আমার বাবার একটা ঘড়ি ছিল। ছোট গোল টেবিলঘড়ি। পেতলের বডি। আঁকাবাঁকা চার পায়ের উপর দাঁড়ানো। তারই মাঝে ঝুলছে পেন্ডুলাম। ঠিক যেন পঞ্চম জর্জ মার্কা রূপোর টাকা। ওদিকে তাকালেই চোখ আটকে যাবে। কী নিষ্ঠার সঙ্গে গোলকটা দুলে চলেছে অবিরত। গোল ডায়ালে উড়ন্ত ডানা। ডানায় ফুল-লতা-পাতার কারুকাজ। ছোট ছোট পাতাগুলো সবুজ। ফুল লাল। আর ডাল পাতার আউটলাইন হল কালো রেখার মিনে। এখন অনেক রংই উঠে গেছে। ঠিক যেন নখ দিয়ে খুঁটে খুঁটে তুলেছে কেউ।
মাসে একবার দম দিত বাবা। আর প্রতিদিন সকালবেলা সাফ সুফ। কটসউলের বড় একটা কাপড় ছিল। সেটা চার ভাঁজ করে পাতা থাকত তলায়। যেন ঠাকুরের আসন পাতা হয়েছে, এত যত্ন। আমাদের বাড়ি যেই আসত তার চোখে পড়ত। চোখ আটকে যেত। বাবা বুঝত। আমিও বুঝতুম। আড়চোখে বাবাকে দেখতুম। বাবার বুক ফুলে উঠেছে। মুখখানা ভারী। লাল লাল ছোপ। নাকের পাটা ঠেলে নিখুঁত হচ্ছে। মনে হত, বাবার সাদা চুলের মাঝে দু-একটা কালো চুল ঝলসে উঠছে বিদ্যুতের মতো। আমার ভেতরে তখন গুম গুম ধ্বনি। যেন যুদ্ধ জয়ে...। যেন শিকারে। বাবার দিকে তাকিয়ে থাকতুম। বাবা কত বড় হয়ে যাচ্ছে। আর আমি কত ছোট!
ঘড়িটা ছিল সেলফের উপর। অনেকটা ফাঁকা জায়গায়। লম্বা টানা বুকসেলফের ছাদ দুভাগ করেছে টেরাকোটার পাহারাদার। গোল গোল চোখ। এ-হাতে বল্লম। ও-হাতে ঢাল। বুক চিতিয়ে সটান পাহারা দিচ্ছে। ডাইনে এলমেলো– পেনের ঝুড়ি ধূপদানী ফ্লাওয়ার ভাস কাগজকাটার ছুরি আর একটা ফটো স্ট্যান্ড। আর পাহারাদারের বাঁয়ে, ঢাল ধরা হাতের দিকে– শুধু ঘড়ি। একা। রাজকীয় ভঙ্গীতে দু-ডানা উড়িয়ে দাঁড়িয়ে। রোমান হরফ ছুঁয়ে ছুঁয়ে দুটো কাঁটা। ঘণ্টায় ঘণ্টায় মৃদু মিষ্টি শব্দ। ফলে হয়তো সবার নজর পড়ত।
আর নজর পড়লে যা হয়, তাই। যে আসত আমাদের বাড়ি, সেই বলত ঘড়ির কথা। নানা জনে, নানা কায়দায় বলত। ওটা অমন আলাদা কেন? একা কেন? বাঃ খুব সুন্দর তো! পুরনো বুঝি, ঠিক টাইম দেয়? সে আমলের জিনিস নিশ্চয়– এখন টাকা দিয়েও মিলবে এমন জিনিস? ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমার মনে হত, এই সব প্রশ্ন, নানা কৌতূহলে ঘড়িটা গম্ভীর হয়ে পেন্ডুলাম আরও দ্রুত করে দিত।
কিন্তু বাবা এই সব নানা কায়দার প্রশ্নে একটাই উত্তর দিত। ওটা আমার জাতের নয়। বেজাতের।
বেজাত? বেজাত মানে? ঘড়ির আবার জাত বেজাত!
বাবা তখন গল্পটা শুরু করত। ঘড়ির গল্প। এই গল্পের সঙ্গে জড়িয়ে থাকত বীরত্ব-যৌবন-ইতিহাস।
আমি শুনেছি। বহুবার শুনেছি। মুগ্ধ হয়ে শুনেছি। যারা আসত তারাও শুনত উনিশশো ছেচল্লিশ। বাবার মাথার অসংখ্য সাদা চুলের ভিড়ে কালো চুল দু-একটা ঝিলিক দিয়ে ওঠে।
সেই ঘড়ি একদিন রাতে বন্ধ হয়ে গেল। সকালে মুছতে গিয়ে নজর পড়ল বাবার। ও-ঘর থেকে আমাকে ডাকল। বলল, এক তারিখ দম দিয়েছিলুম, মনে আছে। তবে বন্ধ হল কেন?
স্তব্ধ পেন্ডুলাম। শেষ বেজেছে দুটো কুড়ি। বুকের ভিতর মুচড়ে উঠল। এক তারিখ, এক তারিখে তুমি ঠিক দম দিয়েছিলে?
