সাইকেল থেকে নেমে রূপা সোজা হয়ে দাঁড়াল। অনেকক্ষণ পিছনের কেরিয়ারে বসেছিল। কোমর টনটন করছে। নীচের দিকে থাই ছাড়িয়ে দু পা অবশ হয়ে এসেছে। মানিকের এক পা তখন মাটি ছুঁয়ে। ঘাড় পিছন দিকে একটু ঘোরানো। টানটান হয়ে দাঁড়াতে মানিক দেখল রূপাকে। বলল, ‘টিপ পরোনি একটা?’
রূপা কপালে হাত দিল। তারপর ঠোঁট উলটাল। মানিক বলল, ‘কপালটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা।’
মানিকের এই কথাটা রূপার ভালো লাগল। সে টিপ পরেনি, এটাও মানিক দেখছে। মানুষেরা বলে বউ পুরনো হলে বর আর ফিরেও তাকায় না। তাদের সাত বছর বিয়ে হয়েছে। পাঁচ বছরের মেয়ে। তাহলে রূপা অতটা পুরনো বউ হয়নি, কেননা এখনও তার বর তাকে এমন করে নজর রাখে, লক্ষ্য করে। কপালের টিপটাও।
মানিক বলল, ‘তোমার কাছে কুড়িটা টাকা হবে?’
‘কেন কী করবে?’
‘কাল সাইকেলটা লিক হয়ে গেছিল, লিক সারিয়ে ছিলাম, টাকা দিইনি, বলেছিলাম, কাল দেব। আজ নির্ঘাত চাইবে। আমার পকেটে দশ টাকা পড়ে আছে।’
রূপা হাত দিল বুকে। বুকের ভেতর থেকে খুব ছোট্ট একটা ব্যাগ বের করল। সেখান থেকে কুড়িটা টাকা নিয়ে মানিককে দিল। বলল, ‘আর পঞ্চাশটা টাকা আছে।’
মানিক কথাটা যেন শুনল না। বরং সে যেন লোভাতুর দৃষ্টিতে তার বউয়ের বুকের দিকে তাকিয়ে থাকল। পুরুষমানুষের এই চোখ রূপা চেনে। কিন্তু সে তো ঘরের বউ—হাত বাড়ালেই— তবে এমন করে দেখে কেন!
রূপা দেখল, মানিকের সারা মুখ ঘামে জবজব করছে। এতটা রাস্তা সাইকেল টেনে আনা মুখের কথা না। কত মাইল পথ হবে কেন জানে। মোটরবাইক বাইরে হলে মাপা যায়। সাইকেলে বোঝা যায় না। মানিকের আগে একটা মোপেড ছিল। রূপা তাতে বসে কোথায় না কোথায় গেছে। একবার তো ডায়মন্ডহারবার যাবে বলে বেরিয়ে কী মতি গেল বাবা বড় কাছারি ঘুরে এল। পরে বুঝেছিল—বাবা টেনেছে। না হলে কোথায় ডায়মন্ডহারবার আর কোথায় বড়কাছারি!
মানিক তখন মার্বেল পালিসের কাজ করত। তিনশো টাকা রোজ। সে বড় সুখের সময়। রূপাও ঘর ছেড়ে বের হয়নি বাইরের কাজে। নিত্য কাজ ছিল। না গেলেই ছুটি। মানিকের ঠিকাদার মল্লিক বড় বড় প্রোমোটারের কাজ করত। কাজের অভাব নেই। কিন্তু সুখ বেশিদিন সইল না। মানিকের সঙ্গে ঠিকাদারের গোলমাল হল। গোলমালটা এমন ঠিকাদার মল্লিক বাড়ি বয়ে এসে মানিকের কলার ধরে চড় চাপড়া মেরে গেল। ফালতু বদনামও দিয়ে গেল। মানিক নাকি সাইট থেকে দু দুটো টুলু পাম্প চুরি করে বিক্রি করে দিয়েছে। প্রথমবারে ধরা পড়েনি, দ্বিতীয়বারে জানাজানি হয়ে গেছে।
এইসব গোলমালের মধ্যে রূপা ঠিকাদারকে বলেছিল— দাদা ও চুরি করলে, টাকা তো সংসারে আসবে। বাড়তি একটা টাকাও তো সংসারে আসেনি গো দাদা।
ঠিকাদার রূপার কথা শুনে হে হে করে হাসল। তারপর, মানিকের থুতনি ধরে নেড়ে দিয়ে বলল, ‘এই মানকে তোর বউকে বলব— কোন আনারকলির ফুটোতে টাকা গুঁজেছিস!’
