষের দাম উর্ধমুখী, ভ্যাক্সিনের সম্ভাবনা তটরেখায় দেখা যাচ্ছেনা, সমস্ত স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে রয়েছে, “নিউ নর্মাল”-এর ঝাঁকুনিতে সবাই যখন বিপর্যস্ত সেরকম এক সময়ে এই শিক্ষানীতিকে এরকম তড়িঘড়ি সংসদীয় চেহারা দেওয়া কি খুব জরুরী ছিল? হয়তো বা জরুরীই ছিল। কারণ দেশের ক্ষেত্রে এই বিশেষ সময় যখন মানুষ নিজেদের জীবন নিয়ে অবদমিত আতঙ্ক আর অনুমান করে-নেওয়া মৃত্যুভয়ের আশঙ্কায় আচ্ছন্ন তখন এটাইতো সময়ের “সদ্ব্যবহার”! একসময়ে গান্ধীর বিখ্যাত উক্তি ছিল – “এডুকেশন ক্যান ওয়েট, বাট স্বরাজ ক্যাননট।” বর্তমান শাসনে এসে একটু পরিবর্তিত হয়ে গেল মনে হয় – সমাজের সুস্থতা ফিরে আসা অপেক্ষা করতে পারে, কিন্তু শিক্ষা নয়। আমরা শিক্ষার দূত – “বিশ্বগুরু” (“India will be promoted as a global study destination providing premium education at affordable costs thereby helping to restore its role as a Vishwa Guru.” – NEP 2020, 12.8) হয়ে উঠতে চাই। শুধু কি শিক্ষায়? অন্য প্রসঙ্গগুলো এখানে এখন বিবেচ্য নয়।
২০১৯ সালে ইসরোর প্রাক্তন প্রধান কৃষ্ণস্বামী কস্তুরীরঙ্গনের নেতৃত্বে পেশ করা হয় “ড্র্যাফট নিউ এডুকেশন পলিসি” – ৪৮৪ পৃষ্ঠার। এতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় ছিল। একে রীতিমতো ছাঁটকাট করে ২৯ জুলাই, ২০২০-তে, আগেই যা বলেছি, সংসদে “ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসি ২০২০” পেশ করা হয়, নিরুপদ্রবে পাস করানো হয়। সংসদের মধ্যেকার স্বাস্থ্যকর ও প্রয়োজনীয় বিতর্ক সুনিপুনভাবে এড়িয়ে যাওয়া হলেও হিন্দু সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী (৩১ জূলাই, ২০২০) “Rigorous consultations done before framing new National Education Policy, says Ramesh Pokhriyal.” কি সেই কর্মযজ্ঞ? আড়াই লক্ষ গ্রাম পঞ্চায়েত, ৬,৬০০ ব্লক, ৬৭৬টি জেলা এবং ৬,০০০ আর্বান লোক্যাল বডিজ অর্থাৎ মিনিসিপ্যালিটি ধরনের সংস্থা থেকে ২,০০,০০০-র বেশি পরামর্শ নেওয়া হয়েছে NEP 2020 পেশ/পাস করার আগে। সহজ প্রশ্ন আসবে – প্রথম, সংসদীয় বিতর্ক পূর্ণত পরিহার করা হল কেন এবং, দ্বিতীয়, ভারতের এই সংকটজনক মুহূর্তকেই কেন বেছে নেওয়া হল একে কার্যকরী করার জন্য?
‘হিং-টিং-ছট’ প্রশ্ন এসব
১৯৯০-এর দশকের প্রথম দিকে ভারতের ক্ষেত্রে (এবং বিশ্বের ক্ষেত্রেও বটে) অর্থনৈতিক সংকট আর মন্দা থেকে মুক্তি পাবার অছিলায় অর্থনীতির লিবারালাইজেশন বা অর্থনীতিকে মুক্ত করে দেবার পথ নিল ভারতের তৎকালীন সরকার। রাজনীতির ক্ষেত্রে নিওলিবারালিজম-এর যুগ শুরু হল। এর ফলে এক বিশেষ ধরনের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক তত্ত্ব এবং প্রয়োগের ভিত্তিও তৈরি হল। এই ভিত্তি জন্ম দিল ভিন্নতর এক বোধের, চিন্তনের। ডেভিড হার্ভে বিষয়টি এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন – “Neoliberalism is in the first instance a theory of political economic practices that proposes that human well-being can best be advanced by liberating individual entrepreneurial freedoms and skills within an institutional framework characterized by strong private property rights, free markets, and free trade.” (David Harvey, 2005, A Brief History of Neoliberalism) এই গ্রন্থেই আরেক জায়গায় বলছেন “Neoliberal theorists are, however, profoundly suspicious of democracy. Governance by majority rule is seen as a potential threat to individual rights and constitutional liberties. Democracy is viewed as a luxury, only possible under conditions of relative affluence coupled with a strong middle-class presence to guarantee political stability. Neoliberals therefore tend to favour governance by experts and elites.” (নজরটান লেখকের) আমরা জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে আলোচনায় এ প্রেক্ষিতটি মাথায় রাখবো।
আরও দুয়েকটি কথা বলে নিই। GATT (General Agreement on Tariffs and Trade) চুক্তি আদতে হয়েছিল ১৯৪৭-এ। এরই উত্তরসূরী হল ওয়ার্ল্ড ট্রেড অরগানাইজেশন (WTO)। GATT বা GATTS (General Agreement on Tariffs and Trade in Services) সুখ্যাত বা কুখ্যাত হয় উরুগুয়ে রাউন্ডের পরে ১৯৯৪ থেকে। উরুগুয়ে রাউন্ডের আলোচনায় ১২৩টি দেশ অংশগ্রহণ করেছিল। মুক্ত অর্থনীতি ও বাণিজ্য ছাড়াও নতুন কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় GATT-এর আওতায় চলে এলো, যেমন “services capital, intellectual property, textiles and agriculture”। শিক্ষাও চলে এলো এর আওতায়। ভারত সরকার ২০১৫ সালে নাইরোবিতে WTO-র নতুন কর্মসূচীতে স্বাক্ষর করে। মুক্ত বাজারের থাবা বিস্তৃত হল উচ্চতর শিক্ষায়, গবেষনায়, স্বাস্থ্যে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে।
এর সাথে মনে রাখবো নিওলিবারাল অর্থনীতির সাথে সঙ্গতি রেখে ২৯টি ইউরোপিয়ান দেশের স্বাক্ষরিত Bologna Process চালু হয় শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রাইভেটাইজেশনকে, যেমন সরকারি জমি প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কম বা নাম মাত্র দামে দিয়ে দেওয়া, কিভাবে ত্বরান্বিত করা যায় সে লক্ষ্যে। বর্তমানে স্বাক্ষর করা ইউরোপীয় দেশের সংখ্যা ৪৮। আরেকটা বিষয় আছে Bologna Process-এ। সেটা হল ৩০০ বছর ধরে ক্রমবিকশিত ইউরোপের সব দেশে শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি স্ট্যান্ডার্ড চালু করা। ভারতের জাতীয় শিক্ষানীতি রূপায়নে এরও প্রভাব আছে। মুশকিল হল ভারতের মতো বিপুল জনসংখ্যার ও জন বৈচিত্র্যের দেশে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাজনীতি ও অর্থনৈতিক অসাম্যের দেশে এই স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন শেষ অব্দি কতটা কার্যকরী হতে পারে সেখানে সংশয় থাকে।
জুলাই মাসের অব্যবহিত আগে ভারতে ঘটে যাওয়া একের পর এক ঘটনা স্মরণ করুন একবার। জেএনইউ-তে ছাত্র বিক্ষোভ। বহিরাগতদের আক্রমণে ছাত্রীদের মাথা ফেটে যাওয়া, শিক্ষিকাও ছাড় পাননি। শিক্ষার বর্ধিত ফি কমানোর জন্য বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্র আন্দোলন। দলিত হবার মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যা। নারী এবং তথাকথিত নীচু জাতের অধিকারের জন্য একের পর এক ক্যাম্পাসে আন্দোলন। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রসারিত সামাজিক এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবীতে আন্দোলনে ছাত্রদের সক্রিয় অংশগ্রহণ। রাইট টু ফ্রি স্পিচ এবং রাইট টু ডিসেন্ট-এর দাবীতে ছাত্রদের নিরলস ভূমিকা – এসবকিছুই পটভূমি হিসেবে কাজ করেছে হয়তো তড়িঘড়ি এই নীতি সংসদে পাস করানোর ক্ষেত্রে।
এখানে শিক্ষার বাইরে গিয়ে দু-একটা কথা বলে নিই যেগুলো কার্যত জড়িয়ে আছে রাষ্ট্রের নীতি ও শিক্ষানীতির সাথেই। এতে আশা করি আমাদের সামগ্রিক আলোচনার সুবিধে হবে। ১২ ডিসেম্বর, ১৯৯১, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ লরেন্স সামার্স একটি গোপন নোট তৈরি করে সহকর্মীদের মধ্যে বিলি করেন, মতামত চান। ১৯৯২-এর ফেব্রুয়ারি মাসে বিখ্যাত পত্রিকা The Economist নোটটি প্রকাশ করে দেয় “Let Them Eat Pollution (ওদেরকে দূষণ খেতে দাও)” শিরোনামে। নোটটির মোদ্দা কথা ছিল, ধনী বিশ্বের সমস্ত প্রাণঘাতী, দূষিত আবর্জনা আফ্রিকা বা কম উন্নত দেশগুলো তথা LDC (Less Developed Countries)-তে পাচার করতে হবে। এজন্য একটি স্বাস্থ্যের যুক্তিও দিয়েছিলেন সামার্স। তাঁর বক্তব্য ছিল আমেরিকার মতো দেশে প্রতি ১,০০,০০০ জনে ১ জনেরও যদি দূষিত বর্জ্যের জন্য প্রোস্টেট ক্যান্সার হয় তাহলেও এর গুরুত্ব আফ্রিকার মতো দেশগুলোতে যেখানে ৫ বছরের নীচে শিশুমৃত্যুর হার প্রতি ১০০০ শিশুতে ৫ জন তার চাইতে বেশি। এবং সেখানেই প্রথম বিশ্বের দেশের এই দূষণ পাচার করতে হবে, পাচার করতে হবে এই বিষাক্ত বর্জ্য। এরকম “চমৎকার ও অভিনব” ধারণার পুরস্কার হিসেবে সামার্স ক্লিন্টন প্রশাসনে ৭ বছর U.S. Treasury Secretary পদে ছিলেন। সে মেয়াদ শেষ হলে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। এসব পুরস্কারের কথা থাক। সামার্স এখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী বিডেনের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা।