নিশ্চয়। উনিশশো ছেচল্লিশ থেকে, আমার এত বছরের অভ্যাস। ভুল হবার নয়। তবু আর একবার দম দিয়ে দেখো।
বাবা নরম হাতে ঘড়ির চাবিতে হাত দিল। পাকে পাকে চাবি ঘুরল। পেন্ডুলাম দুলিয়ে দেওয়া হল আঙুলে। কাঁটা নিথর। পেন্ডুলাম নিঃশেষ হয়ে এল। বাবার মুখে ছুরি কাটা ফালা ফালা বলিরেখা। কী করা যায় বল তো? একটা ভালো দোকান দেখে সারাতে হবে। তবে ভালো একটা মেকানিক ধরে নিয়ে আয়।
অফিস যাবার পথেই ঘোষ ওয়াচে গেলুম।
আমাদের ঘড়িটা আউট অফ অর্ডার। একজন ভালো কাউকে যেতে হবে। এই ঠিকানা। কখন যাবেন?
দোকানদারের এক চোখে ঠুলি। অন্য চোখ কাঁপিয়ে বলল, এখান থেকেই তো বাসে ওঠেন। কাল অফিসে যাবার পথে দিয়ে যাবেন– দেখে রাখব।
এখানে? বাবার, মানে এখানে তো ঘড়ি আসবে না। বাড়ি যেতে হবে।
দোকানদার খোলা চোখ কুঁচকায়, কেন? ভাবছেন পার্টস ঝেড়ে দেব? বাইরে গিয়ে সাইনবোর্ডটা দেখুন। আমাদের বুঝলেন, গুড উইল আছে।
না না, পার্টস ঝাড়ার কেস নয়। আসলে এখানে আসবে না। আমার বাবা, বুঝলেন, তাঁর যৌবনে– ঘড়িটার সঙ্গে একটা হিস্ট্রি– ফাইট জড়িত আর কি।
এবার দোকানদার খোলা চোখ বন্ধ করল। বেশ বুঝলাম, ঠুলির পাইপের ভেতর দিয়ে আমাকে দেখছে। খুব অস্বস্তি লাগছে। মনে হচ্ছে আমি একটা খারাপ ঘড়ি। শরীর নাটবল্টু খুলে, ডালা উলটে দেখছে। ঠুলির ভেতর তার চোখ। সরু হয়ে জ্বলছে। আমার অসুখ ধরছে। কোন পার্টস গেছে বুঝতে চাইছে। বুকের ভেতর ঢক ঢক পেন্ডুলাম দোলে। আমার দুটো হাত যেন ঘণ্টা আর মিনিটের কাঁটা। তিন নম্বর হাত। সেকেন্ডের কাঁটা। ব্যাটা আবিষ্কার করে ফেলেছে। ওই হাত, মানে কাঁটা বেশি চলে কি না। না চললে সব অচল। আমি অচল। বেয়ারা-পিওন অচল। মানে ফাইল অচল। তাই। খেতে হয় তাই খাই। আমি না খেলে বেয়ারা-পিওন খাবে না। ওদের সংসারে নাভিশ্বাস। ঠিক আছে, আমি না খেয়ে ওদের ঢালাও পারমিশন দিলাম। তখন আমার বাঁধা মাইনে। আর খেয়েদেয়ে ওরা আমার উপরে। আঙুল ফুলে কলাগাছ। তাও কাঁঠালিচাপা হলে হত। দেখি মর্তমান। কি লবচবানি। আমার সহ্য হল না। তাই খেলাম। খুব কষ্ট হত। কলেজে বামপন্থী রাজনীতি করতুম। এখনো মনেপ্রাণে বাম। বাবা কাঁধে হাত রাখলেন। নৈতিক সাহস দিলেন। ঘুষ বললেন না। বললেন উপরি। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, মেয়ের বাবা– সবাই জানল, উপরি। মাইনে ছাড়াও উপরি আছে। সবাই বলল, বেশ ভালো, ভালো। যা দিনকাল, না হলে হাঁড়ি ঠকঠক।
বাঁই বাঁই ঘুরছে আমার সেকেন্ডের কাঁটা। ব্যাটা ঠুলি চোখে দিয়ে দেখছে। কেমন যেন একটু লজ্জা লজ্জা করল। কি লজ্জা! কি লজ্জা! এবার মনে হল, নির্ঘাত বেশি চাইবে। উপরির সন্ধান পেয়েছে।
দোকানদার ঠুলি নিচু করে বলল, হুঁ, বুঝলুম সেন্টিমেন্ট।
মনে মনে ভাবলুম, বাহ, বেড়ে ডায়গনসিস হয়েছে। মুখে বললুম, ঠিক ধরেছেন। বাবার বয়েস হয়েছে তো।
কিন্তু হিস্ট্রি সেন্টিমেন্ট এসব দিয়ে কিছু হবে না। বুঝলেন দুটো ব্রিজ– আপার আর লোয়ার। মাঝে ঘুরছে গোয়িং সাইডের মেন হুইল, তারপর ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ড হুইল। একদম মাঝমধ্যি মানে কেন্দ্রে, স্কেপ মেন স্প্রিং লিভার। ওদিকে এলার্ম সাইডের হুইল। এই তো হল খেল। নিয়ে আসুন। সারিয়ে দেব। হিস্ট্রি সেন্টিমেন্ট ওসব ফালতু পার্টস, ছেঁটে দিন।
ঘোষ ওয়াচই ছেঁটে দিলুম। গুডউইল ঝুলে রইল। এবার অন্য দোকান। অফিসফেরতা দু-স্টপ আগে নামলুম। করুণাময়ী মোড়– পারফেক্ট টাইম।
বাড়ি যেতে হবে– এই যে ঠিকানা।
বাড়ি যেতে হবে– ঘড়ি দেখতে! না দাদা, টিভি, ফ্রিজ, এমারজেন্সি পেশেন্ট– এদের জন্য বাড়ি যাবার সিস্টেম আছে। এখনও ঘড়ির জন্য চালু হয়নি। হলে বাড়ি গিয়ে দেখে আসব। ঠিকানা রইল।
হাঁটতে হাঁটতে এবার সোনামণি ঘড়িঘর।
ঘড়ি কি সোনার? কস্টলি স্টোন? তবে? পেতলের জন্য এত! কোত্থেকে যে এসব জোটে কে জানে বাবা!
বাবাকে বললুম, হবে না। কেউ বাড়ি আসবে না। বাড়ি আসার সিস্টেম নেই।
বাবা বলল, সিস্টেম? সিস্টেম আবার কি! এই জন্য বাঙালির ব্যবসা হয় না। ফুলবাবু সব। খদ্দেররা সব আসবে, তেনারা যাবেন না। বাড়ি এলে এক্সট্রা কিছু তো পেতিস– তা না।
সত্যিই তো কাউকে এক্সট্রার কথা কিছু বলা হয়নি। মনে মনে ভাবি বললে হয়তো রাজি হত। ইস। কিন্তু একথা কি আলাদা করে বলার? এলে নিজেরাই ঠিক ধরে নিত। তবে?
বুকসেলফের উপর বন্ধ ঘড়ি। একটু দূরে টেরাকোটার পাহারাদার। এবার বন্ধ ঘড়ি দেখে নানান প্রশ্ন।
কিন্তু উত্তর বাবার একটাই। জাত বেজাত থেকে শুরু করে বীরত্ব যৌবন দেখিয়ে বাঙালির ফেল মারা ব্যবসার গল্প। কী আশ্চর্য, সবাই শুনল বসে। দুদিনে আমারও মুখস্থ হয়ে গেল।
আরও দুদিন গড়ালে, বাবা সেন্টিমেন্ট একটু ঢিলে করল। বলল, মরতে হলে জাত বদ্যির হাতে মরাই ভালো। এই হরিদেবপুর কুঁদঘাটের মেকানিক নয়। বরং তীর্থক্ষেত্র রাধাবাজার যা।
চেয়ারে ব্যাগ ঝুলিয়ে, ফাইলে পেপার ওয়েট চাপিয়ে, মাথার উপর ফ্যান ঘুরিয়ে রাধাবাজার গেলুম।
এ দোকান সে দোকান। জাত বদ্যি খুঁজছিলুম। শুনেছি ডাক্তারদের চেহারা দেখেই পেশেন্ট হাফ ফিট। এও সেরকম। জাত বদ্যি, জাত বদ্যি চাই একজন। এ দোকান ও দোকানে চোখ রাখি। দাড়ি টুপি চিকনের পাঞ্জাবি সুর্মা মেহন্দি। কী করি? কী করি? এখানে কি ঘড়ি রেখে নিশ্চিন্ত? একটা হিস্ট্রি জমা রেখে গেলুম। তারপর হাতে পেয়ে যদি ছোট কাঁটাকে বড়, বড় কাঁটাকে ছোট করে দেয়। মাথার ভেতরে ঢক ঢক। হাতে পেলে কি না করতে পারে। আমাদের অফিসের বিকাশ মঈনকে বলে, গভর্নমেন্ট ফর্ম করুক, তোদের হাতে পাই, এত চুদুরবুদুর সব পোন্দে দিমু।
তবে? কী যে করি? হতাশায় বুকের ভেতর পেন্ডুলামের সুতো ছেঁড়ে। ঢং। এবং সব শেষ।
বাবা বলে, সবে ভারতবর্ষের মানুষ জাগছে। বাবরি ছিল বড় গাঁট। সেটা ধসেছে। এবার টপাটপ হিন্দু এগোবে। এখন অনেক কাজ।
আমি জানি, হিন্দু জাগরণের এ সূচনা। একদিন হিন্দুরা হোল ওয়ার্ল্ডে মার্চ করবে। ফ্লাগ ওড়াবে। নস্ট্রাদামুসে আছে। আমার বন্ধু, দর্শনের অধ্যাপক কিঙ্কর বলেছে। আর ঘড়িটা ঠিক এ সময়েই খারাপ যাচ্ছে। আচ্ছা দেখাই যাক না, ঢুকে পড়ি না কাঁচের দরজা ঠেলে। বড়সড় একটা দোকান। কী আর হবে, কোলকাতায় ব্যবসা করেই ত খাবে।
মোহন। আরে মোহন না? মোহন।
থমকে দাঁড়াই। দেখি কোয়ার্টজের কাঁটার মতো নাচতে নাচতে এক থেকে বারো ঘর ডিঙিয়ে ছুটে আসছে একজন। বেশ সুন্দর দেখতে। বেঁটেখাটো ফরসা টিকালো নাক। গোল মুখ। ঠিক যেন টাইটানের নতুন মডেল।
কে? চিনতে পারছি না তো! টুকরো টুকরো আয়নার মধ্যে আমি। এংলো সুইচ, এইচএমটি, টাইটান, টাইমেক্সের মধ্যে আমি। রঙবেরঙা ডায়ালের কাচে আমি, আমি। কোথায় যেন দেখেছি। চেনা চেনা। বলুর নন্দাই? খোকনের শালা? অবিনাশের ভাড়াটে নাকি?
কী রে মোহন, ভালো আছিস তো? ঠিক চিনেছি।
হ্যাঁ। কিন্তু আমি– ঠিক কোথায় যেন দেখেছি?
চোখে ঘোলা লাগল। চিনতে পারলি না তো? আমাদের প্রিন্স আনারসা, নবীনা সিনিমার সামনে বাড়ি।
হ্যাঁ। ঠিক, তবু–
আরে মোহন, আমি সামসুদ্দিন। সামু আছি।
ওহ, তুই সামু। আরে কত মোটা হয়েছিস। কী ফরসা হয়েছিস রে, জেল্লা দিচ্ছে।
আয় আয়, ভেতরে আয়।
ভেতরে ঢুকি। কাউন্টারের ভেতরে সামু। বাইরে গদির চেয়ারে আমি।
চা চলবে? এ আন্না চা নিয়ে আয়। বল, তোর কী খবর?
এই চলছে। এদিকেই এসেছিলাম একটা কাজে। তুই তো ওই বাড়িতে নবীনার সামনেই থাকিস এখন?
হ্যাঁ। ওখানেই আছি। যাবটা কোথায়? ওখানে চারপুরুষের বাড়ি। আয় একদিন। গোপাল, বীরু কেমন আছে? বহুতদিন হল– বিশ-পঁচিশ সাল।
ভালো ভালো, সবাই ভালো আছে। অনেকদিন তোকে দেখিনি। মোটা ফরসা হয়েছিস।
বহুতদিন এদিকে ফেঁসে আছি। টাইম মেলে না।
চা আসে। কাপে দুধের সর ভাসে। যোগেশ। বি.কম। আমি আর সামু। সামসুদ্দিন। ফু ফু। গরম চায়ে ফুঁ দিই।
এটা নিশ্চয়ই তোর দোকান?
ফুফুর হাজব্যাণ্ডের। তালা মারা ছিল। চাকরি মিলল না। লাগিয়ে দিলাম। যা হোক দানাপানি মিলে যায়।
ভালোই তো। কোলকাতার মতো জায়গায় বিজনেস করেছিস।
কোলকাতাই তো আমার আব্বা-দাদুর চার জমানার বাস। যাবটা কোথায় বল? এই দেখ না, বড় বেটা বোম্বেতে ছিল কামধান্দায়! ফিরে এল, বলল, হালত বহুত খারাপ। নয়া গভমেন্ট বাংলাদেশি বলে মুসলমান খেদাচ্ছে। কী করবে বল, দেশের লোক দেশে থাকবে, না খেদিয়ে দিল।
কাপ রাখি। ঠকাস করে প্লেটের শব্দ। মনে মনে বলি, বেশ করেছে। আমরা পারিনি। ওরা পারছে। রুমালে মুখ মুছে বলি, যাই বলিস– অনুপ্রবেশ একটা প্রবলেম। একেবারে হাঁড়ির হাল করে দেবে।
সামু চুপ করে থাকে। ঢং ঢং টুং টাং বিচিত্র শব্দের সার সার পেন্ডুলাম দুলে ওঠে। রুমালে মুখ মুছি।
আমার একটা ঘড়ি ছিল। তাই চেনাজানা– ভরসা পাচ্ছি, একটু দেখে দিবি।
আরে নিয়ে আয়। যে দিন খুশি।
এই যে, আমার কাছেই আছে।
কোলের উপর রাখা ঘড়ি তুলে ধরি। খড়মড় করে কাগজ খুলে সামু ঘড়ি নিয়ে পরে। এদিকওদিক দেখে, কাঁটা চালাচালি করে বলে, এখন তো হবে না রে মোহন। রেখে যা। পরের উইকে আয়, ঠিক করে রাখব।
সামু খস খস করে বিল লেখে। টাকার জায়গা ফাঁকা। বিলটা ঘুরিয়ে বলে, নে, নাম এ্যাড্রেস লিখে দে। ওই বাড়িতেই আছিস তো?
নাম ঠিকানা লিখি। কত চার্জ বল? দিয়ে দিই।
আরে রাখ তো, আগে সারাই।
শরীর ভারমুক্ত। বিল হাতে আমি উড়ি। উড়তে উড়তে অফিসে আসি। ফ্যান ঘুরছে। চেয়ারে ব্যাগ। গ্লাসে চাপা দেওয়া জল ঢক ঢক চালান করে দিই। বুক মাথা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। ফট করে সামুর মুখ অনুপ্রবেশের কথা বলতে কেমন চুপ মেরে গেল, অ্যাঁ, ওর হাতে ঘড়িটা, কথাটা কোনও ক্যাচালে ফেলবে না তো?
বাবার বয়স হচ্ছে। অল্পে অধৈর্য হয়ে পড়ে। হপ্তাখানিক। মানে কমবেশি সাত দিন। বাবা আঙুল গোনে। কবে সাত দিন হচ্ছে। সোম-মঙ্গল-বুধ-বেস্পতি। সবে চারদিন পড়ল। গম্ভীর মুখে মনে করিয়ে দেয়, আজ চারদিন, রোব হবে সাত। তা কী করবি? হপ্তা কমপ্লিট করে সোমে যাবি? নাকি শনিতে একবার ঢুঁ মারবি?
বুঝি ঘড়িটার জন্য বাবার টান। টিক টিক শব্দ যেন বাবারই হার্ট চলছে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় গুং টাং– বাবা চাঙ্গা হচ্ছে। যৌবনে ফিরে যাচ্ছে। কিংবা ওটা নাড়াচাড়া করা হয়তো এক অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে।
বাবা খুব ভোরে মর্নিং ওয়াকে বেরোয়। সে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা যা হোক। মর্নিং ওয়াক সেরে বাড়ি ঢুকলে, বাবার গলার আওয়াজে আমার বউ আমাকে ধাক্কা মারে। তারপর ঠকাং করে দরজার ছিটকিনি খুলে দেয়। কিন্তু ঘর থেকে বেরোয় না। বাবা সকালে মণির মুখ দেখে না। কখনও দেখে ফেললে খুব অসন্তুষ্ট হয়। আসলে মণির, মানে আমাদের কোনও সন্তান নেই। বাবা ভাবে ওটা মণির দোষ। আমিও ভাবি। ফলে আমার কোনও বাধা নেই। আমি ব্রাশে পেস্ট নিয়ে বাবার ঘরের ভিতর গিয়ে বারান্দায় বসি।
বাবার হাতে তখন কটসউলের কাপড়। ফটাফট ঝেড়ে, দু-চারবার ঝাপটা মেরে ঘড়ি মোছে। কিন্তু এখনও আমি ফটাফট শব্দ শুনি। একদিন অবাক হয়ে ঘরের ভেতর উঁকি মারি। দেখি বাবা কটসউলের কাপড় প্রতিদিনের মতোই ঝাড়ছে। তবে আজ দু-চারবার নয়। দশ-বারো বার।
শুক্রবার অফিস থেকে ফিরলে বাবা আমার হাতে একশো টাকার নোট ধরাল। টাকাটা রাখ।
টাকা কেন? কিসের টাকা?
ঘড়িটার কত কী পড়ে– বাদবাকি তুই দিস, ফিরলে দিয়ে দেব।
তা তুমি কেন দিচ্ছ! মেকানিক আমার বন্ধু। যা হোক আমি দিয়ে দেব।
না, তুই রাখ। ওটা আমার টাকায় সারানো হবে।
তোমার টাকা আমার টাকা কী বলছ তুমি।
আমার জিনিস আমার টাকাতেই সারানো হবে।
আড়ালে বউ বলল, ছাড়ো তো, তুমি একটু বেশি বেশি। আছে– তাই দিচ্ছে। কোনও কিছুতেই তো হাত দিয়ে জল গলে না। সব বুকের ভেতর যক্ষের মতো আঁকড়ে রেখেছে।
বউকে বললুম, আমার টাকা বলতে বাবা অন্য কিছু মানে করল। ওটাও কি আমার রোজগার নয়। চেয়ারে আছি– তাই দিচ্ছে। মুখ দেখে কেউ ছাড়ে না।
আসলে বাবার টাকা আমার টাকা– সেটা কোনও কথা নয়। ঘড়িটা আমারও। আমাদের পরিবারের গর্ব। বাবার অবর্তমানে আমি, তবে? এই একশো টাকা নিয়ে কী করি? রাত কাটে, সকালবেলাও চিন্তায় মাথার ভেতর চিনচিন। মুখ ভর্তি ফেনা। গেলে তো আজই যেতে হয়। আজ শনিবার। কানে ফটাফট শব্দ। বাবা কটসউলের কাপড় ঝাড়ছে। মুখে জল ঝাপটা দিই। সব চিন্তা ধুয়ে আসার চেষ্টা করি। বারান্দায় বসে আছি। চা আসবে। গ্রিল গলে খবরের কাগজ আসবে। দেখি গেট খুলে ঢুকল একটা ছেলে। সঙ্গে সাইকেল। একটু এগিয়ে এনে সাইকেল দাঁড় করাল। কী ব্যাপার? কাগজের হকার ছেলেটি কি পালটে গেল! মানে আবার অন্য হাতে বিক্রি হয়েছি। ঘর বিক্রি।
ছেলেটা দরজার সামনে। আমি উঠে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে হাত বাড়াই। বলে মদনমোহন রায় আছেন?
হ্যাঁ আমিই। কেন?
আমার বাবা পাঠিয়েছেন। লর্ড টাইম সামসুদ্দিন আলম। কাকাবাবু আপনাদের টাইম ক্লকটা এনেছি।
গ্রিলের দরজা খুলি। কে সামু? তুমি সামুর ছেলে! আরে এসো এসো। তোমার বাবা আবার কষ্ট করে বাড়িতে পাঠিয়েছে।
ওয়েডনেসডে-তে হয়ে গেছে। বাবা বলল, পড়ে আছে– দিয়ে আয়। এটা নিয়ে খুব চিন্তায় আছেন। তাই চলে এলাম।
এসো এসো বসো। বুঝলে তোমার বাবা আমার ছেলেবেলার বন্ধু।
ছেলেটা ঘাড় হেলায়। মিটিমিটি হাসে। বাবার কাছে আপনার কথা খুব শুনেছি। বাবা বলল, যা, আমার বন্ধুর বাড়ি ঘুরে আয়।
তুমি কোন ছেলে, ছোট?
না, আমি বড়।
তুমিই তো বোম্বে ছিলে। তোমার বাবা সেদিন গল্প করছিল।
আর একটু হলে আমাকে বাংলাদেশি বলে দিচ্ছিল আর কি। তাই তো ভেগে এলাম। ছেলেটা ঠোঁট টিপে হাসে। ফরসা দুগালে টোল খেয়ে যায়। টিকালো নাক। সামুর মত। কোঁকড়ানো চুল কাঁধ ঝাঁপিয়েছে। পরনে ঢোলা লাল গেঞ্জি। জিনসের প্যান্ট। ব্যাগ থেকে ঘড়ি বের করে। গায়ে জড়ানো ভাঁজে ভাঁজে কাগজ খোলে। ঝিক ঝিক করে ওঠে ঘড়িটা। টেবিলে চার পায়ে দাপিয়ে বসে। টিক টিক শব্দ কান ছুঁয়ে যায়। গলা কাঁপছে। গলা তুলে ডাকি, বাবা বাবা।
বাবা বেরিয়ে এসেই ঘড়ি দেখে। ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়ে। দু হাতে উইনার্স কাপের মতো ঘড়ি তুলে নেয়। বাবার গলা বুজে গেছে, কী হয়েছিল ওর? সব ঠিক আছে?
ছেলেটা বলে, হ্যাঁ তেমন কিছুই হয়নি। কোনও পার্টসে হাত দিতে হয়নি। পুরনো জিনিস একটু তেল খেল। আটকে গেছিল আর কি!
বাবা বুকের উপর ঘড়ি তুলে জামায় কাচ ঘষে। আমি বললুম, বাবা, এ আমার বন্ধুর ছেলে। বড় ছেলে। ওর বাবা আমার কলেজ ফ্রেন্ড।
বাবা এক হাতে ঘড়ি বুকে চেপে অন্য হাত প্রসারিত করল, আশীর্বাদ করি, তোমরা ভারতমাতার সুসন্তান হও। সাহসী হও। কৃতী হও।
বাবা চোখ বন্ধ করল। চোখের কোণে চিক চিক করছে জল। নিস্তব্ধ। ঘড়ির টিক টিক শব্দও নেই। সে শব্দ যেন বাবা হৃৎপিণ্ডের ধকধকের সঙ্গে মিশে গেছে। আমি ছেলেটির মুখের দিকে চেয়ে আছি। ওর সারা মুখে আশ্চর্য এক আভা ফুটে বেরুচ্ছে।
বাবা ঘড়ি বুকে চেপে উঠে গেলেন।
একটা কাক ডেকে চলেছে একটানা। এই সাতসকালের রোদে কেমন তাত। পিঠ বুকের কাছে চিড়বিড় করছে। ওকে জিজ্ঞেস করি, তা কী করবে ভাবছ?
বাংলাদেশি বানিয়ে দিল, নইলে বোম্বের কাজটা তো ভালোই ছিল। দেখি কিছু একটা হয়ে যাবে এখানে।
হ্যাঁ, ওই সব হিন্দুরা বহুত কড়া।
চাকরির হালত তো খারাপ। বিজনেস করব। ঘড়ির কাজ শিখছি। অন্য ভাইরাও তো আছে। না হলে অন্য বিজনেসে যাব।
মনে মনে ভাবি, হ্যাঁ কলকাতা তো লুটে নেবার জায়গা। বলি, কলকাতার আপনপর নেই। সবাই সমান।
ঘাড় ঘুরিয়ে ঘরের ভেতর চোখ রাখি। বুকসেলফের উপর কটসউলের গদির উপর আমার বাবার ঘড়ি। ঘড়ির সামনে বাবা। পাশে টেরাকোটার পাহারাদার। ওধারে মা ফ্রেমের ধুলো সরিয়ে ফিকফিক করে হাসছে।
ছেলেটা নিচু হয়ে আমাকে নমস্কার করল। বাবা এসে দাঁড়িয়েছে। বাবাকে নমস্কার করল– আমি তবে যাই।
উঠতে যাচ্ছিল। আমি কাঁধে হাত দিয়ে বললাম, আরে যাবে কি, একটু চা খেয়ে যাও।
বাবা বলল, তুমি আমায় বড় শান্তি দিলে। ক’দিন খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম। আর সেই তোমাকে শুধু মুখে ছাড়তে পারি। মোহন যা, ওর জন্যে মিষ্টি আনা।
না, না, মিষ্টি কেন!