ঠিকাদারের পাশ থেকে একজন বলল, ‘মানকেদার তো এট্টা বউদি আছে গো, প্যারিস মিস্ত্রি। মানকেদা রোজ সন্ধেবেলা তার সঙ্গে মাদুর পাতে।’
মানিক বিড়বিড় করল, ওটা প্রতিবাদ।
ওদের কথা রূপা বিশ্বাস করেনি। যেমন বিশ্বাস করেনি চুরির কথা। ওরা চলে যেতে মানিক বলেছিল, ‘আমি প্রোমোটার বাবু সাহাকে বলেছিলাম, আমাকে কন্ট্রাক্ট দাও। আমি মার্বেল মোজাইকের ঠিকেদারি করব। একটা বিল্ডিং চেয়েছিলাম। একটার কাজ পেলে, আমি ঠিকেদারি লাইনে চলে আসতাম। শালারা আমাকে চোর বদনাম দিল। ঠিক আছে, আমিও মানিক দাস। ছাড়ব না, ঠিকেদারি করে দেখিয়ে দেব।’
রূপা বলল, ‘সর্বনাশ— ঠিকেদারি! সে তো অনেক টাকার মামলা গো।’
‘অনেক টাকা তো কী হয়েছে, সব প্ল্যান করে রেখেছিলাম। তোমার হার আর কানেরটা নিতাম। আর বউদিকেও বলে রেখেছিলাম, যদি হাজার কুড়ি ত্রিশ ধার দেয়। আমি সুদ দেব।’
‘বউদি অত টাকা পাবে কোথায়—।’
‘বউদি আর পাবে কোথায়!’ মানিক হাসে, ‘বউদির অনেক কাজের বাড়ির বাবু ধরা আছে। তাদের কাছ থেকে পাঁচ দশ করে কালেক্ট করবে। মাসে মাসে আমি দিলে তাদের শোধ করে দেবে। আর সুদটা বউদির পকেটে ঢুকবে। প্ল্যান আমার ছকা ছিল। ওই হারামির বাচ্চা বাবু সাহা সব লাগিয়ে দিল মল্লিক ঠিকেদারকে। নইলে আমার সব প্ল্যান পাক্কা।’ মানিক আবারও হাসল। ‘আমাকে চুরির বদনাম দিয়ে বাড়ি চলে এল—থানায় গেল না। চুরির মাল খুঁজল না। শুধু হল্লা, নে সাহস থাকে আমাকে পুলিসে দে। দু দুটো টুলু পাম্প, আচ্ছা আমিও ছাড়ব না। ওরা ভয় পেয়ে গেছে রূপা বুঝেছ—আমি যদি ঠিকেদারি লাইনে নামি ওরা আমার সঙ্গে পারবে না।’
রূপার মনে হল, মানিক ঠিক কথাই বলেছে, সত্যি সত্যি চুরি হলে ওরা থানা পুলিশ করত না—ছেড়ে দিত? কেউ ছেড়ে দেয়? বাড়ি এসে দুটো চড় থাপড়া, টানা হেঁচড়া করে চলে যেত না। টাকা আদায় করত? আর রূপা ঠান্ডা মাথায় ভেবেছে, মানিক চুরি করবে না। আর চুরি করলেও মানিককে ধরার ক্ষমতা ওদের নেই। মানিক সবকিছুই খুব প্ল্যান করে করে। রূপা যখন মানিকের সঙ্গে সারাদিনের জন্য ঘুরতে যেত প্ল্যান করে দিত মানিক। রূপার দাদা বউদি একটা দিনের জন্য সন্দেহ করেনি, সে মানিকের সঙ্গে যাচ্ছে। বিয়ের সময়ও মানিক কোনও লোক খাওয়ায়নি। পরিষ্কার