এরকম একটা প্রেক্ষিতে আমরা যদি স্বাস্থ্যের চোখ দিয়ে দেখি তাহলে সহজেই বুঝবো স্বাস্থ্যের জগতে দু’ধরনের নাগরিকত্ব (health citizenship) তৈরি হল। একটি পূর্ণ রাশি ১, আরেকটি ০। আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের নাগরিকত্বও এরকম integer দেখা হয় – হয় ০ কিংবা ১। এখানে ভগ্নাংশের কোন জায়গা নেই। যেমনটা আজকের ভারতে এবং বিশ্বে দেখছি আমরা। লক্ষ্যণীয় বিষয় হল যে স্বাস্থ্যের পরিবর্তে শিক্ষার চোখ দিয়ে দেখলেও আমরা একইরকম অবস্থান দেখতে পাবো। ১৯শ শতাব্দিতে আধুনিক রাষ্ট্র তৈরির শুরু থেকেই রাষ্ট্রের প্রয়োজন ছিল মানুষ যাতে “স্বাভাবিক (normal)” এবং “অস্বাভাবিক (pathological)” এই দ্বৈত বিভাজনের গবাক্ষ দিয়ে দেখতে শেখে, সড়গড় হয়ে ওঠে। কিন্ডারগার্টেন, নার্সারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়োত্তর গবেষণা সবকিছুর মধ্য দিয়ে এ শিক্ষা চারিয়ে যায় প্রতিদিন, প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের বোধের মধ্যে।
পশ্চিমী দেশগুলোতে রাষ্ট্র এবং নাগরিকের মাঝে নিরন্তর টানাপোড়েন এবং লড়াইয়ের ফলে একটি গণতান্ত্রিক সামাজিক পরিসর তৈরি হয় – যাকে আমরা বলি নাগরিক পরিসর বা তৃতীয় পরিসর বা কোন ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে বাম পরিসর। কিন্তু ইউরোপের আধুনিকতার বিকাশ এবং বেড়ে ওঠার সাথে ভারতের কিছু পার্থক্য স্বাধীনতার জন্মলগ্ন থেকেই রয়ে গিয়েছিল।
Engrafted মডার্নিটির যে যাত্রা ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে ভারতে রাষ্ট্রিক উদ্যোগে শুরু হয়েছিল সেখানে সবাই মানে সমস্ত ভারতবাসী হয়ে উঠলো নাগরিক, খানিকটা হঠাৎ করেই। লক্ষ্যণীয় যে জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে যেখানে ব্রিটিশ রাষ্ট্র বা ইউরোপের একটি বড়ো অংশ প্রায় ৩০০ বছর ধরে ধীরে ধীরে একটু একটু করে গড়ে উঠেছে ভারত সেসমস্ত ধাপ অতিক্রম করার জন্য পেয়েছে কয়েক দশক মাত্র। ফলে ইংল্যান্ড সহ ইউরোপের গুরুত্বপুর্ণ দেশগুলোতে যেভাবে ঐতিহাসিকভাবে প্রথমে ব্যক্তির অভ্যুদয়, পরবর্তীতে রাষ্ট্রের সাথে নাগরিকের সহাবস্থান, পারস্পরিক সম্পর্ক এবং সমাজ জীবনে ধর্ম-নির্লিপ্ততার (secularism) যে পরিসর তৈরি হয়েছে তা ভারতে হয়নি। যেভাবে শ্রমিক তথা মার্ক্সের ধারণানুযায়ী সর্বহারা শ্রেণীর এবং পুঁজির সাথে শ্রমের টানাপোড়েন থেকেছে বিভিন্ন স্তরে, যেভাবে দেশগত ভিন্নতা থাকা সত্বেও বিভিন্ন সামাজিক ও শ্রেণী সম্পর্কের মানুষের একটি পাব্লিক ডিসকোর্সের পরিসর তৈরি হয়েছে, যেভাবে চার্চ এবং রাষ্ট্র পৃথক হয়েছে, যেভাবে সমাজ জীবন থেকে অপসৃত হয়ে ধর্মানুগত্য ব্যক্তিগত রুচি এবং পরিসরের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ঐতিহাসিকভাবে সেসব পরিবর্তনের পর্যায়গুলি এখানে হয়নি। বিভিন্ন সামন্ত রাজ্যে বিভক্ত ভারত নামের ভৌগলিক ভূখন্ডে সামন্ত রাজা, উদীয়মান বৃহৎ শিল্পপতি শ্রেণী, ব্যবসায়ী, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ এবং ওকালতি ও ডাক্তারির মতো বিভিন্ন স্বাধীন পেশার ব্যক্তিদের উপনিবেশের বিরুদ্ধে ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থে রাজনৈতিক এবং সামরিক সংগ্রামের বিভিন্ন সফলতা ও ব্যর্থতার চিহ্ন বহন করেছে ১৯৪৭ পরবর্তী স্বাধীন ভারতবর্ষ।
এধরনের বিভিন্ন সময়-চিহ্নের স্থায়ী ছাপ নিয়ে যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং একক ব্যক্তির একক ভোটাধিকার চালু হলো সেগুলো মূলত সমাজের উপরের স্তরের ক্ষমতা চিহ্ন। এরকম এক ঐতিহাসিকতায় প্রধানত কৃষিসম্পর্কে আবদ্ধ শতকরা ৮০ ভাগ মানুষকে নিয়ে গড়ে ওঠা নতুন ভারতীয় জাতি-রাষ্ট্রে মডার্নিটি বা আধুনিকতা প্রকৃত অর্থে engrafted হয়ে যায়, ঐতিহাসিকভাবে সামাজিক পরিবর্তন ও গতিশীলতার (social and historical dynamics) নিয়মে জন্ম নেয় না। রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যক্তি-সমাজ-কৌম-রাষ্ট্র-নাগরিকতার যে সম্পর্ক নতুন করে রচিত হয় ১৯৪৭ পরবর্তী ভারতবর্ষে তা প্রায় সম্পূর্ণত ব্রিটিশ রাজনৈতিক সংবিধানের ধারায় তৈরি হওয়া।
প্রধানত শিল্প বিপ্লবোত্তর ইউরোপে সমাজ এবং কৌমের ধারণা খসে গেছে প্রায় ২০০ বছর জুড়ে। নাগরিক ও রাষ্ট্রের মাঝে সরাসরি সম্পর্ক – অধিকার এবং কর্তব্যের বাঁধনে, cash nexus-এর প্রবল উপস্থিতিতে। এখানে মধ্যস্থতাকারী কোন সামাজিক পরিসর নেই, যা আছে তা নাগরিক পরিসর বা সিভিল স্পেস। ডেমোক্রেসির স্বর্ণযুগে কিংবা সামাজিক পরিসরের সবল, জোরালো উপস্থিতির সময় আধুনিকতা নির্মিত নাগরিকতার ভাষ্য ছাড়াও আরও অনেক স্বর, কণ্ঠ, আত্মপ্রকাশ করে – অশ্রুত তথা indiscernible থেকে শ্রুত তথা discernible হয়ে ওঠে, অদৃশ্য তথা invisibility থেকে দৃশ্যমানতা বা visibility-র স্তরে উঠে আসে। বিখ্যাত উদাহরণ হিসেবে ১৯৬০-৭০-এর দশকের প্যারিসের ছাত্র বিদ্রোহ বা আমেরিকায় ভিয়েতনাম বিরোধী আন্দোলনের কথা কিংবা সাম্প্রতিক কালের “Another World is Possible” বা “Occupy Wall Street” বা একেবারে হালের #Black Lives Matter আন্দোলনের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। এরকম একটা পরিসরে নাগরিক হবার ধারণার সাথে নাগরিক না-হবার কিংবা অ-নাগরিকের ধারণাও সামাজিকভাবে মান্যতা, গ্রাহ্যতা পায়। বহু ভাষ্যের নির্মাণ হতে থাকে।
কিন্তু সমগ্র রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াটাই যদি ভিন্নধর্মী হয়? যদি জাতি-রাষ্ট্র তৈরিই হয় প্রভুত্বকারী সামন্ত রাজা ও এর উপযোগী পরিব্যাপ্ত মানসিকতা, কৃষি শ্রম, শিল্পীয় শ্রম, শিক্ষিত জায়মান নাগরিক সমাজ, বৃহৎ পুঁজি এবং জাতীয়তাবাদের উত্তুঙ্গ পর্বে গড়ে ওঠা ছোট বা স্বাধীন পুঁজির মধ্যেকার অসংখ্য বাস্তব দ্বন্দ্বকে অমীমাংসিত রেখে? যদি গড়ে ওঠে জাতিস্বত্তার প্রশ্নকে সমাধানের আওতায় না এনে? Integer বা পূর্ণসংখ্যা না হয়ে, কোন ত্রৈরাশিক বা ভগ্নাংশ কিংবা অ-নাগরিক হয়ে কেউ থাকতে পারেনা। আধুনিকতার একটি এবং একমাত্র ভাষ্যেই এদের শিক্ষিত করে তুলতে হবে। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রবণতাটি সবসময়েই কেন্দ্রাভিমুখী। প্রান্ত এখানে প্রান্তিক, কখনো ব্রাত্যও বটে। অসংখ্য দ্বন্দ্ব অমীমাংসিত রেখে জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে ভারত গড়ে ওঠার এক অসামান্য চলমান চরিত্র (দলিলও বলা যেতে পারে) সতীনাথ ভাদুড়ীর সৃষ্টি ঢোঁড়াই। এরকম দলেই পড়বে আমার মতো সুশীল, সুবোধ, গোপাল-বালক গোছের মানুষজন।
ইউরোপীয় আধুনিকতার ভাষ্য, যা আমাদের দেশে ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে অনুসৃত হচ্ছিল, তার উপাদানের মাঝে (matrix) নিহিত যুক্তি অনুসরণ করে আমরা বুঝতে পারলাম আমাদের মতো নাগরিকদের ধরা হবে একেকটি integer বা পূর্ণ সংখ্যা হিসেবে। এখানে ভগ্নাংশের কোন জায়গা নেই। উদো-বুধোর ত্রৈরাশিক না ভগ্নাংশ, এসব ভাবার কোন অবকাশই নেই। মণিপুরী বা কাশ্মিরী বলে আবার আলাদা কিছু হয় নাকি? এগুলো তো ভগ্নাংশ। পূর্ণসংখ্যা ভারতীয় নয়।
এরকম এক social psyche তৈরির অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হল ভাষা, শিক্ষাক্রম এবং disciplinary time তথা শৃঙ্খলাবদ্ধ সময়। এরকম এক সোশ্যাল সাইকিতে মিশে থাকে ইংরেজিতে যাকে বলে numbing of collective consciousness বা বিবশ হয়ে যাওয়া সম্মিলিত সংবেদনশীলতা এবং historical and social amnesia বা ঐতিহাসিক আর সামাজিক বিস্মরণ। খুব অল্প সময়ের মধ্যে ধীরে ধীরে নির্মাণ করা হয়েছে এসমস্ত উপাদান। জারিত হয়েছে সমাজের স্তরে স্তরে। যারা এই বিস্মরণের শিকার নয় তাদের জন্য আছে অন্য দাওয়াই।
ঘৃণাকে সামাজিক কাঠামোর মধ্যে প্রবেশ করানো হলেও এই বিবশ হয়ে যাওয়া সম্মিলিত সংবেদনশীলতা নিয়ে সুশীল, সুবোধ, গোপাল-বালক গোছের মানুষজন কিচ্ছুটি হয়তো বলবেনা। স্মরণে আনুন ক’দিন আগেকার টাটার একটি কোম্পানি তানিশ্ক-এর কথা। একটি ৪৩ সেকেন্ডের ভিডিওতে দেখানো হয়েছিল একটি মুসলিম ধর্মাবলম্বী পরিবারে হিন্দু মেয়ের বিয়ে এবং এতে পরিবারটি তানিশ্কের গয়না ব্যবহার করছে। একে “লাভ জিহাদ” আখ্যা দিয়ে তোলপাড় হল দেশের একাংশ, তানিশ্কের শো রুমে ভাঙ্গচুর চালানো হল। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় খবর হল। নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর মতো প্রভাবশালী সংবাদপত্রে একটি খবরের (১৩.