এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক

  • ভাঙা দিনের ঢেলা - ১

    বিমোচন ভট্টাচার্য
    ধারাবাহিক | ২৫ জুলাই ২০২০ | ৩৭৫৬ বার পঠিত | রেটিং ৪.৫ (২ জন)
  • ইনি আসতেন সপ্তাহে তিনদিন। বুধ, শুক্র আর রবি। বুধ আর শুক্র তাঁকে দেখা হত না আমার। রবিবারেও হত না কারণ তখন আমি ভয়ংকর আড্ডা মারতাম।

    এঁর কথা আমি প্রথম শুনি আমার মেজদির কাছে। মেজদির কথা আমি আগে লিখেছি। আমাদের ভাইবোনেদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিক্ষিত ছিলেন মেজদি আর আমার ন-দা। বাকি পাঁচজন দাদাদিদি শিক্ষিত আর আমিই একমাত্র অশিক্ষিত৷ মেজদি ছিলেন আমার পাড়ার সব কাজের মহিলাদের গার্জেন। কার বাড়িতে কী অসুবিধে, কার বর তাকে রোজ পেটায় এ সবের পরামর্শদাতা ছিলেন আমার অবিবাহিত মেজদি৷ আমাদের সবার অলিখিত গার্জেনও ছিলেন তিনিই৷

    একবার, আমাদের বাড়িতে তখন কাজ করে ভগবতী। পুরুষদের মতো কণ্ঠস্বর ছিল তার। তবে প্রায় আমাদের বাড়ির অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠেছিল ক্রমেই। বয়সও হয়েছিল বেশ৷ তো ভগবতীর বিয়ের কথা চলছে৷ পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে৷ কোথায় দেখানো হবে৷ কেন ভগবতীর মেজমাসি আছে না! বাইরের ঘর সাজানো হল। তারা দেখতে এলেন৷ মিষ্টি-ফিষ্টি আনা হল৷ ভগবতীকে সাজানো হল৷ তারা দেখে চলে যাবার সময় বলে গেলেন, পাত্রী ভালো, তবে বয়সে বেঁটে৷ এই ‘বয়সে বেঁটে’ কথাটা আমাদের বাড়িতে চালু হয়ে গিয়েছিল সেই সময়।

    ওই পঁচাশি সাল নাগাদ মেজদি একদিন আমাকে বলল, “রবিবার একটু পরে আড্ডা মারতে বেরোস। তোকে একজনকে দেখাব। পরের রবিবারই আমি প্রথম দেখি তাঁকে৷ খুব রোগা এক বয়স্কা মহিলা। একটা জীর্ণ এবং ময়লা সাদা শাড়ি পরনে৷ মাথা থেকে ঘোমটা পড়ে যায় না তবে ঘোমটা দেবার ধরনটা আমাদের প্রচলিত ধরন নয়। মাথায় একটা ময়লা ঝুড়ি। মেজদি বলল, “এই দ্যাখ, এর কথাই বলছিলাম তোকে। এর নাম সাকিনা। সাকিনা বিবি। গ্রাম থেকে হাঁসের ডিম এনে বিক্রি করে। আমি নিই৷” একগাল হাসলেন সেই মহিলা। ফোকলা৷ কিন্তু কী আন্তরিক ছিল সেই হাসি!! আমায় বললেন খুব মিহি গলায়, “ও মা, তুই আমার এই বুনটার ভাই নাকি? তাহলে তো তুই আমারও ভাই৷”

    আমি চিনে ফেললাম সাকিনা বিবিকে৷ বুধবার অফিস যাবার সময় দেখে হত। সেই হতশ্রী ঝুড়ির ভেতর গোটা তিরিশ-চল্লিশটা ডিম নিয়ে আসতেন আমাদের পাড়ায়৷ বিক্রি না হলে মেজদির কাছে রেখে যেতেন আমাদের ফ্রিজে রেখে দেবার জন্য। লেখাই বাহুল্য যে মেজদিকে গুনতে বারণ করতেন। পরে যেদিন আসতেন সেদিন নিয়ে যেতেন সেই ডিমগুলো। সেদিনও গুনতেন না৷ আমাদের বাড়িতে মেজদি ওকে দুটো রুটি আর চা দিত রোজ৷ সেটা খেতে খেতেই মেজদির সাথে গল্প করতেন। বাড়িতে ছেলে আছে দুটো। তিনটে মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। আমি শুনতাম মেজদির কাছে।

    আমার মেয়েকে দেখে এক ভদ্রলোক, যিনি প্রফেশনাল জ্যোতিষ ছিলেন না কিন্তু মোটামুটি নির্ভুল গণনা করতেন ইচ্ছে হলে, একদিন আমাদের বলেছিলেন এক গরিব মহিলাকে নতুন কাপড় কিনে দিতে। আমাদের মনে হল সাকিনা বিবিকেই দিলে হয়। মেজদিকে বললাম সাকিনাকে জিজ্ঞেস করতে। মেজদি বলল সাকিনা তো আনন্দে কেঁদেই ফেলল তবে ওর একটা শর্ত আছে। শাড়িটা রঙিন দিতে হবে। ওর ছেলের বউ পোয়াতি৷ তাকে দেবে। যেদিন আমাদের মেয়ের হাত দিয়ে শাড়িটা দিলুম, কী হাসি বুড়ির ফোকলা দাঁতে৷ কত আদর করল আমার মেয়েটাকে!!