বলে দিয়েছিল— দেখো যদি আয়োজন করে বিয়ে করি, তোমার দাদার কিছু টাকা গচ্চা যাবে, আমারও যাবে। বরং তোমার দাদা যদি বিয়ের খরচটা তোমার হাতে তুলে দেয়—তাহলে একটা ঘর তুলি, ভালো করে থাকব। মন্দ বলেনি মানিক। রূপার দাদা রাজি হয়ে গিয়েছিল। বিয়ে হয়েছিল কালীঘাটে। যে টাকা ওর দাদা দিয়েছিল তার ডবল টাকা মানিক ধার করেছিল বিল্ডারের দোকান থেকে। তাতে দেড়খানা ঘর বারান্দা কোমর সমান তুলে ফেলেছিল। ভিত দিয়েছিল দোতলার। ত্রুটি রাখেনি। বিয়ের পর রূপা বলেছিল— তুমি বললে নতুন ঘরে আমাকে রাখবে, তাহলে সেই পুরনো বাড়িতে তুলছ কেন?
মানিক বলল, জায়গা তো এক, শুধু আমার বাড়িটা হয়নি। কিন্তু ওই বাড়িটা দাদার নয় বাবার। যদি বাড়ি ছেড়ে এখানে চলে আসি, দাদা জায়গা প্লাস বাড়ি পেল, আমি কী পেলাম? আমি দাদার থেকে বাড়ি বাবদ টাকা নিয়ে এই বাড়িতে আলাদা হয়ে আসব।
মানিক হেসেছিল, ‘দেখো তোমার সঙ্গে বউদির আজ নাহোক কাল অশান্তি লাগবেই। তখন আমি বলব, পাশের বাড়িটা হাফ করেছি, তুমি টাকা দাও কমপ্লিট করে আমি চলে যাব।’ মানিক বুঝিয়ে দিয়েছিল, ‘শোনো রূপা যা করবে আগে থেকে প্ল্যান করে নেব। ভালো মন্দ সব দিক বিবেচনা করে করবে। ভালোমানুষীর জায়গা সংসার নয়।’
মানিকের দাদা এক মস্ত বাবুর ড্রাইভারি করে। সকাল হলেই বেরিয়ে যায়। রাতে ফেরে। নিত্যদিন মদ খায়। তবে গোলমেলে লোক নয়। ভালো মানুষ, মনে হয়তো চাপা দুঃখ আছে, ছেলে নেই। দু মেয়ে। চুপচাপ এসে খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ে। বড়জোর একটু জোরে জোরে রফির গান শোনে। আর বউদির নেশা সোনা। কিন্তু সোনা কেনা তো মুখের কথা নয়। তবু মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করতে বউদি সোনা কিনছে। দু দিন ছাড়া ছাড়া এটা ওটা বানাচ্ছে। মানিক বলে, বউদি এই বাড়িতে সোনা রাখে না। কোন একটা ব্যাঙ্কে লকার বানিয়েছে। ব্যাঙ্কের কোন এক দাদাবাবু বউদিকে পালিশ করত, সেই করে দিয়েছে।
কথাটা শুনে রূপা খুব আপত্তি করেছিল। ‘বাজে কথা বলো না তো।’
‘বাজে কথা বলছি। বউদি বেছে বেছে সেই সব বাড়িতে কাজ নেয়, যে বাড়ির ব্যাটাছেলেদের নামে বদনাম আছে।’
‘তুমি এত কথা কী করে জানো?’
