এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  স্মৃতিকথা  শনিবারবেলা

  • ভাঙা দিনের ঢেলা- ৮

    বিমোচন ভট্টাচার্য
    ধারাবাহিক | স্মৃতিকথা | ২৮ আগস্ট ২০২১ | ৯২২ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)

  • কাল এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। প্রায় ভুলে যাওয়া একটি ঘটনা এবং একজন মানুষকে মনে পড়িয়ে দিল সেই ঘটনা। অবশ্য এটাকে ঘটনা বলাও যায় না মনে হয়। তবু...।

    কাল আমার জামাই কেশব এসেছিল বেশ কয়েকদিন পর৷ হঠাৎ ঠিক করে, চাইনিজ খাবার আনাল মেয়ে। রাত প্রায় দশটার সময় এক মোটরবাইক চালক সেই খাবার দিয়ে গেল সুইগি থেকে। অতি মনোরম সেই খাবার খেয়ে উঠতে উঠতে প্রায় সাড়ে এগারোটা বেজে গেল। এর মধ্যে পুটপুটকে ধরতে হয় একজনকে। আমরা চারজন খেতে বসলাম আর ওর রাধা-মা ওকে নিয়ে বসল টেবিলেই। কন্সট্যান্ট চ্যাপ চ্যাপ আওয়াজ করে কি একটা চিবিয়ে গেল পুটপুট। আর একদৃষ্টিতে আমাদের খাওয়া দেখতে থাকল।

    এমন সুস্বাদু খাবার খেলে আমায় আবার একটু মিষ্টি খেতেই হয়। কিছু না থাকলে চিনি৷ শুনেছি যে আমরা নবাবের দেশের লোক, তাই এই লাক্সারিটুকু ছাড়তে পারিনি। কাল ফ্রিজ খুলে দেখলাম, দু’টুকরো ক্যাডবেরি সিল্ক পড়ে আছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে দিলাম চালান করে মুখে৷ এগুলো না, মুখে দিলেই আস্তে আস্তে গলে যায়। ফ্রিজে অনেকদিন থাকার ফলে শক্ত হয়ে গিয়েছিল সেটা। মুখে নিয়েই চলে গেলাম বাথরুমে ছোট-বাইরে করব বলে আর তক্ষুনি মনে পড়ল ঘটনাটা আর মনে পড়ল সেই মানুষটিকে৷ বলি ঘটনাটা।

    আমরা বিশ্বরূপায় আসি সাতান্ন সালে। তখন আমার বয়েস সাত। আমাদের দু’টো “বড়-বাইরে” ছিল। দু’টোই দোতলায়। একটিতে খুব একটা কেউ যেত না। সেটি, বাবা বলেছিলেন, নাট্যাচার্য শিশিরকুমারের ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্যে ছিল৷ আমাদের আগে তিনিই থাকতেন সেই বাড়িতে। দোতলায় জল ছিল না। সেটা আনতে হত একতলার বাথরুম থেকে। ফলে জলের একটা সমস্যা ছিলই৷ যে দিনের কথা লিখতে বসেছি, সেদিন সকালে মা দোকানে পাঠিয়েছিল আমায়৷ সেখান থেকে একটা বেশ বড় লজেন্স কিনে বাড়ি ফিরে মুখে দিতেই “বড় বাইরে” পেল খুব জোর। লজেন্স মুখে নিয়েই ঢুকে পড়লাম ভেতরে। জল নিয়ে ঢুকিনি কোনদিনই! আমার জল দেবার মানুষ ছিলেন আমার ন’কাকিমা। তার সঙ্গে আবার সেই ওই বয়েস থেকেই আমার কথা বন্ধ ছিল৷ কেন? তা আর মনে নেই আমার। তবে ওই জল দেওয়া হোক, এটা করা হোক – এমন বলতাম আমি। তিনি দিতেনও, যা চাইতাম। তো সেদিন, জল দেওয়া হোক, জল দেওয়া হোক – বলে দু’চার বার হাঁক দিলেও, তিনি এলেন না৷ দাদা (বড়দা) শুনতে পেয়ে এলেন জল নিয়ে। মুখে লজেন্স থাকার জন্যে আমার কথা মনে হয় অন্যরকম শোনাচ্ছিল। দাদা বললেন – তোর মুখে কী রে? আমি বললাম – লজেন্স। দাদা একেবারে ভাল মানুষ ছিলেন। প্রায় ষোল বছরের ছোট ভাইটিকে ভালও বাসতেন খুব। সেদিন বললেন – মুখে লজেন্স নিয়ে পায়খানা করতে গেছিস হতভাগা! ফেলে দে লজেন্সটা। ওটা তো হেগো হয়ে গেছে! হেগো জিনিসটা খাচ্ছিস? ফ্যাল শিগগির। বেশ বড় জেলি লজেন্স ছিল সেটা। তখনও জেলিটা আসেনি মুখে৷ ফেলিনি আমি। কামড়ে খেয়ে ফেলেছিলাম। দাদা রেগে জল নিয়ে চলে গিয়েছিলেন৷ বলেছিলেন – থাক পায়খানায় তুই।