    এর কিছুদিন পরই আমার মেজদির ক্যানসার ধরা পড়ল। থুতনিটা অনেক বড়ো হয়ে নীচের দিকে নেমে এল। মেজদির কিন্তু ভ্রূক্ষেপ নেই। সেই নিয়েই বাসে শ্যামবাজারে পড়াতে যেত৷ কেউ জিজ্ঞেস করলে বলত, “ক্যান্সার হয়েছে আমার৷” তারা অপ্রস্তুত হতেন৷

    প্রথম যেদিন সাকিনা মেজদিকে ওইরকম থুতনি নিয়ে দেখল এবং মেজদির মুখে শুনল যে ওর ক্যানসার হয়েছে সে কী কান্না বুড়ির। শুধু বলে, “ও মা, তাহলে তো তুই বাঁচবি না রে মেয়ে৷” মেজদিই বরং ওকে সান্ত্বনা দিত। এরপরই সাকিনা বিবি এমন একটা কাজ করেছিল যা আমি কোনোদিন ভুলব না। মেজদিকে, যবেই আসত গোটা তিনেক করে ডিম দিত খেতে। পয়সা নিত না। কিছুতেই নিত না৷ বলত, “তোর শরীর খারাপ রে মেয়ে৷ রোজ খাবি একটা করে। দিশি ডিম। উপকার হবে৷” অবাক হতাম। এক হতদরিদ্র গ্রাম্য মহিলা কোন্‌ মনের জোরে এমন কাজ করতেন!!



    আমার মেজদি খুবই ধর্মপ্রাণা মহিলা ছিলেন৷ সাকিনা বিবি যখন ওর গায়ে হাত বুলিয়ে দিত তখন চুপ করে বসে থাকত মেজদি। আমাদের বাড়িতে শালগ্রাম শিলা আছেন কয়েকশো বছর ধরে৷ মেজদি বড়ো হয়েছেন আমার চেয়েও বেশি ধার্মিক পরিমণ্ডলে৷ তবু সেই সময়গুলোয়, যেদিন আমি বাড়ি থাকতাম, দেখতাম এক উচ্চশিক্ষিত ব্রাহ্মণকন্যা এক অশিক্ষিত গ্রাম্য মুসলিম বৃদ্ধার দোয়া নিচ্ছেন৷ দুজনের কারোরই ধর্ম তাদের এই সম্পর্কে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি৷
    মেজদি চলে গেলেন মাত্র ছাপ্পান্ন বছর বয়েসে৷ পরে এসে সাকিনা বিবির সে কী কান্না!

    আর কোনোদিন আমি সাকিনাবিবিকে দেখিনি।

    বাংলা গানের চেয়ে এইসব চরিত্রের কথা মনে পড়লে আমার হিন্দি গানের কথা বেশি মনে পড়ে আজকাল। যেমন আজ মনে পড়ছে ‘মুনিমজি’ ছবির একটি গানের কথা। এস ডি বর্মণের সুরে কিশোরকুমার গেয়েছিলেন৷ লিখেছিলেন প্রবাদপ্রতিম কবি শাহির লুধিয়ানভি—
    “জীবন কে সফর মেঁ রাহি
    মিলতে হ্যায় বিছড় যানে কো
    ঔর দে যাতে হ্যায় ইঁয়াদে
    তনহাই মেঁ তড়পানে কো।”

    সেই তানহাই এর মধ্যেই কখনও এসে পড়েন শচীনবাবু অথবা কখনও এসে পড়েন সাকিনা বিবি।
    তখন শক্তিবাবুর কথায় “চক্ষে জল আসে”।


    ছবি: ঈপ্সিতা পাল ভৌমিক
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ২৫ জুলাই ২০২০ | ৩৭৫৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Saoni | 2600:1700:c780:38a0:251e:90d0:9e5a:***:*** | ২৫ জুলাই ২০২০ ১৯:৪৬95507
  • Mon chhuye jaoya ai dharabahik er apekhhay thakbo.

  • | ২৫ জুলাই ২০২০ ২১:৪৪95511
  • এরকম কত মানুষ আমাদের আশেপাসেই ছিল।,এই সাকিনাবিবি এই মেজদিদের মত। কোথায় যে গেল সব।
  • hu | 2607:fcc8:ec45:b800:2960:cc8e:288c:***:*** | ২৫ জুলাই ২০২০ ২১:৫৯95512
  • খুব খুশি হলাম এই সিরিজ শুরু হতে দেখে
  • গৌতম দত্ত | 103.217.***.*** | ২৫ জুলাই ২০২০ ২২:৩১95514
  • দারুন শুরু বিমোচনদা...আগ্রহ থাকল...

  • একলহমা | ২৬ জুলাই ২০২০ ০০:১৭95524
  • শচীন বাবুর কথা আগেরদিন পড়েছিলাম। আজ পড়লাম সাকিনাবিবির কথা। অপার মুগ্ধতা। 

  • Arnab Das | 2607:fea8:4cdf:9b00:1d16:be7f:b3de:***:*** | ২৯ জুলাই ২০২০ ০২:২১95645
  • পুরানো সেই দিনের কথা 

  • reeta bandyopadhyay | ২৯ জুলাই ২০২০ ১৭:২৪95656
  • চমৎকার শুরু. ..অপেক্ষা করব পরের পর্বের জন্য ।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু প্রতিক্রিয়া দিন