‘শোনো রূপা, আমি প্রোমোটারদের সঙ্গে ঘুরি, মিস্ত্রিদের সঙ্গে চলাফেরা করি, আমি জানব না তো কে জানবে?’
রূপা চুপ করে শুনত, সে সব কথা, মাঝে মাঝে মানিকের কথা ধরে মেলানোর চেষ্টাও করত। তার মেয়েমানুষের চোখে কিছু যেন গোলমালও লাগে। বউদি চেহারাটা সত্যি চমৎকার। এ পাড়ার বউঝিরা বলে— ওই গতরে এ পাড়ার কম ব্যাটাছেলে কপাল ঠুকে মরেছে! এখন দেখো, সকাল হলেই সেজেগুজে কাজে যাচ্ছে।
রূপা বোঝে মানিক ভুল কিছু বলে না। ওই বাড়ি ছেড়ে নতুন বাড়িতে আসতে মানিক ষাট হাজার টাকা নিয়েছিল দাদার কাছ থেকে। কোমর পর্যন্ত বাড়ি তুলল শ্বশুরবাড়ির টাকায়, তারপরের টুকু দাদার টাকায়। মানিক খুব শান্ত মাথায় প্ল্যান করতে পারে। প্রোমোটার সাহাবাবু না বলে দিলে মানিক হয়তো এতদিকে মার্বেল মিস্ত্রি থেকে ঠিকেদার হয়ে যেত। ওকে আটকাতেই বাড়িতে এসে মল্লিক তোড়ফোড় করে গেল। কিন্তু ওরা যে বলে গেল কোন প্যারিস মিস্ত্রি বউদি যাকে নিয়ে নাকি মানিক রোজ সন্ধেবেলা মাদুর পাতে!
রূপা চোখ বন্ধ করে চিন্তা করে, এটাও ভুল কথা। ওটাও বদনাম। যে পুরুষমানুষ রোজ সন্ধেবেলা পরস্ত্রীর বাগানে চাষ করে আসে সে কেন আবার রাত হলেই বউয়ের জমিতে হাল টানবে? না, না, বাজে কথা।
মানিকের প্ল্যান ভেস্তে দিতেই এত আকথা কুকথা!
কিন্তু এই আকথা কুকথার জেরে মানিক আর মার্বেল মিস্ত্রির কাজ পায় না, ঠায় ঘরে বসে। সংসার যেন ক্রমশ অচল হয়ে পড়ে। তখন মানিকের বউদিই পরামর্শ দেয়— আমি তোকে দুটো বাড়িতে রান্নার কাজ ধরিয়ে দিচ্ছি। দুই দুই চারহাজার টাকা তো পাবি। রূপা এসে মানিককে বলতে সে-ও রাজি হয়ে যায়। গত আড়াই বছর ধরে রূপা সেই কাজই করে যাচ্ছে। এখন তিনটে বাড়ির রান্নার কাজ করে।
তবে মানিক রূপার এই কাজের বাড়িগুলো নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। ওর মনে হয়, ওরা সবাই রূপাকে বেশি বেশি খাটিয়ে নেয়। ন্যায্য পাওনা দেয় না। রূপা বলে— তা কেন মাইনে বোনাস কোনওদিনই তো অন্যথা হয়নি। তবে?