    আমি ভেতরে, ল্যাংটো। শেষ ভরসা মাকে ডাকছি। মা-ও আসছে না৷ শেষে এলেন সেই কাকিমাই। দাদাকে ঠাকুরপো বলতেন। আমি তখন কাঁদছি৷ বললেন – আর কোনোদিন যেন পায়খানায় লজেন্স না খাওয়া হয়। আমি ঠাকুরপোকে বলে জলের ব্যবস্থা করছি৷ দিলেন তিনি জল। আমি বেরিয়ে দেখি মা রান্নাঘরে। ডিসি ফ্যানের আওয়াজে আমার ডাক শুনতে পাননি। বললেন - কাঁদছিস কেন? পারুল জল দেয় নি তোকে? তাহলে তুই বেরোলি কী করে? তুই হেগো নয় তো? তাহলে ছুঁবি না আমায়। দাদা অফিস বেরনোর সময় মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে গেলেন।

    যৌথ পরিবারের একটা আলাদা বাঁধন ছিল। ঝগড়া, মনোমালিন্য – এসব ছিল, কিন্তু সেসব পেরিয়েও ছিল এক অদ্ভুত বন্ধন। আমার সেই ন’কাকিমা। সাড়ে চার ফুটের মানুষ ছিলেন৷ যশোরের মেয়ে৷ আমার ন’কাকার সাথে যখন বিয়ে হয়, তখন ষোল-সতেরো বছর বয়েস। আমার বড়দা, বড়দির চেয়ে বয়েসে ছোট ছিলেন৷ আমি সারাজীবন তাঁর সঙ্গে সরাসরি কথা বলিনি৷ তবু আমার মা চলে যাবার পর প্রতি জামাই-ষষ্ঠীতে তিনি আসতেন আমাদের বাড়ি৷ তখন তাঁরা আলাদা থাকেন। পাখার হাওয়া দিতেন। হাতে দিতেন একটা আম বা কলা। টিভি দেখে বাড়ি যেতেন৷

    আমার বাড়ির সব গুরুজনদের মৃত্যুর পর সব কাজ আমি করেছি৷ না, মুখাগ্নি-টুঘাগ্নি নয়। সব ঘাটের কাজ। শুধু এই কাকিমা যেদিন চলে যান, সেদিন আমি কলকাতায় ছিলাম না৷ দক্ষিণ ভারত বেড়াতে গেছিলাম মেয়ে-বৌ সমেত৷ করমণ্ডলে ফেরার সময় খবর পেয়েছিলাম কাকিমার চলে যাবার৷ ফোনেই বন্ধুদের খবর দিয়ে দিয়েছিলাম। তারা এবং কাকিমার পাড়ার লোকজনেরা নিয়ে গিয়েছিল শ্মশানে।

    আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম কাকিমাকে। কাল ওই চকোলেট মুখে ছোট-বাইরে করতে গিয়ে হঠাৎ মনে পড়ল সেইদিনের ঘটনার কথা। মনে পড়ল আমার পিতৃপ্রতিম দাদাকে। মনে পড়ল কাকিমাকে। মাকে। অনেকদিন কিছু লিখতে পারছিলাম না। সেটা সরিয়ে একটানা লিখলাম এই লেখা।

    কিশোরকুমারের নিজের সুর করা, শৈলেন্দ্র সাহেবের লেখা একটি কালজয়ী গানের ক’টি লাইন দিয়ে শেষ করি এই লেখা। এ যেন আমারই মতন কোন মানুষের মনের কথা।

    ম্যায় আকেলা তো না থা
    থে মেরা সাথী কাঈ
    এক আঁধি সি উঠি
    যো ভি থা লেকে গেয়ি।

    অ্যায়সে ভি দিন থে কভি
    মেরী দুনিয়া থি মেরী
    বীতে হুয়ে দিন ও হায়ে
    প্যারে পলছিন...

    কোঈ লৌটা দে মেরে বীতে হুয়ে দিন...

    কিন্তু সে তো আর সম্ভব নয়...


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ২৮ আগস্ট ২০২১ | ৯২২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন