বেশ কিছুদিন তেমন কিছু লিখতে পারছি না। হঠাৎ ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা নিয়ে লিখছি। কাল আমাদের এলাকার কো অপারেটিভ ক্রেডিট সোসাইটির এ জি এম ছিল। এই দিনগুলোতে অনেক পুরোনো মানুষজনের সংগে দেখা হয়। কালও অনেকের সাথে দেখা হল। আমি আগেও লিখেছি যে আমাদের এলাকাতে দুটি কো অপারেটিভ চালাই আমরা। একটি এটি আর একটি কো অপারেটিভ কনজুমার্স স্টোরস। সেটির সাহায্যে আমরা একটি রেশনের দোকান আর একটি ওষুধের দোকান চালাই। দুটিরই পরিচালন কমিটিতে আছি আমি।
তো কাল আমার পাশের চেয়ারটিতে এসে বসলো অনিমেষ। অনিমেষ হালদার। বসেই বললো এত চেয়ার থাকতে এই চেয়ারটাতেই কেন বসলাম বলুন তো বাসুদা? অনেকদিন পর আপনার পাশে বসতে পারবো বলে। আর তক্ষুনি জানেন আমি আমার লেখার পরবর্তী চরিত্র পেয়ে গেলাম। না,সে চরিত্র অনিমেষ নয় তবে সেই চরিত্রের সাথে অনিমেষ এর নাড়ির টান।
অনিমেষকে নিয়ে একটু লিখে নিই তারপর "তার" গল্প বলবো। আমাদের পাড়ায় সেই আমাদের ওপরের ব্যাচ থেকে কয়েকজন এমন থাকতেন/ থাকতো যারা আমাদের পাড়ার বাসিন্দা নয়৷ যেমন আমি মানিকতলায় ছিলাম৷ তাদের দেখে মনেই হত না যে তারা সেই পাড়ার নয়। সবাই চিনতো তাদের। অনেকে জানতোই না যে তারা পাড়ার বাসিন্দা নন। তেমনই ছিল অনিমেষ। থাকতো/ থাকে সামান্য দূরে। বাইশ নম্বরে। আসলে বাইশ নম্বর মণীন্দ্র রোড। সবাই একুশ নম্বর, বাইশ নম্বর বলে৷ আমাদের চেয়ে প্রায় দশ পনেরো বছরের ছোট ওরা। আমি যখন এ পাড়ায় আসি তখন ওরা শিশুমাত্র বছর দশ বারো বয়েস।
আমরা পাড়ায় প্রথম নাটক করি মনোজ মিত্রর " অথ স্বর্গ বিচিত্রা"৷ সেই নাটক থেকেই অনিমেষ আমাদের সংগে অভিনয় করেছে দীর্ঘদিন৷ খুবই জনপ্রিয় আর ভাল ছেলে অনিমেষ৷ ছিয়াত্তর সালে শুনলাম অনিমেষ একটা ম্যাটাডোর কিনেছে। পাড়ায় নিয়ে এল সেই গাড়ি। চার চাকার ছোট গাড়ি। আজ আমার লেখা সেই গাড়িটা নিয়েই। আমরা নাম দিয়েছিলাম অনিমেষের পক্ষীরাজ।
গাড়ি নিয়ে লেখা!! তাও ম্যাটাডোর। দেখি পক্ষীরাজকে আপনাদের ভাল লাগে কী না। সম্ভবত ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে পক্ষীরাজকে কিনেছিল অনিমেষ। এমনি দিনে পক্ষীরাজ ভাড়া খাটতো। কলকাতার বিভিন্ন যায়গায় দেখা যেত পক্ষীরাজকে৷ তবে পাড়ার একটি বিশেষ কাজে আমরা সব সময় পক্ষীরাজকে পেতাম। সেটা হল মৃতদেহ বহন। অনিমেষ খবর পেয়েই যেত তবু ওকে বলতে হত না। ঠিক পক্ষীরাজ নিয়ে হাজির হয়ে যেত। কখনো নিজেই যেত শ্মশানযাত্রী হয়ে আবার কখনো ও ছাড়াই আমরা যেতাম পক্ষীরাজকে নিয়ে৷ মোটামুটি পক্ষীরাজে শেষযাত্রা করেছেন আমার পাড়ার প্রায় সব অভিভাবকেরা। মনে করুন কেউ একজন প্রয়াত হলেন। তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসেছেন পাড়ার আরো অনেক বয়োজ্যেষ্ঠরা। সেখানে অনিমেষকে অবধারিত শুনতে হত - ওরে বাবা অনিমেষ, আমাকেও নিয়ে যাস তোর ম্যাটাডোর করে। তাঁদের মধ্যে গেছেনও কেউ কেউ পক্ষীরাজে চড়েই।
আমার বাবা চলে গেলেন ১৫ই নভেম্বর ১৯৮৬ গভীর রাত্রে। ১৬ তারিখ সকালেই পক্ষীরাজ নিয়ে হাজির অনিমেষ। পক্ষীরাজে চড়েই বাবা চললেন শেষ যাত্রায়। কদিন পর অনিমেষকে টাকা দিতে গেলাম আমি। কিছুতেই টাকা নিলো না অনিমেষ৷ কিছুতেই না।
আমার মেজদি গেলেন অন্যলোকে চুরানব্বই সালে৷ খুবই অসুস্থ ছিলেন কিন্তু সজ্ঞানে ছিলেন। আমায় বলেছিলেন - আমি মারা গেলে আমার ডাইরিটা বের করবি। একটা পাতা তোর চোখে পড়বেই।যা লেখা আছে সব করবি। যেদিন মারা গেলেন সেদিনও বলেছিলেন আমায়। অনেক রাত্রে মারা গেলেন মেজদি। মেজদিকে ধরে ছিলাম আমি, দিদি আর মেজদা৷ একটু সময়ের জন্যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তিনজনেই। ঘুম ভাঙতেই দেখি মেজদি আর নেই। আলমারি খুলে মেজদির ডাইরি নিলাম হাতে। পাতার ভেতর থেকে উঁকি মারছিল বেশ কয়েকটা একশো টাকার নোট।সেই পাতাতেই লেখা -
বাসু, এই টাকাগুলো দিয়েই আমার শেষ কাজ করবি। নিজেরা টাকা খরচ করবি না। আর আমাকে অবশ্যই, অবশ্যই অনিমেষের লরিতে নিয়ে যাবি নিমতলা শ্মশানে। অনিমেষকে টাকা দিবি। বলবি মেজদি বলে গেছে। বাবার সময় টাকা নেয়নি ও। আরো অনেক কথা লেখা ছিল। সেকথা এখানে নয়।
সকাল হতেই অনিমেষকে খবর পাঠানো হল। পক্ষীরাজের বুকিং ছিল অন্য জায়গায়। সেখানে অন্য লরি পাঠিয়ে পক্ষীরাজ এল আমাদের ফ্লাটের সামনে।মেজদিকে নিয়ে চললাম আমরা আবার সেই নিমতলা শ্মশান। এইসব দিনে পক্ষীরাজ দাঁড়িয়ে থাকতো ওইখানে। আমাদের নিয়েই ফিরতো। সেবার অনিমেষকে টাকা নিতেই হয়েছিল।
পক্ষীরাজের বয়েস হচ্ছিল। কলকব্জা গুলো বিগড়োচ্ছিল একে একে। এর মধ্যে অনিমেষ একটা বাস কিনে ফেলেছে৷ ৩বি /৩ডি ৩ডি/১ হয়ে সেই বাস আমাদের পাড়া থেকেই ছাড়ে রোজ৷ পক্ষীরাজ আর চলতে পারলো না ছিয়ানব্বুই এর গোড়া থেকেই৷ স্থায়ী ঠিকানা হল দত্তবাগান মোড় এর পেট্রল পাম্প৷ অনিমেষ ভাবে থাক ওখানেই। বিক্রি করবে না৷ কিন্তু লোক আসতে থাকে ওর কাছে। পক্ষীরাজকে স্ক্রাপ হিসেবে কিনতে চায় তারা। অনিমেষ রাজি হয় না৷ তারপর একদিন আসেন এক কালোয়ার। অনিমেষ তাঁকেও বলে ও বিক্রি করবে না পক্ষীরাজকে। সেই কালোয়ার ভদ্রলোক তখন এমন একটি কথা বলেন অনিমেষকে যে অনিমেষ তাঁকেই বিক্রি করে দেয় নিজের পক্ষীরাজকে। উনি বলেছিলেন - স্যার, আপনি তো এই গাড়িটাকে নিজের বাড়ির লোকের মত দেখেন। তো আপনার বাড়ির কেউ মারা গেলে কি তাকে বাড়িতেই রেখে দেন? আপনার গাড়িটা মরে গিয়েছে সাহেব। বাড়িতে রাখবেন তো বদগু ছড়াবে। একদিন দেখবেন, একটা দরয়োজা নেই। আর একদিন টায়ার, এক এক কোরে সব কুছ লিয়ে লিবে চোরেরা। বিক্রি ভি করবে আমাদেরই। দিয়ে দিন সাহেব৷ দিয়ে দিয়েছিল অনিমেষ সেই কালোয়ারকে ওর পক্ষীরাজ। বত্রিশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন সেই ভদ্রলোক। অনিমেষ তাঁকে বলেছিল আমি দেখতে যাবো না আপনি যে দিন নিয়ে যাবেন ওকে।
যায়নি অনিমেষ। টাকা বাড়িতে দিয়ে পক্ষীরাজকে শেষবারের মত আমাদের পাড়া থেকে নিয়ে গিয়েছিলেন ভদ্রলোক। যে পক্ষীরাজ আমাদের প্রিয়জনদের নিয়ে গিয়েছে অনন্তযাত্রায় অগুনতি বার আবার ফিরিয়েও এনেছে পাড়াতে তার নিজের অন্তিমযাত্রা কেউ দেখেনি৷ একেবারে অনাড়ম্বর ছিল সেই যাত্রা।পক্ষীরাজ ফেরেও নি আমাদের পাড়াতে আর কোনদিন।
অবলিভিয়নে মিলিয়ে গেছে WBV- 7189, আমাদের পক্ষীরাজ উনিশ শো আটানব্বই সালে৷ কুড়ি বছর হয়ে গেল ওর চলে যাবার। এখনও ওর কথা মনে পড়লে গলা ধরে আসে অনিমেষের। আমাদের মনে পড়ে "পক্ষীরাজ" এ চড়ে আমাদের অসংখ্য প্রিয়জনের চলে যাবার দৃশ্য। মন ভারি হয়।
অনিমেষকে দেখে মনে পড়লো ওর পক্ষীরাজকে। লিখেও ফেললাম এই লেখাটা। পক্ষীরাজ নেই, আর কোথাও নেই। মানুষ মারা গেলে স্টার হয়ে যায়। আমার আয়ূষবাবা বলে আমায়।
আর ম্যাটাডোর মারা গেলে!!! আয়ূষবাবা জানে না। ওর ছোদ্দাদুও না৷
এই সিরিজটা পড়লেই কতকিছু মনে পড়ে যায়।
মায়াময়
এইরকম কতশত গল্প জুড়েই তো গোটা একটা জীবন.....খুউব ভালো লাগলো. ...চলুক ।