১০.২০২০) শিরোনাম হল – “Jewelry Ad Featuring Interfaith Couple Sparks Outrage in India”। এই প্রতিবেদনে বলা হল – “The jeweler withdrew its forty-three second advertisement after Hindu nationalists accused the company of promoting “love jihad” on social media... “The beauty of oneness. One as humanity. One as a nation.” But on social media, the ad quickly created fault lines, and #BoycottTanishq soon topped Twitter trends. “Why are you showing a Hindu ‘daughter-in-law’ to a Muslim family and glorifying it,” Khemchand Sharma, a member of the country’s governing Hindu nationalist Bharatiya Janata Party, asked on Twitter. Mr. Sharma accused the company of love jihad, and of favoring one faith over another. “Why don’t you show a Muslim daughter-in-law in your ads with a Hindu family?” (নজরটান আমার)
আরেকটি প্রথমসারির আন্তর্জাতিক দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্ট খবর করলো (১৪.১০.২০২০) – “An Indian jewelry brand made a touching ad about an interfaith marriage. Outrage ensued.” সে খবরে বলা হল – “The ad was meant to portray interfaith harmony: a Muslim household preparing a Hindu-style baby shower for their Hindu daughter-in-law. The tagline read, "A beautiful confluence of two different religions, traditions, cultures," in a tribute to India's reputation as a multiethnic home to more than 1 billion people of all faiths.” আরও বলা হল – “Kothapalli Geetha, a former BJP legislator, called the ad “highly objectionable” for “normalizing love jihad.” Love jihad is a conspiracy theory espoused by right-wing Hindu activists that Muslim men are engaged in a deliberate effort to convert Hindu women through marriage.”
জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে আলোচনার সময় রাষ্ট্র, নাগরিক এবং তৃতীয় পরিসরের পারস্পরিক সম্পর্কের এই বিষয়গুলোও আমরা মাথায় রাখবো। এই বোধ ব্যতিরেকে বর্তমানের অভূতপূর্ব অনিশ্চিত সময়ে তাড়াহুড়ো করে পাস করিয়ে নেওয়া জাতীয় শিক্ষানীতিকে এবং এর অন্তর্বস্তুকে বোঝা অসম্পূর্ণ থাকবে, বা হয়তো পুরোপুরি বোঝাই যাবেনা।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০
শুরুতে “জাতীয় শিক্ষানীতির”-র মূল বিষয়গুলোকে আমার ভাবনা অনুযায়ী পরপর সাজিয়ে নিই। একেবারে গোড়ার দিকে বলা হয়েছে – “The rich heritage of ancient and eternal Indian knowledge and thought has been a guiding light for this Policy. The pursuit of knowledge (Jnan), wisdom (Pragyaa), and truth (Satya) was always considered in Indian thought and philosophy as the highest human goal. The aim of education in ancient India was not just the acquisition of knowledge as preparation for life in this world, or life beyond schooling, but for the complete realization and liberation of the self.”
লক্ষ্যণীয়, প্রাচীন ভারতের পরেই বর্তমান ভারতে চলে আসা হয়েছে। মাঝখানে মধ্যযুগ বলে একটি আলাদা ঐতিহাসিক অংশ যে ইতিহাস জুড়ে আছে সেটার অস্তিত্বই অস্বীকার করা হল। আর প্রাচীন যুগ তো একমাত্রিক কবি-কল্পনায় রাঙ্গানো কোন সময়কাল নয়। বহু স্তরে স্তরায়িত এই প্রাচীন যুগ। যেভাবে উল্লেখ করা হয়েছে তাতে এর শুরুই বা কোথায় শেষই বা কোথায় তার কোন হদিশ পাওয়া যায়না। এক বায়বীয়, অনৈতিহাসিক সময়কাল শুরুতেই বিধৃত হল ইতিহাস হিসেবে। “The pursuit of knowledge (Jnan), wisdom (Pragyaa), and truth (Satya) was always considered in Indian thought and philosophy as the highest human goal” – এরকম এককথায় সেরে ফেলা প্রাচীন ভারতের গরিমা আমাদেরকে ধন্দে ফেলে দেয়। সত্যিই “প্রাচীন” ভারতের ইতিহাস এত পেলব, নিষ্কলুষ এবং সুকুমার ছিল? আমাদের ইতিহাসের পাঠতো সেরকম কোন ইঙ্গিত দেয়না!
আরেক জায়গায় বলা হল – ““Knowledge of India” will include knowledge from ancient India and its contributions to modern India and its successes and challenges, and a clear sense of India’s future aspirations with regard to education, health, environment, etc.” (NEP, 4.28) ওপরে যা বললাম তারই যেন হুবহু প্রতিধ্বনি। প্রসঙ্গত, শেল্ডন পোলোকের নেতৃত্বে সুবিশাল Sanskrit Knowledge Systems (খেয়াল রাখুন, বহুবচনে) on the Eve of Colonialism Project-এর সুবিপুল গবেষণার ভাণ্ডার অনুসন্ধান করতে পারেন আগ্রহী পাঠকেরা। এই প্রোজেক্টের একটি গবেষণাপত্রে বলা হচ্ছে – “The remarkable lack of a historical-referential dimension in Sanskrit literature and the absence of a strong historical awareness in South Asian culture have struck observers from outside South Asia, from the eleventh century Muslim author Al-Biruni onwards, and especially the indologists of the 19th and 20th century.” (Jan E.M. Houben, “The Brahmin Intellectual: History, Ritual and “Time Out of Time”, Journal of Indian Philosophy 30: 463–479, 2002)
ডিজিটাল বিভাজনের সাথে “মেরিট” যখন যুক্ত হচ্ছে শিক্ষা এবং মূল্যায়নের কাজে তখন প্রথম সারিতে থাকবে মুষ্টিমেয় কিছু সামাজিকভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত শিক্ষিত এবং এর বাইরে থাকবে বিপুল ছাত্রসমষ্টি যাদের কাছে একমাত্র টেকনিক্যাল সাপোর্ট দেওয়া ছাড়া অতিরিক্ত কোন যোগ্যতা নেই। ঘুরপথে কর্পোরেট দুনিয়ার জন্য কম মুল্যের শ্রম পাওয়া যাবে এবং এই শ্রমের সরবরাহকারী হবে নতুন শিক্ষানীতি। সর্বোপরি, এ প্রক্রিয়া চলবে বছরের পর বছর ধরে। এদের অভিধা হবে শিক্ষিত কিন্তু কার্যত কর্মহীন।
Foundational Stage (৩ বছর অঙ্গনওয়ারি বা প্রি-প্রাইমারি স্কুলে প্রথম থেকে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত বিস্তৃত)। সব মিলিয়ে ৩ বছর থেকে ৮ বছর বয়স পর্যন্ত চলবে নতুন শিক্ষাব্যবস্থার প্রথম ধাপ।
Preparatory Stage – তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত, বয়স ৮-১১ বছর।
Middle Stage – ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত, বয়স ১১-১৪ বচর।
Secondary stage – নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত, বয়স ১৪-১৮ বছর।
First, Second, and Third languages by number of speakers in India (2011 Census) | ||||||
First language speakers | Second language speakers | Third language speakers[11] | Total speakers | |||
Language | Figure | % of total population | Figure | % of total population | ||
528,347,193 | 43.63% | 139,207,180 | 24,160,696 | 691,347,193 | 57.09% | |
259,678 | 0.02% | 83,125,221 | 45,993,066 | 129,259,678 | 10.67% | |
97,237,669 | 8.03% | 9,037,222 | 1,008,088 | 107,237,669 | 8.85% | |
83,026,680 | 6.86% | 12,923,626 | 2,966,019 | 99,026,680 | 8.18% | |
81,127,740 | 6.70% | 11,946,414 | 1,001,498 | 94,127,740 | 7.77% | |
69,026,881 | 5.70% | 6,992,253 | 956,335 | 77,026,881 | 6.36% | |
55,492,554 | 4.58% | 4,035,489 | 1,007,912 | 60,492,554 | 4.99% | |
50,772,631 | 4.19% | 11,055,287 | 1,096,428 | 62,772,631 | 5.18% | |
43,706,512 | 3.61% | 14,076,355 | 993,989 | 58,706,512 | 4.84% | |
37,521,324 | 3.10% | 4,972,151 | 31,525 | 42,551,324 | 3.51% | |
34,838,819 | 2.88% | 499,188 | 195,885 | 35,538,819 | 2.93% | |
33,124,726 | 2.74% | 2,300,000 | 720,000 | 36,074,726 | 2.97% | |
24,821 | 0.002% | 1,234,931 | 1,196,223 | 2,360,821 | 0.19% |
এ তালিকা থেকে দেখা যাচ্ছে উর্দু রয়েছে (ইংরেজি এবং হিন্দি বাদ দিলে) ৬ নম্বরে – ওড়িয়া, কন্নড় এবং মালয়ালমের ওপরে। ৫.১৮% ভারতীয় এ ভাষায় কথা বলে। কিন্তু উর্দু বাদ পড়েছে ই-কোর্স-এর তালিকা থেকে। কারণ কি খুব অস্পষ্ট? অথচ শিক্ষানীতির বিভিন্ন জায়গায় মাঝেমাঝে মন্ত্রপূত জল ছেটানোর মতো করে “pluralism” বা বহুত্ববাদ বা ধর্মীয় বহুত্বের কথা এসেছে। আমরা বিশ্বাস করি, বহুত্ববাদ একটি রাষ্ট্রিক এবং জীবন দর্শনের প্রশ্ন। সাজিয়ে-গুছিয়ে দেখানোর মতো কোন কসমেটিক সামগ্রী নয়।
এবং এ তালিকা থেকে এটাও বোঝা যায় শিক্ষানীতিতে বিশেষ গুরুত্ব পাওয়া একটি ভাষা সংস্কৃততে কথা বলে ১৩২ কোটি জনসংখ্যার দেশে ২৪,৮২১ জন বা ০.১৯% মানুষ।
Total Public Investment in Education
Country | Investment in 2017 (as % of GDP) |
India | 2.7 |
USA | 5 |
UK | 5.5 |
Brazil | 6 |
“The world is undergoing rapid changes in the knowledge landscape”। “This National Education Policy 2020 is the first education policy of the 21st century and aims to address the many growing developmental imperatives of our country. This Policy proposes the revision and revamping of all aspects of the education structure, including its regulation and governance, to create a new system that is aligned with the aspirational goals of 21st century education, including SDG4 (Sustainable Development Goal 4), while building upon India’s traditions and value systems.” (নজরটান আমার)
● প্রাচীন ভারতের ভাণ্ডারে কি রয়েছে? “The aim of education in ancient India was not just the acquisition of knowledge as preparation for life in this world, or life beyond schooling, but for the complete realization and liberation of the self.” (নজরটান আমার) শিক্ষার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে ফেলা liberation of the self বা আত্মার মুক্তির এরকম প্রসঙ্গ ভারতের একটি-দুটি দার্শনিক ধারার মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল, সার্বজনীন ছিলনা। বেদান্তবাদীদের মধ্যে এ ধারণা থাকলেও প্রাধান্যকারী অন্যান্য দার্শনিক ধারার মধ্যে এরকম কোন ধারণা ছিলনা। ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ন্যায়, বৈশেষিক, সাংখ্য বা লোকায়ত দর্শনের মধ্যে এরকম কোন ধারণা শিক্ষার বনিয়াদ তৈরি করেনি। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি প্রতিনিধিস্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ পাঠকেরা অবশ্যই দেখে নিতে পারেন – (১) পাঁচ খণ্ডের সুবিশাল, অসীম গুরুত্বসম্পন্ন এস এন দাশগুপ্তের লেখা History of Indian Philosophy, (২) দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের Lokayata: A Study in Ancient Indian Materialism এবং Science and Society in Ancient India, (৩) বিমলকৃষ্ণ মতিলালের Logic, Language and Reality এবং (৪) প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের A History of Hindu Chemistry from the Earliest Times to the Middle of the Sixteenth Century, A.D. (দু খণ্ডে)। বিবেকানন্দের মতো অসীম ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং গণমানসিকতায় প্রভাবশালী ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের প্রভাবে বেদান্তবাদী দর্শন উপনিবেশকালে ভারতীয় হিন্দু চিন্তার (বিশেষত উচ্চকোটির হিন্দুদের ক্ষেত্রে) প্রায় একমাত্র গ্রাহ্য দর্শন হয়ে ওঠে। সমাজের অন্যান্য অংশের নিজস্ব দার্শনিক চিন্তাভাবনা একেবারেই হারিয়ে যায় বলা যায়। নতুন শিক্ষানীতির ওপরের বক্তব্যের সাথে সঙ্গতি রেখে পড়তে হবে শিক্ষানীতির এ অংশটুকুকে – “As consequences of such basic ethical reasoning, traditional Indian values and all basic human and Constitutional values (such as seva, ahimsa, swachchhata, satya, nishkam karma, shanti, sacrifice, tolerance, diversity, pluralism, righteous conduct, gender sensitivity, respect for elders, respect for all people and their inherent capabilities regardless of background, respect for environment, helpfulness, courtesy, patience, forgiveness, empathy, compassion, patriotism, democratic outlook, integrity, responsibility, justice, liberty, equality, and fraternity) will be developed in all students.” (নজরটান আমার) নিষ্কাম কর্মের মতো শব্দবন্ধের কথা ভারতীয় সংবিধানে রয়েছে? রয়েছে বেদান্তবাদী দর্শনে। এর সামাজিক অভিঘাত যেকোন শিক্ষিত চিন্তাশীল মানুষই বুঝতে পারবেন।
এরকম অবস্থান থেকে একুশ শতকের ভারতীয় শিক্ষা কাঠামোর আমূল বদলে ফেলা জাতীয় শিক্ষানীতিতে অন্তর্নিবিষ্ট liberation of the self-এর ধারণাকে বুঝতে পারলে মঙ্গল।
একই অবস্থান থেকে বলা হয় – “World-class institutions of ancient India such as Takshashila, Nalanda,Vikramshila, Vallabhi, set the highest standards of multidisciplinary teaching and research and hosted scholars and students from across backgrounds and countries. The Indian education system produced great scholars such as Charaka, Susruta, Aryabhata, Varahamihira, Bhaskaracharya, Brahmagupta, Chanakya, Chakrapani Datta, Madhava, Panini, Patanjali, Nagarjuna, Gautama, Pingala, Sankardev, Maitreyi, Gargi and Thiruvalluvar, among numerous others, who made seminal contributions to world knowledge in diverse fields such as mathematics, astronomy, metallurgy, medical science and surgery, civil engineering, architecture, shipbuilding and navigation, yoga, fine arts, chess, and more. Indian culture and philosophy have had a strong influence on the world. These rich legacies to world heritage must not only be nurtured and preserved for posterity but also researched, enhanced, and put to new uses through our education system.”
এক নিঃশ্বাসে সময়ের ব্যবধান মুছে, জ্ঞানের বিশেষ ক্ষেত্র এবং নির্দিষ্ট উদ্ভাবনের প্রসঙ্গ একজায়গায় এনে দলা পাকানো হল। রাষ্ট্রের নির্মিত সেই কাল্পনিক, নালকের মতো অপাপবিদ্ধ প্রাচীন ভারতকে কাজে লাগানো হবে একুশ শতকের ভারতীয় শিক্ষাবিধিতে। প্রসঙ্গত, উদাহরণ হিসেবে জোর দিয়ে বলা দরকার যে প্রাচীন ভারতের যুগে ফেলা হলেও চিকিৎসক মাধব বা মাধবকর নবম শতাব্দীর মানুষ (দ্রষ্টব্য – Meulenbeld, The Madhavanidana)।
তারপর?
