আমরা এই পাড়ায় আসি আটষট্টিতে। আমি তখন আঠারো। তখন পাড়ার বন্ধুদের সংগে আড্ডা মারতাম না। দু বেলাই চলে যেতাম পুরনো পাড়া মানিকতলায়। যদিও এই পাড়াতেও আমার বন্ধুরা ছিল। এখনো তারাই আমার বন্ধু। সত্তর সাল থেকে আমি পাড়াতেই আড্ডা মারি। সকাল দুপুর সন্ধে রাত্তির শুধুই আড্ডা ।
এই সময়েই আমি ওঁকে প্রথম দেখি। অনিলদা। পদবি মনে নেই আমার। তখনই তাঁর বছর তিরিশেক বয়েস। নিজেই এসে একদিন আলাপ করলেন আমার সাথে। বাবার নাটকের ভক্ত।
অনিলদার একটু বর্ণনা দিই আপনাদের আপনাদের। অনিলদার শ্বেতী ছিল।এমনিতে কালো ছিলেন,শীর্ণও। আর শ্বেতী ছিল সারা শরীরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। সেই জন্যেই সবার সাথে মিশতেন না। সেই প্রথম দিন আমিও একটু কুণ্ঠিত ছিলাম। সেই কুড়ি বছর বয়েসে আমি জানতাম না শ্বেতী ছোঁয়াচে নয়। আমার শিক্ষক ছিলেন একজনই। আমার মা। তাঁকে জিজ্ঞাসা করাতে, এবং অনিলদার কথা বলাতে তিনি আমায় বলেন, না, শ্বেতী ছোঁয়াচে নয়।
তারপর থেকে অনিলদার সংগে আমি বিনা দ্বিধায় কথা বলতাম। অনিলদা রাজ্য সরকারি কর্মচারী ছিলেন। পরোপকারী ছিলেন। আমার সংগে মূলত কথা বলতেন বাবার নাটক নিয়ে। আর রবীন্দ্রনাথের গানের কথা বলে দিতে পারতেন না দেখে। মূলত রবিবারই দেখা হত বেশী।
তিয়াত্তর সাল নাগাদ অনিলদা একদিন আমাকে বললেন - বুঝলে বাসু, বিয়ে করছি আমি। আমি তাকিয়ে আছি দেখে বললেন - না, অবাক হয়ো না। খুব গরীব ঘরের মেয়ে। বাবা মা নেই। দেখতেও ভাল নয়। আমার এক কলিগের পরিচিত। রেজিস্ট্রি বিয়ে করবো। আমি তবুও ভাবছিলাম ঠিক করছেন কি অনিলদা?
বৌদিকে দেখে ভুল ভাঙলো আমার। অত্যন্ত সাধাসিধে আটপৌরে মহিলা। অনিলদাকে দেখে ভাল লাগতো আমার।
বছর খানেক বাদেই মনে হয় একটা ছেলে হল ওঁদের। অনিলদা পরে আমাকে বলেছিলেন - আর জি করে ছেলেটা হবার পরে শুধু ভেবেছিলাম - শ্বেতী হয় নি তো ছেলেটার?