তা হোক। তুমি একটু বসো। আমি আসছি।
ঘরে ঢুকে ফ্রিজ খুললুম। কিছু নেই ফাঁকা। কিন্তু ভ্যাপসা গন্ধ ভেতর পর্যন্ত ছড়িয়ে গেল। কাজের মেয়েটিকে বললুম, লক্ষ্মী, যা তো দশটাকার মিষ্টি নিয়ে আয়।
বউ বলল, কে এসেছে এই সাতসকালে!
ঘড়িটা দিতে এসেছে। তুমি ওর জন্যে চা পাঠিও। আর লক্ষ্মীকে পাঠাচ্ছি মিষ্টি আনতে।
বউ দুধ গুলছিল। মুখ ঝামটা দিয়ে উঠল। শুধু চা দাও। আর মিষ্টি দিতে হবে না।
বাবা বলল, এখন না আনলে ভালো দেখায়? যা তো লক্ষ্মী।
লক্ষ্মী এখন যেতে পারবে না। বাবা আর বাবা। যত আদিখ্যেতা।
অগত্যা জামা টেনে পকেটে মানিব্যাগ ঠেসে বেরিয়ে পড়লুম। ফিরে মিষ্টির প্যাকেট রান্নাঘরে জমা করে বসলুম বারান্দায়। গল্প খুব জমে উঠেছে...
... আমরাও ঠিক করে ফেললাম, একজন হিন্দু মরলে দশজন মুসলমান মারব। আমাদের ভেতর তখন আগুন জ্বলছে। জিন্নার ডাইরেক্ট অ্যাকশন, লীগ প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দির মুসলমান যুবসমাজকে সর্বশক্তি নিয়ে প্রস্তুত থাকার আহ্বান, এক-একটা হিন্দুর দোকান লুট হচ্ছে– জওহরলাল পান্নালাল, কমলালয় স্টোর্স, কে.সি বিশ্বাসের মতো বড় দোকান। মুসলমান দোকান ওরা চিহ্ন দিয়ে রেখেছিল, লুটের হাত থেকে বাঁচাতে। এমন কি হাঙ্গামা হতে পারে ধরে নিয়ে মুসলমানদের জন্য এ্যাম্বুলেন্স মজুত রেখেছিল। লীগ প্রধানমন্ত্রীর গাড়িতে করে লীগের লোকদের জন্য ছোরাছুরি, পেট্রল, কেরোসিনও নিয়ে যাওয়া হয়।
আমি সামুর ছেলের দিকে তাকাই। চোখ দুটো বড়। যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে, ঠোঁট দুটো একটু ফাঁকা, শুকনো খট খট করছে। বুঝতে পারি মুখ দিয়েই এখন বাতাস চলছে ওর। নিচু স্বরে বলি, বাবা।
কিন্তু ওরা বোঝেনি আমরাও ভেতরে ভেতরে তৈরি ছিলাম। ন্যাকড়ার বল বানিয়ে কেরোসিনে চোবানো হল। বোমা বাঁধা হল। এমনকি টেরিটরিয়াল আর্মিতে কাজ করে এরকম কিছু লোক বন্দুকের যোগান দিল। বোমা-লাঠি-বন্দুক নিয়ে গঠিত হল প্রতিরোধ বাহিনী।
এরপর বাবা কী বলবে আমি জানি। বাবা আজ সংক্ষেপে বলছে, তবু আমি জানি বাবা কী বলবে। ছেলেটি কঠিন চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার বুকের ভেতর ছটফট করছে হাওয়া। বাবাকে থামাতেই হবে। গলা তুলে ডাকার চেষ্টা করি, বাবা, বাবা ও... ।
বাবা হুঙ্কার দিয়ে ওঠে, বন্দে মাতারম! ফিয়ার্স লেনে, সাগর দত্ত লেনে প্রচুর হিন্দু মরছে। ঠিক হল একটা হিন্দুর লাশ দেখলে দশটা মুসলমানের লাশ ফেলতে হবে। একদিকের হিন্দুদের রেসকিউ করলাম, অন্যদিকে হিন্দু হত্যার বদলা। লাশে লাশে ভরে গেল কলকাতা। আর এ সময়েই লুটে এনেছিলাম এ ঘড়ি। এক মুসলমানের অন্দরমহল থেকে। সেই ১৯৪৬! আজ কত বছর? কত বছর হল?
ওর মুখে আঁকাবাঁকা ঘাম নামছে। চোখ দুটো লাল। নাকের সামনের গুল্টি পাকিয়ে ফুলে উঠেছে। দু হাত শক্ত হয়ে মুষ্টিবদ্ধ হচ্ছে। সামুর ছেলে এখন পিঠ সোজা করে বসে। যে ভাবেই হোক বাবাকে থামাতে হবে। আমি বাবাকে থামানোর জন্য প্রাণপণ চিৎকার করে উঠি, বাবা! বাবা!
বাবার মুখও লাল। থমথমে। আমার থেকে আরও জোরে চিৎকার করে বাবা, থাম! একদম চুপ করে থাকবি, কাপুরুষ, নপুংসক।
আমার বুকের ভেতর ধক করে ওঠে, সেই কাপুরুষ, সেই নপুংসক?
দেশের জন্যে কী করেছিস তোরা? কী করেছে তোদের জেনারেশন? সব কাপুরু্ষের বাচ্চা। সব নপুংসকের দল!
আমি শূন্যে চাপড় মেরে চিৎকার করে উঠি, আমরা বাবরি মসজিদ ভেঙেছি– আর কী চাও তোমরা!
বাবার স্বর নামে। কণ্ঠনালির ধুকপুক ওঠানামা করে। উথলে ওঠা দুধে যেন জল পড়েছে। বাবা নিজের বুকে দু হাত চেপে বলে, হ্যাঁ, ওই একটা এ্য্যাচিভমেন্ট তোদের জেনারেশনের। কিন্তু আমরা তোদের কাছে আরও অনেক কিছু আশা করেছিলাম।
আমার নাভি থেকে কথা ওঠে, আমরা ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানাব।
বাবা চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরে যায়। ঘড়ির সামনে থুম মেরে দাঁড়ায়। সামুর ছেলেও চেয়ার ছেড়ে ওঠে, আমি চলি।
আরে তোমার নামটাই তো জানা হল না।
আমাকে ঘড়ির চার্জটা দেবেন– দুশো টাকা।
দুশো টাকা। ভাবি, এই বললে কিছু হয়নি। আটকে গেছে, একটু তেল খেল। তবে? তার জন্য দুশো? ব্যাগ খুলে টাকা দিই।
চলি।
তোমার জন্যে মিষ্টি। খেয়ে যাও।
কোনও প্রবলেম হলে দোকানে আসবেন।
ছেলেটা লাফিয়ে বেরিয়ে যায়। ঘরের ভেতর টুং টাং আটটার ঘণ্টা পড়ে। অনেকদিন পর।
পরদিন সকাল।
সাতসকালে গেট খুলে সামসুদ্দিন বাড়িতে ঢুকল। ওকে দেখে অবাক হলাম প্রথমে, এই সাতসকালে কী ব্যাপার। তার পরই ভাবি, দুশো টাকা ঝেড়েছে, তাই লজ্জার খাতিরে দেখতে এসেছে– কেমন আছে ঘড়ি? আবার খারাপ হলে ওকেই যাতে সারতে দিই, সেই লাইন আর কি!
দরজা খুলে হেসে বলি, কি রে তুই?
অবাক হচ্ছিস! আসতে নেই বুঝি? কতদিন আসা হয়নি এদিকে, তাই চলে এলাম।
সামু বসে। চিবুক বুকের কাছে ঠেকিয়ে কি ভাবে। বলে, তোর সঙ্গে একটু দরকার ছিল, তাই ছুটে আসতে হল।
কেন? কী দরকার?
কাল আমার বড় বেটা এক মস্ত অন্যায় করে গেছে। তাই আমাকে ছুটে আসতে হল। সামু বুকপকেটে হাত দেয়। আমি ওকে বলিনি কোনও টাকা নেবার কথা। তবু কেন যে বড়বেটা টাকা নিল বুঝলাম না। তারপর দুশো টাকা সামসুদ্দিন আমার হাতে গুঁজে দেয়।
এখনকার ছেলেদের কিছু বুঝি না বুঝলি। এখান থেকে ফিরে গিয়ে টাকাটা আমার কোলের উপর ছুঁড়ে দিল। বলল, ঘড়ির মেরামতির চার্জ। তারপর স্নান সেরে ছুটল মসজিদে। অথচ অন্য সময় বলে বলে পাঠাতে হয়। কাল কেমন যেন... । অথচ তোর বাড়ি আসার সময় বারবার বলে দিয়েছিলাম, আমার বন্ধুলোক আছে। অথচ কেন যে এমন করল? কেন যে হঠাৎ দুশো টাকা নিয়ে গেল? তাই ছুটে এলাম। ওকে মাফ করে দিস। একটু থামে সামসুদ্দিন।
ওর ফরসা মুখ লাল। ঘামের নকশা সারা মুখে। পকেট থেকে সাদা রুমাল বের করে মুখ মোছে। যেন বুক ভরে বাতাস নেয়। নিয়ে বলে, ঘড়ি নিয়ে কোনও দুশ্চিন্তা করিস না। এ ঘড়ি এখনও বহুতদিন সার্ভিস দেবে। বহুত দিন।
বাড়ির ভেতর থেকে বাবার গলার শব্দ, কাশির শব্দ, পায়ের শব্দ বারান্দার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি চেয়ার ঘুরিয়ে ঘরের দরজা আড়াল করি, সামসুদ্দিনকে আড়াল করি। ফিসফিস করে বলি– তুই অনেকদিন পরে এদিকে এলি সামু। গোপাল বীরুর বাড়িতে যাবি? চ, সামু চ। অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয়নি। চল, আজ চারজনে মিলে কোথাও ঘুরে আসি।
"নির্বাচিত গল্পপাঠ" থেকে