শেষ কথা
নিওলিবারাল অর্থনীতির নতুন একটি ধরন হল Philathropocapitalism। আজকের দুনিয়ায় বিল গেটস জুকেরবার্গদের উত্থানের পরে এ নিয়ে বিস্তর চর্চা হচ্ছে। বই এবং গবেষণাপত্র প্রকাশিত হচ্ছে। ফলে এটা নিরীহ ও মানবপ্রেমে আকুল কোন ব্যাপার নয়। পরে বলা হচ্ছে – “Private philanthropic efforts for quality education will be encouraged - thereby affirming the public-good nature of education - while protecting parents and communities from arbitrary increases in tuition fees.” (NEP, 8.7)
ফলে শিক্ষার জগতে এক নয়া উপনিবেশবাদ আসতে চলেছে এতদূর বলাও হয়তো বাড়াবাড়ি হবেনা।
Is there an Indian way of thinking?
Is there an Indian way of thinking?
Is there an Indian way of thinking?
Is there an Indian way of thinking?
প্রতিটি ক্ষেত্রে জোর কোথায় পড়ছে তার ওপরে নির্ভর করছে কি উত্তর পাওয়া যাবে। তিনি দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর কি হতে পারে তার ব্যাখ্যায় বলেছিলেন – “There is no single Indian way of thinking ... Each language, caste and region has its special world view ... Vedists see a vedic model of in all Indian thought.” আমাদের যাত্রা শুরু হচ্ছে যেন কেবলমাত্র একটি ভারতীয় চিন্তাপদ্ধতির দিকে। ভারতের অসমস্তত্ব (heterogeneous and heterodox) বহুধা-বিস্তৃত চরিত্র রূপান্তরিত হবে হয়তো একটি সমসত্ত্ব (homogeneous and orthodox) ও একমাত্রিক চিন্তাপদ্ধতির কৃৎ-কৌশলের দিকে।
দেবদত্ত পট্টনায়ক বাচ্চাদের জন্য Hanuman’s Ramayan বলে একটি চমৎকার মজাদার চটি বই লিখেছিলেন। এ গল্পে বাল্মিকী হনুমানের রামায়ণ পড়ে মনের দুঃখে নিজের লেখা রামায়ণ নষ্ট করে ফেলতে চেয়েছিলেন। হনুমান তাঁকে বিরত করে। সবার শেষে লেখক শিশুদের বলছেন – “So there are amny Ramayans, each one wonderful. Finally, what matters is the story, not the teller.” আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতির মধ্য দিয়ে যে সন্তান-সন্ততিরা বড়ো হয়ে উঠবে তারা অনেকগুলো রামায়ণের পাঠ শিখবে তো? না কি রাষ্ট্র এবং শিক্ষানীতি নির্ধারিত একটি রামায়ণেরই এবং টেক্সটের পাঠ শিখবে? শিক্ষানীতিতে একাধিকবার critical thinking-এর কথা বলা রয়েছে কিন্তু।
লেখার শুরুতে তানিশকের বিজ্ঞাপনের ওপরে যে দক্ষিণপন্থী আক্রমণের কথা বলেছিলাম সেখানে এই critically-thinking, inquiry-driven সন্তানেরা রুখে দাঁড়াবে তো? কর্পোরেট পুঁজি নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র সে কথা ও কাজের পরিসর দেবে তো? কিংবা পরিসর তৈরি করে নিতে হবে? ভবিষ্যতের হাতে তোলা রইলো উত্তর।
এই শিক্ষা নীতির মধ্যে অনেক কিছু আছে কিন্ত শিক্ষা টা বাদ পড়ে গেছে। আসলে অল্প শিক্ষিত শ্রমিক তৈরির ব্যাবস্থা যাদের কম দামে কিনতে পারা যাবে। খুব ভালো হয়েছে লেখাটা
সমৃদ্ধ হলাম অনেক।
অসাধারণ উচ্চ মানের লেখা ও তাঁর বিশ্লেষণ করেছেন লেখা টির মধ্যে। অনেক সমৃদ্ধি হলাম।
Good one sir
অসাধারণ বিশ্লেষন। উঁচু মানের লেখা। সমৃদ্ধ হলাম।
খুব সুন্দর বিশ্লেষণ।
অত্যন্ত গভীর চিন্তার ফসল এই লেখা। শিক্ষানীতি নিয়ে এত সুন্দর বিশ্লেষণ আগে পড়ি নি।
প্রাচীন ভারতের ঋষি তৈরির কারখানা হবে বিদ্যাল়গুলোতে। আর এন্ড প্রোডাক্ট তৈরি হবে ঋষি কাপুর।
শিক্ষার নামে অশিক্ষা/কুশিক্ষা চালু করে শিক্ষাইয় কর্পোরেট-দের হাতে তুলে দেওয়া এবনহ তার সঙ্গে সঙ্গে অল্প শিক্ষিত এবং বাধ্য শ্রমিক তৈরি করা এবং আরো অনেক সমস্যা সৃষ্টি করার সরকারি/রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টাটি সুন্দঅর এবনহ স্পষ্ট ভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য লেখককে ধন্যবাদ।
খুব সুন্দর লেখা স্যার
দারুণ, মননশীল লেখা। এই সিস্টেমে আধা খিচূড়ি জানা ছেলে বেরোবে। কাজের কাজ কতটুকু হবে সে কে জানে! কিন্তু বিল যে পাশ হয়ে গেলেও ইম্পলিমেন্ট আটকাতে পরবর্তী ভোটের অপেক্ষা করতে হবে।
প্রাসঙ্গিক লেখা, সমৃদ্ধ হলাম। বিশ্বের তথা দেশের অতিমারীর সময়ে সিদ্ধান্ত। আলোচনা হওয়া দরকার ছিল।
লেখাটা অসাধারণ । সমৃদ্ধ হলাম ।
অসাধারণ বিশ্লেষন, সমৃদ্ধ হলাম