তারপর আমি চাকরি পেলাম। অনিলদার ছেলে বড় হতে লাগলো। বৌদি স্কুলে নিয়ে যান ছেলেটিকে। আমরা চলে এলাম উল্টোদিকের সরকারি আবাসনে। অনিলদার সংগে দেখা হওয়া কমে গেল আমার।
একদিন নব্বই সাল নাগাদ অনিলদার সংগে দেখা। বললেন- বাসু, চললাম তোমাদের পাড়া থেকে। বারাসতের পরে কদম্বগাছিতে একটা বাড়ি করেছি। সেখানেই চলে যাব। আর কতদিন ভাড়া বাড়িতে থাকবো।
চলে গেলেন অনিলদা। পরে আরো বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে। বলেছেন, ছেলে বড় হয়ে গেছে। ইনকাম ট্যাক্সে চাকরি পেয়েছে। বিয়ের চেষ্টা করছেন। তবে ছেলের বাবার শ্বেতী আছে দেখে সবাই পিছিয়ে যাচ্ছে।
সেদিন বাজারের কাছে অনিলদার সংগে দেখা। দেখলাম আরো রোগা হয়ে গেছেন। হাতে একটা লাঠি। আমায় দেখতে পান নি।আমিই এগিয়ে গিয়ে কথা বললাম। খুব খুশি আমায় দেখে। বললেন - তোমার বৌদি চলে গেছে জানো। হঠাৎ তিন দিনের জ্বরে চলে গেল। একা হয়ে পড়েছি বড্ড, বুঝলে। চোখেও কম দেখি আজকাল। তাই বই পড়াও বন্ধ। তারপর একটু চুপ করে রইলেন, তারপর বললেন - আমি এখন এক বৃদ্ধাশ্রমে থাকি বাসু। না, স্ব-ইচ্ছায়। ছেলেটা নিজে দেখেই বিয়ে করলো এক সময়। আমায় বলতে পারছিল না। ওর মাকে বলে যে আমার শ্বেতী থাকাটা ওর হবু বৌএর পছন্দ নয়। আমরা সংগে না থাকলে সে বিয়ে করতে পারে। আমি বলি - বিয়ে করুক ও। কলকাতার দিকে ফ্লাট কিনুক। আমি কিছু টাকা দিচ্ছি। আমাদের সংগে থাকতে হবে না। তাই হল। আমি বিয়েতেও যাই নি। ছেলের বৌকে আশির্বাদও করিনি। ওরা চলে এল কলকাতায়। ছেলেটা আমার সামনে আসতে পারতো না। তারপর একটা নাতি হল আমার।
এবার বাসু, আর সামলাতে পারলুম না নিজেকে। গেলাম তোমার বৌদিকে সংগে নিয়ে দেখতে নাতিকে। সে বড় অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। একেবারেই অনাহূত আমি। দেখেছিলাম নাতিকে। দেখে স্বস্তি পেয়েছিলাম নাতিটার শ্বেতী হয় নি। ঠিক ওর বাবার বেলায় যেমন স্বস্তি পেয়েছিলাম।
তারপর তোমার বৌদি মারা গেল। বড় কষ্টে ছিল বেচারা। ছেলেকে দেখতে পেতনা। নাতিকেও নয়। বেঁচে গেল। ওর কাজের কদিন আমার কাছেই ছিল ওরা। ছেলে কথাও বলেছিল অনেক দিন পর । আমায় নিয়ে চিন্তা ছিল। জেনুইন।কে দেখবে আমায়? ওকে বলেছিলাম- আমার চিন্তা করো না। আমি যা পেনশন পাই তাতে আমি ঠিক চালিয়ে নেব। বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছি। যা টাকা পেয়েছি তা পোস্ট অফিসে রেখেছি মান্থলি ইনকাম স্কিমে। সবকটার নমিনি ছেলে।
ছেলেকে বলে দিলাম একদিন মোবাইলে যে আমি বাড়ি বিক্রি করে এক বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাচ্ছি এই দিন। সেইদিন ছেলে এসে নিজে আমায় বৃদ্ধাশ্রমে পোঁছে দিয়ে গেছিল। এখন প্রায় প্রতি রবিবার আসে। নাতির ছবি দেখি, ভিডিও দেখি। তোমাদের পোস্ট অফিসে একটা ডিপোজিট ছিল। এটাই শেষ। তাই এসেছিলাম আজ। ভাবছিলাম কেউ কি আর চিনবে আমায়? তোমার কথা ভাবছিলাম। দেখো, ঈশ্বর দেখা করিয়ে দিলেন তোমার সাথে।
চুপ করে শুনছিলাম এই বৃদ্ধের কথা। কত, কত লোক তো পড়েছেন রবীন্দ্রনাথ। পড়েছেন - ভালমন্দ যাহাই আসুক,- সত্যরে লও সহজে। কিন্তু সত্যকে জীবনে এমনভাবে নিতে পেরেছেন কেউ??
অনিলদার মত এক অতি সাধারণ মানুষ কত সহজে তা নিয়েছেন। খুব ইচ্ছে করছিল অনিলদাকে একটা প্রণাম করি। পারি নি। আগে করি নি তো কোনদিন।আর একটা কারণও ছিল।কেঁদে ফেলতাম আমি। নিশ্চিত।
আমারও তো বয়েস হচ্ছে...।
অসাধারণ। সত্যের এ লও সহজে, কেন পারি না।
বিমোচন ভট্টাচার্যের লেখা পড়লাম। বেশ ভালো লাগলো।
এভাবেই কাটে জীবন