মানিক একস্ট্রা চায়। চোখ বুজিয়ে বলে— ‘বউদি করিতকর্মা মেয়েমানুষ। শুনেছি লকারে গয়না রাখার জন্য টিফিন কৌটো কিনেছে—কোথা থেকে আসে গয়না কেনার টাকা? কেন দেয় বুঝি না? বেশ করে, গুছিয়ে নিচ্ছে, দিন কাল এমনই— লুটে নিতে হয়। ভালোমানুষী করেছ কী মরেছ! মেয়েগুলোর ভবিষ্যৎ করে দিল। বিয়েবাড়ি কাজবাড়িতে আমি নিজের চোখে দেখেছি বউদির গয়না দেখে আচ্ছা আচ্ছা বউ ঝিরা এসো গো, বসো গো করে, কেউ বলে— তুমি কাজের বাড়ির দাদাবাবুদের সঙ্গে গা ঘষাঘষি করো? বলে না। সন্দেহ করে। সন্দেহের মুখে পেচ্ছাপ করে দিই। একস্ট্রা ইনকাম কীভাবে করতে হয় বউদি জানে। নাহলে আমাকে বলে—কতটাকা লাগবে বলো, আমি এনে দিচ্ছি, তোমাকে কিন্তু সুদ দিতে হবে।’
রূপা বোঝে তিন বছরের বেশি মানুষটা ঘরে বসে। কাজকর্ম কিছু নেই। মাসে দু চারদিন ছুটকো ছাটকা কাজ করে। বাঁধা কাজ পায় না। ঘরে বসে বসে ওর মনোবৃত্তিটাই এমনধারা হয়ে গেছে, ভক ভক করে পচা গন্ধ বের হয়।
তিনটে বাড়ির রান্নার কাজ করে হাজার সাতেক টাকা আসে। সংসারটা নুন ভাত করে দিব্যি চলে যাচ্ছে। কিন্তু মানিকের নজর অন্যদিকে। যেন রূপা ঠিক করিৎকর্মা নয়। ওর আরও কিছু টাকা আনা উচিত ছিল। ওকে সবাই খাটিয়ে নিচ্ছে। মানিক একদিন বিড়িতে টান মেরে রূপাকে বলে— ঝি মাগিদের মতো কাজে যাবি না। বউদিকে দেখেছিস—।
রূপা মানিকের বউদিকে দেখে, টিপ টপ সাজে। টান টান শরীর। রূপা তিনটে বাড়িতে রান্নার কাজ করেই বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তবে সে তার মধ্যেও চেষ্টা করে ফিটফাট হয়ে থাকতে।
মাস খানেক আগে হুট করে মাসিমার বাড়ির কাজটা চলে গেল। মাসিমা মেয়ের কাছে দিল্লি চলে যাবে। খুব আতান্তরে পড়েছিল রূপা। মাস তিনেক দুটো কাজ, প্রায় আড়াই হাজার টাকা কম।
যাক বাবা অবশেষে একটা কাজ পেয়েছে রূপা। একা এক গুজরাটি বুড়ো, তিনহাজার টাকার কাজ। বাসনমাজা, রান্না করা। রান্নার বেশি ঝামেলা নেই। ভালোই ছিল। কিন্তু একদিন মানিকের বউদি এসে রূপাকে বলল—‘এই রূপা তুই কি বড়বাজারের বুড়োর ফ্ল্যাটে কাজ নিয়েছিস? ওই বুড়োর স্বভাব চরিত্র ভালো নয়। ও নিজের ছেলের বউয়ের ওপর হামলা করেছিল। ছেলে ছেলের-বউ সব চলে গেছে, তারপর থেকে একা থাকে। তোকে ওই বুড়োর কাজটা কে দিল— বাসন্তী। বাসন্তী জেনে বুঝে তোকে বাঘের মুখে ফেলল। ওই ফ্ল্যাটে তো তপতীর মা কাজ করতে গিয়েছিল, ওই ঢেকনা বুড়ো নাকি তপতীর মাকে মুখে কিছু বলত না, খালি টাকা দেখাত। সামনে বসে টাকা গুনত। তপতীর মা দু মাস কাজ করে পালিয়ে বাঁচে। পারলে অন্য কাজ দেখে ওটা ছেড়ে দে।’
রূপা বলল, ‘অনেকগুলো টাকা গো দিদি। তিন হাজার। যা বলেছি, তাতেই রাজি হয়ে গেল। বেশি কাজও নয়। দুধ জ্বাল দেওয়া। ঢেঁড়স বা আলু ভাজা, আর ছটা রুটি। খায় তো বড়বাজারে। ঠিক আছে দেখি।’
কথাটা মানিকের কানেও এসেছিল। বউদি চলে যেতেই ফুঁসে উঠেছিল মানিক। বলেছিল, ‘কম খেটে তিন হাজার টাকা পাচ্ছিস, বউদির সহ্য হচ্ছে না। খবরদার ওই কাজটা ছাড়বে না। তুমি ছাড়লেই দেখবে বউদি গিয়ে ওই কাজটা ধরবে। আমি চালাকি বুঝি না।’
রূপা তবু কিন্তু কিন্তু করছিল, ওরও মনে হচ্ছিল বুড়ো যেন কাজের সময় বড্ড তার পিছনে পিছনে ঘোরে। দু চোখে গিলে খায়। বউদি বলতে সে আরও ভালো করে নজর করেছে। একটা ভালো কাজ পেলে সত্যি সত্যি সে ছেড়ে দেবে। সারা ফ্ল্যাটে সে আর বুড়োটা!
মানিক তাকে রোজ সাইকেলে করে ছেড়ে দিয়ে যায়। সেদিন টিপের কথা বলতে রূপার বড্ড ভালো লেগেছিল। মনে হয়েছিল, এখনও তার বর তাকে দেখে, লক্ষ্য রাখে।
তারপর থেকে কোনওদিন রূপা টিপ ছাড়া আসেনি। কিন্তু তাতেও যেন মানিক খুশি নয়। সে কেমন যেন ছটফট করে। একদিন তো দুম করে রূপাকে বলেই বসল, ‘বুড়োকে বলো না, হাজার বিশেক টাকা ধার দিতে। আমি বিজনেস করব। তুমি কাজ করে শোধ করে দেবে।’
রূপা মুখ ভেঙচে বলেছিল, ‘যা মাইনে চেয়েছি তাই দিয়েছে বলে ভেবো না হাজার বিশেক টাকা এক কথায় বের করে দেবে।’
‘ভালো করে চাইবি— দেবে না মানে? তুমি তো শোধ করে দেবে।’
‘দেখি, বলে দেখবখন।’
‘বলে দেখব কী—ম্যানেজ করতে হয়। বউদি হলে দেখতিস, এতদিনে ধার করে টাকা নিয়ে হার বানিয়ে ফেলত।’
‘রাখো তোমার বউদির কথা। আমি গতর খাটিয়ে পরিশ্রম করি।’
‘পরিশ্রম করে—সতীলক্ষ্মী মারাচ্ছে! যা যা খেটে খেটে মর। এ সংসারে ভালোমানুষরা খেটে মরব। আর সুখ ভোগ করে অন্যলোকেরা।’
মানিকের কথায় রূপা থম মেরে থাকল।
রাতে অকাতরে ঘুমিয়ে থাকা রূপার পাশ থেকে মানিক উঠল। দেখল, একটা শাড়ি আর ব্লাউজ চেয়ারের মাথায় রূপা ঝুলিয়ে রেখেছে। মানে ওই শাড়ি-ব্লাউজ পরে কাল কাজে যাবে।
মানিক উঠে এসে রূপার ব্লাউজটা নিল, তারপর দাঁত দিয়ে তীব্র আক্রোশে ব্লাউজের সামনের হুকটা টেনে ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।
পরেরদিন রূপা দেখল তার ব্লাউজের ওপরের হুকটা ছিঁড়ে গেছে। সে একটা সেফটিপিন দিয়ে ব্লাউজটা আটকে সাইকেলে চেপে বসল।
সাইকেল থেকে নেমে মানিক বলল, ‘তোমার কাছে সেফটিপিন আছে, আমার হাওয়াই চটির স্ট্যাপটা এবার ছিঁড়ে যাবে।’
রূপা কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগে মানিক বলল, ‘ওই তো, ওই সেফটিপিনটা দাও। নইলে ভারি বিপদে পড়ে যাবে।’
রূপা বলল, ‘এই সেফটিপিনটা! না, না—’
‘কেন, না না কেন? কী ভাবো নিজেকে, তোমার ব্লাউজের ওপরটা একটু খোলা থাকলে ওই বুড়ো এসে হামলে পড়বে। দাও, দাও বলছি— চটি ছিঁড়ে গেলে আমি সাইকেল চালাব কী করে?’
মানিকের কথায় রূপা কেমন আবিষ্টের মতো ব্লাউজ থেকে সেফটিপিনটা খুলে ওর হাতে দিয়ে ধীর পায়ে ফ্ল্যাটবাড়ির ভেতর সেঁধিয়ে গেল। আর মানিক এক পা মাটিতে, এক পা সাইকেলে তুলে, সেফটিপিনটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিল— সেফটিপিন তো নয়, ঠিক যেন বঁড়শি! বুড়ো মাছটা গেঁথে তুলতে হবে।
কিন্তু মানিক যা জানত না, তাহল, রূপার বুকের ভেতর ছোট্ট সেই টাকার ব্যাগে বড় একটা সেফটিপিন থাকে। তার দশ হাত নেই। দুটো হাত। এক হাতে একটা অন্তত অস্ত্র থাকা ভালো। কখন কী কাজে লেগে যায়!
বেশ লাগলো গল্পটা
ভালো লাগলো !
ভালো লাগলো মানিক আর রূপার এই ঘর গৃহস্থালীর গল্প !
"কত মাইল পথ হবে কেন জানে।" কেন না কে?
"মানিকের আগে একটা মোপেড ছিল। রূপা তাতে বসে কোথায় না কোথায় গেছে। একবার তো ডায়মন্ডহারবার যাবে বলে বেরিয়ে কী মতি গেল বাবা বড় কাছারি ঘুরে এল। পরে বুঝেছিল—বাবা টেনেছে।" -- কার বাবা?
"ওরা ভয় পেয়ে গেছে রূপা বুঝেছে—আমি যদি ঠিকেদারি লাইনে নামি ওরা আমার সঙ্গে পারবে না।’ - বুঝেছে না বুঝেছো?
" তাতে দেড়খানা ঘর বারান্দা কোমর সময় তুলে ফেলেছিল। ভিত দিয়েছিল দোতলার।" -- সময় না সমান?
এত অমনোযোগী এডিটিঙ কেন রে বাপু?
দমদি, বড়কাছারি বাবা ।
খুব ভালো গল্প।
গল্পটার একটা নিজস্ব চলন আছে। ভালো লাগে। কিন্তু শেষটা যেন বড় তাড়াহুড়ো করে শেষ হল!
ভালো লাগলো
ভালো লাগলো
গল্পটা ভাল লাগলো। নামকরণের পাঞ্চটুকুও বেশ। কিন্তু খুব আঁটসাঁট প্লট, আরেকটু রয়েসয়ে লিখলে ভালোর চেয়ে ভালো হতো। :)
আরও লিখুন।
ঈপ্সিতা ফটোগ্রাফি চমৎকার!
ভালো লাগলো
Darun galpo
উফফফ্ দুর্দান্ত অসাধারণ লাগল
দারুন গল্প।
নিউমার্কেট গাউসিয়া আর বইমেলায় আমরা সেফটিপিন হাতে রাখতাম। সিনিয়র ভাইয়া আপুরা শিখিয়ে দিয়েছিল।
পুরো গল্পটা ঠিকঠাক লেগেছে! খুব ভালো হয়েছে।
গল্পটি খুবই ভালো। এমন মানুষের গল্প জয়ন্ত লেখেন হাত খুলে। এই বাস্তবতা অসহনীয় হয়েও সত্য তো নিশ্চিত।
বেশ অন্য ধরনের একটা গল্প পড়লাম.....
মুগ্ধ। আপনার লেখা পড়ে শিখতে ইচ্ছা হয়
বেশ লাগল৷